মুহাম্মদ মিযানুর রহমান : সাইফুল আযম!একজন বীর বাহাদুর শাদূল মুসলিম বাঙ্গালী পাইলট। শত্রু শিবিরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া যার অন্যতম কাজ। শেরদিল মর্দে মুজাহিদ’ উন্মত্ত জিঘাংসার মতো ঝাপিয়ে পড়ে কুফুর – মুশরিকদের উপরে ।
মুসলমানদের প্রথম কেবলা অবৈধ দখলদারিত্বে ইসরাইল বাহিনীকে খাইয়েছে নাকানি-চুবানি ।ফলশ্রুতিতে দুনিয়া বুকে পেয়েছেন অসংখ্য সম্মান ও মর্যাদার পদক। যদিও স্বজাতিরা তাকে চিনতে ও জানতে গতানুগতিকভাবে যথেষ্ট ভুল করেছে ।যার দরুন হাজারো মেধাবী বাঙালি তরুণ হারিয়ে শাণিত পাতের খোসরাত দিতে হচ্ছে সোনার বাংলাদেশকে।
বলছিলাম একজন সাইফুল আজমের গল্প। পৃথিবীর ইতিহাসের একমাত্র যোদ্ধা যিনি আকাশপথে লড়াই করেছেন তিনটি ভিন্ন দেশের বিমানবাহিনীর হয়ে। আর একক ব্যক্তি হিসেবে আকাশপথের যুদ্ধের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক ইসরাইলি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার অনন্য রেকর্ড গড়েছেন। বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে একের পর এক ইতিহাস রচনা করে গেছেন এই বীর বাঙালি। পৃথিবীর ২২ জন ‘লিভিং ঈগলের’ অন্যতম ছিলেন এই বাঙালি বৈমানিক।
১৯৭১ সালের আগে পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন সাইফুল আজম। স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে যোগ দেন। পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় ১৯৬৭ সালের জুন মাসে তৃতীয় আরব-ইসরাইল যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে অংশ নিতে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ইরাকি বিমানবাহিনীতে বদলি হন সাইফুল আজম। পশ্চিম ইরাকে অবস্থান নিয়ে ইসরাইলিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিলেন তিনি।
আরবদের নাজুক পরিস্থিতিতে একজন বীরের উদয় হয় আরবদের তাঁবুতে। ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ওই সময়ের বাঁক বদলে দেওয়া সেই বীর সাইফুল আজম। যিনি পূর্ব পাকিস্তান থেকে ডেপুটেশনে গিয়েছিলেন জর্ডানে। সেই দিনের পূর্ব পাকিস্তান আজকের বাংলাদেশ।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার মাত্র ৫ দিনের মাথায় গাজা এবং সিনাইয়ের কর্তৃত্ব নিয়েছিল ইসরাইল। জুনের ৫ তারিখে সিরীয় বিমানবাহিনীর দুই-তৃতীয়াংশ শক্তি ধ্বংস করে দেয় ইসরাইলি বিমান সেনারা। তেমন কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই ইসরাইল পশ্চিম তীর এবং জেরুজালেম তারা দখল করেছিল। দখল করেছিল সিরিয়ার গোলান মালভূমিও। তাদের সামনে বিন্দুমাত্র প্রতিরোধ তৈরি করতে পারেনি মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশ।এ সময় ইসরাইলিদের যমদূত হয়ে জর্ডানে যান সাইফুল আজম।
৬ জুন আকাশ থেকে প্রচণ্ড আক্রমণে মিসরীয় বিমানবাহিনীর যুদ্ধ-সরঞ্জাম গুঁড়িয়ে দেয় ইসরাইলি বাহিনী। একই দিন বেলা ১২টা ৪৮ মিনিটে চারটি ইসরাইলি সুপারসনিক ‘ডাসল্ট সুপার মিস্টেরে’ জঙ্গি বিমান ধেয়ে আসে জর্ডানের মাফরাক বিমান ঘাঁটির দিকে। এবার তাদের লক্ষ্য জর্ডানের ছোট্ট বিমানবাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া।
সে সময় ইসরাইলি সুপারসনিকের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার মতো সমকক্ষ বিমান আরবীয়দের ছিল না। তবু ইসরাইলিদের ঠেকাতে মাফরাক বিমান ঘাঁটি থেকে ‘হকার হান্টার’ জঙ্গি বিমান নিয়ে বুক চিতিয়ে উড়াল দেন সাইফুল আজম।
আর সেই হকার হান্টার দিয়েই ক্ষিপ্রগতির দুটি ইসরাইলি সুপারসনিক ঘায়েল করে ফেললেন সাইফুল আজম। তার অব্যর্থ আঘাতে ভূপাতিত হয় একটি ইসরাইলি ‘সুপার মিস্টেরে’। আরেক আঘাতে প্রায় অকেজো হয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে কোনো মতে পালিয়ে ইসরাইলি সীমানায় গিয়ে আছড়ে পড়ে আরেকটি বিমান।
সে দিন অকুতোভয় বৈমানিক সাইফুল আজমের অকল্পনীয় বীরত্বের কারণে ইসরাইলের পুরো পরিকল্পনাই ভেস্তে যায়। উল্টো নিজেদেরই দুটো বিমান হারায় তারা। এমন বীরত্বের জন্য পুরস্কারস্বরূপ সাইফুল আজমকে ‘হুসাম-ই-ইস্তিকলাল’ সম্মাননায় ভূষিত করে জর্ডান সরকার।
সাইফুল আজমের কাছে ইসরাইলি বৈমানিকদের ধরাশায়ী হওয়া এটাই প্রথম। পরদিনই তার কৃতিত্বে ইরাকি বৈমানিক দলের কাছে চরমভাবে পরাজিত হয় ইসরাইলিরা। ৭ জুনে ইরাকের ‘এইচ-থ্রি’ ও ‘আল-ওয়ালিদ’ ঘাঁটি রক্ষা করার দায়িত্ব পড়ে এক ইরাকি বৈমানিক দলের কাঁধে। আর সাইফুল আজম সেই দলের অধিনায়ক। সে দিন চারটি ‘ভেটোর বোম্বার’ ও দু’টি ‘মিরেজ থ্রিসি’ জঙ্গি বিমান নিয়ে আক্রমণ চালায় ইসরাইল।
একটি ‘মিরেজ থ্রিসি’ বিমানে ছিলেন ইসরায়েলি ক্যাপ্টেন গিডিওন দ্রোর। দ্রোরের গুলিতে নিহত হন আজমের উইংম্যান। তার হামলায় ভূপাতিত হয় দুটি ইরাকি বিমান। পরক্ষণেই এর জবাব দেন আজম। তার অব্যর্থ টার্গেটে পরিণত হয় দ্রোরের ‘মিরেজ থ্রিসি’। সে আঘাতের পর বাঁচার উপায় না পেয়ে যুদ্ধবন্দি হিসেবে ধরা দেন ক্যাপ্টেন দ্রোর। ওই যুদ্ধবন্দির বিনিময়ে জর্ডান ও ইরাকের সহস্রাধিক সৈন্যকে মুক্ত করে ইসরাইল।
আরব-ইসরাইল যুদ্ধের প্রথম ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই সাইফুল আজম একটি অনন্য রেকর্ড তৈরি করেন। ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি ভূপাতিত করেছেন সর্বোচ্চ তিনটি ইসরাইলি বিমান। যে জন্য ‘নাত আল-সুজাহ’ সামরিক সম্মাননায় ভূষিত করা হয়।
শুধু আরব যুদ্ধেই কৃতিত্ব দেখাননি সাইফুল আজম। এর আগে ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে তার বীরত্বে আক্রান্ত হয় একটি ভারতীয় ‘ফোল্যান্ড নেট’ জঙ্গি বিমান। সে বিমান থেকে ভারতের ফ্লাইট অফিসার বিজয় মায়াদেবকে যুদ্ধবন্দি হিসেবে আটক করা হয়। সে সময় প্রশিক্ষকের দায়িত্বে থাকাকালীনই সেপ্টেম্বর পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ১৭ নম্বর স্কোয়াড্রনের হয়ে ‘এফ-৮৬ স্যাবরজেট’ জঙ্গি বিমান নিয়ে এ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন।
বিরল এই পারদর্শিতার স্বীকৃতিস্বরূপ সাইফুল আজমকে পাকিস্তানের তৃতীয় সর্বোচ্চ সামরিক সম্মাননা ‘সিতারা-ই-জুরাত’-এ ভূষিত করা হয়। সাইফুল আজমই পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র বৈমানিক যিনি চারটি দেশের বিমানবাহিনীর সৈন্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই চারটি দেশ হল পাকিস্তান, জর্ডান, ইরাক ও মাতৃভূমি বাংলাদেশ।
এ ছাড়া আটটি ভিন্ন দেশের আট বাহিনীর বিমান পরিচালনা করেছেন আজম। যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, ইংল্যান্ড, জর্ডান, ইরাক, রাশিয়া, চীন ও নিজ মাতৃভূমি বাংলাদেশের হয়ে বিমান চালিয়েছেন তিনি। যুদ্ধক্ষেত্রে অনন্য সব অর্জন আর ইতিহাস গড়া সাইফুল আজমকে ২০০১ সালে ইউনাইটেড স্টেটস এয়ার ফোর্স বিশ্বের ২২ জন ‘লিভিং ইগলস’-এর একজন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।‘ যা মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া একটি খেতাব।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর আরব বিশ্বের একাধিক রাষ্ট্র থেকে খেতাব পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। এই খেতাব যখন পেয়েছেন তিনি নিশ্চয়ই বড় মাপের কেউ। সংবাদ স্ক্রল করে নিচের দিকে গেলে পাওয়া যায় তিনি ছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের প্রশিক্ষক। বিদেশে তাঁর রয়েছে বিপুল সুনাম।
আফসোসের ব্যাপার হলো, তাঁর মৃত্যুসংবাদ প্রকাশ হয় গণমাধ্যমে। জানানো হয়, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সাবেক এমপি সাইফুল আজমের মৃত্যু হয়েছে। এবং এই মৃত্যুতে কারা কারা শোক প্রকাশ করেছেন তাদের একটি তালিকাও প্রকাশ করা হয়। কয়েকটি সংবাদমাধ্যম কেবল এতটুকু তথ্য দিয়েই দায় সেরেছে। তবে কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম খবরের
এইটুকু পরিবেশনার মধ্য দিয়ে বিদায় জানানো হয়েছে দুঃসাহসিক এই বৈমানিককে। কিন্তু তার দুঃসাহস যে কতোটা ছিলো, সেটা নিয়ে আলোচনা হয়নি তিনি বেঁচে থাকতেও, এমনকি মৃত্যুর পরও। তবে মৃত্যুর পর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে পরিবেশিত কিছু খবর তার ব্যাপারে কৌতুহলী করে তুলেছে অনেককে।
যখন এই বীরের মৃত্যুতে শোক নেমে এসেছে ফিলিস্তিনের মাটিতে, তখন বাংলাদেশে তার প্রতিবেশীদের অনেকেই অবাক হয়েছেন। জানার চেষ্টা করেছেন, তার অতীত।
সাইফুল আজমের অতীত বর্ণাঢ্য, সাগরের মতো বিশাল। আরব-ইসরাইল ছয়দিনের যুদ্ধে মাত্র দুটি আকাশলড়াইয়ে চারটি ইসরায়েলি বিমান ধ্বংস করা সহজ কাজ নয়। এই কঠিন কাজটা তিনি করেছিলেন ফিলিস্তিনীদের জন্য। মুসলমানদের পবিত্র ভূমি আল আকসার জন্য। তাই এই যোদ্ধার মৃত্যুতে ফিলিস্তিনীদের শোক।
ফিলিস্তিনের ইতিহাসবিদ ওসামা আল-আশকার সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে লিখেছেন, ‘আল-আকসা মসজিদকে রক্ষায় আমাদের এই লড়াইয়ে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের ভাইয়েরা সঙ্গে ছিলো।
ফিলিস্তিনের অধ্যাপক নাজি শৌকরি টুইট বার্তায় লিখেছেন, ‘সাইফুল আজম ফিলিস্তিনকে ভালোবাসতেন এবং জেরুজালেমের স্বার্থে লড়াই করেছিলেন।’ শৌকরি সাইফুলকে সালাম জানিয়ে আল্লাহর কাছে তার জন্য অনুগ্রহ চেয়েছেন।
ফিলিস্তিনের আরো অনেকেই তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন। তার অনন্য বীরত্বের কথা তুলে ধরেছেন। তাহলে কি এই বীর কেবল ফিলিস্তিনীদের জন্য!
তিনি বাংলাদেশের জন্য কী করেছেন?
যখন পাকিস্তান বাহিনীতে ছিলেন, এই সাইফুল আজম লড়েছেন দেশের জন্য। যখন মধ্যপ্রাচ্যে ছিলেন, লড়েছেন দায়িত্ব আর বিশ্বাসের জন্য। আর একাত্তরের অস্থির সময়ে ছিলেন বাংলাদেশের জন্য।
প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য তার সামনে এসে দাঁড়ায় আরেক কঠিন বাস্তবতা। ১৯৭১ সাল। আগেই বলা হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউরের প্রশিক্ষক ছিলেন তিনি। আর বিমান ছিনতাইয়ের গোপন পরিকল্পনাটিও তার সঙ্গে আলাপ করেছিলেন মতিউর। এছাড়া করাচি থেকে একটি জেটবিমান ছিনতাই করার পরিকল্পনা ছিলো আজমের। সে অনুযায়ী মার্চের ৬ তারিখে স্ত্রী ও সন্তানকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেন তিনি।
‘টি-৩৩’ জঙ্গি বিমান নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় শহীদ হন মতিউর। এর পর পাক গোয়েন্দা সংস্থার সন্দেহ যায় সাইফুল আজমের দিকে। তাকে রিমান্ডে নিয়ে টানা ২১ দিন জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এর আগেই তার ওপর উড্ডয়ন নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিলো। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তার সঙ্গে আরো খারাপ কিছুও হতে পারতো। কিন্তু পাকিস্তানের জন্য যে বৈমানিক এতোকিছু করেছেন, তাকে হত্যা করতে চায়নি দেশটির সামরিক বাহিনী। কথিত আছে, তাঁকে হত্যা না করার জন্য জর্ডানের বাদশাহর অনুরোধ ছিলো। সে যাই হোক বেশ কিছুদিন অজ্ঞাত স্থানে আটকে রাখা হয় আজমকে।
১৯৭২ সালে তিনি ফিরে আসেন বাংলাদেশে। ১৯৭৭ সালে উইং কমান্ডার হন। পরে বিমান বাহিনীর ঢাকা ঘাঁটির অধিনায়ক হন। ডিরেক্টর অব ফ্লাইট সেফটি ও ডিরেক্টর অব অপারেশনস এর দায়িত্বও পালন করে। ১৯৭৯ সালে অবসর নেন সাইফুল আজম।
স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে যথেষ্ট মূল্যায়ন না দেওয়ায় শেষ জীবনে বেশ ভোগ পোহাতে হয়। এরপরএকসময় তিনি সিভিল অ্যাভিয়েশন অথরিটির চেয়ারম্যান, ফিল্ম ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশনের এমডির দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৯১ থেকে ৯৬ সাল পর্যন্ত পাবনা-২ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। তার রাজনৈতিক দল বিএনপি। শেষ জীবনে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘নাতাশা ট্রেডিং এজেন্সির’ এমডির দায়িত্ব পালন করেন।
অতঃপর ১৪ জুন ৭৯ বছর বয়সে এই আকাশযুদ্ধা কিংবদন্তীর মৃত্যু হয় ‘সাধারণ এক বৃদ্ধ’ হিসেবে। আল্লাহ তায়ালা তাকে বেহেশত নসিব করুন। আমীন।আর সাইফুল আযমের জীবনের নানান দিক থেকে আগামীর বাংলাদেশ শিক্ষা গ্রহন করুক- সেটাই হবে মহান এই মুসলিম পাইলটের জীবনের সফলতা।