728 x 90

বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রাক্কালে ‘জামায়াতি দুর্বৃত্তরাই” হত্যা করেছিলো বুদ্ধিজীবীদের

আমেরিকার গোপন দলিল কায়সার আহমেদ: সুপ্রভাত পত্রিকার সম্পাদক শামীম ইউসুফ একজন অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি, অন্তত আমার কাছে। বহুদিন হলো তার উৎসাহে সুপ্রভাত পত্রিকায় লিখে যাচ্ছি। একমাত্র তার পত্রিকা ছাড়া সিডনীর সব বাংলা পত্রিকা এখন শুধু অন-লাইন পত্রিকা, বর্তমানে সুপ্রভাত অন-লাইনের সাথে সাথে নিয়মিত প্রিন্টেড পত্রিকাও প্রকাশ করে যাচ্ছে। আগে নিয়মিত সময়মত লেখা পাঠালেও, গত ২/৩

আমেরিকার গোপন দলিল

কায়সার আহমেদ: সুপ্রভাত পত্রিকার সম্পাদক শামীম ইউসুফ একজন অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি, অন্তত আমার কাছে। বহুদিন হলো তার উৎসাহে সুপ্রভাত পত্রিকায় লিখে যাচ্ছি। একমাত্র তার পত্রিকা ছাড়া সিডনীর সব বাংলা পত্রিকা এখন শুধু অন-লাইন পত্রিকা, বর্তমানে সুপ্রভাত অন-লাইনের সাথে সাথে নিয়মিত প্রিন্টেড পত্রিকাও প্রকাশ করে যাচ্ছে। আগে নিয়মিত সময়মত লেখা পাঠালেও, গত ২/৩ মাস যাবত নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পাদকের দপ্তরে লেখা পৌছাতে ব্যর্থ হচ্ছি। তারপরও সম্পাদক মহোদয় হতাশ হন না, নিয়মিত মনে করিয়ে তাগাদা দেন। মাঝে মাঝে ভাবি একটু দেরি করে লেখা পাঠালে হয়তো বাদ দিয়ে দিবেন, তিনি বাদ দেন না বরং সম্পূণ পত্রিকা সাজিয়ে বসে থাকেন আমার জন্যে বরাদ্দ করা পাতা ভরবার জন্যে আমার লেখাটি কখন পৌছাবে। আমাকে বাদও দেন না। তিনি বিএনপি ঘরানার লোক। অনেকেই আমাকে বলতেন তার ওখানে লেখা দিবেন না, তিনি তার ইচ্ছে মত কাটাকুটি করে তারপর ছাপবেন। নিন্দুকের মুখে ছাই যে, আমি আমার লেখায় তার কোন কলম পড়তে দেখিনি। আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছি, তাই বঙ্গবন্ধুর প্রতি অমোঘ টান আমার। তাই বলে আমার কলমে ভুল ত্রুটি অন্যায় লিখবো না তা নয়।

২০২০ সালের আগস্ট মাস থেকে অফিসিয়ালি অবসর নিয়েছি। এক ছোট ভাইয়ের প্রস্তাবে গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে সপ্তাহে ৭/৮ ঘন্টা কাজ করা শুরু করেছি। তেমন কোন কাজ নয়, প্রয়োজনের সময় যাওয়া আসা আর পরামর্শ দেয়া। গাড়ি চালিয়ে কাজের উদ্দেশ্যে যাচ্ছি। পাশে বসে আছেন বাঙালি মালিকানা কোম্পানির, বাঙালি মালিক। স্ত্রীর সূত্রে পরিচয়। হঠাৎ করে প্রস্তাব দেয় তার সাথে মাঝে মাঝে কাজ করার। আমার থেকে বয়সে অনেক ছোট, তার সাথে কাজ করতে যেয়ে বুঝতে পারলাম অসাধারণ মেধাবী। তুখোড় তার জ্ঞানের পরিধি। কাজের অনেক সমস্যা সমাধান করে ফেলে চোখ বুজে। যত দেখি ততই অবাক হই। যাক আসল কথায় আসা যাক, গাড়িতে বসেই সে আমাকে প্রশ্ন করে বসেন। আচ্ছা ভাই, আপনিতো একজন মুক্তিযোদ্ধা বলুনতো আসলেই কি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিন লক্ষ নারী নির্যাতিত / আর ত্রিশ লক্ষ শহীদ হয়েছিলো কথাটি সঠিক কিনা?

আমি একটু ধাক্কা খেলাম। ১৯৭০ সালে তার জন্ম হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের পরিবারে তার জন্ম। তিনি কিন্তু রাজনীতি নিয়ে তেমন নাড়াচাড়া করেন না। উত্তরে বললাম ভাই, আজ কেনো আমরা সংখ্যা নিয়ে বিতর্কে যাচ্ছি? এই কথা বলে বললাম সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক তুলে আমরা কাকে দোষারোপ করে লাভবান হবো বা কাকে আমরা রক্ষা করতে চাচ্ছি? একজনকে নির্যাতিত করা আর একজনকে হত্যা করলেও তো একই অপরাধ। কয়েক বছর আগে আমাদের দেশের বিরোধী দলের একজন মহান নেত্রী ধর্ষিত নারী ও শহিদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক উষ্কে দিয়েছেন। যা নিয়ে আজো বিতর্ক ঘুরে বেড়াচ্ছে। তিনি কাকে তোষণ করতে যেয়ে এ কাজটি করেছিলেন! এতে তার দল বা তিনি কি ফায়দা লুটেছেন আমার বোধগম্য নয়, তবে জামায়াতি ইসলাম ও পাকিস্তানের সুবিধে হয়েছে এটা বুঝতে পারি।

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তার দোসর রাজাকার-আল বদরের অত্যাচার স্বচক্ষে দেখেছি। আমিও অত্যাচারিত হয়েছি, তাদের বেয়নটের আঘাতে আমার বোন জামাইকে হত্যা করেছে আর বোনটি মাত্র ২১ বছর বয়সে তিন সন্তান ও আরো একজন আগত সন্তান নিয়ে বিধবা হয়েছেন। তাই এ নিয়ে বিতর্ক করবো না, শুধু বলবো তারা আমার মা-বোনের ইজ্জত হরণ করেছে, তারা আমার বাবা-ভাইদের নির্বিচারে হত্যা করেছে। কতজন করেছে তার হিসেব আমার দরকার নেই। বেশ কিছুদিন যাবৎ একটা বিষয় বেশ চাউর হয়ে বেড়াচ্ছে যে স্বাধীনতার প্রাক্কালে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের দায় মুক্তিযোদ্ধা তথা মুক্তিযুদ্ধ নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের উপর চাপানোর চেষ্টা হচ্ছে। বিশিষ্ট সাংবাদিক লেখক মিজানুর রহমান খানের অনুসন্ধানী ও গবেষণাধর্মী বইয়ের সূত্র ধরে আমার আজকের লেখা।

যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র নিয়ে ভন্ডামি, হিপোক্রেটিক রাজনীতি সম্পর্কে আমরা সবাই জানি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন সার্বক্ষণিকভাবে গণতন্ত্র গণতন্ত্র বলে চিৎকার করলেও ১৯৭১ এ তারা বাংলাদেশের জনতার পাশে না দাড়িয়ে, গণতন্ত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পাকিন্তানের তৎকালিন সেনাবাহিনীকে গণহত্যায় পূর্ণ সমর্থন দিয়েছেন। আজকে পাকিস্তানের রাজনীতিতে দৃষ্টি দিলে কি দেখতে পাই? বর্তমান পাকিস্তানের জননন্দিত জনপ্রিয় নেতা ইমরান খান। তিনি ও তার দল বিপুল ভোটে নির্বাচিত সরকার। এক মুহূর্তের ষড়যন্ত্রে তার সরকারের পতন এবং তাকে পাঠানো হয়েছে কারান্তরে। যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চুপ, কারণ পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশিত পথে চলেননি। তাদের কথা শুনেননি বা পাশে থাকেননি। তার মানে যারা আমেরিকার পাশে থাকবে তারা সব খুন থেকে মাফ।

 

তবে যুক্তরাষ্ট্রের আইনের একটা দিক খুব ভালো যে, একটা বিশেষ সময় অতিবাহিত হবার পর সরকারের বিগত দিনের গোপন কর্মকন্ডের নথি তাদের বিরুদ্ধে হলেও অবমুক্ত করতে আইনে বাধা নেই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় লগ্নে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা সম্পর্কে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের অবমুক্ত করা গোপন দলিল বিশ্লেষণ করলে তিনটি নতুন বিষয় উদঘাটিত হতে দেখা যায়: প্রথমত: ভারতীয়দের নিকট পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পনের শর্ত ‘ন্যায্য’তা নিশ্চিত করতে প্রায় ৩০০ বুদ্ধিজীবীকে জিম্মি করার পরিকল্পনা করা হয়েছিলো। দ্বিতীয়ত: কিছুসংখ্যক বুদ্ধিজীবীকে বিহারি ক্যাম্পে অন্তরীণ করে রাখা হয়েছিলো এবং তাঁদেরকে ডিসেম্বরের শেষের দিকে হত্যা করা হয়েছিলো। তৃতীয়ত: পাকিস্তানীরা ওয়াশিংটনের কাছে অভিযোগ করেছিলো যে মুক্তিযোদ্ধারাই প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিলো।

এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখার নির্দেশ পাওয়ার পর ঢাকার তৎকালিন মার্কিন কনসাল মি: হার্বাট ডি স্পিভাক এক তার বার্তায় নির্দিষ্টভাবে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরকে নোট দেন যে ‘জামায়াতি দুবৃত্তরাই’ বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। এ-সংক্রান্ত নোটের বাক্যে মি: হার্বাট স্পিভাক ‘জামাতি থাগস’ বা জামায়াতি দুর্বৃত্ত শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। আর একই সংগে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগ প্রত্যাখান করে মি: হার্বাট স্পিভাক বলেন, বুদ্ধিজীবীদের গ্রেপ্তার ও হত্যার সময় ঢাকা সম্পূর্ণভাবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিলো।

মি: হার্বাট ডি স্পিভাক বাংলাদেশে মার্কিন দুতাবাসের প্রথম ভারপ্রাপ্ত চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের বেশিরভাগ সময় তিনি মার্কিন কনসাল জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মি: হার্বাট ডি স্পিভাকই সেই ব্যক্তি যার নিকট পাকিস্তানের ইস্টার্ন কমান্ডের তৎকালিন প্রধান লে. জেনারেল নিয়াজী ও সামরিক উপদেষ্টা লে. জেনারেল রাও ফরমান আলী সাক্ষাৎ করে প্রথমবারের মত আত্মসমর্পণের আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন।

হার্বাট ডি স্পিভাক মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে আনা পাকিস্তানের অভিযোগ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনকে যে তারবার্তা পাঠিয়েছিলেন তাতে তিনি যে কারণগুলো বর্ণনা করেছিলেন তাতেই তিনি স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার দায় মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর চাপানোটা সন্দেহজনক। প্রথমত: ১৪-১৫ই ডিসেম্বর ১৯৭১ বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ড ঘটে। এ সময়টায় পুরো ঢাকা শহরে কারফিউ বলবৎ ছিলো এবং শহর ছিলো সম্পূর্ণভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। দ্বিতীয়ত: এই সময়ে শহরে যে মুক্তিবাহিনী ছিলো, তেমন কোন প্রমাণ নেই। তৃতীয়ত: যারা নিহত হয়েছেন তাঁহারা কেহই পাকিস্তানপন্থি রাজাকার ছিলেন না। তাঁদের বেশীরভাগই ছিলেন সুপরিচিত বাঙালি জাতীয়তাবাদী। যদিও তাঁরা মুক্তিযুদ্ধকালে ঢাকা শহরেই ছিলেন, কিন্তু তাঁরা তাঁদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বহি:প্রকাশ ঘটাননি। হার্বাট স্পিভাক তার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে পাঠানো তাঁর বার্তার সপক্ষে প্রমাণ হিসেবে মুনীর চৌধুরী, ফজলে রাব্বি, শহীদুল্লা কায়সার, সিরাজুদ্দীন হোসেন, এ এস মান্নান (যিনি ইংরেজী পত্রিকা অবজারভার এর তৎকালিন সম্পাদক ছিলেন), নিজামুদ্দীন আহমেদ, অধ্যাপক এ খায়ের ও ড. আলীম চৌধুরীর নাম উল্লেখ করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে পাঠানো এক তারবার্তায় ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস সময়ে বুদ্ধিজীবীদের ভাগ্যে কি ঘটেছে, তা জানতে ওয়াশিংটন এর জবাব বার্তায় হার্বাট স্পিভাক একটি প্রতিবেদন পাঠান। তার শিরোনাম ছিলো ‘নৃশংসতা ও রাজাকার’। তিনি লিখেছেন, ‘যুদ্ধ শেষ হওয়ার দিকে ২০০ থেকে ৩০০ বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়। ঢাকার বাহিরে অন্যান্য শহর থেকেও এ রকম খবর পাওয়া যাচ্ছে, তবে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। এ তালিকার সবাই বাঙালি। কিন্তু সাধারণভাবে তাঁরা রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় ছিলেন। তাঁদের মৃত্যুর প্রেক্ষপট সম্পর্কে আমরা অপারগ। তবে তাঁদের অধিকাংশকে ১১ থেকে ১৫ই ডিসেম্বরের মধ্যবর্তী সময়ে তাঁদের বাড়ী থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়।’

কারা গ্রেফতার করেছিলো, সে সম্পর্কে হার্বাট স্পিভাক তার পাঠানো তারবার্তায় বলেন, ‘সশস্ত্র ব্যক্তিরা। এদের সংগে উর্দিধারী, সশস্ত্র সৈনিকেরা ছিলেন।’ বিবরণ অনুযায়ী, সংবাদপত্র, মার্কিন কনসাল জেনারেল অফিসের কর্মী ও মার্কিন সংবাদদাতারা ঢাকায় প্রায় ২০টি মরদেহ দেখেছেন এবং তাঁরা নিশ্চিত করেছেন যে হত্যা করার আগে তাঁদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছিলো।

মার্কিন কনসাল হার্বাট স্পিভাক তাঁর ঐ তারাবার্তায় উল্লেখ করেছিলেন যে মার্কিন তথ্যকেন্দ্র ইউসিসের কর্মকর্তারা রিপোর্ট করেছেন যে বেশ কিছু নিখোঁজ বুদ্ধিজীবীদেকে মোহাম্মদপুর বিহারীশিবিরে আটকে রাখা হয়েছিলো এবং পরে তাদের হত্যা করা হয়। ‘নৃশংসতা ও রাজাকার’ শীর্ষক ঐ প্রতিবেদন তাঁরবার্তায় তিনি ১৯ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম উল্লেখ করেন। তার হলেন মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, আবুল খায়ের, সন্তোষ ভট্টাচার্য, গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, রাশিদুল হাসান, সিরাজুল হক খান, মোহাম্মদ মর্তুজা, সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লা কায়সার, নিজামুদ্দিন আহমেদ, নাজমুল হক, এ এস মান্নান, গোলাম মোস্তফা, ফজলে রাব্বি, আলীম চৌধুরী, আবুল কালাম আজাদ ও আমিনুদ্দিন।

ঐ একই বার্তায় মার্কিন কনসাল আরো তথ্য দেন যে, ‘আমরা মৌলভী ফরিদ আহমেদ ও অন্যান্য দক্ষিণপন্থী রাজনীতিককে গ্রেফতারের খবর পেয়েছি। মুক্তিবাহিনীর সাথে সম্পর্কিত কনসাল জেনারেলের অফিসের স্থানীয় কর্মীদের দ্বারা এ বিষয়ে নিশ্চিতও হয়েছি। তবে

আমরা জানতে পেরেছি যে রাজাকারির দায়ে ইতিমধ্যেই অনেককে অন্তরীণ করা হয়েছে। তাঁদের শিগগিরই বিচারের মুখোমুখি করা হবে।’ এই তারাবার্তার উপসংহারে হার্বাট স্পিভাক বলেন, ‘ঢাকার প্রেস অব্যাহতভাবে নতুন নৃশংসতার খবর ছাপছে। ১৯৭১ সালের ৩১শে জানুয়ারী কুমিল্লা সেনানিবাসে গণকবর পাওয়া গেছে। তবে এটা খুবই বিরক্তিকর যে কিছু সংবাদপত্র হত্যাকান্ডের নায়কদের প্রতি মার্কিন সমর্থনের অভিযোগ করেই চলেছে।’

হার্বাট স্পিভাক এর উক্ত তারবার্তা থেকেই জানা যায় যে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ব্যাপকভিত্তিক গ্রেফতারের সংগে যে আত্মসমর্পণের শর্তসম্পর্কিত দর-কষাকষির কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে, তা সম্ভবত হার্বাট স্পিভাকের তারাবার্তা থেকেই জানা যায়। তৎকালিন পাকিস্তানের ইস্টার্ন কমান্ড প্রধান লে: জেনারেল নিয়াজি ও সামরিক উপদেষ্ট লে: জেনারেল রাও ফরমান আলী তাঁদের যৌথ স্বাক্ষরে আত্মসমর্পণের বার্তা সর্বপ্রথম একাত্তরের ১৪ই ডিসেম্বরেই হার্বাট স্পিভাকের কাছে দিয়েছিলেন।

হার্বাট স্পিভাক ১৯৭১ সালের ১৮ই ডিসেম্বর তার অপর এক তারবার্তায় (ক্রমিক ঢাকা ৫৬৯৬) লিখেছেন, আত্মসমর্পণের দুই দিন আগে ঢাকার পশ্চিমে একটি মাঠের মধ্যে ৩০টির মতো গলিত মরদেহ পাওয়া গেছে। সেখানে ইট পোড়ানো হয়। মনে করা হয় যে এসব মরদেহের মধ্যে বুদ্ধিজীবীদের অনেকে থেকে থাকবেন। আত্মসমর্পণের শর্ত যাতে ন্যায্য হয়, সেটা নিশ্চিত করতে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর স্থানীয় সমর্থক ও রাজাকাররা প্রায় ৩০০ বুদ্ধিজীবীকে ‘জিম্মি’ করেছিলো। আত্মসমর্পণের দুই দিন আগে অনেককে হত্যা করা হয়। কথিতমতে, রাজাকাররা এখনো ইটখোলা দখলে রেখেছে।

 

১৮ই ডিসেম্বর হার্বাট স্পিভাক তারবার্তায় (ক্রমিক ঢাকা ৫৬৯৩) লেখেন, ঢাকায় সহিংসতার প্রকোপ কমে এসেছে, কিন্তু ‘বিহারী’ এবং ‘কোলাবরেটরদের’ বিরুদ্ধে কিছু প্রতিশোধপরাণয়তা চলছে। একই সঙ্গে রাজাকারদের বাঙালি হত্যাও অব্যাহত আছে। কিছুদিনের বিরতিতে আজা ঢাকায় পত্রিকা বেরিয়েছে।

পল্টন ময়দানে কিছুক্ষন আগে পাঁচ-ছয় হাজার লোকের সমাবেশ শেষ হয়েছে। নুরুল আলম সিদ্দিকীসহ ঢাকা, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলের মুক্তিযোদ্ধা অধিনায়কেরা বক্তব্য দিয়েছেন। তারা বলেছেন মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকাররা অস্ত্র জমা দিবেন। দেশ কে যে চালাচ্ছেন, তা বোঝা যাচ্ছে না। কোন জ্যেষ্ঠ নেতাকেই দেখা যায় না।

হার্বাট স্পিভাক ১৯ ডিসেম্বর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে ‘বাংলাদেশের মুজিবকে প্রয়োজন’ শিরোনামে একটি বার্তা (ক্রমিক ঢাকা ৫৭০২) পাঠিয়েছিলেন। এই বার্তায় তিনি উল্লেখ করেন যে পরিস্থিতি এখনো বিষ্ফোরণোম্মুখ। চরম ডানপন্থী গোষ্ঠীর দ্বারা বুদ্ধিজীবীদের হত্যার খবর প্রকাশিত হওয়ার পর নতুন এক তিক্ততার ¯্রােত বয়ে যায়। এ ঘটনা পুনরায় গোষ্ঠীগত গণহত্যার হুমকি বৃদ্ধি করেছে।’

১৭ই ডিসেম্বর কলকাতার মার্কিন কনসাল গর্ডন লিখেছিলেন, ১৪ই ডিসেম্বর ঢাকা কলেরা রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ড. জন রোড কলকাতায় মার্কিন-সমর্থিত সাহায্য সংস্থার ভোলাগ প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি বৈঠক ডেকেছিলেন। সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র এবং ত্রাণ মন্ত্রনালয়ের পরিকল্পনা শাখার প্রধান উপস্থিত ছিলেন। কেয়ার অনুপস্থিত ছিলো। এর অংশত কারণ, পূর্ব পাকিস্তানে ধারণা আছে যে তারা সামরিক সরকারকে সহায়তা দিয়েছিলো।

জন রোড বিশ্বাস করেন যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি খুব তিক্ততা থাকলেও এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে এবং তার মূল্যবোধ ও নীতির ওপর একটা মৌলিক বিশ্বাস আছে। এই মূহুর্তে যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে একটি ভালো কথা বলা বা মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের মতো ঝুঁকি বাংলাদেশ সরকারের উচ্চ পর্যায়ে কেউ নেবেন না। ‘এ অবস্থা থেকে কেবল মুজিবই পরিত্রাণ দিতে পারেন।’ কলহ-বিবাদ এমন পর্যায়ে আছে যে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অনেকেই দেশে ফিরে পদত্যাগ করতে চাইছেন।

মি. রোড তখন যুক্তি দেন যে মুজিবই শুধু স্থিতিশীলতা আনতে পারেন; অন্তত একটি বছরের জন্যে হলেও। তাঁকে যদি মুক্তি দিয়ে দেশে ফিরতে দেওয়া হয়, তাহলে উপদলীয় লড়াই অন্তত সাময়িকভাবে হলেও বন্ধ হবে। বাংলাদেশ নিয়ন্ত্রিত এলাকায় বাংলাদেশ সরকার ভিসা দিতে প্রস্তুতি নিয়েছিলো। এখন সব ভিসা অবশ্যই দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দ্বারা ছাড় হওয়া উচিত হবে। তাঁর সন্দেহ, বিদেশি সংবাদদাতাদের বাংলাদেশ সরকার যে দেশে ঢুকতে দিতে অনীহা দেখাচ্ছে, তার মূলে আছে ভীতি। বিহারীবিরোধী তৎপরতার খবর যদি তাঁরা লিখতে শুরু করেন, তাহলে বিশ্বজনমত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চলে যাবে। বাংলাদেশের প্রতি গভীর অনুরাগী জন রোড ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করেন, ‘বিহারীরা নিপীড়নের শিকার’। হার্বাট স্পিভাক ১৯৭২ এর ৮ই জানুয়ারী লিখেছেন, ‘গেরিলা নেতা আব্দুল কাদের সিদ্দিকীকে গ্রেফতার করা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও সেনাবাহিনীর মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গেছে। আত্মসমর্পণের পরদিন ঢাকা স্টেডিয়ামে তিনি দুজন কথিত রাজাকারকে হত্যা করেন। ভারতীয় সেনারা তাঁকে দুবার গ্রেফতার করে। দুবারই তাজউদ্দীন আহমদের হস্তক্ষেপে তিনি ছাড়া পান।’

কলকাতার মার্কিন কনসাল গর্ডন একাত্তরের ১৪ই ডিসেম্বর বার্তা পাঠান যে, ‘১২ই ডিসেম্বরের স্টেটসম্যান খবর দিয়েছে যে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম “গণবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক তৎপরতার” দায়ে চারটি রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষনা করেন। এগুলো হলো: পাকিস্তান ডেমোক্র্যাট পার্টি (পিডিপি), মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও নেজামে ইসলাম। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার পর পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচনে এসব দল অংশ নিয়েছিলো। সন্দেহ করা হচ্ছে, বিশেষ করে হিন্দুদের প্রতি রাজাকারি কারণেই তাদের নিষিদ্ধ করা হয়। ঢাকার পলিটিক্যাল অফিসারের সঙ্গে কথা বলে এই বার্তা পাঠানো হলো।’

হার্বাট স্পিভাক একাত্তরের ২৯শে ডিসেম্বরের এক বার্তায় (ক্রমিক ঢাকা ৫৮৩৭) লিখেছেন, ‘বঙ্গভবনে ঘন্টাব্যাপী এক সংবাদ সম্মেলনে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, রাজাকারদের বিচার করা হবে এবং কঠোরভাবে আইনি প্রক্রিয়া অনুসরন করা হবে।’

 

সুত্র: মার্কিন দলিলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। ২৫শে আগস্ট ২০২৩

Read More

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked with *

সর্বশেষ পোস্ট

Advertising