রাস্তার তেমাথায় শহীদবেদী নীরবে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। বেদীটির সম্মুখে শ্বেতপাথরের ওপর খোদাই করা; কালো কালিতে অস্পষ্ট লেখা, “বীর শহীদ জামিল আহমেদ অমর রহে।”
বেদীটির বয়স পনের বছর দু’মাস। তার মাসখানেক আগে কনকপুর মাঠ থেকে বাড়ি ফেরার পথে সন্ধ্যার আঁধারে বিপক্ষদলের বোমার আঘাতে লুটিয়ে পড়েছিলেন জামিল আহমেদ। সঙ্গীসাথীরা ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। সেদিন প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে মুড়িমুড়কির মতো বোমা পড়ে। বোমাগুলি থেমে যাওয়ার আধঘন্টা পরেও জামিল বেঁচে আছে কি না, সাহস করে কেউ ছুঁয়ে দেখেনি।
বিপক্ষদলের দুষ্কৃতিরা তান্ডব চালিয়ে পালিয়ে গেলে ভয়ে গা ঢাকা দিয়ে থাকা প্রতিবেশি কয়েকজন ছুটে এসে দেখে জামিলের দেহ রক্তে ভেসে যাচ্ছে। মাথার নীচে ঘাড়ের কাছে গভীর ক্ষত। সেখান থেকে তখনও তাজা রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে। হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তারবাবু দেখে জামিল আহমেদকে মৃত ঘোষণা করেন। তার লাশ নিয়ে এলাকায় বিশাল জমায়েত ও মিছিল হয়। অসংখ্য মানুষ কান্নায় ভেঙে পড়ে।
জামিল আহমেদ খুন হওয়ার পনের দিন পরে ছিল জাতীয় সংসদীয় প্রতিনিধি নির্বাচন। মৃত্যুর দুই দিনের মধ্যে কনকপুর বাজারের তেমাথার মোড়ে জামিল আহমেদের আবক্ষ মর্মর মূর্তি স্থাপিত হল। যে দলের হয়ে জামিল আহমেদ প্রাণপাত করে দিনরাত সংগঠনে মেতে থাকতেন সেই শ্রমিককল্যাণ দলের সাংসদ প্রার্থী মহিউদ্দিন তালুকদার শান্ত মূর্তি উন্মোচনের সময় ঘোষণা করলেন, -আজ থেকে শহীদ জামিল আহমেদের পরিবারের সব দায়িত্ব শ্রমিককল্যাণ দল নিল।
উপস্থিত জনগণের করতালিতে চারপাশ মুখরিত হয়ে উঠল।
তিনি আবার শুরু করলেন, -আজ থেকে ওনার নাবালিকা কন্যা ও নাবালক পুত্রের সকল দায়িত্ব আজীবন গ্রহণ করলাম। ওদের শিক্ষা ও ভরণপোষণের জন্য প্রতিমাসে দশ হাজার টাকা আমার এ্যকাউন্ট থেকে পাঠিয়ে দেব।
আরো জোরে হাততালিতে চারপাশ মুখরিত হল।
মহিউদ্দিন তালুকদারের বক্তব্য ছবিসহ পরদিন প্রথম শ্রেণির সব জাতীয় পত্রিকায় ফলাও করে প্রচারিত হল। প্রিন্ট মিডিয়া ছাড়াও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় খবরটি দুইদিন ধরে প্রচারের বন্যায় ভেসে গেল।
কর্মীরা উজ্জীবিত হয়ে নির্বাচনের আগে আরো কিছু রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা হাঙ্গামায় জড়িয়ে পড়ল। গুরুতর আহত হল কিছু লোক। আহত পরিবারের সদস্যদের সাথে দেখা করে সমবেদনা জানিয়ে সাহায্যের আশ্বাস দিলেন মহিউদ্দিন তালুকদার শান্ত।
গ্রামাঞ্চলের অল্পশিক্ষিত, নিরক্ষর, প্রান্তিক চাষি, শ্রমিক, অটো, টোটো, ভ্যান-রিকশা চালক, দিনমজুর সকলস্তরের মানুষের এখন যেন মাসিহা তিনিই। অল্পদিনের মধ্যে জনগণ শ্রমিককল্যাণ দলের ভক্ত হয়ে পড়ল।
শ্রমিককল্যাণ দলের সভাপতি নিশান খান জাতীয় টিভি চ্যানেলে এক জ্বালাময়ী ভাষণে বললেন, -আমরা সত্য ও ন্যায়ের জন্য লড়াইয়ে নেমেছি। খেলা হবে। দেশের সম্পদ লুন্ঠন ও পাচারকারীদের বিরুদ্ধে আমরা দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেব। আমাদের এই লড়াইয়ের যারা বিরোধিতা করবে ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে তাদের জবাব দিয়ে প্রত্যাঘাত করা হবে।
নিশান খানের ভাষণ শোনার পর থেকে জনগণ বেশ উত্তেজিত। চায়ের দোকান, বৈঠকখানা, অফিস আদালত সর্বত্র শ্রমিককল্যাণ দলের সমর্থনে তর্কের তুফান উঠতে লাগল। ভোটের আগে জনসাধারণের আলোচনায় একটি নাম, নিশান খান।
ক্ষমতাসীন “কৃষক মজদুর পার্টি”র সীমাহীন দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, অনুন্নয়ণ ও সর্বোপরি লাগামহীন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে জনমত এককাট্টা। ক্রমশ জনরোষে পর্যবসিত। অপরদিকে কৃষক মজদুর পার্টি বা কে এম পি ক্ষমতা ক্ষমতা যেনতেন প্রকারে ধরে রাখতে মরিয়া।
দশই জুন ভোট দানের দিন এগিয়ে এল। সমস্ত রকম প্রচার আগে থেকে বন্ধ। গ্রামেগঞ্জে চাপা উত্তেজনা। নয়ই জুন বাড়ি বাড়ি গিয়ে শাসানো, অত্যাচার, আই কার্ড কেড়ে নেওয়া, শারীরিক নির্যাতন, বোমা গুলির আওয়াজে মহল্লায় ত্রাস সৃষ্টি সবই চলল প্রধান যুযুধান দুই পক্ষের মধ্যে। ভোটের দিন রক্তে ভেসে গেল সারাদেশ। বুথে বুথে চলল দেদার ছাপ্পা, ব্যালট ছিনতাই, বাক্স লুট, বুথ জ্যাম, বৈধ ভোটারকে বাধাদান, বোমা, গুলি। কী নয়!
সারাদেশে কয়েকজনে গুম করা হল। ভোটপর্ব মিটে গেলেও তাদের কোন খোঁজ পাওয়া গেল না। বাহান্ন জনের বেশি সহনাগরিকের মৃত্যু হল। তারা সবাই গরিব প্রান্তিক চাষি, ভূমিহীন ক্ষেতমজুর, হকার, পরিবহন শ্রমিক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী।
গরীব মানুষের মৃত পরিবার সরকারের পক্ষ থেকে কোন ক্ষতিপূরণ পেল না। লাশ কাদের, তাই নিয়ে টানাটানি চলল। প্রধান প্রতিপক্ষ দুই দলই দাবি করল মৃতব্যক্তি তাদের কর্মী, সমর্থক। হাঙ্গামার দায় তাদের নয়, সব দোষ বিপরীত দলের। সরকার পক্ষ হাত তুলে বলল, দ্যাখো হাতে কোন খুনের দাগ নেই, দায় নেই। একেবারে ধোয়া তুলসী পাতা। সব ওই ব্যাটারাই করেছে।
দেশ বিদেশে ভোট প্রক্রিয়া নিয়ে সমালোচনার ঝড়া। দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের প্রতিবাদ মিডিয়াতেই সীমাবদ্ধ থেকে গেল।
গণনায় কারচুপি করেও শ্রমিককল্যাণ দলের বিপুল জয় আটকানো গেল না।
নিশান খানের নেতৃত্বে নব সরকার গঠিত হল। রাষ্ট্রপতি সৈয়দ কওসার আনোয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিশান খানকে শপথ বাক্য পাঠ করালেন। মন্ত্রীসভায় গুরুত্বপূর্ণ গৃহমন্ত্রীর দায়িত্ব পেলেন মহিউদ্দিন আহমেদ শান্ত।
দেশে বিজয়ী দলের তান্ডব চলল কয়েক সপ্তাহ ধরে। কারো ঘরবাড়ি, দোকানপাসারি ভেঙে জ্বালিয়ে দেওয়া হল। লুট করা হল ব্যবসাস্থল। পূর্বতন ক্ষমতাসীন দলের উচ্চ পদমর্যাদার নেতারা বিচার ও গণরোষের ভয়ে বিদেশে পালিয়ে গেলেন। পরাজিত দলের নীচুতলার কর্মীরা হাওয়া বুঝে রাতারাতি দলবদল হয়ে গেল।
সব শ্রমিক ইউনিয়নের সাইনবোর্ড পাল্টালেও সবিশেষ নেতৃত্ব একই থাকল।
মাসখানেক পর ফিরে এল একই রকম তোলাবাজি, সিন্ডিকেট ব্যবসা, প্রমোটারি, চাঁদাবাজি, নিচুতলার মানুষের উপর ক্ষমতার দাপট, অত্যাচার, অবিচার।
সরকার পরিবর্তন আন্দোলনের প্রথম শহীদ জামিল আহমেদের স্ত্রী ছকিনা বেগম ও কন্যা, পুত্র একবার মাত্র দশহাজার টাকা সাহায্য হিসাবে পেয়েছিলেন। সেই শুরু আর শেষ। আর কোন সাহায্য তারা পাচ্ছে না। মহিউদ্দিন তালুকদার শান্ত এখন মস্তবড় ক্যাবিনেট মন্ত্রী। এলাকায় আসেন না, কেউ দেখা করতে গেলে নাগাল পান না। নেতাদের ধরে নাগাল পেলেও কাউকে চিনতে পারেন না অথবা না চেনার ভান করেন। তিনি যে প্রতিমাসে দশহাজার টাকা সাহায্য দানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সেকথা নির্দিধায় অস্বীকার করলেন।
ছকিনা বেগমের সংসারটা ভেসে যাবার উপক্রম।
ভূমিহীন নিঃশ্ব পরিবার। অর্ধাহার, অনাহারে দিনকাটে। প্রতিবেশিরা কতটাই বা দেখবে! সবাই দরিদ্র। দিন আনে দিন খায়।
এভাবেই পাঁচ বছর অন্তর ভোট আসে, ভোট যায়। কিন্তু বোমা, বন্দুক, খুন, জখম, ছাপ্পা চুরির সেই ট্রাডিশন আজ অবধি একটুও বদলায় নি।
একদিন পাড়ার এক পার্টি লিডার জামিলের মেয়ে সুহানাকে শহরে কাজ দেবার নাম করে নিয়ে যায়। তিন বছর হয়ে গেলেও আর ফিরে আসেনি। লোকে বলে বিক্রি করে দিয়েছে। তারা মধ্যপ্রাচ্যের এক দেশে নিয়ে চলে গেছে। ছেলে নকিব আহমেদ চা-কচুরির দোকানে পেটভাতে কাজ করে। আনছার মাষ্টারের ছেলে খোকন তার কাজ দেখে দিয়েছিল। ছকিনা বেগম রোজ একবার করে স্বামীর আবক্ষ মূর্তির সামনে যায়। গিয়ে জানতে চায় শহীদ হয়ে কী লাভ হল তোমার? পনের বছর হয়ে গেল কোন উত্তর আসে না। মূর্তির মাথায় বসে পাখি পায়খানা করে। ময়লা আবর্জনায় ছেয়ে আছে মূর্তিটা। মূর্তি উন্মোচনের পর অদ্যাবধি ফুলমালা ঝাড়পোঁচ পড়েনি। ছকিনা বেগম শতছিন্ন মলিন পোশাক পরে মূর্তির সামনে গান গায়, ধেই ধেই করে নাচে। না খেতে পেয়ে শরীরখানা পাকানো দড়ির মতো হয়ে গেছে তার। খাবার না জুটলে লোকের কাছে হাত পাতে না, ধুলোমাখা দেহে দিনদুপুরে মূতির সম্মুখে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকে।
লোকে বলে, সে পাগলি হয়ে গেছে। ছকিনা বেগম পথেঘাটে নাচতে নাচতে একটা বাক্য শুধু বলে, “আমগো লইয়া খেলা হইতাছে, খেলা!”