728 x 90

নতুন মানবিক অষ্ট্রেলিয়া

সামসুল ইসলাম টুকু , সিডনী থেকে : আমার ছেলে অষ্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসে রাজ্য সরকারের অধীনে  পরিকল্পনা ও পরিবেশ অধিদপ্তরে প্রকৌশলী হিসেবে চাকুরী করার সুবাদে ৭৫ দিনের জন্য সিডনী সফরে এসেছি । এখানে এসে যে বিষয়গুলি মোটাদাগে আমার চোখে পড়েছে সেগুলোই তুলে ধরার চেষ্টা করবো । এখানে বর্নবৈষম্য লক্ষনীয় নয় । থাকলেও তার উলঙ্গ প্রকাশ

সামসুল ইসলাম টুকু , সিডনী থেকে : আমার ছেলে অষ্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসে রাজ্য সরকারের অধীনে  পরিকল্পনা ও পরিবেশ অধিদপ্তরে প্রকৌশলী হিসেবে চাকুরী করার সুবাদে ৭৫ দিনের জন্য সিডনী সফরে এসেছি । এখানে এসে যে বিষয়গুলি মোটাদাগে আমার চোখে পড়েছে সেগুলোই তুলে ধরার চেষ্টা করবো ।

এখানে বর্নবৈষম্য লক্ষনীয় নয় । থাকলেও তার উলঙ্গ প্রকাশ নেই । কালো সাদা ,বেটে লম্বা সহ বিভিন্ন রঙ ও সাইজের পার্থক্য থাকলেও সবাই চলছে নিজ নিজ গতিতে । চলার পথে হাই হ্যালো একটু মুচকি হাঁসি দেখা যায় । লেখা পড়ার ক্ষেত্রে সকল শ্রেণী ও গোত্রের সমান সুযোগ থাকলেও চাকুরী ক্ষেত্রে উচ্চ পদে ইংরেজদের অগ্রাধিকার রয়েছে । তবে যোগ্যতারও বিচার আছে । এখানে খৃষ্টান , মুসলমান, হিন্দু্‌,বৌদ্ধরা নিজ নিজ ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করে । যেমন হাফ প্যান্ট পরা মানুষ দেখা যায় তেমনি হিজাব পরা দাড়ি টুপি পরা মানুষ কম দেখা যায়না । বিভিন্ন জাতির কৃষ্টি সংস্কৃতি পালনে কোন বাধা নেই । খৃষ্টান প্রধা্ন দেশ হিসেবে  যেমন গীর্জার ছড়াছড়ি আছে তেমনি মসজিদ মন্দির প্যাগাডোর সংখ্যাও কম নয় । তবে ধর্ম নিএ বাড়াবাড়ি কোন সুযোগ নেই । এখানে দেখলাম মুসলিম সমাজের লোকজন কোন বাড়ি ভাড়া নিয়ে নিয়মিত নামাজ পড়ে ।মিন্টোর কাছে প্রায় ১৫ বিঘা জমি কিনে মুসলিম ওয়েলফেয়ার সেন্টার নির্মান করেছে । লুমিয়াহ এলাকায় একটি পরিত্যাক্ত চার্চ ক্রয় করে মুসলমানেরা নামাজ পড়ে । শুধু তাইনয় এখানে তাবলিগ জামাত সংগঠন তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে ।

এখানে ৫২% খৃষ্টান ,৩০%এর কোন ধর্ম নেই অথবা বলেনা ,২.৪% মুসলমান , ১.৯% হিন্দু  রয়েছে ।হিদুদের নিয়মিত পুজা পার্বন অনুষ্ঠিত হয়  প্রসাদ বিতরন হয় । এখানে ২৫.৫%অষ্ট্রেলিয়ান ২৫%ইংরেজ , ৭.৬% আইরিশ , ৬.৪% স্কটিশ , ৪.৫% চাইনিজ এবং অন্যান্ত দেশের প্রায় ৩০% অধিবাসী রয়েছে ।

বৃটিশরা একসময় অষ্ট্রেলিয়ার মাটিতে স্থানীয় আদিবাসীদের হত্যা করে  রক্ত রঞ্জিত করে ক্ষমতায় এসেছিল ও তাদের শাসন কায়েম করেছিল । ১৭৭০ সালে ইংরেজ নাবিক জেমস কুক অষ্ট্রেলিয়া পুর্ব উপকুলকে তাদের উপনিবেশ করার জন্য চিহ্নিত করে যায় এবং ১৭৮৮ সালে সেই লক্ষে ক্যাপটেন আর্থার ফিলিপের নেতৃত্বে ১১ টি নৌযান ভর্তি করে কয়েক হাজার সাজাপ্রাপ্ত দাগী বন্দীদের পাঠানো হয় বর্তমান নিউ সাউথ ওয়েলসের সিডনী এলাকায় । এই বন্দীদের ব্যাবহার করা হয়েছিল অষ্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের নির্মমভাবে হত্যা ও বিতাড়নের কাজে । অষ্ট্রেলিয়ার এই আদিবাসীদের ইতিহাস ৬০ হাজার বছরের পুরনো । কিন্তু তাদের মাঝে শিক্ষার আলো পৌছায়নি । বৃটিশদের সশস্ত্র আক্রমনের বিরুদ্ধে তেমন কোন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি । বরং ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে গভীর জংগলে পালিয়ে যায় । অন্যদিকে বৃটিশরা সুদুর অষ্ট্রেলিয়ায় তাদের উপনিবেশ পাকা পোক্ত করে । উঁচু নিচু পাহাড়  পরিবেষ্টিত মনোরম পরিবেশ ও স্বাস্থ্যকর স্থানের কারনে সিডিনীতেই তাদের বসতি গড়ে তুলে । ১৮৪২ সালে সিডনীকে বৃটিশ কলোনীর রাজধানী ঘোষনা করে । ১৯০০ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ ১১২ বছর পর এটি উপনিবেশিক ব্যাবস্থা মুক্ত হয় । তাই বলে বৃটিশদের এ দেশ ছেড়ে যেতে হয়নি পাকভারত উপমাহাদেশ সহ অন্যান্য উপনিবেশিক দেশের বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের মুখে ।কারন এখানে তাদের প্রতিরোধ করার মত কেউ ছিলনা ।

দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর ইংল্যান্ডে যখন ব্যাপকহারে বেকারত্ব বৃদ্ধি পায় তখন দলে দলে ইংরেজ ,আইরিশ ,স্কটিশ ,চীন, ভিয়েতনাম সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুর মানুষ অষ্ট্রেলিয়ায় প্রবেশ করে । এতে অবশ্য অষ্ট্রেলিয়া সরকারের সমর্থন ছিল ।তার দেশের জ্নসংখ্যাবৃদ্ধির হার সর্ব নিম্ন হওয়ায় নির্দিষ্ট পর্যায়ে উন্নীত করা এবং দক্ষতার ঘাটতি পুরন ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য অষ্ট্রেলিয়া প্রতি বছর ১ লাখ ৩০ হাজার বাড়তি অভিবাসী নেয় । এখন এ সংখ্যা কমে গেলেও এবং কিছু বিধি নিষেধ থাকলেও অভিবাসী নেয়া অব্যাহত আছে ।এভাবেই অষ্ট্রেলিয়া ক্রমশ কল্যান রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় । দেশটিকে আরও গনতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে উন্নীত করার চেষ্টা অব্যাহত আছে । সম্প্রতি ধর্মীয় বৈষম্যের বিরুদ্ধে এবং কোন ধর্মকে অবমাননার বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক এন্টি ডিস্ক্রিমিনেশন বিল পাশ হয়েছে অষ্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যে । গত আগষ্ট/২৩ মাসের প্রথমসপ্তাহে এই রাজ্য সংসদে বিলটি গৃহিত হয়েছে । কিছুদিন আগে সুইডেনে কোরয়ান শরীফে আগুন দেওয়ার ঘটনাকে তথাকথিত বাকস্বাধীনতা  বলে কিছু ধর্ম বিদ্বেষী সমাজবিদ বাখ্যা করেছেন । যে কোন ধর্মপ্রান মানুষের কাছেই তার ধর্মের অবমাননা ভীষন সংবেদনশীল ও স্পর্শকাতর বিষয় । এমন অবস্থাকে বিশ্লেষন করেই নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্য সরকার সকল ধর্মের জন্য সম্মাননা নিশ্চিত করতেই এই বিল পাশ করেছে । এই আইন প্রনয়নের একটি ঐতিহাসিক ঘটনা বলে বিবেচিত হয়েছে ।(তথ্যসূত্র –সুপ্রভাত সিডনী)

গৃহিত এই আইন বিষয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে অষ্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বেশী বাংলাদেশী অধ্যুসিত সিডনীর ল্ল্যাকেম্বার প্রাক্তন এমপি ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা জিহাদ দীব বলেন একজন বিশ্বাসী ব্যক্তি হিসেবে এই নতুন আইনটির গুরুত্ব অপরিসীম । যদি আইনটি আরও আগে গৃহিত হতো তাহলে বিভিন্ন ধর্মের অনেক মানুষকেই বৈষম্যের মত মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার শিকার হতে হতোনা । ধর্মীয় বিশ্বাসের কারনে আক্রমনের শিক্র হওয়ার কিছু ঘটনা আমি নিজ চোখেই দেখেছি । আমার মায়ের হিজাব টেনে ধরা হয়েছিল একটি শপিং সেন্টারে । তবে আমি বিশ্বাস করি আমাদের এই পরিবর্তনশীল চমৎকার দেশটিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসছে ।

মানবিকতার বিকাশে অষ্ট্রেলিয়া সরকার আরও একটি চমক দেখাতে যাচ্ছে । তা হলো অষ্ট্রেলিয়ার সংসদে আদিবাসী ও টরেস স্ট্রেইট দ্বীপবাসী মানুষদের অধিকার নিশ্চিত করতে ভয়েস বা কন্ঠ প্রতিষ্ঠার জন্য শিঘ্রই একটি রেফারেন্ডাম বা গনভোটের আয়োজন করা হচ্ছে । এই হ্যাঁ ভোট দেওয়ার জন্য আহবান জানিয়েছেন এমপ্লয়মেন্ট এন্ড ওয়ার্কপ্লেস রিলেশন মন্ত্রী টনি বার্ক এম পি । দীর্ঘকাল যাবৎ এ দেশের আদিবাসী মানুষেরা অন্যদের তুলনায় শোচনীয় এবং অবহেলিত অবস্থায় রয়েছে ।স্বাস্থ্য ,শিক্ষা , কর্মসংস্থান ,বিচার প্রভৃতি ক্ষেত্রে এ বাস্তবতা লক্ষ্যনীয় । আর সেই পরিস্থিতিকে সংশোধন করতে এই ভয়েস বা কন্ঠভোটের আয়োজন হচ্ছে । মন্ত্রী টনি বার্ক আশা করছেন এই ভয়েস আমাদের জন্য আছে কেবলই প্রাপ্তি । হারানোর কিছু নেই । ঐক্যবদ্ধ হলে আমরাই পারবো নতুন ইতিহাস তৈরী করতে এবং সবার জন্য একটি ন্যায় নির্ভর ভবিষ্যৎ রেখে যেতে।

প্রায় ২৩৫ বছর পুর্বে বৃটিশদের পুর্বপুরুষরা অষ্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের হত্যা করে যে নিষ্ঠুরতার ইতিহাস রচনা করেছিল তা কেউ কখনো মুছে ফেলতে পারবেনা । কিন্তু বর্তমান অষ্ট্রেলিয়া সরকার রেফারেন্ডামের মাধ্যমে দীর্ঘকাল পরে হলেও আদিবাসীদের মৌলিক অধিকার ও সামাজিক মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে যে ইয়েস ভোটের ব্যবস্থা করেছে তা সেই অতীতের নিষ্ঠুরতার সামান্য হলেও মোচন হয়ে পারে । এই ইয়েস ভোট সফল হবে বলেও আশা করা হচ্ছে । এতে আদিবাসীদের অধিকার  সংরক্ষিত হতে পারে , গতি পেতে পারে এবং মানূষ হিসেবে মর্যাদা ফিরে পেতে পারে বলে ধারনা করা হচ্ছে ।উল্লেখ করা যেতে পারে,এ দেশে কোন অনুষ্ঠান করার পুর্বে গান গেয়ে স্বীকৃতি দেয় যে আদিবাসীরাই এ দেশের প্রথম মানুষ ।

 

 

Read More

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked with *

সর্বশেষ পোস্ট

Advertising