এস,এম,কামাল হোসেন (ফ্লোরিডা, যুক্তরাষ্ট্র ): সৃষ্টিকর্তা নারীর মধ্যে একটি ম্যাজিক দিয়েছেন। এটা প্রবলভাবে পুরুষ জাতিকে আকর্ষন করে। তাদের সাথে সময় কাটাতে অন্য রকম আনন্দের ছোঁয়া লাগে। মনে জান্নাতের সুখ অনুভূত হয়।
ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়ে মায়ের কাছেই বড় হয়েছি। সুতরাং কারনে অকারনে তাকে কত যন্ত্রনা দিয়েছি, তার ইয়ত্তা নেই। তারপরেও মায়ের কাছে কত অভিযোগ! তিনি নিরবে সব সয়ে গেছেন। জায়নামাজে বসে সন্তানের জন্য দোয়া করেছেন। হয়ত সেই আশীর্বাদেই অজপাড়া গা থেকে উঠে এসে, দেশের সেরা কলেজ হয়ে, একদিন খোদ মার্কিন মুল্লুকের বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডীও পার হতে পেরেছিলাম। অথচ আমার অধিকাংশ বাল্যবন্ধু এখনো সেই গ্রামেই পড়ে আছে।
আমি রোজগার করতে শুরু করার পর, মাকে দু’বার কাছে পেয়েছিলাম। তার সাথে কাটানো প্রতিটি মূহুর্ত আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। সারাদিন তাকে ডাক্তারের অফিসে, ক্লিনিকে অথবা ল্যাবে টেস্ট করানোর পর যখন বাসায় ফিরব, তখন মায়ের আব্দার, আইসক্রীম খাবে। শুনে আমার সে কি আনন্দ! ইচ্ছে হচ্ছিল, তার পছন্দের বিভিন্ন ফ্লেবারের সকল আইসক্রীম সুপার শপ থেকে সব তুলে নিয়ে আসি। আমার ছোট্ট ভাতিজিরও আইসক্রীমের শখ। আহা, গ্রীষ্মের ভর দুপুরে, দাদি ও নাতনী একসাথে আইসক্রীম খাচ্ছে, আর আমি প্রাণভরে উপভোগ করছি। সবসময় মায়ের পায়ের কাছে বসে থাকতে ইচ্ছে হতো। রাতে তাকে খাটে শুইয়ে আমি ফ্লোরে ঘুমাতাম। কি জানি, তার কখন কি দরকার হয়। তারপর একসময় সামার শেষ হয়ে গেলো, সাথে হারিয়ে গেলো মায়ের প্রিয় আম। তিনিও টায়ার্ড, বিদেশ বিভুইয়ে। শত চেষ্টা করেও তাকে আর নিউইয়র্ক অথবা মায়ামীর মতো পরম আকর্ষনীয় শহরেও ধরে রাখা গেলো না। বাবার ভিটে, গ্রামের মাটি এবং মানুষ তার কাছে বেশি সুখ ও শান্তিদায়ক। বাধ্য হয়েই তাকে আল্লাহর ঘর ঘুরিয়ে অবশেষে নিজ গ্রামে রেখে আসতে হয়েছে। সেটাই ছিলো তার শেষ বিদায়। আর কোনদিনই তিনি আমার ছোট্ট ঘরে আনন্দের বন্যা নিয়ে আসবেন না। তবে যার কাছে আছেন, সেই প্রভু দয়াময়, তিনি নিশ্চয়ই মাকে আরও যত্নে রাখবেন, এই বিশ্বাস করি।
আমার দু’কন্যা। আর দশজন কর্মজীবী বাবা মায়ের মতো, আমার মেয়েরাও স্কুলের বাইরে সময় কাটিয়েছে বেবি সীটার, ডে কেয়ার আর আফটার কেয়ার প্রোগ্রামে। তাদের জন্য হয়ত অনেক টাকা খরচ করতে পেরেছি, কিন্তু পর্যাপ্ত সময় দিতে পারি নি। অনেক সময় মনে হয়েছে, অর্থ আর ক্যারিয়ারের কাছে আমরা ভালোবাসা কোরবানী দিয়েছি। এটাই হয়ত অধুনা জীবন।
দেখতে দেখতে বড়মেয়ে একদিন স্কলারশিপ নিয়ে চারশ মাইল দূরের ইউনিভার্সিটিতে চলে গেলো। যে কখনো রান্না করে নি, এমনকি বাঙালী খানা নিজে মুখে তুলে খেতে শেখে নি। আর সেই হঠাৎ একদিন নিজে নিজে রান্না করা, খাওয়া, বাসা পরিষ্কার রাখা, কলেজে যাওয়া সহ সকল দায়িত্ব একাই করতে যাচ্ছে। তার নতুন বাসায় সব গোছগাছ করে, যখন মেয়ের কাছ থেকে বিদায় নেব, তখন গিন্নির কান্না আর থামে না। আল্লাহ মনে হয় সকল ভালোবাসা মায়েদের অন্তরেই দিয়ে দেন।
মা ও বড়মেয়ের মধ্যে প্রতিদিন কথা হয়। আমার সাথে শুধু বৈষয়িক আলাপ। কয়েকদিন পর, মেয়ে একদিন আমাকে জিজ্ঞ্যেস করল, বাবা, তোমার কি জেল (Zelle) একাউন্ট আছে? আমি কারনটা না বুঝলেও তাকে বিশদ তথ্য দিলাম। একটু পরে দেখি, সে আমাকে একাউন্টে তিন ডলার সাতচল্লিশ সেন্ট পাঠিয়েছে। সে যখন তার বান্ধবীদের আমার ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে কিছু কিনে দেয়, তখন আবার সেই অর্থ বুঝে নিয়ে আমাকে জেল এ্যাপে ফেরত পাঠায়। সেই থেকেই চলছে আমাকে তার উল্টো অর্থপ্রেরন। আমি আর কি বলব? তারা বোকা, নাকি ফেরেশতা, সেটা জানি না। তবে এই প্রজন্ম নিঃসন্দেহে আমাদের তুলনায় অনেক উত্তম। বাবা হিসাবে আমার জন্য এরচেয়ে আনন্দ, গর্ব ও সৌভাগ্যের বিষয় আর কি হতে পারে?
আমার ছোট মেয়েকে অনেকেই আমার অবিকল কপি মনে করেন। সে দেখতে যেমন আমার মতো, চিন্তাধারার ক্ষেত্রে সে আমার চেয়েও স্বচ্ছ, তার বুঝার উপলব্ধি সমস্যার আরও গভীরে প্রোথিত। সে লিবারেল ডেমোক্রেট। বন্চিত মানুষের জন্য তার মনে অনেক দয়া, বিশেষ করে আমেরিকার মাইনরিটি থেকে শুরু করে, প্যালেস্টাইনের নির্যাতিত মানুষদের জন্য। সে তাদের অধিকারের জন্য মার্কিন মুল্লুকে লড়াইয়ে সামিল হয়, বিক্ষোভ ও সমাবেশে অংশ নেয়, ফিলিস্তিনের ঐতিহ্যবাহী কুপিয়া পরিধান করে, মাথা উঁচু করে স্কুলে যায়, স্টারবাক্স, ম্যাকডোনাল্ডস, কোকাকোলা, পেপসি সহ দখলদারদের অন্ধ সমর্থক যাবতীয় পণ্য বয়কট করে, ইত্যাদি। আমি অবাক হয়ে ভাবি, বাংলাদেশে ক’জন বাবা-মা সন্তানকে দেশ ও স্বজাতির প্রেমে উদ্বুব্ধ করেন, স্বদেশী পন্য কিনতে অনুপ্রানিত করেন, এবং ন্যায় ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করতে বলেন? বরং দেশ ও সমাজ থেকে গা বাঁচিয়ে, বিদেশী শিক্ষা ও সংস্কৃতি রপ্ত করে, বিদেশে সেটেল্ড করতে তারা ডেসপারেট। বাংলাদেশকে তাহলে কারা ঠিক করবে?
যাই হোক, গিন্নির স্বদেশ ভ্রমনের প্রেক্ষিতে ছোটমেয়ের দায়িত্ব এখন আমার কাঁধে। অন্য সকল কাজকে ছুটি দিয়ে আমি এখন মেয়ের বাটলার, ড্রাইভার, বন্ধু ও বাবা, এককথায় সবকিছু। সে প্রাইভেট ট্রান্সপোর্টকে বাদ দিয়ে আমার সাথে স্কুলে যাবে, বাসায় ফিরবে, একসাথে রান্না করবে, ব্যাকইয়ার্ড থেকে আখ কেটে এনে একসাথে খাবে, বাগানে পানি দিবে, গান রেন্জারে গিয়ে শ্যুটিং প্র্যাকটিস করবে, কেনাকাটা করবে, রেষ্টুরেন্টে খাবে, এসব আর কি। আমিও কেন জানি অন্য সবকিছু বাদ দিয়ে, তার আব্দার পূরন করে বেশি আনন্দ পাই।
বউয়ের কথা না হয় অন্য একদিন আলাপ করব। আজ শুধু মায়েদের কথাই বলি। তারা আসলেই বিধাতার শ্রেষ্ঠ নিয়ামত। স্বয়ং আল্লাহ পাক তাদের সালাম জানিয়েছেন, সম্মানিত করেছেন। সুতরাং আমরাও যেন তাদের অত্যন্ত যত্ন করি। তারা সকল রূপেই মানবকুলের জন্য জান্নাত !