728 x 90

নিলু ফিরে এসো: আহমদ রাজু

  গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে যখন নিলু ঘর থেকে বেরিয়েছিল তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। টিনের চালের ওপর বৃষ্টির ফোটা পড়ার শব্দ আর ব্যাঙের ঘ্যানোর ঘ্যানোর ডাক এক অন্যরকম পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল। অন্যদিন সন্ধ্যার পর আশপাশের বাড়িগুলোতে আলো জ্বললেও আজ তেমন কোথাও আলোর চিহ্ন দেখা যায় না। বিকালে যখন প্রথম বাতাস বইতে শুরু করেছিল তখনই বিদ্যুৎ

 

গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে যখন নিলু ঘর থেকে বেরিয়েছিল তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। টিনের চালের ওপর বৃষ্টির ফোটা পড়ার শব্দ আর ব্যাঙের ঘ্যানোর ঘ্যানোর ডাক এক অন্যরকম পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল। অন্যদিন সন্ধ্যার পর আশপাশের বাড়িগুলোতে আলো জ্বললেও আজ তেমন কোথাও আলোর চিহ্ন দেখা যায় না। বিকালে যখন প্রথম বাতাস বইতে শুরু করেছিল তখনই বিদ্যুৎ চলে যায়। তারপর বেশ কয়েকঘন্টা পেরিয়ে গেলেও আসার কোন নাম নেই। আজ আর আসবে বলে মনেও হয় না। অথচ গতকাল আকাশটা ছিল ফুরফুরে মেজাজের। বৃষ্টিতো দূরের কথা, মেঘের কোন ছায়াও লক্ষ্য করেনি দামিনী। যদি একটুখানি আঁচ করতে পারতো তাহলে ফয়সালের হাতে তার মেয়েকে তুলে দেবার দিনটা পরিবর্তন করতে দ্বিতীয়বার ভাবতো না।

যখন তখন বিদ্যুৎ চলে যাবার কারণে জনজীবনে নাভিশ্বাস চারদিক। সবকিছু হঠাৎই থমকে যায়। যে শিশু মায়ের কোলে দুগ্ধ পান করছিল সে গরমে আড়মোড়া খায়, যে শিক্ষার্থী বই নিয়ে কেবল বসেছিল, তার পড়া বন্ধ হয়ে যায়, যে শ্রমিক কলকারখানার উৎপাদন শুরু করেছিল তার উৎপাদন বন্ধ হয়। এমনকি যে বিজ্ঞানী গবেষণার কাজে মন দিয়েছিল তার গবেষণাও বন্ধ হয়ে যায়। সেদিন বাজার থেকে ফেরার পথে দেয়ালে আঠা দিয়ে লাগানো দৈনিক সংবাদপত্রের দিকে চোখ যায় দামিনীর। প্রথম পাতায় বড় বড় অক্ষরে, ‘দেশে বিদ্যুতের ঘাটতি মিটিয়ে বিদেশে রফতানী করা হচ্ছে। আর একটা পরিবারও বিদ্যুৎ বিহীন থাকবে না।’ লেখা দেখে সরকারের মন্ত্রীদের এমন বক্তব্যকে গালগল্প ভেবে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল সে। অথচ সেই বিদ্যুৎ-ই যে আজও থাকবে না, তা সে ঘুনাক্ষরে বুঝতে পারেনি। অবশ্য, শুধু যে একতরফা সে বিদ্যুতের দোষ দেয় তা নয়, নিয়তি তার পক্ষে একটুও কাজ করেনি। যদি সেটা করতো তাহলে আজই কেন নিম্নচাপ হতে হবে? কেন আকাশের মন এত খারাপ হবে? সবই ভাগ্য বলে নিজের কপালকে দোষ দিয়েই ক্ষান্ত থেকেছে দামিনী।

 

অন্ধকার আর বিদ্যুতের কথা ভাবতে ভাবতে বেমালুম ভুলে গিয়েছিল মেয়ের কথা। যখন মনে পড়ে তখন চারদিকে নিস্তব্ধতায় ভরা। নিলু তখনও ঘরে ফেরেনি। কোথায় যেন যাচ্ছে বলে বাইরে পা বাড়ালো তা মনে করতে পারে না দামিনী। সে বার কয়েক ডাক দেয়, ‘নিলু; মা নিলুফা কোথায় গেলি?’ নিলুর কোন সাড়া শব্দ নেই। কোথায় গেল সে? উঠে যে এদিক-ওদিক খুঁজতে যাবে তারও উপায় নেই। সেই সন্ধ্যায় ছোট একটা মোমবাতি জ্বালিয়েছিল নিলু যা আর বেশি অবশিষ্ট নেই। দু’দশ মিনিটের মধ্যে নিভে যাবে। মনে পড়ে রান্না ঘরের আড়ায় টাঙানো হারিকেনের কথা। গত বছর ফাল্গুন মাসে নিলুর কলেজ ছুটিতে একবার জ্বালিয়েছিল। সেদিনও বিকেলে এভাবে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় আগাম প্রস্তুতি হিসেবে বহুদিনের ফেলে রাখা হারিকেন রান্নাঘরের আড়ার ওপর থেকে পেড়ে দেখে সারা গায়ে ধুলোর আস্তারণ ঘাসের ওপর শিশির বিন্দুর মতো জমে আছে। কাপড় ভিজিয়ে পরম মমতায় তা পরিষ্কার করে গ্লাসটা কলপাড়ে নিয়ে ছায় দিয়ে মেজেছিল নিলু। হারিকেন তখনও ভাল আছে নিশ্চিত হয়ে মোড়ের সোবহানের দোকান থেকে বিশ টাকার কেরোসিন এনে তাতে ভরে আলো জ্বালিয়েই ক্ষ্যান্ত হয়েছিল নিলু। সে দৃশ্যগুলো চোখের সামনে পুরোনো ছবির মতো ভেসে উঠে দামিনীর।

মোমবাতির কাছে যেয়ে সেটাকে হাতে তুলে নিতে যেয়েও পারে না। অবশিষ্ট যা আছে তা হাতে নিতে গেলেই নিভে যাবে বুঝতে পেরে একটি ভাতের থালার ওপরে সাবধানে উঠিয়ে নিয়ে যায় রান্না ঘরে। যা ভেবেছিল তাই। হারিকেনটা রান্নাঘরের আড়ায় দড়ি দিয়ে বাঁধা অবস্থায় তখনও টাঙানো আছে। সেটাকে পেড়ে কানের কাছে নিয়ে ঝাঁকিয়ে দেখে, তেল যা আছে তা বেশ। গ্লাস খুলে নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে মোমবাতি থেকে এক টুকরো কাগজে আগুন লাগিয়ে হারিকেনের সলতের কাছে দিতেই ধপ করে জ্বলে ওঠে। চারিদিক ফকফকা আলোর ঝলকানি, যেন অমাবশ্যার আকাশে একটুকরো চাঁদ।

 

দামিনী হারিকেন নিয়ে ছোটে এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি। কোথাও নেই নিলু। সে হাঁক ছাড়ে, ‘নিলু, কোথায় গেলিরে, নিলুফা, ও নিলুফা।’ বরাবরের মতো কোন উত্তর নেই। রাত দশটার ট্রেন দানবীয় শব্দ করে এইমাত্র পেরিয়ে গেল অথচ চারিপাশ দেখে মনে হয় রাত গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে। অন্য রাত হলে অবশ্য দু’চারটা রাত জাগা পাখি সহসা ডেকে উঠতো। আজ তেমন কোন পাখির ডাক শুনতে না পেলেও পাশের আবুল মিয়ার বাঁশ ঝাড় থেকে কয়েকটা পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ কানে আসে দামিনীর। ছেলেবেলায় মা তাকে একবার বলেছিল, নিশুতি রাতে পাখির ডানা ঝাপটানি অশুভ লক্ষণ। এখন নিশুতি রাত না হওয়ায় মায়ের কথাটাকে মোটেও পাত্তা দেয় না। ঘড়ির কাটায় এখন নিশুতি রাত না হলেও প্রকৃতি যেন সেভাবেই সেজেছে। এদিক বিবেচনা করে ভয় এবং শঙ্কা একটু একটু করে দাঁনা বাঁধে মনে। তার মনের মধ্যে উথাল পাথাল শুরু হয়। সামনে কোন খারাপ কিছু অপেক্ষা করছে না তো?

এপাড়া-ওপাড়া ঘুরে ক্লান্ত দামিনী বাড়িতে ফিরেই হতবাক। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে ফয়সাল। সারা শরীর তার ভিজে একাকার। দামিনীকে দেখে ফয়সাল এগিয়ে আসে তার কাছে। ‘আমি দুঃখিত আন্টি আসলে এমন জায়গায় বাসের চাকা পাংচার হয়ে গিয়েছিল যে, সেখান থেকে সময়মত আসতে পারিনি। তার ওপর বৃষ্টি। আমি যে খবর দেবো সে সুযোগও পাইনি।’

ফয়সালকে দেখে নির্বাক হয়ে যায় দামিনী। সে এখন কী বলবে? এমন দুর্যোগ মুহূর্তে তার কী করার আছে? কিন্তু মেয়েকে যে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না সেকথা কীভাবে বলবে তাকে?

দামিনীর নীরবতা দেখে ফয়সাল বলল, ‘আমার এ অপরাধের কোন ক্ষমা নেই তা আমি জানি। তবে এ অনিচ্ছাকৃত ভুল আমার কারণে হয়নি। আশাকরি, সেটা কোনদিন হবেও না। তারপরও ভুলটাতো আমার। আমাকে আপনারা ক্ষমা করে দিন।’

যান্ত্রিক ত্রুটি আর প্রাকতিক দুর্যোগে কার-ই বা হাত আছে? তবুও ফয়সাল নিজেকে অপরাধী ভাবায় দামিনী বলল, ‘এখানে তোমার কোন দোষ নেই বাবা। তবে একটা খবর দিতে পারতে?’

‘ঐ যে বললাম, এমন জায়গায় গাড়িটি দাঁড়িয়েছিল সেখান থেকে খবর দেবার কোন সুযোগ ছিল না।’

‘আমি বুঝতে পেরেছি, তোমার সমস্ত শরীর ভিজে। ঘরে এসে আগে কাপড় পাল্টাও। আলনায় লুঙ্গি- গেঞ্জি সব রাখা আছে।’ বলে ফয়সালকে পাশ কাটিয়ে ঘরে যেয়ে হারিকেনটা টেবিলের ওপর রাখে।

 

ফয়সাল আসবে বলে নতুন লুঙ্গি- গেঞ্জি কিনে আলনায় সাজিয়ে রেখেছিল নিলু। এ বাড়িতে পুরুষ ছেলে নেই, যার কাপড় সে পরতে পারবে। ফয়সাল আলতা- স্নো থেকে শুরু করে কণের যা যা লাগে সব ব্যাগে ভরে নিয়ে এসেছে। নিজের জন্যে লুঙ্গি- গেঞ্জি আনতেও ভুল করে নি। তাইতো সে তার হবু শাশুড়ীর কথায় পেছনে পেছনে ঘরের ভেতরে ঢুকে বলল, ‘আন্টি আপনি কোন চিন্তা করবেন না। আমার ব্যাগে সবকিছু আছে।’

নিলুর চিন্তায় নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে না দামিনী। বলল, ‘নিলু কোথায় গেছে বলতে পারো?’ এই কথাটা বলার জন্যে হাঁসফাস করছিল তার মন।

কথাটা যেন ফয়সালের শরীরে কাঁচের মতো বিঁধে। সে ক্ষণেক নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে বলল, ‘আমি ঠিক বুঝলাম না আপনার কথা আন্টি।’

‘নিলুফাকে সন্ধ্যে থেকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না।’

‘কী বলেন! সে বাড়িতে নেই! এটা কীভাবে সম্ভব?’

‘কোনটা সম্ভব কোনটা অসম্ভব কিছুই বুঝতে পারছি না। সন্ধ্যার পরে নিলুফা কিছু একটা বলে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে ঘর থেকে বের হলো। তারপর সে আর বাড়ি ফেরেনি।’ ইতিমধ্যে চোখ জলে ভরে উঠেছে দামিনীর।

ফয়সাল নিজেকে ধিক্কার দেয়। নিজের কপাল চাপড়ায়। বলল, ‘দোষটা আমারই। বিকেলে আমার আশার কথা ছিল। সে হয়তো অপেক্ষায় থেকে….’

দামিনী পরনের শাড়ি দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলল, ‘তারপর কী বাবা?’

‘আপনি কী সব জায়গায় দেখেছেন?’ ফয়সালের প্রশ্ন।

‘আমি মহিলা মানুষ, তার ওপর বয়স হয়েছে। রাতে ভাল চোখেও দেখিনা। একপ্রকার আন্দাজের ওপরে ছুটতে ছুটতে এপাড়া- ওপাড়া দুইপাড়াই গিয়েছিলাম। বিদ্যুৎ না থাকায় অধিকাংশ বাড়ি অন্ধকারে পরিপূর্ণ। প্রায় সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। যা দু’একজনকে পেয়েছিলাম তারা কেউ কিছু বলতে পারে না।’

‘ আপনাকে সে কখনও কিছু বলেনি?’

‘তেমন কিছুতো মনে পড়ছে না। কোথায় যেতে পারে নিলু! তোমার সাথে কী কোন কথা হয়েছিল?’

‘আমি আসবো। এখানকার দু’চারজন মানুষের উপস্থিতিতে বিয়ে হবে। এই ছাড়া আর কোন কথা হয়নি।’

‘এ কথাতো আমি জানি। তাহলে….’ দামিনী কথা শেষ না করতেই ফয়সাল বললো, ‘আমি স্টেশনের দিকে দেখে আসি। ওদিকে কি আপনি গিয়েছিলেন?’

দামিনী বলল, ‘তা যাইনি। ঠিক আছে যাও। আমি কী আসবো তোমার সঙ্গে?’

‘না আন্টি, আপনার আসার দরকার নেই; আমি যাচ্ছি।’ বলে ফয়সাল স্টেশনের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হয়।

কোন আশ্বাস-বিশ্বাসকে মনের কোনে ঠাঁই দিয়ে নিলু বৃষ্টিকে সাথী করে অন্ধকারে বাড়ির বাইরে যেতে পারে? তার সাথে কী এমন ঘটেছে, যার জন্যে নিজেকে আড়াল করতে হবে? ফয়সালের মাথায় কিছুই আসে না।

 

বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেই জানাশোনা- তারপর প্রেম। ফয়সাল সংস্কৃতি প্রেমী। কলেজের যে কোন অনুষ্ঠানে তার সরব উপস্থিতি নিলুর নজর কাড়ে। জারুল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা ফয়সালকে নিলুই প্রথম কোন রকম বিশেষণ হাতে না রেখে বলেছিল, ‘আমি নিলু। তোমার মনটা আমাকে দেবে?’ ফয়সাল এমন ঘটনার মুখোমুখি এর আগে কোনদিন হয়নি। যদিও স্কুল-কলেজের বিভিন্ন নাটকে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করে অনেক কথাই বলেছে। বাস্তবে এমন কথা তাকে কেউ কোনদিন বলতে পারে তা তার মাথায় আসেনি। তাইতো কথাটা শোনার পর লাজ এবং দ্বিধায় তার শরীর হিম হয়ে যাবার জোগাড়। ফয়সালের মুখের অবস্থা দেখে নিলু হেসে উঠে বলেছিল, ‘আমি বুঝতে পেরেছি, তোমাকে মুখে কিছু বলতে হবে না। মনটা আমি নিয়েই নিলাম।’ সে চলে যায়। ফয়সাল নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থেকে অনুভব করে, মনটা এখন আর তার কাছে নেই, সত্যিই ছিনিয়ে নিয়ে গেছে নিলু নামের মেয়েটা!

সেই থেকে অনুভবে- বৈভবে দু’জনের মেলামেশা। ফয়সালের যখন দেড় বছর বয়স তখন এক সড়ক দুর্ঘটনায় তার বাবা-মা দু’জনেই মারা যায়। অলৌকিকভাবে বেঁচে যায় ফয়সাল। সেই থেকে খালার কাছে মানুষ হলেও গত বছর সেই খালাও পরপারে পাড়ি জমায়। খালাতো ভাই-বোনেরা থেকেও নেই। তারা ফয়সালের কোন খোঁজ খবর নেয় না, পাছে জায়গা জমির ভাগ দিতে হয়। পারলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। ফয়সাল বুঝতে পেরে তাদের সাথে খুব একটা যোগাযোগ করার চেষ্টা করে না। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকলেও হোস্টেল ছেড়ে বাড়ি যায় না সে।

মেধাবী ছাত্র বলতে যা বোঝায় তার সব গুণই ফয়সালের মধ্যে আছে। পরীক্ষায় প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হয়নি কোনদিন। স্বাভাবিকভাবে সব শিক্ষকদের সুদৃষ্টি তার প্রতি। এ কারণে কয়েকটি টিউশানি জোগাড় করতে বেগ পেতে হয়নি। টিউশানি থেকে মাসে যে টাকা পকেটে আসে তা দিয়ে পড়ালেখা আর খাওয়ার খরচ চলে যায়। অতিরিক্তও থাকে কিছু। চাকুরীর চিন্তা ভুল করেও তার মাথায় আসে না। ঘুষ ছাড়া চাকুরীর সম্ভবনাযে কম, তা ভাল করেই জানে। প্রাইভেট পড়িয়েও নির্দিধায় জীবনটাকে পার করে দেওয়া সম্ভব। তবে ভাল চাকুরী পেলে ভেবে দেখার মানুষিকতা সে পোষণ করে যা বাইরে প্রকাশ পায় না।

 

নিলুর বাবা নেই। ও যখন খুব ছোট তখন তাদের ছেড়ে সেই যে নিরুদ্দেশ হয়েছে আজও ফেরেনি। আর ফিরবে সে আশাও করে না তারা। গত বছর কে একজন বলেছিল, চিটাগাংএ তাকে দেখা গেছে। কথাও হয়েছে। সেখানে বিয়ে থা করে সংসারী হয়েছে। এসব কথা অবশ্য বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাস কোনটাই করেনি নিলু কিংবা তার মা। সে অন্য একটা সংসার করলেই কী আর না করলেইবা কী? সে তো আর পুরোনো দিনগুলোতো ফিরিয়ে দিতে পারবে না। এখানে- এই অবেলায় তার আর কোন প্রয়োজন নেই।

নিলুর বাবা নিরুদ্দেশ হবার পর তাদের কী কঠিণইনা দিন গিয়েছে! দামিনী কখনও রাজ মিস্ত্রির হেলপার, কখনও দিনমজুর, কখনওবা পরের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেছে। বিভিন্ন অসুখ-বিসুখে জর্জরিত হয়ে আগের মতো আর শক্তি সামর্থ নেই তার। তাইতো বছর তিনেক আগে দর্জি প্রশিক্ষণ নিয়ে মহল্লার মহিলা- বাচ্চাদের পোশাক তৈরি করে। আয় যে বেশি হয় তা নয়। যা হয় তা দিয়ে কোন রকম চলে যায় মা- মেয়ের সংসার। মেয়েকে লেখাপড়া শেখতে যেয়ে কত কষ্ট, কতটা চাপ নিজের ওপর দিয়ে গিয়েছে তা মেয়েকে বুঝতে দেয়নি দামিনী। সে শুধু স্বপ্ন দেখেছে, মেয়ে শিক্ষিত হয়ে একদিন সকল দুঃখ কষ্ট চাপা পড়ে যাবে পিরামিড সভ্যতার মতো। মেয়েকে শিক্ষিত করার ইচ্ছা তার অনেকদিনের। সে নিজেও ভাল ছাত্রী ছিল। সংসারের টানাপোড়েনে বাবা তাকে অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেয়। যার ফল সে নিজেই ভোগ করছে। এমনিতে সময়ের আগে বিয়ে, তার ওপর নিলুর জন্ম তাকে পুষ্টিহীন করে তোলে। রোগে শোকে জর্জরিত হয়ে নিজের স্বাভাবিক অবয়ব হারিয়ে বর্তমানে বৃদ্ধাদের কাতারে এনে দাঁড় করিয়েছে।

 

দু’জনেরই মাষ্টার্স পরীক্ষা শেষ হয়েছে গত সপ্তায়। এখন রেজাল্টের অপেক্ষা। রেজাল্ট বের হলে কোন রকম একটা চাকুরীর খোঁজ করে সেখানে থিতু হবে বলে মনে মনে ভেবেছিল ফয়সাল। তবে চাকুরী না পেলেও আক্ষেপ থাকবে না। টিউশনিতো রয়েছেন। আর নিলু কিছু করবে না বলে বরাবরই বলে আসছে। ‘যে মা যত শিক্ষিত তার সন্তান ততটাই শিক্ষিত হতে বাধ্য’ এমন বিশ্বাস বুকে ধারণ করে এতদূর পর্যন্ত পড়াশুনা করেছে সে।

পরীক্ষা শেষে দু’জনকেই হোস্টেল ছেড়ে দিতে হবে। নিলু চলে যাবে মায়ের কাছে। ফয়সাল কোথায় যাবে? তার যাবার তেমন কোন জায়গা নেই। টিউশনি শহরের ভেতর। এখন একমাত্র উপায় ঘর ভাড়া করে থাকা। ঢাকা শহরে ব্যাচেলরদের ঘর ভাড়া পাওয়া মুষ্কিল। অবশ্য মন দিয়ে খুঁজলে একদমই যে পাওয়া যাবে না তা নয়। হয়তো যাবে। সে পথে না এগিয়ে দু’জনে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়। আয়োজন যতটুকু না করলে নয় ততটুকু। নিলুদের আপনজন-প্রতিবেশি থাকলেও ফয়সালের পরিচয় দেবার মতো এখন আর কেউ নেই। যারা ছিল তারা সীমানার ওপারে পাড়ি জমিয়েছেন। আর যারা বেঁচে আছে তারা ইচ্ছা করেই তাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। এ জন্যে তার ইচ্ছে হয় না, কাউকে বিয়ের কথা জানানোর।

যথাসম্ভব কেনাকাটা করে নিয়ে আসলেও নিলুর হঠাৎ অন্তর্ধানে মনে মনে ভেঙে পড়ে ফয়সাল। যা বাইরে প্রকাশ করে না, পাছে তার মা কষ্ট পায়।

সন্ধ্যায় চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার থাকলেও রাত বাড়ার সাথে সাথে সে অন্ধকারকে হারিয়ে আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঁকি দেয়। অনেক দূরের সবকিছু স্পষ্ট দেখা যায়। ফয়সাল ঘর থেকে বের হয়ে জ্যোৎন্সার আলোয় উপস্থিত হয় রেল স্টেশনে। জনশূন্য স্টেশনে কয়েকটা বেওয়ারিশ কুকুর ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না। গা ছম ছম করা পরিবেশ। হঠাৎ নিজের শরীরে কেমন যেন শীতলতা অনুভব করে সে। শরীরটাকে ভার ভার মনে হয়। সে মনে সাহস সঞ্চয় করে স্টেশন মাষ্টারের রুমের দিকে এগিয়ে যেয়ে দেখে একজন মোটা ফ্রেমের চশমা পরিহিত লোক টেবিলের ওপর কাগজ রেখে কি যেন লিখছে। সামনে তার বৃটিশ আমলের হারিকেন জ্বলছে মিটিমিটি।

‘আপনি কী এই স্টেশনের দায়িত্বে আছেন?’ লোকটিকে প্রশ্ন করে ফয়সাল।

লোকটি লেখা বন্ধ করে কাগজের ওপর কলমটা চাপা দিয়ে রাখে। ফয়সালের দিকে মুখ উঁচু করে চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে বলল, ‘আমাকে কিছু বললেন?’

‘জ্বী হ্যা।’

‘বলুন’

‘আপনি কী এখানকার দায়িত্বে আছেন?’

‘দায়িত্ব কী বলছেন মশায়, একেবারে স্টেশন মাস্টার। তবে এখন কিন্তু কোন ট্রেন নেই।’

‘আমি ট্রেনের জন্যে আসিনি।’

‘তাহলে!’ বিস্মিত স্টেশন মাষ্টার।

নিলুর কথা লোকটিকে বলবে কী না দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগে ফয়সাল। দুই কান থেকে দু’শো কান হতে সময় বেশি লাগবে না। সামান্য একটা কথা-ই যথেষ্ট। যেহেতু আর কোন উপায় সামনে অবশিষ্ট নেই, একারণে একপ্রকার বাধ্য হয়ে বলল, ‘নিলু নামের একটি মেয়েকে সন্ধ্যা থেকে খুঁজে পাচ্ছি না। আপনি কী চব্বিশ/পঁচিশ বছর বয়সী কোন মেয়েকে এখানে আসতে দেখেছেন?’

‘নিলু মানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া মেয়েটাতো?

ফয়সাল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘আপনি ঠিকই ধরেছেন। দেখেছেন কী তাকে কোথাও?’ আশার স্বপ্ন তার চোখে মুখে ফুটে ওঠে।

‘হ্যা, হ্যা, দেখেছি, দেখেছি। সাতটার মেইলেই তো টিকিট নিয়েছিল। আমি নিজেই দিয়েছিলাম।’

বিস্মিত ফয়সাল বলল, ‘কোথাকার টিকিট?’

‘ঢাকার।’

ফয়সাল মনে মনে বিড়বিড় করে বলল, ‘তাহলে নিলু কোথায় যেতে পারে?’

কথাটা কানে যায় স্টেশন মাস্টারের। বলল, ‘ট্রেনে আমি তাকে উঠতেও দেখেছিলাম।’

কথাটা বিশ্বাস হয় না ফয়সালের। তাইতো সে স্টেশন মাস্টারকে বলল, ‘আপনি ভীড়ের মধ্যে তাকে কী ঠিক দেখেছেন?’

‘দেখুন মশায়, এই স্টেশনে হাতে গোনা দু’চারজন যাত্রী উঠানামা করে। ট্রেন ছাড়ার জন্যে আমি নিজেই সিগন্যাল দিই। ভুল হবার প্রশ্নই ওঠে না। আর হ্যা, তখন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টিতে সে ভিজেও গিয়েছিল। এখন বিশ্বাস করা না করা একান্ত আপনার ব্যাপার।’

স্টেশন মাস্টারের তথ্যটা এখনও পর্যন্ত ভুল প্রমাণের সুযোগ নেই। সে তো সত্যিই বলছে। যদি তাই হয়, তাহলে কেন গেল সে? কী এমন প্রয়োজন হলো, যার জন্যে তাকে বিয়ের পিঁড়িতে না বসে ঢাকায় যেতে হলো? নিজের মনকে হাজারো প্রশ্ন করে কোন উত্তর পায়না। সে বাড়িতে ফিরে যেয়ে দামিনীকে সব কথা বললে সেও হতবাক হয়ে যায়। সেও বুঝতে পারে না কেন- কী কারণে তার মেয়েকে চলে যেতে হলো।

 

ঢাকায় ফিরে অনেক খুঁজে একটা মেসে উঠে ফয়সাল। সে প্রেস থেকে অনেকগুলো পোস্টার ছাপায়। তাতে বড় বড় অক্ষরে লেখা, ‘নিলু ফিরে এসো’। টিউশনির ফাঁকে যখনি সময় পায় তখনি বিভিন্ন দেয়ালে- বৈদ্যুতিক পোলে- পাঁচিলের বাইরে মারে সেই কাগজগুলি। একসময় সব পোস্টার শেষ হয়ে গেলে পরবর্তীতে আরো কয়েক হাজার ছাপায়। তার পোস্টার শহরের অলি গলি কোথাও বাদ যায় না। বছরের পর বছর পার হয় নিলু ফিরে আসে না। তবে কী তার চোখে পড়েনি এ পোস্টার! হতাশ হয় না ফয়সাল। তার বিশ্বাস, একদিন না একদিন তার নিলুর চোখে পড়বে পোস্টারটি।

 

মাঝ দুপুর। সূর্য মাথার ওপরে। কিন্ডারগার্টেন স্কুল ছুটি হয়েছে এইমাত্র। ফয়সাল কাগজে আঠা লাগিয়ে পাঁচিলে লাগানোর জন্যে ব্যস্ত। বাচ্চারা এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে। পেছন ফিরে দেখে- একজন ভদ্রমহিলা ছোট্ট একটা মেয়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে। তার চোখে চোখ পড়তেই ফয়সাল তো হতবাক। বলল, ‘নিলু তুমি?’

নিলু বিস্মিত হলো কিনা বোঝা গেল না। সে ফয়সালের প্রশ্নের স্বাভাবিক উত্তর দেয়, ‘হ্যা আমি। তুমি আমাকে দেখে হতবাক হয়ে গেলে কেন?’

দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যায় ফয়সাল। এই মুহূর্তে তাকে কেমন যেন বোকা বোকা লাগে। যার জন্যে এতটা বছর অপেক্ষা করা, খুঁজে বেড়ানো শহরের অলি গলি, পোস্টারে ছেয়ে ফেলা সমস্ত শহর! আর তার সাথে দেখা হতেই, এ কী ব্যবহার! কষ্টে তার চোখ দু’টি মুহূর্তে লাল হয়ে ওঠে। কোন কথা তার মুখ থেকে বের হয় না।

নীরবতাকে কাটিয়ে নিলু বলল, ‘তুমিতো দেখছি সেই আগের মতোই আছো?’

ফয়সাল মুখে কোন কথা না বলে সম্মতিসূচক সামান্য মাথা নাড়ে।

নিলু দেওয়ালে লাগানো পোস্টারের দিকে তাকিয়ে বলল ‘সংস্কৃতি নিয়ে আছো তাহলে? নামটা চমৎকার- নিলু ফিরে এসো। নাটকটা কোথায় মঞ্চস্থ হবে?’

‘কোন নাটক?’

‘এই যে- নিলু ফিরে এসো।’

ফয়সালের বিস্ময়ের ঘোর আরো বৃদ্ধি পায়। বলল, ‘এটাকে তুমি নাটক বলছো?’

‘তাহলে…?’

তুমি ঠিকই বলেছো, নাটক- মহা নাটক। তা না হলে শহরের অলিতে গলিতে পোস্টারে ছেয়ে থাকবে কেন?’

নিলু কী কিছুই বুঝতে পারছে না? নাকি না বোঝার ভান করছে? তবে কী তার অর্ন্তধানের পরে সবকিছু ভুলে গেছে? অথচ ফয়সাল পুরোনো ব্যথায় ক্ষণে ক্ষণে জর্জরিত। সে যে এত বছর পাগলের মতো নিলুকে খুঁজে ফিরেছে তার মূল্যায়ন কি নাটকের নামে প্রতিষ্ঠিত হবে?

‘আমি আসি। নাটকটি কোথায় মঞ্চস্থ হবে আমাকে জানিও; সময় পেলে আসবো।’ বলে মেয়েটির হাত ধরে সামনে দিয়ে চলে যায় নিলু। ফয়সাল সেদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। অজান্তেই তার চোখ দু’টি বেয়ে অবিরাম অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে মাটিতে।

‘সব মিথ্যা, সব ফাঁকি।’ আপন মনে বলে ফয়সাল হাতের তালু দিয়ে চোখ মুখে সেখান থেকে যাবার জন্যে দু’পা বাড়াতেই পেছন থেকে কেউ একজন হাত টেনে ধরে। ফয়সাল চমকে ঘাড় ফিরিয়ে দেখে নিলু দাঁড়িয়ে আছে। সে ঠোঁট কাঁপাতে কাঁপাতে সজল চোখে বলল, ‘তোমাকে ভালবাসার আগুনে পুড়িয়ে খাঁটি করে ফেলেছি। এই দ্যখো, তোমার নিলু তোমার কাছেই ফিরে এসেছে আজ।’

বহুদিন পরে ফয়সালের মুখে হাসির রেখা দেখা যায়। ‘তোমার জন্যে আমি সারা জীবন পুড়তে রাজি আছি। আজ থেকে এগুলোর কোন প্রয়োজন নেই।’ বলে হাতে থাকা পোস্টারগুলো ছিঁড়ে যখন সে বাতাসে উড়িয়ে দেয় তখন এক পশলা দখিনা হাওয়া দু’জনের হৃদয় শীতলতায় ভরিয়ে দেয়।

Read More

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked with *

সর্বশেষ পোস্ট

Advertising