ইদানীং আয়শার ছোট ছেলের জীবনে সমস্যার শেষ নেই। মা হয়েও কিছু করতে পারছে না। ছোট ছেলে তানভীরের চাকরি চলে গেছে। হঠাৎ করে কোম্পানি থেকে কিছু কর্মচারী ছাঁটাই করা হয়। তার মধ্যে তানভীরের নামও ছিল। অনেক চেষ্টা করেও চাকরিটা বাঁচাতে পারেনি। এখানে পাঁচ বছর চাকরি করছিল। অথচ কোম্পানির মালিক এতটুকু দয়া করলো না। তানভীরের দুই
ইদানীং আয়শার ছোট ছেলের জীবনে সমস্যার শেষ নেই। মা হয়েও কিছু করতে পারছে না। ছোট ছেলে তানভীরের চাকরি চলে গেছে। হঠাৎ করে কোম্পানি থেকে কিছু কর্মচারী ছাঁটাই করা হয়। তার মধ্যে তানভীরের নামও ছিল। অনেক চেষ্টা করেও চাকরিটা বাঁচাতে পারেনি। এখানে পাঁচ বছর চাকরি করছিল। অথচ কোম্পানির মালিক এতটুকু দয়া করলো না। তানভীরের দুই বাচ্চা ও সংসার খরচ নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে।
আয়শা আর তানভীরের জমানো টাকা সব প্রায় শেষ। যতটুকু পারে করেছে আয়শা। সারারাত ঘুম হয় না ছেলের চিন্তায়। কীভাবে কী করবে সেই চিন্তা করে আর নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করে। তানভীরের বউ চাকরি করতো। কিন্তু ছোট মেয়েটা হওয়ার পর চাকরি ছাড়তে হয়। দুটো বাচ্চা কে দেখবে?
তানভীর বিভিন্ন জায়গায় চাকরি খুঁজছে। করোনার পর থেকে কর্মী ছাঁটাই হচ্ছে। কিন্তু চাকরি পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে। অনেক বন্ধুদের কাছে গেছে একটা চাকরির জন্য। অনেকে বিপদের দিনে টাকা ধার দিতে চাইলেও চাকরির ব্যবস্থা কেউ করে দিতে পারেনি। আয়শা তবুও ছেলেকে সাহস দেয়। নিরাশ হতে নিষেধ করে। বলে, “নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও বাবা। আল্লাহ নিশ্চয়ই পথ দেখাবেন। আল্লাহ বিপদ দিয়েছেন, উনিই উদ্ধার করবেন।” মায়ের কথায় তানভীর সাহস পেলেও চিন্তা তো দূর হয় না। বাসা ভাড়া, খাবার খরচ, বাচ্চার স্কুল খরচ; কতকিছু আছে।
চাকরি চলে যাওয়ার পর থেকে তানভীরের বউ রিমি বড় ছেলে তন্ময়কে নিজে পড়ায়। হাউজ টিউটর একজন ছিল তাকে বাদ দিয়ে দেয়। মাসে মাসে চার হাজার টাকা তো বাঁচলো। এসব দেখে আয়শা পাশেই বড় ছেলের বাসায় চলে যায়। ছোট ছেলের সাথেই বেশি থাকতো আয়শা। কিন্তু এই সময় ছেলের উপর আর চাপ দিতে চায়নি। আয়শার ঔষধ খরচও এখন সে বড় ছেলে আসিফের কাছে থেকে নেয়। নিজের কথা ভাবে না আয়শা। ছেলেটার ছয় মাস চাকরি নেই। সেই চিন্তা করে শুধু। বড় ছেলেকে কিছু বলতে পারে না। কারণ তাও তো অনেক আছে এমন না। তবুও মাঝে মাঝে আসিফ তানভীরের খবর নেয়। মা’কে কিছু টাকা দিয়ে বলে, তানভীরের বাচ্চাদের জন্য কিছু কিনে নিয়ে যেও। কাছাকাছি থাকার কারণে আয়শা একদিন পরপর তানভীরের বাসায় যায়। বাচ্চাদের না দেখে থাকতে পারে না।
আয়শা দুপুরের আগে তানভীরের বাসায় আসার সময় বক্সে করে তার দুপুরের খাবার নিয়ে আসে। আসলে তানভীরের বাচ্চাদের কথা ভেবে সে খাবার আনে। নিজে তো ভাজি ভর্তা দিয়েও খেতে পারে। কিন্তু যখন দেখে আদরের নাতি নাতনি ডাল, ডিম ভাজি দিয়ে খাচ্ছে। তখন ভালো কোনো খাবার গলা দিয়ে নামে না।
একদিন অবশ্য আসিফের বউ বীথী বলেছিল, “মা, আপনি তো দুপুরে এখানেই খেয়ে যেতে পারেন। খাবার টেনে নেওয়ার কী দরকার?” আয়শা জানে বীথী কেন এ কথা বলেছে। কারণ আয়শা এখানে খেলে খাবার তরকারি এতো লাগতো না। নিয়ে যায় তাই বেশি লাগে। আয়শা বীথীকে বলে, “দুপুরে এতো তাড়াতাড়ি খাই না আমি। এটা তো তুমি জানো। তোমার সমস্যা হলে আর নিব না। “বীথী সাথে সাথে ক্ষমা চায় তার শাশুড়ির কাছে। কারণ সে জানে মা যদি কষ্ট পেয়ে বা রাগ করে খাবার না নেয় আর আসিফ যদি শুনতে পায় তাহলে চিল্লায় বাড়ি মাথায় তুলবে। মায়ের কোনো কষ্ট দুই ভাই একদম সহ্য করতে পারে না।
দুই দিন ধরে আসিফের বড় ছেলে হৃদয়ের জ্বর। তাই তার মনটা ভালো না। রাতে বাচ্চার জ্বর বাড়ে। ঘুম আসছিল না তাই বারান্দায় আসে একটু বসার জন্য। এসে দেখে আয়শাও বসে আছে। মা’কে এভাবে বসে থাকতে দেখে আসিফ জিজ্ঞেস করে,
-কেন এতো রাতে বসে আছো মা?
-ঘুম আসে না বাবা। তুমিও তো জেগে আছো। হৃদয়ের জ্বর কমেনি?
-না মা। ছেলেটার কী যে হলো? দুই দিন হলো এতো জ্বর আসছে। আগামীকাল সকালেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। কিছু ভালো লাগে না মা। আমার হাসিখুশি চঞ্চল ছেলেটা কেমন যেন মন মরা হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকে।
-চিন্তা করো না বাবা। ইনশাআল্লাহ দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবে। ডাক্তার দেখাও। ভাইরাস জ্বর হয়তো। কয়েকদিন তো থাকবেই। দোয়া করছি হৃদয়ের জন্য সবসময়ই। জানি সন্তান কষ্টে বা বিপদে থাকলে মা বাবার শান্তি হারাম হয়ে যায়। ঘুম- খাওয়া সব অস্বস্তি লাগে।
আসিফ মায়ের কথা বুঝতে পারে। মায়ের চিন্তা হচ্ছে তানভীরের জন্য। এজন্যই ঘুম আসে না। মা’কে ইদানীং খুব দুর্বল লাগে। হয়তো ঠিক মতো খায়ও না। মা’কে তাই সান্ত্বনা দিয়ে বলল, মা চিন্তা করো না। তানভীরের কিছু না কিছু একটা তো হবেই। ওর অভিজ্ঞতা আছে, চাকরি ওর হবেই। সময় ভালো না তাই দেরি হচ্ছে। আমিও অনেক জায়গায় বলে রেখেছি। দেখা যাক কী হয়। তুমি যেয়ে ঘুমাও। তোমার সুস্থ থাকা জরুরি। তুমি অসুস্থ হলে আমাদের চিন্তা বেড়ে যাবে মা। শুধু দোয়া করো আমাদের জন্য।
আজ তানভীরের বড় ছেলে তন্ময়ের জন্মদিন। দুই দিন ধরে কেক কাটবে বলে বাবাকে বলে আসছে কিন্তু মন ভালো নেই। তাই এসব কিছু করবে না রিমি। তানভীরকেও কেক আনতে নিষেধ করেছে। কিন্তু ছোট মানুষ কিছুতেই শুনতে রাজি না। আয়শারও খুব খারাপ লাগছে। আয়শা কেক আনতে চেয়েছিল কিন্তু রিমি নিষেধ করে বলেছিল, না মা বাচ্চারা বাবার সমস্যা বুঝে বড় হোক, যখন যেমন তখন তেমন। তন্ময়ের সাথে তার ছোট বোন তন্বীরও মন খারাপ।
আসিফের মনে ছিল আজ তন্ময়ের জন্মদিন। তাই অফিস থেকে ফেরার পথে কেক আর বিরিয়ানি নিয়ে আসলো তানভীরের বাসায়। আসিফের বউ আর বাচ্চা দুটোও আসলো। তন্ময় সারপ্রাইজ পেয়ে সেই খুশি। ছেলে মেয়ের আনন্দ দেখে রিমির চোখে পানি চলে আসে। বারবার আসিফকে ধন্যবাদ দিচ্ছিল আর বলছিল, এতো কিছুর কী দরকার ছিল?
আসিফ বলে, তানভীরের ছেলে কী আমার ছেলে না? আজ তানভীরের জায়গায় আমি হলে তোমরা কী এটা করতে না? আমরা দুই ভাই আলাদা না কেউ কারো থেকে। ওর কষ্ট বা ওর বাচ্চাদের কষ্টে আমারও কম কষ্ট লাগে না। অনেক কিছু করতে চাইলেও পারি না। জানো তো আমারও অনেক আছে এমন না। রিমি অনেক খুশি হয়। আসলে বিয়ের পর থেকে আসিফে নিজের বড় ভাইয়ের মতোই দেখেছে। আর আসিফের বোন নেই বলে রিমিকে বোনের মতোই মনে করে।
রিমি বীথীর হাত ধরে বলে, ভাবি আপনি এতো কষ্ট করে মায়ের কাছে বাচ্চার জন্য খাবার পাঠান। আমারও অনেক কিছু দিতে ইচ্ছা করে। আগে মাঝে মাঝে এক সাথে খাওয়া হলেও ইদানীং পারি না। বীথী খুব অবাক হয়। মা এসে তাহলে রিমিকে বলেছে, আমি বাচ্চাদের জন্য খাবার দেই। মা আমাকে এখানে বড় করেছে। অথচ আমি মা’কে দুপুরে বাসায় খেয়ে যেতে বলেছিলাম। নিজের কাছে খুব লজ্জা লাগলো। কী বলবে বুঝতে পারছিল না।
এমন সময় আয়শা এসে তাদের কথা শুনে বলে, তোমরা এভাবেই সবসময় একে অন্যের পাশে থেকো; সুখ দুঃখ ভাগাভাগি করলে জীবন অনেক সহজ হবে। আজ আমি আছি কাল না থাকলেও দোয়া করি তোমরা এমনি থাকো সারাজীবন। রিমি আর বীথী দু’জনেই শাশুড়ি মা’কে জড়িয়ে ধরে বলে, আপনি কোথায় যাবেন মা? আমাদের ছেড়ে কোথাও যেতে পারবেন না। আয়শার চোখে আনন্দের অশ্রু আজ। তার দুই ছেলের দুই বউ ঠিক তার দুই মেয়ে যেন।
আসিফ তানভীরের বাসায় গিয়ে অনেক কিছুই বুঝতে পারে। তাই সে তানভীরকে ডেকে বলে, আমার কাছে কিছু টাকা আছে চাকরি তো হচ্ছে না কবে হয় ঠিক নাই। এভাবে কীভাবে চলবি? আয় দু’জন মিলে একটা বিজনেস করি। প্রথমে হয়তো তেমন লাভ হবে না কিন্তু তুই চলতে পারবি। আপাততঃ আমাকে কিছু দিতে হবে না। মাস ছয়েক পর বিজনেস ভালো চললে তখন না হয় লাভ ক্ষতি ভাগাভাগি করবো। দু’জন অর্ধেক অর্ধেক পাটনার শিপ থাকবো। আমি চাকরি ছাড়তে পারবো না তাই বিজনেস সম্পূর্ণ তোর দেখাশোনা করতে হবে। তুই কম্পিউটার ইন্জিনিয়ারিং পড়লি। চাইলে প্রথম থেকে নিজে বিজনেস করতে পারতি। এখন এটাই কর। আমি তো আছিই। অফিস শেষে তোকে সাহায্য করবো। আর আমার কিছু পরিচিত লোকজন আছে। তোমার কাস্টমার পেতে কষ্ট হবে না।
তানভীর বড় ভাইয়ের কথায় কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না শুধু হাত ধরে বলল, অনেক বড় উপকার করলে ভাইয়া। আমার দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে আর পারছিলাম না। জমানো সব টাকা শেষ। তুমিও মাঝে মাঝে কিছু দিয়েছো। মা-ও ত্রিশ হাজার টাকা দিয়েছে। তোমার কাছে ঋণী থাকলাম। তুমি দেখো তোমাকে নিরাশ করবো না। আমি সব সামলে নিব। আমি নিজেই একবার ভেবেছি এ কথা কিন্তু টাকা নেই। কী দিয়ে বিজনেস করবো? তাই বাদ দিয়েছি।
আয়শা আসিফের সিদ্ধান্তে অনেক খুশি হয়েছে। দুই ছেলে যে এক সাথে থাকতে চায়। এটাতে তার মন শান্তি পেয়েছে। দুই ভাই একজন অন্যজনের বিপদে এভাবেই যেন পাশে থাকে এই দোয়া করলো।
আট বছরের মধ্যে আজ তানভীর আর আসিফ দুই ভাই তাদের বিজনেস অনেক বড় করে ফেলেছে। আজ তাদের কোম্পানি বেস্ট কোম্পানি হিসাবে পুরষ্কার পাচ্ছে। দুই ভাই এক সাথে না হলে হয়তো এমন দিন আসতো না। একা এতকিছু করতে পারতো না তানভীর। এখন আসিফ চাকরি করে না। দুই ভাই মিলে বিজনেস করছে। লাভ ক্ষতি তাদের দুজনের। এতদিনে তাদের মাঝে কখনো ভুল বোঝাবুঝি হয়নি আর রিমি ও বীথী দু’জনেই শাশুড়ি মা’কে অসম্ভব সম্মান করে ও ভালোবাসে। অনেক কিছু শিখেছে তারা মায়ের কাছে যা সারাজীবন কাজে লাগবে। বিপদ এক নিমেষে কেটে যায় যদি পাশে দাঁড়িয়ে কেউ সাহস দেয়। বিপদে আপনজনেরা যদি পাশে আসে তাহলে বিপদ কেটে যায় খুব তাড়াতাড়ি। পরিবারের একজনের কষ্টে পাশে এসে দাঁড়ালে কোনদিন তার বিপদে অবশ্যই পাশে কাউকে না কাউকে পাবে।
Leave a Comment
Your email address will not be published. Required fields are marked with *