প্রকৌশলী আতিকুর রহমান: কোরআন বান্দার জন্য আল্লাহ তা’আলা প্রদত্ত এক মহামূল্যবান নেয়ামত। অনেকেই আল্লাহ তা’আলার এ কালাম অন্তরে প্রবেশ করানোর ইচ্ছা লালন করেন কিন্তু সময়ের অভাবে ও নানা কারণে তা হয়ে উঠেনা। কোরআনে কারীম হিফয করা ও তা ধরে রাখার বিষয়ে কিছু টিপস দেয়া হলো। আশা করি পাঠক এ থেকে উপকৃত হবেন, ইনশাআল্লাহ।
১. প্রথমেই সহিহ নিয়ত করা। কোরআন অন্তরে প্রবেশ করানো ও তা ধরে রাখার জন্য আমৃত্যু মহান আল্লাহর সাহায্য কামনা করা, নিয়মিত দো’আ করা।
২. কোরআন অন্তরে ধারণ করার ফায়দা জেনে নেয়া যার মাধ্যমে নিজের মাঝে প্রচন্ড ডেডিকেশন সৃষ্টি করে নেয়া। অনেকে বৃদ্ধ বয়সে কোরআনে হিফয সম্পন্ন করেছেন। কিছুদিন আগে সোস্যাল মিডিয়ায় এসেছে ৭০ বছর বয়সে এক মহিলা কোরআন মুখস্থ করেছেন। অতএব কোরআনে কারীম হিফয করার ক্ষেত্রে বয়স কোন বাঁধা নয়।
৩. নিজের লাইফস্টাইল অনুযায়ী হিফয করার জন্য বাস্তবসম্মত একটি প্ল্যান তৈরি করা। আবেগের বসবর্তী হয়ে কঠিন ও অকার্যকর প্ল্যান করা থেকে বিরত থাকা। কেননা এতে আশানুরূপ সাফল্য না পেলে পরবর্তীতে মনে হতাশা জন্ম নিতে পারে। যা কাম্য নয়।
৪. একজন নির্ভরযোগ্য হিফয শিক্ষক নিয়োগ করা ও তাঁর নিকট নিয়মিত পাঠ দেয়া। বাসার নির্ভরযোগ্য কাউকে পাশাপাশি পাঠ দেয়াও উত্তম। আমি নিজে ৩০তম পারা হিফয করে যখন শিক্ষককে পাঠ দিলাম, দেখি বেশ কিছু স্থান ত্রুটিযুক্তভাবে মুখস্থ হয়েছে। এটা সোধরাতে আমাকে বেগ পেতে হয়েছে ও এখনো পুরো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। আল্লাহ তা’আলা সাহায্য করুক, আ-মীন।
৫. সকালের দিকে বেশী সময় হিফয করা। কেননা এসময়টা মুখস্থ করার সর্বোত্তম সময়। জনৈক শাইখ বলেছেন, সকালের স্মৃতি শক্তির উপমা শিশুর মতো সজিব-সতেজ আর বিকাল বা রাতের স্মরণ শক্তির উপমা শ্রান্ত ক্লান্ত একজন বৃদ্ধের ন্যায়। অতএব সকালের সময়টা বেশী করে কাজে লাগানো চাই।
৬. নতুন সবকে মুখস্থ করার পর আট ঘন্টার আগেই আবার তা তিলওয়াত করা চাই। এটি একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা: অধিক বিরতির কারণে নতুন সবক স্মৃতি থেকে হারিয়ে যেতে পারে।
৭. দৈনন্দিন রুটিনে রিভিশন করার প্ল্যান রাখা যা সার্বক্ষণিকভাবে অনুসরণ করা।
৮. মুখস্থ করার ক্ষেত্রে প্রচুরসংখ্যক পন্থা রয়েছে। একেক জনের জন্য একেক পন্থা কার্যকর হতে পারে। পাঁচ আয়াত নির্দিষ্ট করে তা বিশ বার করে পাঠ করে মুখস্থ করা। অথবা এক আয়াত ভেঙে ভেঙে মুখস্থ করা। বহুল আলোচিত পন্থাসমূহের মাঝে এ দু’টো অন্যতম।
৯. যাবতীয় গোনাহ থেকে বেঁচে থাকা। তাকওয়াপূর্ণ জিন্দেগী অবলম্বন করা। ঈমাম শাফেঈ রহ: এর স্মৃতি শক্তি এতটা শক্তিশালী ছিল যে তাকে বলা হতো ফটোগ্রাফিক স্মৃতি শক্তির অধিকারী। তিনি একবার যা পড়তেন বা দেখতেন তা সাথে সাথে মুখস্থ হয়ে যেত। তারপরও তিনি তাঁর উস্তাদকে প্রশ্ন করলেন, কিভাবে তিনি তাঁর স্মৃতি শক্তির আরও উন্নতি করতে পারেন। এতে তাঁর উস্তাজ ঈমাম শাফীকে পরামর্শ দিলেন: গোনাহ ছেড়ে দাও। গোনাহ হলো অন্ধকার। ঈলম হলো নূর বা আলো। অন্ধকার আর আলো একস্থানে থাকতে পারে না।
১০. যে আয়াত মুখস্থ করছি তার প্রতিটি শব্দের অর্থ জেনে নেয়া। মেমোরি পেগ (আমাদের আঞ্চলিক ভাষায় একে খোটা বলে। যার মাধ্যমে গবাদি পশু বেঁধে রাখা হয়) বলে একটি কথা আছে। মেমোরি পেগের উদাহরণ দিচ্ছি।
ধরুন সুরা আল-ইহসান ৭৬:১২ নং আয়াত মুখস্থ করছি।
وَجَزَىٰهُم بِمَا صَبَرُوا۟ جَنَّةً وَحَرِيرًا
আর তারা যে ধৈর্যধারণ করেছিল তার পরিণামে তিনি তাদেরকে জান্নাত ও রেশমী বস্ত্রের পুরস্কার প্রদান করবেন।
এখানে জাযা (جَزَ) শব্দের অর্থ বিনিময়
ছবারো (صَبَرُوا۟) শব্দের অর্থ সবর
জান্নাত (جَنَّةً) শব্দের অর্থ আমরা জানি জান্নাত বা বাগান।
হাড়িরা (حَرِيرًا) শব্দের অর্থ রেশমী বস্ত্র। হাড়ি বা পাত্র মনে রাখার মাধ্যমে এ শব্দ সহজেই মনে রাখা সম্ভব। হাড়ি মনে রাখার মাধ্যমে حَرِيرًا মনে রাখাই হলো মেমোরি পেগ।
পারিপার্শ্বিক অন্যান্য শব্দ, যেমন ‘বিমা’, ‘হুম’ জেনে নেয়া। পাশাপাশি আরবি গ্রামার জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এভাবে সহজেই যে কোন সুরার আয়াত দ্রুত মুখস্থ করা সম্ভব ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তা’আলা সকলের জন্য সহজ করে দিক আ-মীন।
১১. চলতে ফিরতে নিয়মিত কোরআন শোনা। এক্ষেত্রে গাড়ির মিডিয়া প্লেয়ার বা মোবাইল ডিভাইসের সাহায্য নেয়া যেতে পারে।
১২. সোস্যাল মিডিয়া (ফেসবুক) থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকা কেননা সোস্যাল মিডিয়া অল্প সময়ে আমাদের মাথায় প্রচুর ইনফরমেশন ঢুকিয়ে দেয়। ইনফরমেশনের জেমে/ভীড়ে মন বিক্ষিপ্ত হয়। যা মুখস্থ শক্তিকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে।
১৩. যে অংশটুকু যত আগে মুখস্থ করেছেন, এরপর নিয়মিত রিভিশন চলেছে সে অংশ তত বেশী শক্তিশালী ভাবে মনে দাগ কেটে থাকে। অতএব নতুন মুখস্থের দিকে বেশী গুরুত্ব দেয়া দরকার। পাশাপাশি রিভিশনও চালিয়ে যাওয়া। এর মানে এই নয় যে রিভিশনের গুরুত্ব কম করা যাবে।
লেখক: পেশায় একজন প্রকৌশলী এবং সম্প্রতি ইসলামিক স্টাডিজে ব্যাসেলর সম্পন্ন করেছেন।