728 x 90

আমার বাংলাদেশ সৈনিক থেকে রাষ্ট্রনায়ক

কায়সার আহমেদ: আমার আজকের লেখাটা কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে লেখা নয় বা কোন তুলনামুলক নয়। বিভিন্ন সূত্র থেকে একজন প্রয়াত রাষ্ট্রপতির আত্মজীবনীর কিয়দংশ তুলে ধরার চেষ্টা মাত্র। পৃথিবীর সকল গনতন্ত্রকামী দেশুগুলো তাদের বর্তমান বা বিগতদিনে যে সকল নেতারা দেশকে সেবা দিয়েছেন, তাদের সকল অবদানকে স্মরন করে থাকেন। একটি দেশ বিশাল তার রাজনৈতিক পরিধি, বিশাল প্রশাসন, নেতৃত্ব

কায়সার আহমেদ: আমার আজকের লেখাটা কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে লেখা নয় বা কোন তুলনামুলক নয়। বিভিন্ন সূত্র থেকে একজন প্রয়াত রাষ্ট্রপতির আত্মজীবনীর কিয়দংশ তুলে ধরার চেষ্টা মাত্র। পৃথিবীর সকল গনতন্ত্রকামী দেশুগুলো তাদের বর্তমান বা বিগতদিনে যে সকল নেতারা দেশকে সেবা দিয়েছেন, তাদের সকল অবদানকে স্মরন করে থাকেন। একটি দেশ বিশাল তার রাজনৈতিক পরিধি, বিশাল প্রশাসন, নেতৃত্ব দিতে ভূল ত্রুটি থাকতেই পারে, দ্বিমত থাকতেই পারে। তাই বলে তাদের কৃতিত্বগুলো মনে রাখবো না, তাতো হতে পারে না। বিশ্বের বেশীরদভাগ গনতান্ত্রিক দেশে জনগন তাকেই ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনে যে ব্যক্তি বা দলের নির্বাচনী মেনিফেস্টো দেশটির কল্যান বয়ে আনার কথা দিবেন। তাকেই ভোট দিয়ে থাকে যিনি জনগনকে দেয়া কথার বরখেলাফ করবেন না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে আমরা জাতীয় অর্থনীতি, উন্নয়ন বাস্তবায়ন দেখি না, আমরা ভোট দিয়ে থাকে মার্কা দেখে। আমরা ভোট দেই নৌকা বা ধানের শীষ বা লাঙ্গল দেখে। কখনো ভাববার চেষ্টা করি না কোন দল কি ভাবে দেশ চালাবে, যাকে ভোট দিলাম সেকি পূর্বে জনগনকে দেয়া তার কথা রেখেছে? কখনো ভাবি না, যেই লোকটিকে সংসদ সদস্য বা উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে ভোট দিচ্ছি তার বিগতদিনের কার্যকলাপ কি? আমারা শিক্ষিত বা অশিক্ষিতরা খুব গর্ব করেই বলি আমরা আওয়ামী ঘরানা, আমাদের বাপ-দাদারাও এই দলকে ভোট দিয়েছেন, তাই আমরাও দেই। যেনো উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পদ। ঠিক তেমনটি দেখতে পাই বিএনপিতে। আমরা জিয়ার অনুসারী, ধানের শীষ আমাদের জীবন।

হুজুকে বাঙালী একটি প্রচলিত বাংলা প্রবাদ। বাংলাদেশে বৃহৎ দুইটি রাজনৈতিক দল। জন সমর্থনের দিক দিয়ে কেহ কারো থেকে কম নয়। অথচ উভয় দলের জাতীয় নেতাদের বক্তব্য শুনলে মনে হবে যে নিজ দল ব্যতিত অন্য দলটি জনগন আস্তাকুড়ে নিক্ষেপিত। আমরা বিগত দিনে তিন তিনটি নির্বাচন দেখেছি তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে, সেখানে কিন্তু সংসদে যে কয়টা আসন দল দুটো পেয়েছে সেদিকে লক্ষ না করে, জন সমর্থনের হিসাব করার জন্যে সমগ্র দেশের ভোটের ফলাফলে নজর দেই তবে দেখা যাবে যে উভয় দলই প্রায় সমান সমান বা উনিশ বিশ ভোট পেয়েছেন। উভয় দলের কেন্দ্রীয় নেতাগন তাদের বিরোধী দলের নেতাদের সমালোচনাতেই ব্যস্ত থাকেন এবং তা নির্লজ্জ মিথ্যে হলেও তারা কুণ্ঠাবোধ করেন না। এমনকি তারা একে অন্যের প্রয়াত জনপ্রিয় জননন্দিত নেতাদের নিয়ে অস্বাভাবিক বা ইতিহাস বিকৃত করে বক্তব্য দিয়ে থাকেন। অথচ বর্তমান এই দুই দলের বর্তমান প্রজন্মের সমর্থন বা নেতারাও তাদের পূর্বসূরী জাতীয় নেতাদের রাজনৈতিক কর্মকান্ড বা দেশের স্বার্থে বিভিন্ন সময়ে পদক্ষেপ সঠিকভাবে জানেন না। আমরা আমাদের জাতীয় নেতাদের পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম ও অবদান তুলে না ধরে তাদের ভূল ত্রুটিগুলো উপস্থাপন করে থাকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমেদ, মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, জিয়াউর রহমান বীর উত্তম, মনি সিংহ এর মত জাতীয় নেতাদের দেশ সেবার দৃষ্টান্ত বর্তমান প্রজন্মের নিকট তুলে না ধরে যে যার মত করে নোংরা রাজনীতি করে থাকে।

বাংলাদেশের জাতীয় নেতা ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এর জীবনি ও শাসনামল নিয়ে অনেক বই ও লেখা প্রকাশিত হয়ে থাকলেও, দু:খজনক হলেও সত্যি বিএনপি’র মত বৃহৎ একটি দলের প্রতিষ্ঠাতা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বের খেতাব প্রাপ্ত অন্যতম নায়ক, অন্যতম সেক্টর কমান্ডার, জননন্দিত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর উত্তম এর কোন আত্মজীবনী নিয়ে লেখা ভালো কোন তথ্যবহুল বই নেই। ১৯শে জানুয়ারী এই নেতার জন্মদিন উপলক্ষে বাংলাদেশে তথা সমগ্র বিশ্বেই তার অনুসারী বা দলীয়ভাবে পালন করা হচ্ছে তার জন্মদিন। অনুষ্ঠানগুলোতে নেতারা বাংলাদেশে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে বক্তব্য রাখলেও রাষ্ট্রপতি জিয়ার জীবন, রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে কোন কথা বলে থাকেন না। এমতাবস্থায় বর্তমান জিয়াকে তাদের নেতা জানলেও নেতার জীবন-আদর্শ নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হলে তাদের মুর্খতার বহি:প্রকাশ ঘটে।

কে এই জিয়াউর রহমান। ১৯৩৬ সালের ১৯শে জানুয়ারী তিনি জন্মগ্রহন করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ১৯৫৩ সালে কমিশন লাভ করেন। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এমন এক কোম্পানীতে কর্মরত ছিলেন, যার নামে সকলেই গর্ববোধ করতো। জিয়া ছিলেন তেমনই একটা ব্যাটেলিয়ানের কোম্পানী কমান্ডার। সেই ব্যাটেলিয়ান এখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীরও গর্বের বিষয়। তখন জিয়ার নেতৃত্বে তার ব্যাটেলিয়ান নিয়ে খেমকারান রণাঙ্গনের বেদিয়ানে বীরত্বের সাথে যুদ্ধরত ছিলেন। আর এই বীরত্বের জন্যেই তার ব্যাটেলিয়ানকে পুরষ্কার স্বরুপ প্রদান করা হয়েছিলো পাক বাহিনীর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বাধিক বীরত্ব পদক। আর এই ব্যাটেলিয়ানের পুরষ্কার বিজয়ী কোম্পানী ছিলো জিয়ার নেতৃত্বাধীন “আলফা কোম্পানী”। এই কোম্পানী যুদ্ধ করেছিলো ভারতীয় সপ্তদশ রাজপুত, উনবিংশ মারাঠা লাইট ইনফ্যান্ট্রি, ষোড়শ পাঞ্জাব ও সপ্তম লাইট ক্যাভালরীর (সাঁজোয়া বহর) এর বিরুদ্ধে। এই কোম্পানীর সেনারা জিয়ার নেতৃত্বে এককভাবে এবং সম্মিলিতভাবে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে ঘায়েল করেছে প্রতিপক্ষকে।

জিয়া বাংলাদেশের সংকটকালীন নেতা। তিনে সেই ঈপ্সিত রাষ্ট্রনায়ক, যিনি বাংলাদেশ রাষ্ট্রব্যবস্থায় একটি বিশেষ সময়ে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। এ ধরনের নেতৃত্বকে সংকটকালীন নেতা বলা হয়ে থাকে। দেশের আপদে বিপদে যথার্থ নেতৃত্ব যখন অনুপস্থিত, তখন এ ধরনের নেতা-নেতৃত্ব আশার আলো নিয়ে আবির্ভূত হয়ে থাকেন। ঐতিহাসিকদের মতে জিয়া বাংলাদেশের জাতীয় জীবনের খুব বড় ধরনের দুটো সংকটে সঠিকভাবে দেশের হাল ধরেছিলেন। এই দুটো হলো ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ২৭শে মার্চ এ চট্টগ্রাম কালুরঘাট থেকে বেলাল মোহাম্মদ পরিচালিত স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বার্তার বরাতে তার পক্ষে গর্জে উঠে “আমি মেজহর জিয়া বলছি …….”। অনেকেই বলে থাকেন অখ্যাত মেজর জিয়ার কথায় স্বাধীনতা হয়নি। এইভাবে বলাটা রাজনৈতিক প্রতিহিংসাকেই প্রাধান্য দেয়। বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘদিনের ত্যাগ তিতিক্ষার ফসল এই স্বাধীনতা, ১৯৭১ সালে যুদ্ধের প্রারম্ভে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে একজন সামরিক মেজরের ঘোষনা তৎকালিন সময়ে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারন জনগনের মাঝে কতটা সাহস ও উদ্দীপনার যুগিয়েছিলো, তা আজ আমরা নোংরা রাজনীতির বেড়াজালে তা ভুলে গেছেন।

 

অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু ও তার স্বপরিবারে নৃশংসা হত্যাকান্ডের পর ১৯৭৫ এর আগস্ট থেকে ৭ই নভেম্বর পর্যন্ত একটি অস্থির ও দিক নির্দেশনায় ছিলো সমগ্র জাতি, স্বাধীনতার চার বছর অতিক্রান্ত করার পর দেশটি তখন বিস্ফোরন্নোমুখ বারুদাগারের শীর্ষে অবস্থান করছিলো। ঐ সময়ে সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে তিনি মধ্যস্তা করে দু’পক্ষকে নিয়ন্ত্রনে আনার চেষ্টা করে সফলতা আনতে ব্যর্থ হন।  বিবাদমান দু’পক্ষই জিয়াউর রহমান এর উপর আস্থা রাখতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধে জিয়ার ক্যারিশমা এবং সাধারন সৈনিকদের কাছে প্রশ্নহীন বিশাল গ্রহণযোগ্যতা তাঁকে সময়ান্তরে ৭ই নভেম্বরে সিপাহী জনতার বিপ্লবের কেন্দ্রবিন্দুতে দাড় করিয়ে দেয়। আভ্যন্তরীন বিশৃঙ্খলা, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সসস্ত্র শাখা গণবাহিনীর প্রতিবিপ্লব প্রচেষ্টা, সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার অপতৎপরতা, নেতৃত্বশূন্যতা, অফিসারদের ভীতিপ্রবণতা, সর্বোপরি, সেনাবাহিনীর রাজনীতিকরণের বিষবৃক্ষ সকলের অজান্তে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ধ্বংসের দারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিলো। জিয়াউর রহমানের অক্লান্ত পরিশ্রম, দুর্দান্ত সাহস, দৃঢ়তা, কঠোর পদক্ষেপ এবং প্রশাসনিক দক্ষতা সেনাবাহিনীকে শৃৃঙ্খলাপূর্ণ অবস্থানে ফিরে আনে।

১৯৭৫ ১৫ আগস্টে বিদেশী ষড়যন্ত্রে কাবু হয়ে কিছু বিপথগামী সৈনিক কতৃক বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের নৃশংস হত্যাকান্ডের পরবর্তীতে জিয়া শাসনভার নেয়াতে ১৯৭৯ সালের অক্টোবর মাসে ফার ইস্টার্ন ইকনমিক রিভিউ’র প্রতিনিধি রতন টাস্কার, রাষ্ট্রপতি জিয়ার সাক্ষাতকার নিয়েছিলেন। প্রাথমিকভাবে সেনাবাহিনী ও আপনি ব্যারাকে ফিরে যাবেন এবং বেসামরিক প্রশাসনের পথ তৈরী করে দিবেন বললেও এখন নেতা হিসেবে থেকে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখলেন কেন প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন “ আগস্ট ১৯৭৫ সময়ে কি ঘটতে যাচ্ছে প্রকৃতপক্ষে তা আমাদের জানা ছিলো না। তখন আমি উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। সময় গড়িয়ে পরিস্থিতি আমাকে টেনে আনে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার সাথে সাথে লক্ষ্য করলাম, এমন একটা কিছু যেন রয়েছে, যা আমাকে টেনে ধরছে। এরপর গণভোট এবং পরবর্তী পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করি। এরপর সামরিক আইন তুলে দিয়ে বহুদলীয় গনতন্ত্র চালু করে দেই”।  বাংলাদেশ থেকে ফিরে যেয়ে রতন টাস্কার লিখেছিলেন যে, জিয়ার প্রধান সম্পদ হলো তাঁর ব্যক্তিগত সততা। জিয়ার কট্টর সমালোচকরাও তার সততা ও নিষ্ঠা সম্পর্কে একমত। তিনি তাঁর পরিবারের কোন সদস্য এবং আত্মীয়স্বজনকে কখনো তার ক্ষমতার কাছে ধারে আসতে দেননি। তার নিকটজনরা কখনো তার নাম ভাঙ্গিয়ে কোথাও ফায়দা লুটার চেষ্টা করেছে এমন কথা এখন পর্যন্ত কাউকে বলতে শোনা যায়নি। দেশ শাসনকালে তাঁর নিজ স্টাইলে পায়ে হেঁটে চলা গ্রামের পর গ্রাম দেখে বিদেশী সাংবাদিক মার্কাস ফ্রান্ডা ও পর্যবেক্ষকরা তাকে ফিডেল ক্যাস্ট্রো, জুলিয়াস নায়ারে, সুকর্নের সাথে তুলনা করতো।

প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগন রাষ্ট্রনায়কের যে গুণাবলির কথা দুটো ভাগে স্পষ্ট করেছেন। প্রথমত: ব্যক্তিগত গুণাবলি, দক্ষতা, যোগ্যতা- যা রাষ্ট্রকে প্রভাবিত করবে। দ্বিতীয়ত: রাষ্ট্রিক নীতিমালা স্থায়িত্বশীল, ধারণযোগ্য, বাস্তবানুগ কর্মকৌশল যা রাষ্ট্রকে অব্যাহত উন্নয়নে সহায়তা করবে। জিয়া’র ব্যক্তিগত গুণাবলি, দেশপ্রেম, দুরদৃষ্টি, মঙ্গলাকাক্সক্ষা, কঠোর শৃক্সক্ষলাবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, আত্মসংযম, দ্রুত সিদ্ধান্তগ্রহণ ক্ষমতা, সুদৃঢ় ইচ্ছাশক্তি, কৃচ্ছ্রতাপূর্ণ সাধারণ জীবনযাপন এবং আল্লাহর প্রতি গভীর আস্থা ও বিশ্বাস রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং তাঁর সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়াকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অব্যাহত উন্নয়ন এবং এর জনগণের কল্যাণই ছিলো তাঁর প্রথম ও প্রধান সাধনা। কায়মনোবাক্যে ধ্যানজ্ঞানে সময় ও শ্রমে বাংলাদেশই ছিলো তাঁর জীবন লক্ষ্য। রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমান যে উন্নয়ন কৌশল অবলম্বন করেছিলেন তার ফলে জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রেরণা, উদ্দীপনা ও উন্নয়ন প্রয়াস সুচিত হয়েছিলো। পরিকল্পনা ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সুচিত হয়েছিলো। শিক্ষা, শিল্প, কৃষি, বাণিজ্য– প্রতিটি ক্ষেত্রে সমৃদ্ধির সুচনা ঘটেছিলো। তিনি মানবসম্পদ রফতানিতে যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রেমিট্যান্স অভাবনীয়ভাবে সফলতা এনেছিলো, যার ধারাবাহিকতা এখনো অব্যাহত আছে। জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্রনায়কোচিত আরেকটি অধ্যায় প্রশাসনিক সংস্কার ও পুনর্বিন্যাস। ভঙ্গুর এবং দুর্নীতিগ্রস্থ আমলাতন্ত্রকে হটিয়ে পেশাদারী মনোভাবাপন্ন, নিরপেক্ষ এবং যোগ্যতর দক্ষ প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্বিন্যাস করার চেষ্টা। তিনি রাষ্ট্র পরিচালনা সর্বদা অভিজ্ঞ আমলা ও বিশেষজ্ঞদের উপর নির্ভর করে থাকতেন।

জিয়ার মতে বাংলাদেশ একটি সমজাতীয়বোধ সম্পন্ন জাতীয় রাষ্ট্র। ভাষা, ধর্ম, নৃতাত্ত্বিক গঠন, রাজনীতি, অর্থনীতি সবকিছুই প্রায় এক ও অভিন্ন হওয়া স্বত্ত্বেও ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধেও পরপরই বাঙালি-বাংলাদেমী, মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা, মুজিবনগরীয়-অমুজিবনগরীয়, স্বাধীনতার সপক্ষ-বিপক্ষ ইত্যাদির বিভাজননীতি ও কার্যক্রম গোটা জাতিকে কৃত্রিমভাবে বিভক্ত করে। রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সম্প্রদায়, লেখক, বুদ্ধিজীবীগণ এই বিভাজনকে তীব্র করে তোলেন। জিয়াউর রহমান কৃত্রিমভাবে বিভক্ত এই জাতিকে এক ও অভিন্ন সত্তায় দাঁড় করানোর প্রয়াসে বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ গ্রহণ করেছিলেন।

শুধু ভাষার ভিত্তিতে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে গ্রহণ না করে ধর্ম, বর্ণ, মুক্তিযুদ্ধ, সর্বোপরি, ভৌগলিক মানচিত্রের ভিত্তিতে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে জিয়াউর রহমান জাতীয় ঐক্য, সংহতি ও সমন্বয়ের লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োগ করেছিলেন। যেসব মাধ্যমে জনগণের ভাব, ভাষা, সমর্থন, সহযোগিতা বোঝা যায়, পরিমাপ করা যায়, সেসব মানদন্ডে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে জনগণ গ্রহণ করেছে বলে নিশ্চিত করা যায়। শাসনতন্ত্র সংশোধনী, গণভোট, নির্বাচন, প্রচার মাধ্যম, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ইত্যাদি প্রক্রিয়া অবশেষে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জন করেছে। জিয়াউর রহমানকে সৈনিক থেকে রাষ্ট্রনায়ক বলা যায়। জাতিসত্তার উত্তরণ সংকটের মতো কঠিন বিষয়কে যে বাস্তবতা দিয়ে তিনি মোকাবেলা করেছিলেন, তা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের রিতিমত হতবাক ও বিস্মিত করেছিলো। জিয়া’র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো তার সুদুরপ্রসারী তাৎপর্য এবং পরবর্তীকালে সকল রাজনৈতিক দল এর মূল চেতনাকে সচেতন এবং অবচেতনভাবে গ্রহণ এবং আত্মস্থ করা। আর কিছু না হলেও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মধ্যপন্থী ভাবধারার প্রাতিষ্ঠানিকতার কারণে বাংলাদেশের রাজনীতিতে জিয়াউর রহমান ক্রিয়াশীল থাকবেন চিরকাল। এটি তাঁর রাষ্ট্রনায়কোচিত গুণাবলির উজ্জ্বল উদাহরণ।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, আজকের দিনে সভা সমাবেশে বিভিন্নভাবে জিয়াকে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী এজেন্ট, বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রকারী ও সেনাবাহিনীর ক্যু করার একজন হোতা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। অথচ এ সবে প্রমাণ করে কোন দলিল কেহই কোথাও দাখিল করতে পারেনি বা করেনি। এ সব বিবৃতি দেশের নোংরা রাজনীতিরই একটি অংশ। এ বিষয়ে দু’দলই সমান পারদর্ষী। অন্যদিকে ইতিহাসের দিকে নজর দিলে দেখা যাবে যে, জিয়া বাংলাদেশের স্থপতি ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রিয়ভাজনদের একজন ছিলেন। তার প্রমান মিলে তাকে মুক্তিযুদ্ধের বীর উত্তম খেতাব প্রদান এবং স্বাধীনতা পরবর্তী মাত্র এক বছরে তিন তিনটি পদোন্নতি দিয়ে সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান করা। যা সেনাবাহিনীর ইতিহাসে বিরল। আবার জীবদ্দশায় রাষ্ট্রপতি জিয়া কখনো কোনো রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক সভায় বা কোনো বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু অসম্মান করে কোন কথা বলেছে বা নিজেই স্বাধীনতার ঘোষক বলেছেন এমন প্রমান কেউ হাজির করেননি বা করতে পারেননি। এমনকি জিয়ার নির্দেশে সংকলিত পনেরো খন্ডের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, তাতেও তিনি কোনরুপ ইতিহাস বিকৃত হতে দেননি। জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির আদর্শকে উজ্জিবীত করার লক্ষ্য নিয়ে বিরোধীকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন তিনি কিন্তু কখনো হত্যা করার চেষ্টা করেননি। দু:খজনক হলেও সত্যি, বর্তমান বিএনপি’র নেতৃত্বের মধ্যে জিয়া’র আদর্শের প্রতিচ্ছবি খুজে পাওয়া যায় না।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Read More

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked with *

সর্বশেষ পোস্ট

Advertising