728 x 90

১৮৫৭ সিপাহী বিদ্রোহ: ঐতিহাসিক কিছু বিচ্ছিন্ন বয়ান

কায়সার আহমেদ: ২৩শে জুন ১৮৫৭। একশত বছর পূর্বে এই দিনটিতেই নিজের প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খানের বিশ্বাসঘাতকতায় বিশাল সেনাদল থাকা স্বত্তেও পলাশীর মাঠে পরাজয় বরণ করতে হয়েছিলো বাংলা বিহার উড়িষ্যার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলকে। তাই পলাশীর যুদ্ধ জয়ের শতবার্ষিকী উদযাপনে ব্যস্ত ইংরেজ শিবির। ১৮৫৭ সালে ২৩ জুন তারিখটি অমাবস্যা ছিলো। এই অমাবস্যা তিথি হিন্দু ও

কায়সার আহমেদ: ২৩শে জুন ১৮৫৭। একশত বছর পূর্বে এই দিনটিতেই নিজের প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খানের বিশ্বাসঘাতকতায় বিশাল সেনাদল থাকা স্বত্তেও পলাশীর মাঠে পরাজয় বরণ করতে হয়েছিলো বাংলা বিহার উড়িষ্যার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলকে। তাই পলাশীর যুদ্ধ জয়ের শতবার্ষিকী উদযাপনে ব্যস্ত ইংরেজ শিবির। ১৮৫৭ সালে ২৩ জুন তারিখটি অমাবস্যা ছিলো। এই অমাবস্যা তিথি হিন্দু ও মুসলমান উভয় জাতির পক্ষেই যথার্থ শুভ বলিয়া বিবেচিত হয়ে থাকে।

ভারতের সম্পদ ও সমৃদ্ধি ইংরেজ কোম্পানীকে এদেশে বাণিজ্য ও দস্যুবৃত্তি করতে প্ররোচিত করেছিলো। দেশে বিদেশে ভারতীয় কৃষি ও শিল্প সম্ভারের চাহিদা তখন ব্যাপক। আন্তর্জাতিক বাজারে তার অবারিত দ্বার। সেই কৃষি ও বাণিজ্য আত্মসাৎ করে,ইংল্যান্ডে শুরু হয়েছিলো শিল্প বিপ্লব। ইংল্যান্ডের নিজস্ব কোন মূলধন বিনিয়োগে তাদের শিল্প প্রসার ঘটেনি।

১৮৫৭ সালের সেনা অভ্যুত্থানকে ইংরেজ রাজকর্মচারীরা বলেছিলো, নিজেদের অপকর্মের ফলশ্রæতিতে এই অভ্যুত্থান– যা কেবল সিপাহিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, ভারতের বৃহত্তম  অংশের সাধারন মানুষও এই অভুত্থানের অংশীদর ছিলো, ইংরেজদের পক্ষে এ কথা মেনে নেয়া একেবারেই সম্ভব ছিলো না বরং এটা ছিলো তাদের আত্মহত্যার সামিল। গো-শূকর চর্বির টোটা আর খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের অজুহাত তুলে, অভুত্থানের প্রকৃতিকে বিকৃত করাই ছিলো ইংরেজদের উদ্দেশ্য। ভারতবাসী যে কতটা কুসংস্কারাচ্ছন্ন সেটিও প্রতিপন্ন করার একটা কৌশল মাত্র। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট কতখানি গভীরভাবে ভারতবাসীকে বিক্ষুদ্ধ করে তুলেছিলো, তা বিদেশী শোষণকারী ইংরেজ সরকারের পক্ষে কোনভাবেই মেনে নেয়া সম্ভব ছিলো না। ইংরেজদের রেখে যাওয়া নথিপত্র ও বিবরণ ঘাটা-ঘাটি করে অভুত্থানের সঠিক প্রকৃতি নির্ণয় করা আজো সম্ভব হয়নি। সেদিন সাফল্যতা না আসলেও বিদেশী শাসকদের দেশের মানুষের যে ভয়ঙ্কর প্রকাশ ঘটেছিলো, তার মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিলো পুঞ্ছিভুত অসন্তোষের প্রতিচ্ছবি। সিপাহী বিদ্রোহ ভবিষ্যতের জাতীয় জাগরণের পথ দেখিয়েছিলো। বিদ্রোহ ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়েছে সাধারণ অভ্যুত্থানের দিকে।

এই অভ্যুত্থানের সূচনা ও পরিণতির দিকে এগিয়ে যাওয়ার পেছনে ছিলো বেঙ্গল আর্মির অসাধারণ ভূমিকা। তৎকালিন বৃটিশ আর্মির প্রেসিডেন্সি ডিভিশনে সেনা বাহিনীর তিনটি শাখা ছিলো – বেঙ্গল আর্মি, মাদ্রাজ আর্মি ও বোম্বাই আর্মি। এর মধ্যে সব বড় শাখা ছিলো বেঙ্গল আর্মি। ঐ সময় বেঙ্গল আর্মির সেনাবাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিলো ১,৩৯,৮০৭ জন ভারতীয় সিপাহী এবং ২৬,০৮৯ জন ইউরোপীয় অফিসার।  এই বিশাল বাহিনী করা হয়েছিলো ব্রিটিশ দখল প্রসারের অভিযানে। আধুনিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই আধুনিক সেনাদল নিজেদের জীবন বিপন্ন করে সা¤্রাজ্যবাদী ব্রিটেনের শক্তিস্তম্ভকে সুদৃঢ় করায় লিপ্ত ছিলো। যেসব যুদ্ধে তারা অংশ নিয়েছিলো তার অন্যতম কয়েটি হলো: ১৮৩৮-৪২ প্রথম আফগান যুদ্ধ, ১৮৪০-৪২ চীনের বিরুদ্ধে আফিং যুদ্ধ, ১৮৪৩ সালে সিন্ধিয় বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ, ১৮৪৫-৪৬ সালে পাঞ্ছাবের যুদ্ধ, ১৮৪৮-৪৯ সালে পাঞ্ছাবের দ্বিতীয় যুদ্ধ, ১৮৫২ সালে বার্মার সাথে দ্বিতীয় যুদ্ধ, ১৮৫৬-৬০ সালে চীনের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় আফিং যুদ্ধ। ঐতিহাসিকদের মতে নেপোলিয়নের পতনের পর (১৮১৫) বিশ্বে এ ধরনের দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনী আর কোথাও গড়ে উঠেনি।

আত্মবিসর্জনকারী সেনানীদের পদোন্নতির কোন সুযোগ ছিলো না বললেই চলে। অফিসার পর্যায়ের সকল পদই ছিলো ইউরোপীয়দের জন্য সংরক্ষিত। এই সেনাবাহিনীর এক্তিয়ার ভুক্ত ছিলো সিন্ধু প্রদেশ বাদে সমগ্র উত্তর ভারত। গভর্নও জেনারেলের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির এই নিজস্ব বাহিনীতে লোক নেওয়া হতো বর্তমান উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানা, বিহার এলাকা থেকে। সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত লোকদের বেশীর ভাগই কথা বলতো হিন্দুস্থানীতে এবং ছোটখাটো জমির মালিক ছিলো তারা। পদাতিক বাহিনীর ১,১২,০০০ সদস্য ছিলো ব্রাম্মন। তারপর রাজপুত, অন্যান্য হিন্দু ও মুসলমান। ১৯০০০ অশ্বারোহীর বেশির ভাগ ছিলো সৈয়দ ও পাঠান মুসলমান। ৫০০০ সদস্য নিয়ে গঠিত গোলন্দাজ বাহিনীতে ছিলো সব সম্প্রদায়ের মানুষ। সেনাবাহিনীর বৃহত্তম অংশের সিপাহীদের নিয়োগ করা হয়েছিলো বর্তমান লখনউ ও ফৈজাবাদ ডিভিশন (পুরোন অয়োধ্যা) থেকে। আর সিপাহী অভ্যুত্থানে এই অঞ্চলই ছিলো সব থেকে উপদ্রুত। কারণ অযোধ্যা দখলের আগে ও পরে সেনানীদের পরিবারগুলির ওপর রাজস্ব পরিমান বাড়ছিলো। জমিজমাও বেহাত হয়ে যেতো। ফলে তাদের চরম আর্থিক দুর্গতির সম্মুখীন হতে হয়েছিলো, যাকিনা কয়েক পুরুষেও ঘটেনি।

বিশ্লেষণ করলে দেখা গিয়েছে যে, ভারতবর্ষে বিটিশ রাজত্বের প্রথম একশত বছরের ইতিহাস যেনো একটি সুতোর মধ্যে গাথা অবিচ্ছিন্ন এই বিদ্রোহের ধারা। জমিদার, ছোটো ছোটো দলনায়ক এবং কৃষকদের মধ্যে যে পুরানো সম্পর্ক ও বিশ্বস্ততার যোগসূত্র ছিলো তাকে আশ্রয় করেই জ্বলে ওঠে এই বিদ্রোহের আগুন। আঞ্চলিক গন্ডীর মধ্যে সীমিত হওয়ার ফলে এগুলি ছিলো পারস্পরিক সম্পর্ক বিহীন। এদের দৃষ্টিও ছিলো পেছনের দিকে — অতীতের দিকে। আধুনিক জাতীয়তাবাদ সাম্রাজ্যবাদের চরিত্র ও স্বরুপ সম্পর্কে আধুনিক চেতনা, নতুন সামাজিক সম্পর্কের ওপর গঠিত সমাজবোধ এই বিদ্রোহ বিশ্লেষণ করলে এর কোনটাই পাওয়া যাবে না। এগুলির যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁরাও ছিলেন প্রাচীনত্বের প্রতিনিধি; তাদের চারিদিকের পৃথিবীতে কী পরিবর্তন ঘটছে সে সম্পর্কে তারা সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিলেন। অনেক সময়ই তাদের দমন করার জন্যে ব্রিটিশকে প্রচুর সৈন্য বল প্রয়োগ করতে হয়েছে, তবু ব্রিটিশের ক্ষমতার সঙ্গে সত্যিকার মোকাবিলা করার মতো প্রতিরোধ তাদের কাছ থেকে আসেনি। তবু তাদের মহৎ অবদান হচ্ছে এই যে বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার আঞ্চলিক ঐতিহ্য তারা স্থাপন করে দিয়েছিলো।

১৮৫৭-৫৮ এর বিদ্রোহ কি কেবলই সেনাবাহিনীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো? না, বিদ্রোহের সুচনা সিপাহীদের মধ্যে থেকে ঘটলেও, পরবর্তী সময়ে তা ব্যাপক সংখ্যক গ্রাম ও নগরবাসীর সমর্থন লাভ করে। তাদের মধ্যে পুঞ্ছিভুত জমাট বাঁধা ক্ষোভের বহি:প্রকাশ অগনুতপাত ঘটে এই দিন। সিপাহীরা ছিলো এই দেশের সাধারন মানুষ। দেশের অভ্যন্তরে ও বিদেশে ইংরেজের সাম্রাজ্য বিস্তারে তাদের ছিলো বিশেষ ভূমিকা। সাধারন পরিবার থেকে উঠে আসা সেনাবাহিনীর অসীম সাহসি এই  বীর সেনা সদস্যরা একশ বছর ধরে দেখে আসছিলো ইংরেজ সরকারের অবহেলা ও বৈষম্যের স্বরুপ। পুরষ্কৃত হওয়া দুর কথা বরং দিনে দিনে তাদের এক দু:সহ জীবনের মুখোমুখি হতে হয়েছিলো। সেনাবাহিনীর বিক্ষোভের কারণ হিসাবে যাই বলা হোক না কেন, পেছনে ফেলে আসা পারিবারিক জীবনের দু:সহ যন্ত্রণা থেকে তারা মুক্ত ছিলো না।

ব্রিটিশ সরকার বিদ্রোহ দমনে আগ্রা, দিল্লি, কানপুর, অযোধ্যা ও লাহোর সহ অন্যান্য স্থানে অসংখ্য সৈন্য পাঠাতে থাকে। সেই সৈন্যদের জন্যে আহরাদি পাঠাতে হতো কলকাতা ও অন্যান্য প্রধান প্রধান শহর থেকে। ফলে এইসব অঞ্চলে দেখা দেয় ভয়ঙ্কর খাদ্যাভাব। ব্যবসায়ীরাও অতিরিক্ত লাভের আশায় আহার দ্রব্য বাইরে পাঠাতে থাকে। খাদ্যদ্রব্য দুর্মূল্য হয়ে ওঠে। ধনী লোকেরাও খাদ্য সংকটের আশংকায় কোম্পানীর কাগজ বিক্রয় করে ছয় মাসের আহারোপযুক্ত ইত্যাদি মজুত করতে থাকে। ফলে দরিদ্র মানুষ নিদারুন সংকটের সম্মুখিন হয়েছিলো। চারিদিকে ছিলো কেবল নাই নাই রব। ডাল, চাউল, তেল-ঘি সবই বিত্তবানদের ঘরে চলে গিয়েছিলো। দরিদ্র মানুষ পাঁচ পয়সায় এক পয়সার জিনিষও সংগ্রহে ব্যর্থ হয়েছিলো। ঐ সময় আম কাঠাল সস্তা হওয়ায়, কিছুদিন গরিবদের প্রাণ বেঁচে ছিলো এইসব খেয়ে। কিন্তু তাও শেষ হলো। তৎকালিন সময়ে সম্বাদ ভাস্কর পত্রিকায় অভিযোগ করা হয়েছিলো যে ধনীলোকেরা শহরে হাহাকার ফেলছেন তাতে দরিদ্র লোকেরা সকল বাজারে আহারীয় দ্রব্য না পাইলে ক্ষুদা তৃষ্ণায় কাতর হয়ে দল গঠন করে ধনীদের বাড়ী বাড়ী যাইয় সর্বস্ব লুঠ করবে এতে কোন সন্দেহ নেই। আহার না পাইলে কি করবে তারা? হয়তো নিজেদের ঘরে ঘরে কাটাকাটি হানাহানি শুরু করে দিবে। অতএব ধনীগন যেনো এইসব দরিদ্র প্রজাদের প্রতিপালন ও সাহায্যের ব্যবস্থা করেন। সিপাহীরা যেমন ব্রিটিশ সরকারের প্রতিকুল হইয়া সকলকে ব্যাকুল করিয়াছে প্রত্যেক ধনীর দৌবারিকাদি ভৃত্যেরাও এমন কিছু করতে পারে কারণ মরিয়া হইয়া উঠিলে মানুষের হিতজ্ঞান থাকে না।

অযোধ্যার নির্বাসিত নবার ওয়াজেদ আলি তখন মুচিখোলায় নির্বাসিত। জনরব উঠলো যে তার অনুচরেরা কলকাতা দুর্গের মুসলমান প্রহরীদের উত্তেজিত করছে। তারা বিদ্রোহী সিপাহীদের সঙ্গে গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত এমন অভিযোগও তুলেছিলো ইউরোপীয় সাহেবেরা। দুর্গের প্রহরীদের সাথে নবাবের লোকজনদের সাক্ষাৎ হতে দেখা যাচ্ছিলো প্রতি নিয়ত। এমনকি অযোধ্যার প্রধান তালুকদার রাজা মানসিংহ নাকি কলকাতায় এসে নবাব এবং তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন। গভর্নর জেনারেল অবস্থার জটিলতায় উদ্বিগ্ন হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে নবাব ওয়াজেদ আলী, তাঁর প্রধানমন্ত্রী আলি নকি খাঁ এবং আরো তিনজন কর্মচারীকে অবরুদ্ধ করার। এই সিদ্ধান্ত কার্যকরী করার করবার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো পররাষ্ট্র দপ্তরের তৎকালিন সেক্রেটারী এডমনস্টোনকে। এডমনস্টোন সাহেব গভর্ণর জেনারেলের কয়েকজন কর্মচারী, কিছু ইউরোপীয় সৈন্য এবং পুলিশ নিয়ে ভোরবেলায় নবাবের বাসা ঘিরে ফেললেন। নবাবের লোকজন কোন প্রকার বাধা দিলো না। অনুচরেরা এত সকালে এই সব লোকজন দেখে বিস্মিত ও আশঙ্কিত হয়ে গিয়েছিলো দুর্যোগের সম্ভাবনায়। প্রথমে আলি নকি খাঁ এবং আরো কয়েকজনকে গ্রেফতার করে সৈন্য পাহারায় জাহাজে পাঠানো হয়েছিলো। জাহাজটি কলকাতা থেকে এসেছিলো বন্দিদের নিয়ে যাওয়ার জন্যে।

এরপর এডমনস্টোন সাহেব হাজির হলে নবাবের মূল প্রাসাদে। ঘুম থেকে ওঠে নবাব ¯স্নান ও নামাজ সারলেন। তারপর সপরিষদ দেখা করলেন সরকারি প্রতিনিধিদের সাথে। এডমনস্টোন সাহেবকে সাদরে গ্রহন করা হলে নবাবকে তিনি জানালেন যে গভর্ণর জেনারেল এর নিকট সংবাদ পৌছেছে যে গুপ্তচররা আপনার নাম করে, ব্রিটিশ রাজ্যের সরকারের বিরুদ্ধে সর্বত্র সিপাহীদের উত্তেজিত  করে তুলছে। সেজন্য নবাবকে সাহেবের সাথে কলকাতা যেতে বলেছেন। নবাব নিজেকে নির্দোষ প্রমান করেও রেহাই পাননি। এডমনস্টোনের সাথে প্রাসাদ থেকে বের হয়ে গাড়ীতে করে কলকাতা অভিমুখে যাত্রা করেন। প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে আসবার সময় কোন উদ্বেগ প্রকাশ না পেলেও, কিছুদুর যাওয়ার পর এই অপমানকর পরিস্থিতির জন্য তার দুচোখ বেয়ে জল ঝরতে থাকে। নবাব কলকাতা দুর্গে উপনীত হলেন। যদিও বিদ্রোহী সিপাহীদের সাথে তার যোগযোগের কোন প্রমান ছিলো না।

সংবাদপত্র প্রকাশ ও প্রচারের উপর সরকারি নিয়ন্ত্রন চালু করা হয়। ওদিকে উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ তেকে কলকাতায় ভয়াবহ সংবাদ আসছিলো।স্বদেশবাসীর মৃত্যুতে কলকাতার ইংরেজরা প্রতিহিংসায় উম্মত্ত হয়ে উঠতে থাকে। উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ থেকে পলাতক ইউরোপীয়রা কলকাতায় এসে নানা খবর ছড়িয়ে পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলছিলো। ইংরেজরা একদিকে শোকাভিভুত এবং অপরদিকে হিংসায় নৃশংস হয়ে উঠেছিলো তখন। সমগ্র ভারতবাসীর বিরুদ্ধে ফেটে পড়েছিলো তাদের আক্রোশ। গভর্নর জেনারেলের কার্যক্রম তাদের দাবী অনুযায়ী হিংস্ররুপ না হওয়ায়, তারা ক্রোধ প্রকাশেও দ্বিধা করছিলো না। এই উত্তেজিত সশস্ত্র ইউরোপীয়দের হাত থেকে ভারতবাসীকে রক্ষা করাও কঠিন হয়ে পড়েছিলো।

এই সময় জাহাজ বোঝাই বন্দি সিপাহীদের গোরা সৈন্য পাহারায় নিয়ে আসা হতে থাকে কলকাতায়। হাতে হাতকড়ি, পায়ে বেড়ি দিয়ে আনা বন্দিদের লক্ষ্য করে সেদিনের সম্বাদ ভাস্কর লিখেছিলেন বৃটিশ সরকার সিপাহীদের উপর প্রচন্ড ক্রোধে ছিলেন, ইহা হইতে বোঝা যায় সিপাহীদের যে বলিদান দিবে। কালীঘাটে বহুদিন নরবলি হয় নাই। সেই সময় কলকাতার অন্ত্র ব্যবসায়ীদের বিক্রি বেড়ে যায় প্রচন্ডভাবে। উম্মত্ত হিংস্র ইউরোপীয়রা অস্ত্র সংগ্রহ করছিলো। হিন্দু মুসলমানরা সেজন্যে শংকিত হয়ে উঠছিলো। সরকার সিপাহীদের নিরস্ত্র করলেও, ইউরোপীয়দের হাতে অস্ত্র-সঞ্চয় ক্রমশ বেড়েই চলছিলো। দেশীয় লোকজনের এই বিশ্বাস জন্মায়, ইউরোপীয়রা আত্মরক্ষা ছাড়াও, অন্য কাজে এই অস্ত্র ব্যবহার করবে। অস্ত্র নিয়ন্ত্রনের জন্যে সরকার অস্ত্র সংক্রান্ত আইন প্রনয়নের বাধ্য হয়। রাজকর্মচারীদের নিজেদের বিভাগের লোকজনদের সংগৃহীত অস্ত্রের তালিকা সংগ্রহের নির্দেশ দেয়া হয়। অস্ত্র রাখার লাইসেন্স ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। কলকাতাবাসী ইউরোপীয়ানরা গভর্নর জেনারেল ক্যানিং-এর ওপর এই ব্যবস্থার জন্যে অসন্তোষ্ট হন। ভারতীয় রাজা ও জমিদার এবং বিভিন্ন শ্রেণীর কিছু মানুষ যারা ব্রিটিশ সরকারকে সমর্থন করতো, তাদের রক্ষা করাও তখন সরকারের কর্তব্য ছিলো।

সেকালে বাঙালি ধনীরা কোম্পানীর কৃপা লাভ করেছিলো। তাদেরই দৌলতে ওদের বিলাস বৈভব। কিন্ত এরা কেউই বাংলার প্রতিনিধি নয়। বাংলার কৃষক ও জনসাধারনের মধ্যে ছিলো ব্যপক বৃটিশ বিরোধী মনোভাব। কিন্তু প্রকৃত নেতৃত্বের অভাবে সিপাহী ও কৃষকরা সেদিন সম্মিলিত হতে পারেনি। যার ফল বিদ্রোহের সূচনাখন্ডে আরম্ভই ছিলো অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত কালের। বিদ্রোহের পর দেশব্যাপী শান্তি স্থাপিত হলো। কোম্পানির হাত থেকে ভারতের শাসনভার চলে গেলো ব্রিটিশরাজের হাতে। সেনাবাহিনীর ব্যাপক পুনর্গঠনে দেশীয় এবং ইউরোপীয় সৈন্য বাড়ানো হলো শতকরা ষাট ভাগ। সিদ্ধান্ত হয় কোন ভারতীয়কে গোলন্দাজ বাহিনীতে নেওয়া হবে না। কিন্তু পার্বত্য গোলন্দাজ বাহিনী এবং হায়দ্রাবাদের দেশীয় গোলন্দাজবাহিনী পূর্বাবস্থায় থাকলো।

সিপাহী বিদ্রোহের সূচনা ঘটে সর্বপ্রথম বাংলায়। সেনাবাহিনীতে ভারতীয় নিয়োগের সময় শর্ত ছিলো, তাদের ভারতের বাইরে পাঠানো হবে না। বারাকপুরের এক বাহিনীকে ভ্রম্মদেশে পাঠাবার চেষ্টা হলে, তারা অস্বীকৃতি জানায়। ফলে তাদের প্রাণদন্ড দেয়া হয়। ঘটনাটি ঘটেছিলো ১৮২৪ সালে। সেই থেকেই বেঙ্গল আর্মিতে অসন্তোষ প্রকাশ পেতে থাকে নানাভাবে। ১৮৫৭ সালে বারাকপুরে ছিলো ভারতীয় সৈন্যের ৪টি দল। ২,১৭,৩৪ ও ৮৩ সংখ্যক বাহিনী সেখানে মোতায়েন থাকতো। সৈন্যবাসের কতৃত্ব ছিলো চালর্স গ্রান্টের ওপর। সমস্ত বিভাগের সেনাপতি ছিলেন জন হিয়ার্সে। তিনি ২৮ জানুয়ারি অ্যাডজুডেন্ট জেনারেলের কার্যালয়ে সংবাদ পাঠান বারাকপুরের সিপাহীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে। ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমে পুড়ে গেলো বারাকপুর স্টেশন। ইংরেজ অফিসারদের ঘরের চালে রাতের অন্ধকারে আগুন লাগানো হয়। তীর পড়ে প্রতিদিন দাবানল সৃষ্টি করতে থাকে। রানিগঞ্জে ২ রেজিমেন্টের শাখা কেন্দ্রে এই ঘটনা ঘটতে থাকে। রাতের অন্ধকারে সিপাহীরা মিলে বৈঠকে বসে। বিভিন্ন সেনানিবাসে সংবাদ পাঠানো হতে থাকে কলকাতা ও বারাকপুর থেকে। ২৯শে মার্চ বারাকপুরে মঙ্গল পান্ডের গুলিতে ইংরেজ অ্যাডজুডেন্টের প্রান গেলো। মঙ্গল পান্ডে ও ঈশ্বরী পান্ডের প্রাণদন্ড দেয়া হলো। ভেঙ্গে দেয়া হলো রেজিমেন্ট। মার্চ ও এপ্রিল মাসে পাঞ্জাবের সিপাহীদের মধ্যে চরম উত্তেজনা দেখা দিলো। ১০ই মে মিরাটে বন্দী সিপাহীদের জেল ভেঙ্গে বের করে আনার সময় থেকেই প্রকৃত বিদ্রোহের সূচনা।

১১ই মে ’দিল্লী চলো’ আওয়াজ তুলে মিরাটের বিদ্রোহীরা পৌঁছালো দিল্লী। বাহাদুর শাহকে ঘোষনা করা হলো হিন্দুস্থানের বাদশাহ। ফিরোজপুর, মুজাফ্ফর নগর, লখনৌ, বেরিলি, শাহজাহানপুর, মোরাদাবাদ, এলাহাবাদ, ফতেপুর, কানপুর, এটাওয়া, হথরস, ঝড়কি, মথুরা, ফতেগড়, ফৈজাবাদে বিদ্রোহের অগ্নিশিখা জ্বলে উঠলো। পশ্চিম বিহার থেকে পাঞ্জাবের পূর্ব সিমান্তে বিদ্রোহের ব্যাপক আকার দেখা গেলেও বাংলা, আসাম, বোম্বাই ও মাদ্রাজে চাঞ্চল্যের অভাব ছিলো না। ভারতব্যাপী হিন্দু মুসলমানের এই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মোকাবেলায় ব্রিটিশ শক্তিকে বহু ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছিলো। বাংলার বিভিন্ন জেলার উত্তেজনা কম ছিলো না।

 

বর্ধমানে মহারাজা থেকে শুরু করে অসংখ্য জমিদার ইংরেজের রক্ষা কর্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলো সেসময়। তবুও জুন মাসের আগে ইংরেজ শক্তি চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটায়। অমানুষিক বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার মধ্য দিয়ে সেদিনের শ্বেতাঙ্গ শাসকরা বিভীষিকার সৃষ্টি করেছিলো। দোষী নির্দোষী নারী পুরুষ, বৃদ্ধ শিশু নির্বিশেষে ভারতীয়দের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিলো। বাড়িঘর পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়েছিলো। গ্রামের পর গ্রাম আগুনে পুড়ে শেষ হয়ে যায়। চাবুক মেরে ভারতীয়দের জিভ দিয়ে রক্ত চাটতে বাধ্য করে, গাছের ডালে ডালে ফাঁসি দিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিলো, উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিলো কামানে পুরে তোপের মুখে। আরো বহু নৃশংসতম ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, “তিনমাস ধরে প্রতিদিন মৃতদেহ বোঝাই আটখানি গাড়ী সূর্যোদয় থেকে সূর্যানস্ত পর্যন্ত শবদেহ স্থানান্তরিত করতো। ঐ সব শব চৌমাথা ও বাজারে ঝুলানো থাকতো। এইভাবে ছয় হাজার লোককে খুন করা হয়েছিলো”।

গভর্ণর জেনারেল ক্যানিং এর অবস্থা তখন শোচনীয়। ব্রিটিশদের চাপে তার পক্ষে স্থির থাকা ছিলো অসম্ভব। ১৮৫৭ সালে সেপ্টেম্বর মাসে তিনি বলেছিলেন, কেবলমাত্র ত্রাস সঞ্চার ও প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতেই চল্লিশ হাজার লোককে গুলি করে বা ফাঁসি দিয়ে হত্যার জন্য চাপ দিতে থাকে ব্রিটিশরা। তার মতে এ হলো “আমার দেশবাসীর পক্ষে ভয়ানক কলঙ্ক।” কিন্তু ভারতে অবস্থানকারী ইংরেজরা আরও বেশী কিছু চেয়েছিলো। তাই তারা ক্যানিংকে বিদ্রুপ করে বলতো “দয়াময়”।

অতএব ৩১শে জুলাই সরকারী যে নির্দেশ জারী করা হয়েছিলো তা নিম্নরুপ:

১। যেসব রেজিমেন্টের সিপাহীরা সরকারের বিরুদ্ধে যায়নি, তাদের হাতে অস্ত্র থাকবে না। ২। যেসব সিপাহীরা অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিলো অথচ তাদের অফিসারদের হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলো না এবং তারা নিরস্ত্র ছিলো। তাহলে তাদেরকে পাঠাতে হবে সামরিক বিচারের জন্যে। ৩। সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী, অফিসার বা অন্য ইউরোপীয়দের হত্যায় লিপ্ত ছিলো অথবা গুরুতর অত্যাচারের প্রশ্রয়দানকারীদের বিচার হবে আদালতে। কিন্তু বিচারকদের দন্ডাদেশ কার্যকরী করার আগে সরকারী অনুমোদন নিতে হবে। এই আদেশে অপরাধীদের নির্দোষীতা প্রমানিত হলে মুক্তিদানের কথা উল্লেখ করা ছিলো না।

সুত্র: সিপাহি বিদ্রোহের ১৫০ বছর, কমল চৌধুরী সম্পাদিত। ২৭শে জুন ২০২৩

 

 

Read More

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked with *

সর্বশেষ পোস্ট

Advertising