সামসুল ইসলাম টুকু: বিশ্বব্যাপী বিদ্যুৎ ও জ্বালানী চাহিদার প্রেক্ষিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী ইউরোপিয়ান দেশ সমুহ তাদের ব্যবসায়ীক স্বার্থে একটি আন্তর্জাতিক কাঠামো তৈরী করে । যা এনার্জি চার্টার ট্রিটি (ইসিটি) নামে পরিচিত। আর যে সকল দেশে বিদ্যুতের চাহিদা আছে তারা প্রয়োজনে এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে । বিশ্বায়নের নামে তাদের তৈরী এই আইনী কাঠামো স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রের ওপর ব্যবহার করে । ইতোমধ্যে বেশ কিছু দেশ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে । এরমধ্যে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সরকার পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র হিসেবে স্বাক্ষর করেছে এবং শিঘ্রই ইসিটি তে বিনিয়োগ গ্রহনকারী সদস্য হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে ।
ইসিটি নামক এই আন্তর্জাতিক আইন কাঠামো রাষ্ট্রের স্বার্থ ,নাগরিক অধিকার , প্রকৃতি ইত্যাদি সুরক্ষায় কতটুকু কার্যকর তা জানা দরকার । উল্লেখ্য ১৯৯৪ সালে বিনিয়োগকারীর স্বার্থ রক্ষায় তৈরী হয় ইউরোপিয় জ্বালানী সনদ। তবে সে সময় ওই সনদে স্বাক্ষর করা কোনো রাষ্ট্রের জন্য বাধ্যতামুলক ছিলনা । এটা ছিল ঐচ্ছিক চুক্তি । কিন্তু সোভিয়েট ইউনিয়নের পতনের পর মধ্য ও পুর্ব ইউরোপে পশ্চিমা বহুজাতিক কোম্পানীগুলোর বিনিয়োগের নতুন সম্ভাবনার কারনে এর ব্যাপ্তি ইউরোপ কেন্দ্রিক থাকলোনা । তখন ১৯৯৮ সালে ইসিটি বাধ্যতামুলক চুক্তি হিসেবে কার্যকর হয় । এতে বিভিন্ন রাষ্ট্র নিজ নিজ দেশে জ্বালানী চাহিদা পুরনের জন্য ইসিটি তে স্বাক্ষর করতে থাকে । বর্তমানে ৫৩ টি দেশ ও অর্থনৈতিক জোট এই চুক্তির আওতায় রয়েছে ।
৫০টি ধারা নিয়ে প্রনীত ইসিটি মোটাদাগে ৪ টি মুল ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। ১।স্বদেশি বিদেশি নির্বিশেষে সমানাচরন নীতি । বিদেশি বিনিয়োগ সুরক্ষায় বৈষম্যহীন বানিজ্য ,২। বিভিন্ন জ্বালানী উপাদান , পন্য , সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি গ্রীডের মধ্যমে বা অন্য কোনো উপায়ে স্থানান্তর ও পরিবহন, ৩।আন্তরাষ্ট্রীয় ও বিনিয়োগ গ্রহনকারী রাষ্ট্র বনাম বিনিয়োগকারী রাষ্টের মধ্যে দ্বন্দ্ব নিরসন , ৪। অধিক কার্যকরভাবে জ্বালানী ব্যাবহার নিশ্চিত এবং জ্বালানী উৎপাদন ও ব্যাবহারের কারনে পরিবেশগত ঝুঁকি হ্রাস। চুক্তিটি বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি আন্তর্জাতিক রক্ষা কবচ বটে । উল্লেখিত এই চারটি মুল ভিত্তির ভাষা সহজ সরল মনে হলেও এর বিভিন্ন ধারা স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রের জন্য অসম ও ভারসাম্যহীনতায় ভরা । বিদ্যুত ওজ্বালানী খাত সঙ্ক্রান্ত সিদ্ধান্ত প্রনয়নে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি, বিনিয়োগকারীর সাথে নায্যতা ও আচরনগত সমদর্শিতার বিধান , প্রতিবেশগত উদ্বেগ , জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ,জ্বালানী রুপান্তর , জ্বালানী খাতে বিনিয়োগ স্বন্দ্ব নিরসন প্রক্রিয়ায় অংশ গ্রহনে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রের অসম ও ভারসাম্যহীন অবস্থা বিরাজ করছে । এছাড়া যারা ইসিটিতে স্বাক্ষর করেছে তাদের অভিজ্ঞতা কি সেটাও জানা দরকার ।
এ ব্যাপারে কঞ্জিউমার এসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ক্যাব) সম্প্রতি বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে নাগরিক সংলাপ অনুষ্ঠানে “জ্বালানী উন্নয়নে বিনিয়োগ চুক্তি “শীর্ষক আলোচনায় যা বলেছে তার সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হলো ।
ইসিটির ধারা ১৮তে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রের জ্বালানী সম্পদের ওপর তার সার্বভৌমত্ব ও অধিকারের নিশ্চয়তা দিলেও এর ঘোষনায় বিপরীত কথা বলা হয়েছে । তাহলো রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ধারনাটি যেন চুক্তির অন্য কোনো বিধান প্রয়োগে অন্তরায় না হয়। একইভাবে ধারা ৫,১১,১৪ অনুযায়ী কনো স্বাগতিক রাষ্ট্র বিদেশি বিনিয়োগকারীকে তাদের নিজস্ব কোনো পন্য ব্যাবহারে বাধ্য করার অধিকার রাখেনা । শুধু তাইনয় স্থানীয় কাউকে কর্মসংস্থানের ব্যাপারেও বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের ওপর কোনো বাধ্যবাধকতা চাপিয়ে দিতে পারেনা । অথচ বিনিয়োগকারী ব্যাবসার পুঁজি , মুনাফা ,উদবৃত্ব অর্থ , কর্মকর্তা কর্মচারিদের বিভিন্ন রকম পারিশ্রমিক , উপহার ইত্যাদি বিনা বাধায় নিজ দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার আইনগত অধিকার রাখে । এছাড়া স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র কোনো কারনে অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়লে বিনিয়োগকারী রাষ্ট্রের বা সংস্থার ওপর কোনো কর ধার্য্য সহ ভিন্ন কোনো অবস্থান নিলে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মামলা করার অধিকার রাখে । এমন বিষয় নিয়ে মামলার ঘটনাও আছে । ২০০৭ সালে হাঙ্গেরি ভোক্তাদের জন্য জ্বালানী মুল্য কমালে বৃটিশ এনার্জি সার্ভিস হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে মামলা করে এবং ২০১৩ সালে অষ্ট্রলিয় ভিত্তিক এভলিউশন মাইনিং বুলগেরিয়ার বিরুদ্ধে ক্ষতিপুরনের মামলা করে । মামলার রায় স্বাগতিক দেশের পক্ষে গেলেও ইসিটি আইন অনুযায়ী মামলার খরচ উভয় পক্ষকে সমভাবে বহন করতে হয় । হাঙ্গেরির মামলাটির পেছনে ব্যয় করতে হয়েছিল ৫৯০ কোটি ডলার বা ৫৫ হাজার ৪১ কোটি টাকা ।আর স্বাগতিক রাষ্ট্রের বিপক্ষে রায় হলে ব্যয় বেড়ে যেত কয়েকগুন ।যা বহু রাষ্ট্রের পক্ষেই বহন করা সম্ভব নয় ।
চুক্তির আর একটি বিতর্কিত ধারা ৪৭ (৩) । একে অনেকেই মড়ার জীবন্ত ভুত (জম্বি ) বলে ডাকে । এই ধারা অনুযায়ী কোনো রাষ্ট্র যদি এই চুক্তি থেকে সরে আসতে চায় তাহলে পরবর্তী ২০ বছর পর্যন্ত বিনিয়োগকারীর সুরক্ষা বা ইসিটির চুক্তি মত সকল দায়দেনা পরিশোধ করতে হবে ।এমন একটি মামলার ফল ভোগ করছে ইতালী । রাষ্ট্রটি এ চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার এক বছর পর সংশ্লিষ্ট রকহপার কোম্পানী কর্তৃক মামলার শিকার হয় । ইতালীয় উপকুলে গ্যাস ও খনিজ খনন নিষিদ্ধ করলে কোম্পানীটি ৩৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতিপুরনের মামলা করে । যা এখন চলমান ।এ থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায় এই চুক্তি প্রনয়নের সার্বভৌমত্বকে বিনিয়োগকারীর বানিজ্যিক স্বার্থের অধীনস্থ করে । চুক্তিটি স্বাগতিক রাষ্ট্রকে স্থানীয় ভাবে বা নিজস্ব উপায়ে সমস্যা সমাধানের পথ নির্দেশ করেনা ।যার পুর্বশর্ত হলো মামলার জন্য বিনিয়োগকারী রাষ্ট্রের অনুমোদন নেওয়া । এমনকি স্বাগতিক রাষ্ট্র সালিসির জন্য নিজস্ব আইন কাঠামো ব্যাবহারেরও অধিকার রাখেনা । সেইসাথে রয়েছে সালিসের ব্যয় সমভাবে ভাগের বিধান । এতে বন্ধুত্বপুর্ন উপায়ে বিনিয়োগ সঙ্ক্রান্ত দ্বন্দ্বনিরসনে ৯০ দিন সময় দেওয়া হয়েছে । এসময় দ্বন্দ্ব নিরসন না হলে আন্তর্জাতিক সালিসিতে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে । এখানেও রয়েছে বেজায় ফাঁক । স্বাগতিক রাষ্ট্রের পক্ষে রায় পাওয়া বেশ কঠিন এবং মামলা বিলম্বিত সহ মামলার খরচ অর্ধেক বহন করার ব্যাপার তো আছেই । স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ ঝুঁকি নিতে চায়না । বিশেষত গরীব দেশগুলি ।
ইসিটির ধারা ১০ এ বিনিয়োগকারীর জন্য ন্যায্যতা ও আচরনগত সমদর্শিতার বিধান রয়েছে । এটি নিশ্চিত করে যে বিনিয়োগকারীর ব্যাবসা ,ব্যাবস্থাপনা্ , এর রক্ষনাবেক্ষন , বিনিয়োগের ব্যাবহার এবং এথেকে প্রাপ্ত লাভের ভোগ যেন কোনোভাবেই স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রের অকারনবশত ও বৈষম্যমুলক গৃহিত পদক্ষেপ বাধাগ্রস্থ না হয় । এই অকারনবশত ও বৈষম্যমুলক আচরনের কোনো স্পষ্ট সংজ্ঞা না থাকায় বিনিয়োগকারী এর সুবিধা গ্রহন করে । এ ক্ষত্রেও কয়েকটি স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র বিনিয়োগকারী রাষ্ট্র বা কোম্পানীর মামলা ও হয়রানীর শিকার হয়েছে
ইসিটি বিনিয়োগকারীকে সুরক্ষায় আইন কাঠামো প্রয়োগে যত কঠোর নীতি গ্রহন করেছে অথচ বিপরীতে প্রান, প্রকৃতি , সুরক্ষা সংক্রান্ত জনস্বার্থের ব্যাপারে ততটাই সুবিধাবাদী নীতি গ্রহন করেছে ।চুক্তির ১৯(১) ধারায় পরিবেশগত প্রভাব কমানোর কথা বলা হলেও সেখানে বলা হয়েছে অর্থনৈতিক কার্যকারিতার ওপর ভিত্তি করে টেকসই উন্নয়নের ওপর পরিবেশের বিরুপ প্রভাব কমাতে । কিন্তু পরিবেশ প্রতিবেশের ওপর জ্বালানী খাতের কর্মকান্ডের প্রভাব কমানোর কথা বলা হয়নি । এর দায় দায়িত্ব চাপানো হয়েছে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রের ওপর । এরসাথে যুক্ত করা হয়েছে তা বাস্তবায়ন করতে হবে এমনভাবে যেন জ্বালানী খাতের বিনিয়োগ চক্রের পুঁজি বা আন্তর্জাতিক বানিজ্য মুক্তবাজার বিমুখী না হয় ।শুধু তাইনয় পরিবেশ ও প্রতিবেশগত উদ্বেগ নিরসনে এমন নমনীয় আইন কাঠামোর কারনে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কোনো চুক্তি স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র জিবাশ্ম জ্বালানী থেকে বেরোতে চাইলেও তা বাস্তবায়নযোগ্য হবেনা । এমনকি কোনো রাষ্ট্র নবায়নযোগ্য জ্বালানীতে যেতে চাইলে তা জিবাশ্ম জ্বালানীতে বিনিয়োগকারীর জন্য ক্ষতির কারন হতে পারে এবং তাদের জ্বালানী রুপান্তর প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্থ করতে পারে এমন কোনো কাজ করা যাবেনা । এমন শর্তের প্রেক্ষিতে ফ্রাসের মত রাষ্ট্রওবিদেশী বিনিয়োগকারী মামলার শিকার হয়েছে। এ ধরনের মামলার শিকার হয়েছে বিশ্ব জুড়ে ৪৫ টি দেশ । এরমধ্যে ২০টি দেশ চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী । আবার পরিবেশগত ক্ষতির প্রভাব বিবেচনায় না নিয়ে রাষ্ট্রের সব পর্যায়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নির্ভর এই খাত মুল চালিকা শক্তি হিসেবে নির্ধারিত হয়েছে ।
সবকিছু মিলিয়ে এই চুক্তির আওতায় বিনিয়োগ দ্বন্দ্ব নিরসন পদ্ধতি পুরোপুরি স্বাগতিক রাষ্ট্রের জন্য একটি আইনী ফাঁদ ছাড়া কিছু না । তাহলে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যেসব দেশ ইতোমধ্যে ইসিটি তে স্বাক্ষর করেছে তারা এখনো কেন চুক্তিটি মেনে চলছে বা এর থেকে বেরিয়ে আসছেনা । এমন পরিস্থিতিতে এই চুক্তির মুল উদ্যোক্তা নেদারল্যান্ড সহ ইউরোপের ৭ টি দেশ জার্মানী , লুক্সেমবার্গ , ফ্রান্স , স্পেন , পোল্যান্ড , স্লোভানিয়া এই বিতর্কিত আইন কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে । ইউরোপীয় ইউনিয়ন কমিশন সমন্বিতভাবে ইসিটি চুক্তি থেকে নিজেদের নাম প্রত্যাহারের ঘোষনা দিয়েছে । এমন অবস্থায় বাংলাদেশ কি করতে পারে এটাই গুরুত্বপুর্ন প্রশ্ন। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানী খাতের দায়মুক্তি আইন ২০১০ এর কারনে ইতোমধ্যে বেশ বিতর্কিত হয়েছে এবং আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে । এর সাথে যদি ইসিটি যুক্ত হয় তাহলে বড় ধরনের আর্থিক ফাঁদে আটকিয়ে যাওয়া সহ প্রান প্রকৃতি বিরোধী অন্যায্য অবস্থান বিনিয়োগকারীর অনুকুলে আরো শক্তিশালী হবে এবং তা প্রাতিষ্ঠানিক রুপ পাবে । এতে রাষ্ট্র থেকে সমাজ আরো বিচ্ছিন্ন হবে এবং পাশাপাশি আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়বে । তাই জনস্বার্থে , ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিপদ থেকে রক্ষার তাগিদে ২০১০ সালের দায়মুক্তি আইন থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা সহ কোনোভাবেই ইসি্টি তে স্বাক্ষর করা যাবেনা । এছাড়া বিশ্ব ব্যাপী যেহেতু ইসিটি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে সেহেতু ইসিটি তে পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী । অন্যদিকে কার্বন নিসরন মুক্ত বিকল্পবিদ্যুৎবা সোলার বিদ্যুৎ আমদানী বা উৎপাদন করা সম্ভব কিনা সে ব্যাপারে ভাবতে হবে । এ ব্যাপারে ক্যাব দেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে জরিপ কাজ শুরু করেছে সোলার বিদ্যুতের সম্ভাবনা নিয়ে । শিঘ্রই এর ফলাফল জানা যাবে । সেই প্রেক্ষিতে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহন শ্রেয় হবে ।