ড. মো. নুরুল আমিন : সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপান, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য সফর শেষে দেশে ফেরত আসার পর একটি পুরোনো বাংলা সিনেমার গান সোশ্যাল মিডিয়াতে ট্রল হয়। গানটি হলো “আর যাবো না আমেরিকা, পেলাম যখন তোমার দেখা, তোমার বাড়ির পাশে বাড়ি ভাড়া করে রয়ে যাবো ঢাকা।” গান তো কেবলই গান। এটা দিয়ে বাস্তবতা
ড. মো. নুরুল আমিন : সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপান, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য সফর শেষে দেশে ফেরত আসার পর একটি পুরোনো বাংলা সিনেমার গান সোশ্যাল মিডিয়াতে ট্রল হয়। গানটি হলো “আর যাবো না আমেরিকা, পেলাম যখন তোমার দেখা, তোমার বাড়ির পাশে বাড়ি ভাড়া করে রয়ে যাবো ঢাকা।” গান তো কেবলই গান। এটা দিয়ে বাস্তবতা চিন্তা করা অযৌক্তিক । যেমন যদি বলি “দুনিয়াটা মস্তবড়, খাও-দাও ফুর্তি করো–” তবে কি আমরা সমস্ত কাজ কর্ম বাদ দিয়ে শুধু ফুর্তিতে জীবন কাটাতে পারব? অবশ্যই নয়। যাক সে কথা। আজকের লেখা গানের বাস্তবতা নিরূপণ নয়। বরং গানের এই কথা গুলো আবার কেন আলোচনায় সেই নিয়েই কিছু লেখা।
প্রধানমন্ত্রী তার সফর শেষে বাংলাদেশে ফিরেই একটি বক্তব্য দেন । তিনি দেশে ফিরে ১৫ মে বলেন, যারা বাংলাদেশের উপর নিষেধাজ্ঞা দেবে, সেসব দেশ থেকে কোনো রকম কেনাকাটা করবে না বাংলাদেশ। শুধু তা-ই নয়, একই সময়ে ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূতের বিশেষ নিরাপত্তা–সুবিধা তথা সার্বক্ষণিক পুলিশ এসকর্ট প্রত্যাহার করে নেওয়ার কথা বলা হয়। এই না কেনাকাটার ঘোষণা দিয়ে তিনি আসলে আমেরিকাকে ইঙ্গিত করেন। কিন্তু তার এই বক্তব্যের পরপরই নেটিজেনদের মুখে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। রাষ্ট্রদূতদের নিরাপত্তা সুবিধা বহাল রাখা হয়। অন্যদিকে, আমেরিকা থেকে কোন কিছু না কেনার বাস্তবতা কতটুকু সম্ভব বাংলাদেশের জন্য? বাংলাদেশ কি আসলে আমেরিকা থেকে কিছু কিনে? নাকি বাংলাদেশ আমেরিকায় রপ্তানি করে? ইত্যাদি হিসেব নিকেশ দিতে থাকে নেটিজেনরা । এর মধ্যেই ১৭/১৮ মে ২০২৩ তারিখে বিভিন্ন পত্রিকায় আমেরিকা থেকে সাড়ে বার হাজার টন চিনি কেনার ঘোষণা দেখা গেলো! নেটিজেনরা বলাবলি শুরু করলো আমেরিকা থেকে না কেনার ঘোষণার দুই/তিন পরেই সরকারকে চিনি কিনতে হচ্ছে আমেরিকা থেকে। এসব আলোচনা যখন মুখে মুখে, তখনই আমেরিকা একটি ভিসা নীতি ঘোষণা দিলো। এই ঘোষণায় বলা হলো যারা বাংলাদেশের সুষ্ঠু নির্বাচনে বাঁধা সৃষ্টি করবে তাদেরকে আমেরিকার ভিসা দেয়া হবেনা এবং অতীতের অনুমোদিতে ভিসাও বাতিল হবে ।
বাংলাদেশের সব মিডিয়াতেই ২৫/২৬ মে ২০২৩ তারিখে এটাই ছিলো গরম খবর। প্রথম দিকে এটাকে গুজব বলে চালাতে চেষ্টা করে ক্ষমতাসীন দল। কিন্তু পরে যখন সত্যতা পাওয়া যায় তখন ক্ষমতাসীনরা প্রচার করতে থাকে যে এই নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে বিরোধীদলের উপর। যদিও ভিসা নীতিতে সকলকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। এর মধ্যেই জানা গেলো যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় ডোনাল্ট লূ ৩/৪ মে ২০২৩ তারিখে এই ভিসানীতি সম্পর্কে অবহিত করেছেন। এর কয়েকদিন পরই প্রধানমন্ত্রী ৩ জুন ২০২৩ তারিখে একটি বক্ত্যব্য রাখেন “কে আমাদের ভিসা দেবে না, কে আমাদের স্যাংশন (নিষেধাজ্ঞা) দেবে ওনিয়ে মাথাব্যথা করে লাভ নাই। ২০ ঘন্টা প্লেনে জার্নি করে আটলান্টিক পার হয়ে আমেরিকায় না গেলে কিচ্ছু যায় আসে না। পৃথিবীতে আরও অনেক মহাসাগর আছে, অনেক মহাদেশ আছে; সেই মহাদেশের সঙ্গে আমরা যাতায়াত করব, বন্ধুত্ব করব; আমাদের অর্থনীতি আরও মজবুত হবে, উন্নত হবে, আরও চাঙ্গা হবে।” তার এই বক্তব্য থেকে এটা খুব পরিষ্কার বুঝা যায়যে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে শেখ হাসিনার সরকারের ইচ্ছে নেই। তার এই বক্তব্য আসলে পরোক্ষভাবে আওয়ামী নেতা কর্মীকে সাহস দেয়া হচ্ছে যে নির্বাচন যেন তেন একটি করা হবে তাতে কে কি স্যাংসন দিলো সেটা সমস্যা নেই। কারণ তিনি যদি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন দিতে আগ্রহী থাকতেন তবে তো আমেরিকার এই ভিসা নীতি নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। এটা পরিষ্কার যে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তো আর ভিসানীতি কার্যকরী হচ্ছেনা।
অতএব, তার এই বক্তব্যে যেহেতু এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে যে নির্বাচন সুষ্ঠু হচ্ছেনা তাই নেটিজেনদের এবার আমেরিকা যাওয়া বা না যাওয়া কিংবা আমেরিকার সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলমান। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের আগামী ২০২৩/২৪ সালের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে, মানবাধিকার, গণতন্ত্র ইত্যাদি ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমা দেশ গুলো ও সংস্থা চাপ অব্যাহত রেখেছে। এর মধ্যে আমেরিকার ৬ কংগ্রেসম্যান কতৃক ব্লিঙ্কেনকে চিঠি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের চিঠি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশে আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে যখন বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারের সাথে আমেরিকা বা পশ্চিমাদের চাপাচাপি চলছে এর মধ্যেই চীন যেন আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছেন। আমেরিকাসহ পশ্চিমাদের চাপের বিপক্ষে বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীর এই অবস্থানকে চীন সমর্থন জানিয়েছেন। চীনের সাথে আমেরিকার বৈরিতা বহুদিনের। এখন শেখ হাসিনার সরকারকে চীন সমর্থন দিয়ে আসলে এটা পরিষ্কার করে দিলো যে বাংলাদেশ আমেরিকা ছেড়ে চীনের বলয়ে যাচ্ছে। যেটা আমেরিকা কখনই মেনে নিতে চাইবেনা। তাই চীনের এই সমর্থন আসলে বাংলাদেশের জনগণের জন্য হবে একটি অশনি সংকেত।
বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনরা নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখার নিমিত্তে চীন-আমেরিকার এই দ্বন্দে জড়িয়ে ফেলছে যেটা অবশ্যই দেশের জন্য শুভকর নয়। ঠিক এই মুহুর্তেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার এক বৈঠক নিয়ে ব্রিফিংয়ের সময় সাংবাদিকদের বলেন যে আগামী আগস্টে বাংলাদেশ আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোট -ব্রিকসের সদস্য পদ লাভ করতে পারে । তিনি বলেন যে আগামী আগস্টের ব্রিকস সন্মেলনে শেখ হাসিনা অংশ নিবেন। এখানে উল্লেখ্যযে, ব্রিকস হল উদীয়মান অর্থনীতির পাঁচটি দেশ– ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং সাউথ আফ্রিকার প্রথম অক্ষরের সমন্বয়ে নামকরণ করা একটি জোট। এই জোটের ভবিষ্যতে আমেরিকান ডলারের পরিবর্তে বিকল্প মুদ্রা চালু করে তার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক লেন-দেন করার পরিকল্পনা আছে। যেটাকে ডি- ডলারাইজেশোন বলে অবিহিত করা হয়। এই পরিস্থিত তৈরী হলে আমেরিকার অর্থনীতিতে একটি বাঁধা নেমে আসবে। তাই আমেরিকা এই জোটকে সফল হতে দিতে চাইবেনা।
কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কোনদিকে ঝুঁকবে বাংলাদেশ? চীনের দিকে, নাকি আমেরিকার দিকে? এই প্রশ্নটি উত্তর খুঁজতে বর্তমান বাংলাদেশ-আমেরিকা এবং বাংলাদেশ-চীন এই সম্পর্কের সমীকরণ জানা প্রয়োজন। একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বৃহত্তম রপ্তানি বাজার। বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যেসব পণ্য রপ্তানি হয় তার মধ্যে রয়েছে তৈরি পোশাক, জুতা, টেক্সটাইল সামগ্রী ও কৃষিপণ্য। অন্যদিকে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের যেসব পণ্য আমদানি হয় তার মধ্যে রয়েছে কৃষিপণ্য (খাদ্যশস্য, বীজ, সয়াবিন, তুলা, গম এবং ভুট্টা), যন্ত্রপাতি এবং লোহা ও ইস্পাত পণ্য। কিন্তু অর্থের হিসেবে দেখলে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে যা রপ্তানি করে সে তুলনায় আমদানি করে কম। যেমন ২০২২ সালে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১১.১৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে কিন্তু আমদানি করে মাত্র ২.৯৬ বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ বাংলাদেশে নেট পজিটিভ ব্যালেন্স হচ্ছে ৮.১৯ বিলিয়ন ডলার (সুত্রঃ ইউএস এমবাসি, বাংলাদেশ) । এ বছর ২০২৩ সালে জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এই ব্যালেন্স হচ্ছে ২.২৯ বিলিয়ন ডলার (রপ্তানি ৩.০৫ বিলিয়ন- আমদানি ০.৭৬ বিলিয়ন)। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ৫ হাজার ২০৮ কোটি ডলার রপ্তানির মধ্যে এককভাবে যুক্তরাষ্ট্রেই গেছে ১ হাজার ৪২ কোটি ডলারের পণ্য (আজকের পত্রিকা, ২২ মে ২০২৩ঃ রাজনীতিতে আলোচনায় মার্কিন নিষেধাজ্ঞা)। বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ২০% আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। উল্লেখ্যযে, বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত হচ্ছে তৈরি পোশাক যা থেকে মোট রপ্তানির প্রায় ৮৬% আসে। অধিকন্তু, বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া তৈরি পোশাকের ২১% এবং হোম টেক্সটাইলের ১৭.৮৫% এর গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র (দৈনিক বান্দরবান, ২৩ মে ২০২৩ঃ আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্যে এগিয়ে বাংলাদেশ)। শুধুমাত্র বৈদেশিক মুদ্রা বা ডলার আয়ের জন্যই যুক্তরাষ্ট্র শুধু গুরুত্বপুর্ন নয়। যুক্তরাষ্ট্র আরো অনেকভাবে বাংলাদেশের জনগণের জন্য গুরুত্বপুর্ন। বাংলাদেশে বিনিয়োগ, বিদেশি সাহায্য, জলবায়ু মোকাবেলা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে সহায়তা করে। রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য আমেরিকা আর্থিক সহায়তা করে আসছে। বিগত কোভিড -১৯ এর টিকা বিনামূল্যে টিকাও সরবরাহ করেছে আমেরিকা। এছাড়া শিক্ষা, স্বাস্থ্য সহ বিভিন্ন প্রকল্পে নিযুক্ত দাতা সংস্থাগুলোকে আর্থিক সহায়তার ক্ষেত্রে আমেরিকা এগিয়ে। তদুপুরি, বাংলাদেশ থেকে অনেক পরিবারই তাদের সন্তানদের উচ্চ শিক্ষার জন্য আমেরিকা সহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলোতে পাঠায়।
অন্যদিকে, চীনের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক কি রূপ? চীন বাংলাদেশের প্রায় ৯৮% পণ্যকে শুল্ক মুক্ত প্রবেশিকার দিয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশ শুল্ক ছাড়া পণ্য চীনে রপ্তানি করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ বাস্তবে চীনে তেমন রপ্তানি করেনা, আমদানি করে বেশী। চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশে চীন থেকে ৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য সামগ্রী আমদানির বিপরীতে মাত্র ১ বিলিয়ন ডলারের পণ্যসামগ্রী রপ্তানি করে। অর্থাৎ বছরে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি বাণিজ্য। চীনের সাথে বাণিজ্য করলে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা বা ডলার আসবেনা বরং খরচ হবে। তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে যে স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে এবং সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য অবকাঠামো উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে চীন বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পে কারিগরি ও ঋণ সহায়তা প্রদান করছে। চীন বাংলাদেশে সেতু, রাস্তা, রেলপথ, বিমানবন্দর, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। তবে চীনের ঋণ নিয়ে বিশ্বের অনেক দেশেই বিপদে পরেছে। কারণ চীনের ঋণের সুদের হার বেশী। অধিকন্তু, রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে চীন কোন আর্থিক সহায়তা করে না এবং অধিকন্তু চীনের প্রয়োচনায় মায়ানমার এই সমস্যা চাপিয়ে দিয়েছে। এছাড়া যদিও, চীন বাংলাদেশকে চীনের মুদ্রা ইউয়ান ব্যবহার করে রাশিয়া কতৃক নির্মানাধীন রুপপুর প্রকল্পের ঋণ পরিশোধের আশ্বাস দিয়েছে, বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশের কাছে কোন ইউয়ান নেই। কারণ বাংলাদেশ-চীনের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি। চীন থেকে বাংলাদেশে কোন বৈদেশিক মুদ্রা ডলার বা ইউয়ান আসবেনা। তাই বাংলাদেশ ইউয়ান পেতে হলে ডলার দিয়ে ইউয়ান কিনে রাশিয়াকে পরিশোধ করতে হবে। তাই প্রকৃতপক্ষে ডলারের বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশ এখনো ইউয়ান বা অন্য মুদ্রা ব্যবহারে প্রস্তুত নয়। সেই সাথে অন্যান্য সম্পর্ক বিষয়ে চীনের উপর বাংলাদেশের নির্ভরশীলতা কম। আর আমদানী-রপ্তানি বাণিজ্যে শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশই চীন থেকে আমদানী করে বেশী। তাই সারাবিশ্বেই চীনের একটি লাভজনক বাজার। চীনের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক রাখা এবং চীনের ঋণ গ্রহণ করার অর্থই হচ্ছে চীনকে শক্তিশালী করা এবং নিজেদেরকে দুর্বল করা। শ্রীলঙ্কা, লাওস সহ আফ্রিকার অনেক দেশই তার উদাহরণ। লাওস ইতিমধ্যেই চীনের ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে দেওলিয়া। শ্রীলঙ্কা একইভাবে চীনের ঋণ নিয়ে নির্মিত বন্দর চীনকে দিয়েছে ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে । আফ্রিকার অনেক দেশই চীনের ঋণ নিয়ে কাবু হয়ে পরেছে। এমতাবস্থায়, বাংলাদেশকে কি চীনের ঋণের উপর ভর করে অবকাঠামো উন্নয়ন করা উচিৎ হবে?
এদিকে, বাংলাদেশের উপর আমেরিকার সাম্প্রতিক আচরণ নিয়ে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ যে কথা গুলো বলে থাকেন তা হচ্ছে “ইরানের বিরুদ্ধে অনেকেই স্যাংশন দিয়ে রেখেছে। ইরানের সরকার তো পড়ে যায় নাই, বহাল তবিয়তে আছে। বহু বছরের স্যাংশনেও কিউবাকে টলানো যায় নাই, সরকারও পরিবর্তন হয় না। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বহু বছর ধরে বহু স্যাংশন, সেখানকার সরকারও পরিবর্তন হয়নি। রাশিয়ার বিরুদ্ধে বহু স্যাংশন, সেগুলো অমান্য করেই ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং অনেকে তাদের কাছ থেকে পণ্য আমদানি করছে। অর্থাৎ, এগুলো দিয়ে আসলে লাভ হয় না।” কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ঐসব দেশ আমেরিকার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার শক্তি সামর্থ আছে । কারো আছে পারমানবিক শক্তি, কারণ আছে সোনার খনি, কারো আছে তেল-গ্যাস-কয়লার খনি। কিংবা কারো আছে প্রযুক্তি। সেদিক বিচারে বাংলাদেশের কি আছে? প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গা-গতরে খেটে খাওয়া মানুষের শ্রম বিক্রি। তবুও আবার সেই শ্রমের ফসল তৈরী পোশাক পাঠাতে হয় আমেরিকা সহ পশ্চিমা দেশগুলোতে। এই শ্রম বাণিজ্য যদি বিক্রি না হয় তবে কোথায় দাঁড়াবে বাংলাদেশ। বিগত কোভিড লকডাউনে বিশ্বে অনেক দেশের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা সীমিত করা হলেও চীনের ইলেকট্রনিক্স পণ্য কিন্তু ট্রেন ভর্তি হয়ে ইউরোপে ঠিকই চলেছে। আজ আমেরিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত যে কোয়াড করেছে সেই কোয়াডের দেশে চীনের ইলেকট্রনিক্স ঠিকই যাচ্ছে। যে কোয়াডের উদ্দেশ্য হচ্ছে চীন ও রাশিয়ার উন্নতির লাগাম টেনে ধরা, সেই কোয়াডের সদস্যদেশ ভারত কিন্তু ঠিকই চীন ও রাশিয়ার সাথে ব্রিকস-এ আছে। বাংলাদেশের তুলনার শক্তিধর রাষ্ট্র ভারত ঠিকই দু’কুল রক্ষা করে চলছে। কিন্তু বাংলাদেশ? বর্তমান সরকার শুধুমাত্র ক্ষমতায় থাকার নিমিত্তে একটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন দেয়ার লক্ষ্যে আমেরিকার-চীনের মতো শক্তিধর দেশগুলোর বিবাদে জড়াচ্ছে। আমেরিকার মতো একটি শক্তিধর দেশকে ক্ষেপিয়ে তুলছে। একটা বিষয় মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের উন্নয়নে হয়তো চীনকেও দরকার, তবে আমেরিকার বিকল্প চীন হতে পারেনা। তাই আমেরিকাকে বাদ দিয়ে চীনের বলয়ে প্রবেশ করা বাংলাদেশের জন্য যুক্তিযুক্ত হবেনা। ভু-রাজনীতি নিয়ে বিশ্বশক্তিগুলোর প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশকে ঠেলে দেয়া জাতির জন্য একটা অশনিসংকেত। বাংলাদেশের এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। বরং দেশ ও জনগণের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে দেশের অভ্যন্তরে সকল রাজনৈতিক দল, বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদেরকে নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে নির্বাচনের সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হওয়া দরকার।
Leave a Comment
Your email address will not be published. Required fields are marked with *