728 x 90

দেশ ও জনতার শেষ আশ্রয়স্থল বাংলাদেশ সেনাবাহিনী

আব্দুল্লাহ ইউসুফ,শামীম (প্রধান সম্পাদক-সুপ্রভাত সিডনি): সমরে আমরা শান্তিতে আমরা সর্বত্র আমরা দেশের তরে- এ মূলমন্ত্র ধারণ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পরিচালিত হচ্ছে। এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্ম হয়েছিল। জন্মলগ্ন থেকেই অনেক ত্যাগ তিতিক্ষা ও চড়াই উতরাই পেরিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আজ একটি দক্ষ ও চৌকস বাহিনী হিসেবে গড়ে উঠতে সমর্থ হয়েছে। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব

আব্দুল্লাহ ইউসুফ,শামীম (প্রধান সম্পাদক-সুপ্রভাত সিডনি): সমরে আমরা শান্তিতে আমরা সর্বত্র আমরা দেশের তরে- এ মূলমন্ত্র ধারণ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পরিচালিত হচ্ছে। এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্ম হয়েছিল। জন্মলগ্ন থেকেই অনেক ত্যাগ তিতিক্ষা ও চড়াই উতরাই পেরিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আজ একটি দক্ষ ও চৌকস বাহিনী হিসেবে গড়ে উঠতে সমর্থ হয়েছে। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষার পাশাপাশি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিশ্বপরিমণ্ডলে আজ একটি অতি পরিচিত ও গর্বিত নাম। সামরিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলাসহ যে কোন অভ্যন্তরীণ সংকট নিরসনে এবং দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অকুতোভয় সদস্যরা সকল ক্ষেত্রে অসামরিক প্রশাসনকে সহযোগিতা করে যাচ্ছে।

জাতির পরম আস্থা ও ভালোবাসার প্রতীক বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী গড়ে উঠেছিল রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। দেশ প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালন ছাড়াও জাতির বিভিন্ন সংকট ও ক্রান্তিকালে যথাযথ ভূমিকা পালন ও অবদান রাখার দৃষ্টান্তে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে আজ এ দেশের আপামর জনসাধারণ গর্বিত। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর এসব সাফল্যমণ্ডিত কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে বৃহত্তর পরিসরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে যে বিশাল সম্মান বয়ে এনেছে, তা শুধু সশস্ত্র বাহিনীর নয়, বরং এ দেশের সবার অহংকার।

সেনাবাহিনী বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর স্থল শাখা। এটি বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সর্ববৃহৎ শাখা। সেনাবাহিনীর প্রাথমিক দায়িত্ব হচ্ছে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের অখণ্ডতা রক্ষা সহ বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করা এবং সব ধরনের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সহায়তায় বাংলাদেশ নৌবাহিনী এবং বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সাথে প্রয়োজনীয় শক্তি ও জনবল সরবরাহ করা। সেনাবাহিনীর সব ধরনের কর্মকাণ্ড সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। প্রাথমিক দায়িত্বের পাশাপাশি যেকোন জাতীয় জরুরি অবস্থায় বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় এগিয়ে আসতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সাংবিধানিক ভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট শুরুর মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক জনগণের উপর ঝাঁপিয়ে পরে। পাকিস্তানি বাহিনী এবং এর সহযোগী আধাসামরিক বাহিনী হাজার হাজার সামরিক-বেসামরিক মানুষ হত্যা করে। ২৬ মার্চ  বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা প্রদান করে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান। মার্চ মাসেই ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যরা বিদ্রোহ করে এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। পরবর্তীতে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) সৈন্যরাও সশস্ত্র প্রতিরোধে অংশ নেয়। সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি বেসামরিক জনগণ মিলে গড়ে তোলে মুক্তিবাহিনী। ১৭ এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয় এবং কর্নেল (অব:) মহম্মদ আতাউল গণি ওসমানীকে বাংলাদেশ বাহিনীর নেতৃত্বদানের দায়িত্ব দেয়া হয়।

মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চালিকাশক্তি ছিলেন তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাংলাদেশী অফিসার ও সৈনিকরা। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নেই পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর প্রায় ২৬ হাজার   বাংলাদেশী   অফিসার ও সৈনিক সরাসরি বিদ্রোহ করে দেশের মুক্তি সংগ্রামে অংশ নেন।

বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা পৃথিবীর অন্য দেশগুলোর চেয়ে অনেকটাই ব্যতিক্রম। আমাদের সেনাবাহিনীর জন্ম হয়েছে যুদ্ধক্ষেত্রে, মুক্তিযুদ্ধের সময়, যে যুদ্ধটি ছিল জনযুদ্ধ। সে যুদ্ধের মহানায়ক ও সুপ্রিম কমান্ডার ছিলেন জেড ফোর্স অধিনায়ক জিয়াউর  রহমান। আজ যারা সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে রয়েছেন, তারা প্রায় সবাই মুক্তিযুদ্ধের সমকালীন বা পরবর্তী প্রজন্মের। তাদের জন্য শিকড়ের সন্ধান করতে হলে ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মের কথা জানতে, শুনতে ও বুঝতে হবে। সশস্ত্র বাহিনীর আজকের প্রজন্মকে জানতে হবে, সে যুদ্ধে কৃষক-শ্রমিকের সন্তান, কুলি-মজুরসহ সাধারণ মানুষ সেনাবাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। জনযুদ্ধের ভেতরে জন্ম বলেই এ দেশের সাধারণ মানুষের আবেগ, অনুভূতি, চেতনা সব কিছুর সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীর একটা আত্মিক সম্পর্ক দৃশ্যমান।

১৯৭১ সালের ১১-১৭ জুলাই সেক্টর কমান্ডার্স কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। এই কনফারেন্সে লে: কর্নেল আব্দুর রবকে চিফ অফ স্টাফ, গ্রুপ ক্যাপ্টেন একে খন্দকারকে ডেপুটি চিফ অফ স্টাফ এবং মেজর এ আর চৌধুরীকে অ্যাসিস্ট্যান্ট চিফ অফ স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে বাংলাদেশ বাহিনী কমান্ড প্রতিষ্ঠিত হয়। কনফারেন্সে বিভিন্ন সেক্টরের গঠন এবং বিন্যাস, সেক্টরের সমস্যা, বিভিন্ন কৌশলগত দিক এবং বাংলাদেশ বাহিনীর জনবল বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা হয়। এই কনফারেন্সে বাংলাদেশকে এগারটি সেক্টরে ভাগ করা হয় এবং প্রত্যেক সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার নিয়োগ দেয়া হয়। সেক্টরের সকল কর্মকাণ্ড সেক্টর কমান্ডার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত। নিয়ন্ত্রণের সুবিধার্থে কিছু সেক্টরকে একাধিক সাব-সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল। ১০ নম্বর সেক্টর ছিল সরাসরি বাংলাদেশ বাহিনীর প্রধানের অধীনস্থ এবং এই সেক্টরের জনবল ছিল প্রধানত নৌ কমান্ডোগণ।

কনফারেন্সের পর বাংলাদেশ বাহিনী একটি দীর্ঘমেয়াদী গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে। পরবর্তীতে বাহিনীকে আবার পুনর্গঠন করা হয় এবং তিনটি ব্রিগেড আকারের সৈন্যদলে ভাগ করা হয়: কে ফোর্স, মেজর খালেদ মোশাররফ এর নেতৃত্বাধীন, ৪, ৯ ও ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে গঠিত। এস ফোর্স, মেজর কেএম শফিউল্লাহর নেতৃত্বাধীন, ২ ও ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে গঠিত। জেড ফোর্স, মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন, ১, ৩ ও ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে গঠিত।

২১ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ বাহিনীর সামরিক সদস্যদের নিয়ে। প্রতিষ্ঠার পর মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যুদ্ধের পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনী প্রথাগত যুদ্ধ শুরু করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাছে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ৯ মাসব্যাপী চলা স্বাধীনতা যুদ্ধের অবসান ঘটে এবং স্বাধীন বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয়।

মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর মুক্তি বাহিনীর সদস্যদের সেনাবাহিনীর বিভিন্ন শাখায় অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হয়। ১৯৭৪ সালে পাকিস্তান ফেরত কর্মকর্তা ও সৈনিকদের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সেনাবাহিনীতে মুক্তিবাহিনীর বেসামরিক সদস্যদের অন্তর্ভুক্তি এবং জাতীয় রক্ষীবাহিনী সৃষ্টির মত ঘটনা গুলো নিয়ে তৎকালীন সেনাবাহিনীর সদস্য এবং সরকারের মধ্যে সন্দেহ-অবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়। এই সমস্ত সন্দেহ-অবিশ্বাস এবং ভুল বোঝাবুঝি পেশাদার সেনা কর্মকর্তা এবং বিদ্যমান সরকারের মধ্যে নানা রকম মতবিরোধ সৃষ্টি করে যার ফলস্বরূপ সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তাক্ত অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়।

১৫ অগস্ট ১৯৭৫, কিছু বিপ্লবী সেনা কর্মকর্তা, এবং এনসিও গোপন পরিকল্পনা অনুযায়ী তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে ধানমন্ডিতে তার ব্যক্তিগত বাসভবনে হত্যা করে। রাষ্ট্রপতির দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে অবস্থান করায় তাদের জীবন রক্ষা পায়। হত্যাকাণ্ডের পর খন্দকার মোশতাক আহমেদ এর নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতা দখল করে। একপর্যায়ে, খন্দকার মোশতাক ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন ।

তিনমাস পর ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ এবং কর্নেল শাফায়াত জামিল এর নেতৃত্বাধীন একদল সেনা কর্মকর্তা এবং এনসিও পালটা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে খন্দকার মোশতাকের সরকারকে উৎখাত করেন। সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহ-অন্তরীণ করে রাখা হয় ।

৭ নভেম্বর  ১৯৭৫, লে: কর্নেল আবু তাহের এর নেতৃত্বে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) নিয়ন্ত্রিত এক সংক্ষিপ্ত কিন্তু খুবই সংগঠিত অভ্যুত্থান ঘটে ঢাকা সেনানিবাসে। এই অভ্যুত্থানে খালেদ মোশাররফ, এটিএম হায়দার সহ অনেক সেনা ও বিমানবাহিনী কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়। কর্নেল শাফায়াত জামিলকে জোরপূর্বক অবসরে পাঠানো হয়। কর্নেল আবু তাহের মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহ-অন্তরীণ অবস্থা থেকে মুক্তি দেন। জিয়াউর রহমান পদোন্নতি লাভ করেন এবং পরবর্তীতে তিনি সেনাপ্রধান এবং ডেপুটি প্রধান সামরিক প্রশাসক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন।

কর্নেল তাহেরকে ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে ভূমিকার জন্য মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। ।পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালে এক গণভোটের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হন। ৩০মে ১৯৮১ চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর কিছু বিপদগামী অফিসার ও বিদেশী ষড়যন্ত্রে বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান শহীদ হন।

এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে তৎকালীন সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এক নীরব অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। তিনি সংবিধান বিলুপ্ত করেন এবং দেশব্যাপী সেনা আইন জারি করেন। স্বৈরাচারী শাসন, দুর্নীতি এবং নির্বাচন জালিয়াতির মাধ্যমে তিনি ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ পর্যন্ত ক্ষমতা দখলে রাখেন। প্রচণ্ড বিক্ষোভ এবং গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ এরশাদ ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন।

১৯৭৫ সালের অভ্যুত্থানের পর জাতীয় রক্ষী বাহিনী বিলুপ্ত করে সকল জনবল সেনাবাহিনীতে যুক্ত করা হয়। সাবেক রাষ্ট্রপতি  জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বাংলাদেশ পাঁচটি সামরিক অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। পাঁচটি অঞ্চলের দায়িত্বে ছিল পাঁচটি পদাতিক  ডিভিশন। ১৯৮২ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় আসাকালীন সেনাবাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল ৭০,০০০। ১৯৮৫ সাল থেকে সেনাবাহিনী আরেকবার দ্রুত সম্প্রসারণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়। ১৯৮৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে সেনাবাহিনীর জনবল দাঁড়ায় ৯০,০০০ (অনেক পর্যবেক্ষকের মতে তা ৮০,০০০ এর কাছাকাছি ছিল) যা ১৯৭৫ সালের সংখ্যার তিনগুণ।এই সময়ে সেনাবাহিনীর পদাতিক ডিভিশন সংখ্যা সাতে উন্নীত করা হয়।

১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মিত্র বাহিনীর অধীন বহুজাতিক বাহিনীর অংশ হিসেবে অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম-এ অংশগ্রহণ করে। এটি ছিল জাতিসংঘ মিশনের বাইরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিদেশের মাটিতে প্রথম মোতায়েন। সেনাবাহিনী যুদ্ধ শেষে কুয়েতে থাকা মাইন অপসারণ করতে এক দল ইঞ্জিনিয়ার মোতায়েন করে। ওকেপি (অপারেশন কুয়েত পনরগঠন) বাংলাদেশ একটা কন্টিঞ্জেন ছিল,অপারেশন কুয়েত পুনর্গঠন (ওপিকে) এর আওতায় এই মোতায়েন সম্পন্ন হয় ।

৭ নভেম্বর  ১৯৭৫, লে: কর্নেল আবু তাহের এর নেতৃত্বে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) নিয়ন্ত্রিত এক সংক্ষিপ্ত কিন্তু খুবই সংগঠিত অভ্যুত্থান ঘটে ঢাকা সেনানিবাসে। এই অভ্যুত্থানে খালেদ মোশাররফ, এটিএম হায়দার সহ অনেক সেনা ও বিমানবাহিনী কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়। কর্নেল শাফায়াত জামিলকে জোরপূর্বক অবসরে পাঠানো হয়। কর্নেল আবু তাহের মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহ-অন্তরীণ অবস্থা থেকে মুক্তি দেন। জিয়াউর রহমান লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন এবং পরবর্তীতে তিনি সেনাপ্রধান এবং ডেপুটি প্রধান সামরিক প্রশাসক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন।

কর্নেল তাহেরকে ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে ভূমিকার জন্য মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। ।পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালে এক গণভোটের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হন। ৩০ মে ১৯৮১ চট্টগ্রামে ভারতের গভীর ষড়যন্ত্রে জিয়াউর রহমান নিহত হন।

এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে তৎকালীন সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এক নিরব অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। তিনি সংবিধান বিলুপ্ত করেন এবং দেশব্যাপী সেনা আইন জারি করেন। স্বৈরাচারী শাসন, দুর্নীতি এবং নির্বাচন জালিয়াতির মাধ্যমে তিনি ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ পর্যন্ত ক্ষমতা দখলে রাখেন। প্রচণ্ড বিক্ষোভ এবং গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ এরশাদ ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন।

১৯৭৫ সালের অভ্যুত্থানের পর জাতীয় রক্ষী বাহিনী বিলুপ্ত করে সকল জনবল সেনাবাহিনীতে যুক্ত করা হয়।  জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বাংলাদেশ পাঁচটি সামরিক অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। পাঁচটি অঞ্চলের দায়িত্বে ছিল পাঁচটি পদাতিক  ডিভিশন। ১৯৮২ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় আসাকালীন সেনাবাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল ৭০,০০০। ১৯৮৫ সাল থেকে সেনাবাহিনী আরেকবার দ্রুত সম্প্রসারণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়। ১৯৮৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে সেনাবাহিনীর জনবল দাঁড়ায় ৯০,০০০ (অনেক পর্যবেক্ষকের মতে তা ৮০,০০০ এর কাছাকাছি ছিল) যা ১৯৭৫ সালের সংখ্যার তিনগুণ।এই সময়ে সেনাবাহিনীর পদাতিক ডিভিশন সংখ্যা সাথে উন্নীত করা হয়।

১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মিত্র বাহিনীর অধীন বহুজাতিক বাহিনীর অংশ হিসেবে অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম-এ অংশগ্রহণ করে। এটি ছিল জাতিসংঘ মিশনের বাইরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিদেশের মাটিতে প্রথম মোতায়েন। সেনাবাহিনী যুদ্ধ শেষে কুয়েতে থাকা মাইন পরিষ্কার করতে এক দল ইঞ্জিনিয়ার মোতায়েন করে। অপারেশন কুয়েত পুনর্গঠন (ওপিকে) এর আওতায় এই মোতায়েন সম্পন্ন হয়।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গঠন কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর সেনাবাহিনীর অনুরূপ। তবে যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনীর কৌশলগত পরিকল্পনা প্রণালী, প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাপনা কৌশল এবং এনসিও শিক্ষা ব্যবস্থা আত্মীয়করণের দিয়ে এই অবস্থার বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটছে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বহুবছর ধরেই জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে। ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে প্রথমবারের মত জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে পাঠানো হয়। সেবছর সেনাবাহিনীকে ইরাকে এবং নামিবিয়ায় মোতায়েন করা হয়।

পরবর্তীতে উপসাগরীয় যুদ্ধ শেষে জাতিসংঘ মিশনের আওতায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী একটি যান্ত্রিক-পদাতিক বহর প্রেরণ করে। সেই থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ২৫টি দেশে ৩০টি শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নিয়েছে।এই দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে অ্যাঙ্গোলা, নামিবিয়া, কম্বোডিয়া, সোমালিয়া, সুদান, ইরিত্রিয়া, উগান্ডা, রুয়ান্ডা, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, মোজাম্বিক, যুগোস্লাভিয়া, লাইবেরিয়া, হাইতি, তাজিকিস্তান, পশ্চিম সাহারা, সিয়েরা লিওন, কসভো, জর্জিয়া, পূর্ব তিমুর, কঙ্গো, আইভোরি কোস্ট এবং ইথিওপিয়া।

বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী ফোর্সেস গোল ২০৩০ নামক দীর্ঘমেয়াদি আধুনিকায়ন পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি বড় ধরনের সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়ন কর্মকাণ্ড চলমান। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী পুরো বাহিনীকে উত্তর, দক্ষিণ ও কেন্দ্রীয় নামক তিনটি কোরে ভাগ করা হচ্ছে।

বিশেষ অপারেশন সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ২ প্যারাকমান্ডো ব্যাটালিয়ন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এই ব্যাটালিয়ন এবং পূর্বের ১ প্যারাকমান্ডো ব্যাটালিয়ন নিয়ে গঠিত হয়েছে দেশের একমাত্র প্যারা কমান্ডো ব্রিগেড। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ২০১১ সালে চীন থেকে ৪৪টি এমবিটি-২০০০ ট্যাংক ক্রয় করেছে। এই ক্রয় ছিল দেশটির ইতিহাসের প্রথম বারের মত ট্যাংক ক্রয়।

গোলন্দাজ বহরের আধুনিকায়নের জন্য সার্বিয়া থেকে ৩৬ টি নোরা বি-৫২ ১৫৫মিমি স্বচালিত কামান কেনা হয়েছে। সক্ষমতা আরও বাড়াতে ৪৯টি ডব্লিউএস-২২ মাল্টিপল লাঞ্চ রকেট সিস্টেম কেনা হয়েছে। ট্যাংক বিধ্বংসী সক্ষমতা বাড়াতে কেনা হয়েছে রাশিয়ান মেতিস এম-১ ট্যাংক বিধ্বংসী গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র এবং চীনা পিএফ-৯৮ ট্যাংক বিধ্বংসী অস্ত্র। আকাশ প্রতিরক্ষা সক্ষমতার উন্নয়নে কেনা হয়েছে দুই রেজিমেন্ট এফএম-৯০ স্বল্প পাল্লার বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র।

লিংক 

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পদাতিক সেনাদের আধুনিকায়নের জন্য ইনফ্যান্ট্রি সোলজার সিস্টেম নামক উচ্চাভিলাষী আধুনিকায়ন কার্যক্রম শুরু করেছে। এই কার্যক্রমের অংশ হিসেবে প্রত্যেক পদাতিক সৈন্যকে নাইট ভিশন গগলস, ব্যালিস্টিক হেলমেট, চোখ সুরক্ষা সরঞ্জাম, বুলেটপ্রুফ ভেস্ট, ব্যক্তি-থেকে-ব্যক্তি যোগাযোগের যন্ত্র, হাতে বহনযোগ্য জিপিএস যন্ত্র এবং কলিমেটর সাইট যুক্ত বিডি-০৮ রাইফেল দ্বারা সজ্জিত করা হচ্ছে। ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নতুন অ্যাসল্ট রাইফেল ও সাবমেশিন গান ক্রয়ের মূল্যায়ন প্রক্রিয়া শুরু করেছে।

বাংলাদেশ সরকার আর্মি এভিয়েশন গ্রুপ এর জন্য একটি পুনর্গঠন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী আর্মি এভিয়েশন গ্রুপের নাম পরিবর্তন করে আর্মি এভিয়েশন রাখা হবে এবং এর জনবল ২০৪ থেকে বাড়িয়ে ৭০৪ করা হবে। ২০২১ সাল নাগাদ আর্মি এভিয়েশনের মোট বিমানের সংখ্যা হবে ২৬।

২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নদীভিত্তিক অপারেশনে কমান্ড সেন্টার হিসেবে ব্যবহারের জন্যএকটি ৩০ মিটার দৈর্ঘ্যের কমান্ড শিপ ক্রয়ের টেন্ডার দেয়া হয়েছে। সেনাবাহিনী ২০১৭ সালে দুইটি ল্যান্ডিং ক্রাফট ট্যাংক ক্রয়ের জন্য ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের সাথে চুক্তি সাক্ষর করেছে। ৬৮ মিটার দৈর্ঘ্যের এই জাহাজগুলো ৮টি ট্যাংক বহনে সক্ষম হবে। ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে সেনাবাহিনী দুইটি ট্রুপস ক্যারিয়িং ভেসেল এর জন্য দরপত্র আহ্বান করে। ৫৫ মিটার লম্বা এই জাহাজ গুলোকে ২০০ সৈন্য বহনে সক্ষম হতে হবে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সবচেয়ে পছন্দনীয় ব্যাপারটা হলো তাদের ধৈর্য -শৃঙ্খলা। আর একটা ব্যাপার হলো তাদের শান্ত এবং ঠান্ডা মাথায় কাজ করার কৌশল।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের মাধ্যমে লক্ষ্য অর্জিত হলেও এ দেশের সশস্ত্র বাহিনীর অগ্রযাত্রা কখনো থামেনি। কখনো থামেনি এ দেশের মাটি ও মানুষের প্রয়োজনে সশস্ত্র বাহিনীর কর্মতৎপরতা ও আত্মত্যাগ। তাই তো দেশপ্রেম ও জাতীয় কর্তব্য পালনের যে মহান দৃষ্টান্ত স্থাপনের মাধ্যমে জন্মেছিল আমাদের সশস্ত্র বাহিনী, আজও জাতীয় প্রয়োজনে বিভিন্ন দুর্যোগ ও ক্রান্তিকালে সর্বদাই এ দেশের সবার নির্ভরতার প্রতীক বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী। এ দেশের সশস্ত্র বাহিনী শুধু দেশে নয়, বিদেশেও জাতিসংঘ বাহিনীর বিভিন্ন শান্তি রক্ষা মিশনে এবং অন্যান্য কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রমাণ করেছে তাদের পেশাগত দক্ষতা।

গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখতে সর্বদা সহযোগিতা করে আসছে। জাতিসংঘ মিশনে সেনাবাহিনীর অবদান সর্বজন স্বীকৃত এবং বিশ্ব দরবারে সুপ্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বিশ্ববাসীর কাছে একটি আধুনিক ও সময়োপযোগী সুশৃঙ্খল বাহিনীতে পরিণত হয়েছে।

মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বময় ভূমিকা ও পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আর এক মহৎ অর্জন হলো, শান্তিরক্ষা মিশনে (পিস কিপিং অপারেশন) অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখা। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সামরিক কৃতিত্ব ও অর্জনসমূহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আজ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্রবাহিনী দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে যেমন- দেশের মানুষের আস্থা অর্জন করেছে, তেমনি বিদেশে পেশাদারিত্ব ও নিবেদিত প্রাণ মনোভাবের মাধ্যমে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করে বিদেশিদের মন জয় করেছে।

দুর্গম রুক্ষ আর বন্ধুর সব প্রান্তরে অজস্র বিনিদ্র রাত আর রক্ত-ঘাম ঝরা দিন কাটিয়েছেন বাংলার শান্তিরক্ষীরা। পরিবারের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা, পানি আর খাবারের কষ্ট, সশস্ত্র-সন্ত্রাসীদের রক্তচক্ষু আর এইডস-ইবোলার ঝুঁকি সঙ্গী করে তারা পথ চলেছেন। বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশও দেশের জনগণের ভাবমূর্তি অক্ষুন্নত রাখতে নিরলস পরিশ্রম এবং ত্যাগ স্বীকার করে যাচ্ছেন তারা। জাতি সংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের ভূমিকা খুবই গৌরবের। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা কাজ করছেন সাহস, দৃঢ়তা, শৃঙ্খলা, আত্মত্যাগের ব্রত নিয়ে সেখানে যুক্ত হয়েছে মানবিকতা।

হাইতি থেকে পূর্বতিমুর, লেবানন থেকে কঙ্গো পর্যন্ত বিশ্বের প্রায় সকল সংঘাতপূর্ণ এলাকায় বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের পদচিহ্ন রয়েছে। লাল-সবুজের পতাকা উড়ছে আফ্রিকার গহিন বন থেকে শুরু করে উত্তপ্ত মরুভূমিতে। সংঘাতময় সমুদ্র এলাকায়ও উড়ছে বাংলাদেশের শান্তির পতাকা। বসনিয়ার তীব্র শীত, সাহারা মরুভূমির দুঃসহ গরম ও পূর্ব এশিয়ার ক্লান্তিকর আর্দ্রতার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা। ধর্ম, গোত্র, বর্ণ, রাজনৈতিক আদর্শ ও আঞ্চলিক বৈষম্যকে পিছনে ফেলে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা নিজেদের উৎসর্গ করেছেন বিশ্বমানবতার সেবায়। নীল হেলমেট মাথায় নিয়ে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা ছড়িয়ে আছেন বিশ্বের প্রায় সবখানে। শান্তিরক্ষীদের পেশাগত দক্ষতা, অঙ্গীকার, নিরপেক্ষতা, সততা ও মানবিক কারণে বিশ্বের সকল মানুষের কাছে আজ তারা দৃষ্টান্ত স্বরূপ।

জাতিসংঘ স্বীকৃত শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের প্রথম পদযাত্রা শুরু। ১৯৮৮ সালে ইরান-ইরাক (ইউনিমগ) শান্তি মিশনে যোগদানের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৫ জন চৌকস অফিসার প্রথম জাতিসংঘের পতাকাতলে একতাবদ্ধ হয়। বাংলাদেশ পুলিশ ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ পরিবারের সদস্য হয় নামিবিয়া শান্তি মিশনের (ইউনিকম) মাধ্যমে। বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী বসনিয়ার শান্তি মিশনে (আনপ্রফর) যোগ দেয় ১৯৯৩ সালে।

ইরান-ইরাকের মধ্যে প্রায় ৮ বছরব্যাপী (১৯৮০-১৯৮৮) রক্তক্ষয়ী ভ্রাতৃযুদ্ধ বন্ধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, জাতিসংঘের উদ্যোগে (আগস্ট ১৯৮৮), ‘ইউনাইটেড নেশনস ইরান-ইরাক মিলিটারি অবজারভার গ্রুপ’ (ইউনিমগ) নামে একটি জাতিসংঘ শান্তি মিশন (অবজারভার মিশন) গঠিত হয়।

১৯৮৫ সালে স্টাফ কলেজের তৎকালীন কমান্ড্যেন্ট মেজর জেনারেল আব্দুল মান্নাফ আশ্চর্য্যরকম দূরদর্শী এক পদক্ষেপ নিলেন। স্টাফ কলেজের পাঠ্যসূচীতে ১৯৮৫ সালেই শান্তিরক্ষা অপারেশন বা পিস কিপিং অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। সে এক অন্য ইতিহাস। অর্থাৎ বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীতে শান্তিরক্ষা বিষয়ক প্রশিক্ষণ পূর্ব থেকেই প্রচলিত ছিল।

ইউনিমগ’ মিশনটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য একটি ঐতিহাসিক মিশন। এই মিশনেই প্রথম বারের মতো বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৩১ জন সামরিক পর্যবেক্ষক শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ করেন। এই পর্যবেক্ষক দলটি প্রথম কোন শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ করে প্রশংসনীয় কর্মদক্ষতা ও সাহসিকতা প্রদর্শনের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত করেন।

১৯৯০ সালে ইরাকিদের কুয়েত আগ্রাসনের পরিপ্রেক্ষিতে, বাংলাদেশ সৌদি আরবে (অপারেশন ডেজার্ট শিল্ড ও ডেজার্ট স্টের্ম) ২২৩২ জনবল বিশিষ্ট সেনাবাহিনীর একটি কন্টিনজেন্ট (অপারেশন মরুপ্রান্তর) পাঠায়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এটি ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য একটি বিশাল এক্সপোজার, যা পরবর্তীকালে জাতিসংঘ মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ব্যাপক আকারে নির্বাচনের ক্ষেত্রে অবদান রেখেছিল।

বিশ্বের বিভিন্ন যুদ্ধ বিধ্বস্ত অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে জাতিসংঘের বিশ্বস্ত ও পরীক্ষিত বন্ধু হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। পরিবর্তিত বিশ্বের ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা বিচক্ষণতা, পেশাদারিত্ব এবং বুদ্ধিদীপ্ত উপায়ে সংশ্লিষ্ট দেশের স্থানীয় প্রশাসনকে সর্বদা সহায়তা করা যাচ্ছে। যুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বে একটি সুন্দর ও বসবাস-উপযোগী সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলার শান্তিসেনারা একনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত (২০২৪) ৪৩ টি দেশে/অবস্থানে জাতিসংঘের ৬৩ টি শান্তি মিশনে বাংলাদেশের প্রায় ১ লাখ ৯৪ হাজার ৮৫৬ জন শান্তিরক্ষী অংশগ্রহণ করেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষীর সংখ্যা ১ লাখ ৫৭ হাজার ১৮৪ জন। বর্তমানে মোট ৬ টি দেশে সর্বমোট ৬ টি মিশনে ৪ হাজার ৭০ জন সেনা সদস্য নিয়োজিত আছেন।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষীরা মিশন এলাকায় বিবদমান দলকে নিরস্ত্রীকরণ, মাইন অপসারণ, সুষ্ঠু নির্বাচনে সহায়তা দান, সড়ক ও জনপথ এবং স্থাপনা নির্মাণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। সেনাবাহিনী প্রায় দুইশত আর্মাড পার্সোনাল ক্যারিয়ার, অস্ত্র ও গোলাবারুদ এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক যানবাহন নিয়ে তাদের অপারেশন পরিচালনা করছেন। মাঠ পর্যায়ে শান্তিরক্ষা অভিযানে অংশগ্রহণের পাশাপাশি, জাতিসংঘ সদরদপ্তরের ডিপার্টমেন্ট অব পিস কিপিং অপারেশনেরও স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সেনা কর্মকর্তা অংশগ্রহণ করে থাকেন। গত ৩৬ বছর ধরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা অসামান্য সাফল্যের ইতিহাস তৈরি করেছেন।

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নে বাংলাদেশ এখন এক গর্বিত অংশীদার। শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশ একটি ব্রান্ড। শান্তিরক্ষা মিশনের প্রতি দশজন সদস্যের ভেতর একজন সদস্য এখন বাংলাদেশের। বাংলাদেশের শান্তি রক্ষীদের পেশাগত দক্ষতা, নিরপেক্ষতা, সততা ও মানবিকতার কারণে বিশ্বের মানুষের কাছে আজ তারা দৃষ্টান্তস্বরূপ। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছে ।

বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের অবদান আজ সারা বিশ্বে স্বীকৃত। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান বলেছেন- জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ একটা আদর্শ বা মডেল সদস্য। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে এখন নেতৃত্ব স্থানীয়।

প্রতিটি সেনা সদস্য সেখানে দেশের একেকজন প্রতিনিধি/শান্তিদূত। আইভরি কোস্টে স্থানীয় জনগণ তাদের একটি গ্রামের নাম রেখেছে রূপসি বাংলা। হাইতিতে একটি শিশুর নাম বাংলাদেশ। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের নামে সড়কের নামকরণ করা হয়েছে, যা শান্তিরক্ষীদের প্রতি দেশগুলোর জনগণের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা গড়ে তুলেছেন বাংলাদেশ মৈত্রী স্কুল, বাংলাদেশ সেন্টার। সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি ও প্রাপ্তি হলো যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশসমূহের সাধারণ মানুষের মুখে ফুটিয়ে তোলা হাসি ও তাদের ভালোবাসা।

২০০৯ সাল থেকে সশস্ত্র বাহিনীর নারী সদস্যগণ জাতিসংঘ মিশনে অংশগ্রহণ করে আসছেন। বর্তমানে সশস্ত্র বাহিনীর ৩৭৩ জন ও বাংলাদেশ পুলিশের ১২০ জন নারী সদস্য মিশন এলাকায় দায়িত্ব পালন করছেন।

এ পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১০ জন লে. জেনারেল/মেজর জেনারেল পদবির উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা জাতিসংঘ শান্তি মিশনের সর্বোচ্চ সামরিক পদ অর্থাৎ ফোর্স কমান্ডার/চিফ মিলিটারি অবজারভার এর দায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশের মুখ উ্জ্জ্বল করেছেন।

শান্তিরক্ষী ও বিভিন্ন ইকুইপমেন্ট পাঠিয়ে বাংলাদেশ প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। শান্তিরক্ষীদের বেতন-ভাতা এবং ক্ষতিপূরণের হার বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীও পুলিশ সদস্যদের জন আকর্ষণীয়। মিলিটারি কনটিনজেন্টের অস্ত্র, সরঞ্জাম, যানবাহন, তৈজসপত্রের জন্য জাতিসংঘ কর্তৃক অর্থ পরিশোধ (রিইমবার্সমেন্ট) করা হয়।

বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা বিশ্বের সর্বত্র দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরিতে সাহায্য করেছেন এবং বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারে ভূমিকা রাখছেন।

পিস কিপিং এখন বাংলা সাহিত্যে লেখালেখির নতুন ও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বিষয়। সাম্প্রতিককালে শান্তিরক্ষা অপারেশনে অভিজ্ঞতার উপর চমৎকার বেশ কিছু (প্রায় ৫০টি বই) লেখা এসেছে। মূলত শান্তিরক্ষীগন জাতিসংঘ মিশনে তাদের বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতার উপর ঐ বইগুলো লিখেছেন। এটি নিঃসন্দেহ বাংলা সাহিত্যের নতুন দিগন্ত।

বর্তমানে শান্তি মিশনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা (অধিকাংশই সেনাবাহিনীর) জাতিসংঘের অসামরিক কর্মকর্তা হিসেবে চমৎকার অবদান রাখছেন। ইন্টারন্যাশনাল সিভিল সার্ভিস কমিশনের অধীনে বর্তমানে প্রায় ৫০ জনেরও বেশি অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা বিভিন্ন শান্তিমিশনে অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন।

 

বিবর্তনের ধারায় পিস-কিপিং এ অনেক পরিবর্তন এসেছে ও বতৃমানে ইন্টিগ্রেটেড অথবা মালটি ডাইমেনশনাল শান্তিরক্ষা মিশনগুলো দিন দিন জটিল ও চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠছে। বর্তমানে ‘ডিজিটাল পিস কিপিং’ ও ‘সাইবার পিস কিপিং’ এর বিষয়গুলো আলোচিত হচ্ছে। এ ছাড়াও আলোচনায় আছে ৪র্থ প্রজন্মের ‘রোবাস্ট পিস কিপিং’-এর বিষয়টি।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য জাতিসংঘের মতো একটি বহুজাতিক পরিবেশে কাজ করার সুযোগ অনেক ব্যাপৃত। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এ ধরনের আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অংশগ্রহণের কারণে সংগঠিত সব নীতি ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের প্রত্যক্ষ অংশীদার হতে পারছে, ঠিক তেমনি শান্তিরক্ষায় নিয়োজিত সেনাসদস্যরা কর্মসূত্রে বিভিন্ন দেশের সেনা সদস্যদের সঙ্গে কাজের প্রয়োজনে যোগাযোগ ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের সুযোগ পাচ্ছেন।

শান্তিরক্ষা মিশনগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য পরোক্ষ আর্থিক সুবিধাও তৈরি করেছে, বিশেষ করে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের জন্য কৃষি ও ওষুধ খাতগুলোয় নতুন বাজার সৃষ্টি করেছে। উদাহরণস্বরূপ, বর্তমানে বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে কৃষিজমি লিজ নিয়ে খামার স্থাপন করেছে, যা বাংলাদেশ এবং লিজ প্রদানকারী দেশ উভয়ের খাদ্য চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে এবং একই সঙ্গে তা উভয় দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

শান্তিরক্ষা মিশনে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থেকে সেনা প্রেরণের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এবং অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে নিজ দায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য ভবিষ্যতের সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচন করেছে বাংলাদেশের শান্তিসেনারা।

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে সেনাবাহিনীর জন্ম। আমাদের মধ্যে কয়জন আছে যারা মুক্তিযুদ্ধকে সামরিক দিক থেকে বিশ্লেষণ করতে জানি? যদি জানতাম তাহলে বুঝতে পারতাম মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সেনাবাহিনীর ভূমিকা গেরিলাদের থেকে কত আলাদা ছিল এবং এর গুরুত্ব কেমন ছিল। আমাদের দেশে সেনাবাহিনী নিয়ে যত বিদ্বেষ, যত ঘৃণা পৃথিবী্র আর কোথাও এমনটি নেই। এত ঘৃণা কেন? কেনই বা এত রাগ? আপনারা কি জানেন, স্বাধীনতার পরও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সেনাসদস্য তাদের বীরত্বের জন্য বীর উত্তম, বীর বিক্রম, বীর প্রতীক ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন? পার্বত্য এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় অনেককে নিজের জীবন বিসর্জন দিতে হয়েছে? আমি জানি দেশের ৯৫ ভাগ মানুষ এ সব তথয় জানে না, কারণ আমাদের সেনাবাহিনীর প্রচার বিমুখতা এবং আমাদের মিডিয়ার সেনাবিদ্বেষী মনোভাব। অথচ দেখুন ভারতে যখন হোটেল তাজ-এ অপারেশন পরিচালনা করতে গিয়ে একজন অফিসার প্রাণ হারালেন তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠান টিভিতে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছিল।বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে কত মায়ের বুক খালি হয়েছে, কত বাবা ছেলে হার হয়েছে, কত সন্তান তাদের বাবাকে হারিয়েছে। কত স্ত্রী তাদের স্বামীকে হারিয়েছে , কত লাশ বাক্স বন্দী হয়ে দেশে ফিরেছে -এর খবর কেউ রাখেন ?

সেনাবাহিনীতে সরকারি সম্পদ রক্ষা করার পদ্ধতি অন্য কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানে বিদ্যমান কিনা তা আমার জানা নেই। পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং রাঙামাটির সশস্ত্র বিদ্রোহ দমনে আমাদের সেনাদের দক্ষতার তুলনা নেই। সীমান্ত ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, পাশাপাশি দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের পবিত্র শপথ প্রতিটি সেনাবাহিনীর সদস্যের অন্তর আত্মায় বিরাজমান।

 

বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, যা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত একটি সংস্থা, সেটিকে কৌশলে ধ্বংস করার জন্য আওয়ামী লীগ সরকার লম্বা সময় ধরে চেষ্টা করে এসেছে। বিভিন্ন উপায়ে সেনাবাহিনীকে অপমানিত করা হয়েছে, তাদের প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়েছে, এমনকি একটি সাধারণ পুলিশ সদস্যের মাধ্যমে চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর চৌকস অফিসারকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকারী হিসেবে ভারতীয় গোয়েন্দা সদস্য ও নাগরিক ওসি প্রদীপের নাম প্রমাণিত হয়েছে। এছাড়াও, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ধ্বংস করার জন্য ভারতীয় গোয়েন্দাদের সহায়তায় পিলখানায় একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করা হয়েছে, যা পুরোপুরি বলিউড স্টাইলের এক ধরনের নির্মম ঘটনা।

বাংলাদেশের অমূল্য সম্পদ, প্রায় ৫৭ জন সেনাবাহিনীর চৌকস অফিসারকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়। ফ্যাসিস্ট-খুনি হাসিনার নির্দেশনায় তথাকথিত বিদ্রোহীরা সেনাবাহিনীর অফিসারদের তালিকা সংগ্রহ করে। ভারতীয় হত্যাকারীরা আওয়ামী লীগের নেতাদের সহযোগিতায় পিলখানায় ফিরে গিয়ে তালিকা ধরে ধরে এক এক করে সকল অফিসারকে হত্যা করে। একমাত্র একজন অফিসার, যিনি বাগানের মালির কাপড় পরিধান করে এবং খালি গায়ে দেয়াল টপকিয়ে বের হতে সক্ষম হন। পরবর্তীতে, খুনি হাসিনা সেনানিবাসে যাওয়ার পর ওই প্রত্যক্ষদর্শী সব কিছু ফাঁস করে দেন, যা ছিল অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও মর্মান্তিক। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ভারতকে বিক্রি করে নিজের দেশের সাথে বেঈমানি করার ইতিহাস পৃথিবীতে খুবই বিরল।

২০০১ সালের এপ্রিল মাসে কুড়িগ্রামের রৌমারিত সীমান্ত যুদ্ধে বিডিআর বিএসএফ এর ১৫০ জন জোয়ানকে হত্যা করে।এর আগে পাদুয়ার যুদ্ধে ১৫জন বিএসএফকে হত্যা করে বিডিআর। এই ঘটনার পর ভারতের ডিফেন্স মিনিস্টার জসবন্ত সিং উত্তপ্ত লোকসভায় জানান দেন এ ঘটনার বদলা নেয়া হবে।

১৯৭১ সালে যে সব শর্তে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত সামরিক সাহায্য দেয় তার অন্যতম ছিল “Frontier Guards will be disbanded” (CIA Report SC 7941/71). অর্থাৎ বাংলাদেশের কোনো বর্ডার গার্ড থাকবে না। কিন্তু স্বাধীনতার পরে অজ্ঞাত কারণে পাকিস্তান রাইফেলস বালাদেশ রাইফেলসে (বিডিআর) রূপ নেয়। বিডিআর বাহিনীটি ছিলো আধাসামরিক বাহিনী, যার মূল কমান্ড ও ট্রেনিং ছিলো সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের হাতে। অন্যদিকে ভারতের বিএসএফ ছিলো সিভিল বাহিনী, যাদের ট্রেনিং, জনবল সবই ছিলো নিম্নমানের। এ কারণে বর্ডারে কোনো যু্দ্ধ হলে তাতে বিডিআর সামরিক পেশাদারিত্ব দিয়ে সবসময় জিতে আসতো ।

ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা “র” এর প্রত্যক্ষ মদদে এবং তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান মঈন ইউ আহমেদের পরোক্ষ সহায়তায় এই হত্যাকান্ড সংগঠিত হয়। মঈন উদ্দিন এবং ফকরুদ্দিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মঈন উদ্দিন ভারত সফরে গেলে সে সেনাসরকারের স্থায়ীত্বের প্রস্তাব করে।কিন্তু ভারত সরকার তাতে রাজি ছিল না। তারা মঈনকে প্রস্তাব করে, তোমার নিরাপদ পুনর্বাসন ব্যবস্থা করা হবে, তুমি আওয়ামীলীগকে ক্ষমতায় বসাও। ভারতের প্ল্যান অনুযায়ী বিডিআর বিদ্রোহের ডাল -ভাত নাটক সাজানো হয়। অতঃপর,আওয়ামিলীগকে ক্ষমতায় বসিয়ে বিডিআর বিদ্রোহের পর্দার আড়ালের কুশীলবের ভূমিকা পালন করেন মঈন ইউ আহমেদ। যার কারণে, নিহত সেনা অফিসারদের জানাজা পড়তে গেলে কয়েকজন অফিসার তাকে চেয়ার নিয়ে মারতে যায়।

জেনারেল মইন উ আহমেদ: তৎকালীন সেনাপ্রধান ও ১/১১র প্রধান কুশীলব। ২০০৮ সালের গোড়ার দিকে ভারত সফর করে মইন চেয়েছিলেন পূর্ন ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ভারতীয় সমর্থন। ভারত রাজী হয়নি, বরং আওয়ামীলীগকে ক্ষমতায় আনার লক্ষে মইনকে কাজ করতে বলে, বিনিময়ে সেফ প্যাসেজ পাবে কুশীলবরা। উপায়ান্তর না দেখে মইন রাজী হয় এবং ২৯ ডিসেম্বর পূর্বপরিকল্পিত ফলাফলের নির্বাচনে ক্ষমতার পালাবদল ঘটায়। মইনের বদলে আসেন হাসিনা! ওয়ান ইলেভেনের খলনায়করা যে সব রাজনীতিবিদদের অত্যাচার করেছে, তাদের বিচারের জন্য ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে সংসদে প্রবল দাবি ওঠে। তখন সেনাবাহিনীর চাপের মুখে জেনারেল মইন নিজে দেখা করেন প্রধানমন্ত্রী হাসিনার সাথে সংসদ অফিসে। এরপর শেখ হাসিনা ধমকে দেন মখা আলমগীর, আবদুল জলিলদের, যাতে করে সেনাবাহিনীর বিচারের দাবি আর না তুলে। হাসিনা এ সময় হুঁশিয়ার করেন, “কিভাবে ক্ষমতায় এসেছি, সেটা কেবল আমিই জানি।” অন্যদিকে ঐ সময়ই ভারত তার প্লানমত এগিয়ে যায় বিডিআর অপারেশনে। মইনকে বলা হয় প্রয়োজনীয় সাপোর্ট দিতে। মইন তার  দু’বছরের অপকর্মের সাক্ষী আর্মি অফিসারদের আগে থেকেই পোস্টিং দিয়ে জড়ো করে বিডিআরে। এদের নিধন করা হলে মইনের অপকর্মের সাক্ষী আর পাওয়া যাবে না। ফলে মইনের বিরাট প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল এই হত্যাযজ্ঞ। অন্যদিকে এত সেনা অফিসার নিহত হলে ১/১১ নিয়ে সেনাবাহিনী তথা মইনের বিরুদ্ধে রাজনীতিবিদরা আর মুখ খুলবে না। এতকাল আর্মির রদ্দিমালগুলো যেতো বিডিআরে। কিন্তু এবারে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র- পরিকল্পিতভাবে অনেক চৌকশ অফিসার একসাথে পাঠানো হয় বিডিআরে। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মাত্র ২ মাস আগে গুলজারকে স্ট্যাণ্ড রিলিজ করে বিডিআরে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়। রাইফেলস সপ্তাহের আগেই কানাঘুষা শুরু হয়- ২৫ তারিখে বিদ্রোহ হবে। তাই অনেক অফিসার নানা অযুহাত দিয়ে ছুটিতে চলে যায়। সেনাপ্রধান মইনের পিলখানা হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ছিল, যার প্রমাণ মেলে ঘটনার সাথে সাথেই আক্রান্ত ডিজি শাকিল ও অফিসাররা মইনকে ফোনে জানায়। মইন আশ্বাস দেন সেনা পটাচ্ছি। অথচ তিনি কোনো ব্যবস্থা নেন নি, সময় ক্ষেপণ করে হত্যার সুযোগ তৈরি করে দেয়। ম্ইন চলে যায় যমুনায় প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে। তেজগাওয়ে এয়ারফোর্স রেডি, আর্মি রেডি সেনিাবাসে। কিন্তু হুকুম আসে না। বিকালে কিছু সেনা ও যানবাহন ধানমন্ডি পর্যন্ত পৌঁছে গেলেও অপারেশনের অনুমতি দেয়নি হাসিনা ও ম্ইন। ঘটনার ৪ দিন পরে ১ মার্চে হাসিনা সেনাকুঞ্জে গেলে মইন সেনা অফিসারদের ব্যাপক অসন্তোষের মুখে পরেন।

২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি হাসিনা সরকারের মোক্ষম সময়টিকে বেছে নেয়া হয়। বিডিআর সৈনিকদের দাবিদাওয়ার আড়ালে মুল প্লানটি বাস্তবায়নের জন্য মোট ৬০ কোটি রুপী বরাদ্দ করা হয়। এর মধ্যে পিলখানায় ১৫ থেকে ১৭ কোটি টাকা বিলি হয়, যাতে প্রতিটি অফিসারের মাথার বদলে ৪ লক্ষ টাকা ইনাম নির্ধারন করা হয়। ১৯ ও ২১ ফেব্রুয়ারি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার বাছাই করা ১৫ জন শুটারকে বাংলাদেশে প্রবেশ করানো হয় যারা পশ্চিম বঙ্গ সরকারের ১ লক্ষ মিষ্টির সাথে। একজন বেসামরিক দর্জির কাছ থেকে তাদের জন্য বিডিআর এর পোশাক বানিয়ে বিডিআর সপ্তাহ উপলক্ষে পিলখানায় ঢুকে। তাদের দায়িত্ব ছিলো লাল টেপওয়ালা (কর্নেল ও তদূর্ধ্ব) অফিসারদের হত্যা করবে। তারা একটি বেডফোর্ড ট্রাক ব্যাবহার করে ৪ নং গেইট দিয়ে প্রবেশ করে সকালে। ২৫ তারিখে ১১টায় বাংলাদেশের কোনো সংবাদ মাধ্বিযম জানার আগেই ভারতের “২৪ ঘণ্টা” টিভিতে প্রচার করা হয় শাকিল সস্ত্রীক নিহত। অর্থাৎ মূল পরিকল্পনা অনুসারেই তা প্রচার হতে থাকে!

পরিকল্পনা ব্যর্থ হলে বা আর্মির পদক্ষেপে শেখ হাসিনার জীবন বিপন্ন হলে তাকে নিরাপদে তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য ভারতের ৩০ হাজার সৈন্য, ছত্রীবাহিনী ও যুদ্ধবিমান আসামের জোরহাট বিমানবন্দরে তৈরি রেখেছিলো। বিদ্রোহের দিন ভারতের বিমান বাহিনী IL-76 হেভি লিফ্ট এবং AN-32 মিডিয়াম লিফ্ট এয়ারক্রাফট নিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে পূর্ণ সহায়তা দিতে পুরোপুরি প্রস্তুত ছিলো। ঐসময় প্রণব মুখার্জীর উক্তি মিডিয়ায় আসে এভাবে, “এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে সব ধরনের সহায়তা দিতে ভারত প্রস্তুত। আমি তাদের উদ্দেশ্যে কঠোর সতর্কবাণী পাঠাতে চাই, যারা বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকারকে দুর্বল করার চেষ্টা করছে, তারা যদি এ কাজ অব্যাহত রাখে, ভারত হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না, প্রয়োজনে সরাসরি হস্তক্ষেপ করবে।

ভারতের এই পরিকল্পনাটি শেখ হাসিনাকে অবহিত করা হয় বেশ আগেই। আর পরিকল্পনার বাস্তবায়নের নিমিত্তে ঘটনার ১ সপ্তাহ আগে তড়িঘড়ি করে প্রধানমন্ত্রীকে সুধাসদন থেকে সরিয়ে যমুনা অতিথি ভবনে নেয়া হয় (যদিও যমুনার মেরামত তখনও শেষ হয়নি). এ পরিকল্পনার অধীনে সেনাবাহিনীর বিরাট একটা অংশ মেরে ফেলা হবে, যেটা ১৯৭৫ সালে তার পিতৃ হত্যার একটা বদলা হিসাবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সন্তোষজনক ছিলো। ২৫ তারিখে পৌনে ন’টার মধ্যেই এনএসআই প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করে পিলখানায় বিদ্রোহ হচ্ছে। কিন্তু তিনি কাউকে কোনো ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন নি। সকাল ১০টার মধ্যে র‌্যাবের একটি দল, এবং ১০.২৫ মিনিটে সেনাবাহিনীর একটি দল পিলখানায় পৌছায়। কিন্তু শেখ হাসিনা কোনো অভিযান চালানোর অনুমতি দেয়নি। অথচ তিনি সময় ক্ষেপণ করতে থাকেন। আর এ সময়ের মধ্যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়। বিকালে হত্যাকারীদের সাথে শেখ হাসিনা বৈঠক করে তাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। কিন্তু তিনি একবারও জানতে চাননি, ডিজি শাকিল কোথায়। কি বিস্ময়!!

২৪ তারিখে হাসিনার পিলখানায় যাওয়ার আগের দিন পিলখানা অস্ত্রাগার থেকে ৩টি এসএমজি খোয়া যায়। অফিসারদের লাগানো হয় অস্ত্রাগারের পাহারায়। অথচ প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় উচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও গোয়েন্দাগিরি বহাল থাকে। ন্যূনতম কোনো বিচ্যুতি ঘটলে প্রোগ্রাম বাতিল হয়। এত কিছু সত্ত্বেও ২৪ তারিখে প্রধানমন্ত্রী সেখানে যান। মূলত: বিদ্রোহের আগাম বার্তা সেনাপ্রধান ম্ইন, ডিজিএফআই প্রধান মোল্লা ফজলে আকবর (ইনি হাসিনার এক সময়ের নাগর ছিলেন), এনএসআই প্রধান মেজর জেনারেল মুনির, সিজিএস সিনা জামালী, বিডিআর কমিউনিকেশন ইনচার্জ লেঃ কর্নেল কামরুজ্জামান, ৪৪ রাইফেল’এর সিও শামস, মুকিম ও সালাম-এর জানা ছিল। পরিকল্পনামত ২৪ তারিখে জানিয়ে দেয়া হয়, প্রধানমন্ত্রী ২৬ তারিখের নৈশভোজে যাচ্ছেন না। সজীব ওয়াজেদ জয়: শেখ হাসিনার এই পুত্রটি আগে থেকেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপর ক্ষিপ্ত ছিলো। ২০০৮ সালের নির্বাচনের দেড় মাস আগে ১৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও পুত্র সজিব ওয়াজেদ জয় তার Stemming the Rise of Islamic Extremism in Bangladesh শীর্ষক নিবন্ধে উল্লেখ করেন, জোট সরকারের আমলে সেনাবাহিনীতে ৩০% মাদ্রাসার ছাত্ররা ঢুকে পড়ছে। এবং সেনাবাহিনী পূনর্গঠনের পরিকল্পনাও উপস্থাপন করেছিলেন। পিলখানার প্লানে সেনা অফিসার হত্যা করা হলে সেনাবাহিনীতে ব্যাপক সংস্কার করা সম্ভব হবে, নতুন নিয়োগ করা যাবে- এমন বিবেচনায় জয় প্রস্তাবটি গ্রহণ করেন। পিলখানা হত্যার পরে জয় দুবাই যান এবং সেখানে আগত হত্যাকারীদের পুরস্কৃত করেন বলে গোপন সূত্রে জানা যায়। বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক হ্যাক করে বিপুল অর্থ চুরি ও সেনাবাহিনীর ৫৭ জন অফিসারকে হত্যার দায়ে জয়ের বিরুদ্ধে মামলা সময়ের দাবি। ইনারপুলে রেড এলার্ট জারি করে তাকে ধরে এনে ঠিক মতো খেদমত করলে গোপন সব তথ্য প্রকাশ পাবে বলে অভিজ্ঞ মহল মত প্রকাশ করেন।

শেখ হাসিনার ফুফাত ভাই শেখ ফজলুল হক মনির ছেলে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘটনায় তার পিতা নিহত হয়। পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য তাপসও এই ষড়যন্ত্রকে কার্যকর হিসাবে মনে করে। ২৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ফজলে নুর তাপসের ধানমন্ডিস্থ বাসায় প্রায় ২৪ জন বিডিআর হত্যাকারী চূড়ান্ত শপথ নেয়। তোরাব আলী ও তার ছেলে লেদার লিটন পরিকল্পনাকারীদেরকে গোপন আস্তানা ও যাবতীয় সহায়তা প্রদান করে। বিডিআর বিদ্রোহের বিকালে শেখ তাপসের ঘোষণা প্রচার করা হয়, যাতে করে পিলখানার ৩ মাইল এলাকার অধিবাসীরা দূরে সরে যান। আসলে এর মাধ্যমে খুনীদের নিরাপদে পার করার জন্য সেফ প্যাসেজ তৈরি করা হয়েছিল। তাপসের এহেন কর্মকাণ্ডের বদলা নিতে তরুন সেনা অফিসাররা পরবর্তীতে তাপসের ওপর হামলা করে, কিন্তু ব্যর্থ হয়। পরে ৫ চৌকস কমান্ডো অফিসার চাকরিচ্যুত হয়ে কারাভোগ করছে। বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে সেনা তদন্ত এড়াতে তাপস কিছুদিন গা ঢাকা দেয় বিদেশে।

যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এই হুইপ পিলখানার ঘটনাকালে বিদ্রোহীদের সাথে সেল ফোনে কথা বলতে শুনা যাচ্ছিল। সে হত্যাকারীদের সুনির্দিষ্টভাবে নির্দেশ দেয় কর্নেল গুলজারের চোখ তুলে ফেলতে এবং দেহ জ্বালিয়ে দিতে। কেননা  র‌্যাবের পরিচালক কর্নেল গুলজারের নেতৃত্বে জেএমবির প্রধান শায়খ আবদুর রহমানকে ধরা হয় ও পরে ফাঁসি দেয়া হয়। শায়খ রহমান ছিল মির্জা আজমের দুলাভাই। আজম এভাবেই দুলাভাই হত্যার বদলা নেয়। এছাড়াও ২০০৪ সালে নানক-আজমের ব্যবস্থাপনায় শেরাটন হোটেলের সামনে গানপাউডার দিয়ে দোতলা বাসে আগুন দিয়ে ১১ বাসযাত্রী পুড়িয়ে মারার ঘটনা তদন্ত করে এই গুলজারই নানক-আজমকে সম্পৃক্ত করে। এর প্রতিশোধেই গুলজার দাহ হয়।

এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রীজাহাঙ্গীর কবির নানক । উনি বিডিআরের ঘাতকদের নেতা ডিএডি তৌহিদের ক্লাসমেট। বিডিআর ট্র্যাজেডির আগে থেকেই তৌহিদ যোগাযোগ রাখত নানকের সঙ্গে। ঘটনার দিন ২০৪ মিনিট কথা বলে তারা। বিকালে পিলখানার বিদ্রোহীদের নিয়ে শেখ হাসিনার কাছে নিরাপদে গিয়ে মিটিং করে আসে। এবং তৌহিদকে বিডিআরের অস্থায়ী ডিজি ঘোষণা করে। কর্নেল গুলজার হত্যায় আজমের মত সরাসরি জড়িত নানক। কেননা, র‌্যাবের পরিচালক গুলজারই তদন্ত করে উদ্‌ঘাটন করে- শেরাটনের সামনে দোতলা বাস জ্বালিয়ে ১১ যাত্রী হত্যা করা হয় নানকের নির্দেশে। সেনাবাহিনীর তদন্ত পর্ষদ এড়াতে তদন্তের সময় হঠাৎ বুকের ব্যথার অযুহাতে চিকিৎসার কথা বলে নানক অনেকদিন সরে থাকে সিঙ্গাপুরে। এ নিয়ে সেনা অফিসারদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে ব্রিগেডিয়ার হাসান নাসির দায়িত্বচ্যুত হন।

সুপরিকল্পিত বিডিআর ধংসযজ্ঞ সংগঠনের নিমিত্ত ভারতের পরামর্শে হাসিনার কেবিনেটে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী নিয়োগ করা হয় অথর্ব সাহার খাতুনকে। বিদ্রোহের দিন তার কোনো তৎপরতা ছিলো না সাহারার। বরং সেনা অভিযান ও পিলখানায় র‌্যাব ঢোকার অনুমতি চাইলে সাহারা খাতুন ‘না’ করে দেন। বিকালে বিদ্রোহীদের সাথে করে প্রেস ব্রিফিং করে এই মন্ত্রী। অথচ তার ডিজির কোনো খোঁজ নেয়নি। বিদ্রোহীদের সাথে সমঝোতার পরে রাতে তিনি যান পিলখানায় প্রধানমন্ত্রীর বুলেটপ্রুফ গাড়িতে চড়ে। তিনি বিডিআর অফিসারদের পরিবার পরিজন উদ্ধার না করে কেবল আইজিপি নুরমোহাম্মদের কন্যাকে উদ্ধার করেন। অথচ বাকী পরিবার রাতের আধারে নির্যাতিত হয়। সাহারা খাতুনের সাথে প্রধানমন্ত্রীর মেডিকেল টীম ও রেড ক্রিসেন্টের অ্যাম্বুলেন্স পিলখানায় ঢুকে। এরপরে পিলখানার বাতি নিভিয়ে ঘাতকদের ঐ এম্বুলেন্সে করে পিলখানার বাইরে নিরাপদ জায়গায় সরানো হয়। তখনও অনেক অফিসার আহত হয়ে পিলখানা নানাস্থানে লুকিয়ে ছিলো্ কিন্তু সাহারা এদের উদ্ধার করেনি। কর্নেল এমদাদ, কর্নেল রেজা্, ও কর্নেল এলাহীকে হত্যা করা হয়।

শেখ হাসিনার ফুফাত ভাই শেখ সেলিম। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সে সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়, কিন্তু তার ভাই শেখ মনি নিহত হয়। সেনাবাহিনীর ওপরে তারও রাগ ছিলো প্রচণ্ড। তা ছাড়া ১/১১র পরে সেনারা ধরে নিয়ে যায়, এবং ডিজিএফআই সেলে ব্যাপক নির্যাতন করে শেখ হাসিনার অনেক গোপন কথা, চাঁদাবাজি, বাসে আগুন দেয়া সংক্রান্ত জবানবন্দি দিতে হয়। বিডিআরের বিদ্রোহী দলটি কয়েকদফা মিটিং করে শেখ সেলিমের সাথে। ১৩ ফেব্রুয়ারিতে শেখ সেলিমের বনানীর বাসায় এ ধরনের একটি মিটিং হয় বলে সেনা তদন্তে প্রমাণ পাওয়া গেছে।

স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজকে ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। শেখ সেলিমের বাসায় অনুষ্ঠিত মিটিংয়ে সোহেল যোগ দেয়। বিদেশী হত্যাকারীদেরকে নিরাপদে মধ্যপ্রাচ্য, লন্ডন ও আমারিকায় পৌঁছানোর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল সোহেল তাজকে। জনগণকে ধোকা দেয়ার জন্য প্রচার করা ঘটনার সময় তাজ আমেরিকায় ছিল। এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। সে সময়ে তাজ ঢাকায়ই ছিল। ২৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধায় সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে কয়েকজন হত্যাকারীসহ তাকে সিলেটে নিয়ে যাওয়া হয়, এবং সে রাতেই তাজ ওসমানী বিমানবন্দর থেকে বিদেশের পথে যাত্রা করে। সেই হেলিকপ্টারের একজন পাইলট ছিল লেঃ কর্নেল শহীদ।যাকে পরে হত্যা করা হয় রহস্যজনক হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় মেজর জেনারেল রফিকুল ইসলামের সাথে। এছাড়া বিমানের বিজি ফ্লাইট ০৪৯ দু’ঘণ্টা বিলম্ব করে চারজন খুনি বিডিআরকে দুবাইতে পার দেয়া হয়। এখবরটি মানবজমিন ছাপে ৩ মার্চ ২০০৯।

কর্নেল ফারুক খান ছিলেন পিলখানা বিদ্রোহের ঘটনা তদন্তের লক্ষে গঠিত ৩টি কমিটির সমন্বয়কের দায়িত্বে। জনগণকে ধোঁকা দেয়ার জন্য প্রথমেই তিনি ঘোষণা করেন, পিলখানার ঘটনায় ইসলামী জঙ্গিরা জড়িত। এটার খাওয়ানোর জন্য সোবহান নামে এক লোককে ব্যবহারের চেষ্টা করা হয়। পরে আবার সেখান থেকে সরে আসেন। সেনাবাহিনীর তদন্তে অনেক সত্য কথা উঠে আসলেও তা আলোর মুখ দেখেনি এই ফারুক খানের জন্য। ধামাচাপা দেয়া হয় মূল রিপোর্ট। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে মূল রিপোর্ট বদলে গোজামিলের রিপোর্ট তৈরী করা হয়।

লালবাগ এলাকার আওয়ামীলীগ নেতা হাজী সেলিম । তিনি বিডিআর হত্যাকাণ্ডের সময় রাজনৈতিক সাপোর্ট দিয়েছেন। হাজী সেলিম ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে বেশ কিছু গোলাবারুদ ক্রয় করে, যা বিদেশি ভাড়াটে খুনীরা প্রথমে ব্যবহার করে। ঢাকার দৈনিক প্রথম আলোর এক সাংবাদিক এটা জানার পর সে এনএসআইকে এই মর্মে অবহিত করে যে, পিলখানা সংক্রান্ত ষড়যন্ত্রের প্রস্তুতি চলছে যার সাথে বিডিআর ও আওয়ামীলীগের নেতারা জড়িত। উক্ত সাংবাদিককে এনএসআই থেকে বলা হয় বিষয়টা চেপে যেতে। ঘটনার দিন দুপুরে হাজী সেলিমের লোকেরা বিডিআর গেটে বিদ্রোহীদের পক্ষে মিছিল করে। ২৫ তারিখ রাতের আঁধারে পিলখানার বাতি নিভিয়ে দেয়াল টপকে সাধারণ পোষাক পরে বিদ্রোহীরা তার এলাকা দিয়ে পালিয়ে যায় হাজী সেলিমের সিমেন্ট ঘাটকে ব্যবহার করে। হাজী সেলিম তার লোকজন দিয়ে স্থানীয় জনগণকে সেখান থেকে সরিয়ে দেয়। একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল ২৫ তারিখ রাত ১টার সংবাদে উক্ত ঘটনার খবর প্রচার করে। সেই রিপোর্টে ঘটনার কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য তুলে ধরে, যাতে বলা হয় যে, বেশ কিছু স্পীডবোর্টকে তারা আসা যাওয়া করতে দেখেছে; কিন্তু তারা কাছাকাছি যেতে পারেনি যেহেতু কিছু রাজনৈতিক কর্মীরা তাদেরকে সেদিকে যেতে বাধা দেয়।

তোরাব আলী ও তার ছেলে লেদার লিটন, আওয়ামীলীগের ৪৮ নং ওয়ার্ডের সভাপতি। বিডিআরদের পরিচয় করিয়ে দেয় এমপি তাপসের কাছে। পরে মূল পরিকল্পনায় তোরাব আলীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তার বাড়িতেও বিদ্রোহীরা মিটিং হয়েছে। সে মূলত অবৈধ অস্ত্রের ডিলার। তার ছেলে সন্ত্রাসী লেদার লিটনের মাধ্যমে বিদ্রোহী বিডিআরদের পালিয়ে যাবার ব্যবস্থা করা হয়। এ সংক্রান্ত খরচাদি আগেই তাকে দেয়া হয়। উক্ত লিটনকে ২ মাস আগে তাপস ও নানক জেল থেকে ছাড়িয়ে আনে। ২৫ ফেব্রুয়ারি রাত ৭টা থেকে ৯টার মধ্যে স্পিড বোট যোগে হত্যাকারীদের বুড়িগঙ্গা নদী পার করিয়ে দেয় লেদার লিটন।

মহিউদ্দিন খান আলমগীর, পিলখানার ঘটনার সময় এই সাবেক আমলা ও জনতার মঞ্চের প্রতিষ্ঠাতা মেতে উঠেন বীভৎস উল্লাসে। বার বার ফোন করে খোঁজ নেন বিদ্রোহীদের কাছে। এমনকি নিহতদের লাশ গোপন করার জন্য অ্যাসিড দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হুকুমদাতা ছিলেন তিনি।

হাসানুল হক ইনু,বাংলাদেশের রাজনীতির অন্ধকার গলির নেতা। তিনি ১৯৭৫ সালে অনেক সেনা অফিসার হত্যা করেছেন কর্নেল তাহের বাহিনীতে থেকে। ১৯৭৫ সাল থেকে দেশে সংঘটিত সকল সামরিক অভ্যুত্থানে তার যোগসাজশ রয়েছে। পিলখানা হত্যাযজ্ঞের সময় তিনি তার ঘনিষ্ঠদের ফোন করে হত্যায় উৎসাহ যুগিয়েছেন।

১৫ বছর আগে বিডিআর বিদ্রোহে রাজধানীর পিলখানায় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শেখ ফজলে নূর তাপস ও শেখ সেলিমসহ অনেকে সরাসরি জড়িত ছিল বলে দাবি করেছেন নিহত হওয়া মেজর শাকিলের ছেলে রাকিন আহমেদ। এই ঘটনার পেছনে ভারতের হাত আছে বলেও অভিযোগ করা হয়। পিলখানা হত্যাকাণ্ডে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ফজলে নুর তাপস ও শেখ সেলিম সরাসরি জড়িত। এছাড়াও নেপথ্যে আরও অনেকে জড়িত রয়েছে। স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন হলে তাদের নামও আসবে।

২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি, সকাল ৯-০৫ ঢাকার বিডিআর সদর দফতর পিলখানার দরবার হলে তিন হাজার বিডিআর জওয়ানদের নিয়ে দরবারে বসেন বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ, সাথে ১৩২ অফিসার।

৯-২৬ মিনিটে প্রথমে ৪৪ ব্যাটালিয়নের বিডিআর সৈনিকরা বিদ্রোহ করে। এসময় সৈনিকরা দরবার হল ত্যাগ করে, শেষে ৫০ জনের অধিক অফিসার দরবার হলে অবস্থান করছিল।

জেনারেল শাকিল সহ কর্নেল গুলজার, কর্নেল এমদাদ, মেজর জায়েদী এবং আরো কয়েকজন অফিসার সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ে সাহায্য চেয়ে ফোন করেন। ডিজি বিডিআর প্রথমেই জানান সেনাপ্রধান জেনারেল মইনকে, এছাড়াও এনএসআই প্রধান মে. জেনারেল মুনীর, নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেনারেল তারিক সিদ্দিকের মারফত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদ্রোহের খবর জানতে পারেন।

৯-৪৮ মিনিটে বিডিআর মহাপরিচালক জেনারেল শাকিল নিজে টেলিফোন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সাহায্য পাঠাতে আবেদন করেন। এত আবেদন নিবেদন সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোনো সাহায্য পাঠাননি।

এরপরে বিদ্রোহীরা অস্ত্রাগার ভেঙ্গে অস্ত্র হাতে পুরো পিলখানায় ছড়িয়ে পড়ে। ১০/১৫ জনের একটি অস্ত্রধারী গ্রুপ দরবার হলের নিকটে এসে গুলি করে ১৩ জন অফিসার হত্যা করে। ১১টার দিকে ডিজি মেজর জেনারেল শাকিল নিহত হন। তবে সেখানে আটক অফিসারদের মধ্যে অনেক কমান্ডো থাকলেও কেউই সশস্ত্র সিপাহীদের সাথে কোনো লড়াইতে অবতীর্ণ হননি, বরং অসহায়ভাবেই নিহত হন। ৪৪ ও ৩৬ ব্যাটালিয়ন এবং আরএসইউর সিপাহীও জেসিওরাই মূলত এ বিদ্রোহ করে। অন্যদিকে পিলখানার অফিসারর্স কোয়ার্টারে একদল সিপাহি হামলা চালায়।

তবে ব্যক্তিগত উদ্যোগে সেনাসদরে এবং র‌্যাব হেড কোয়ার্টার্সে সাহায্য চেয়ে যেসব চেষ্টা হয়েছে তার প্রেক্ষিতে ১০:১০ মিনিটে র‌্যাবের ৩৫০ জন জওয়ান ও অফিসার বিডিআর গেইটে হাজির হয়, যারা ৫ নম্বর গেইট দিয়ে ঢুকলেই খুব অল্প সময়ে বিদ্রোহ দমন করতে পারত। কিন্তু তাদের অনুমতি দেয়া হয়নি।

ব্রিগেডিয়ার হাকিমের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর ৪৬ ব্রিগেডের সৈনিকরা ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সকাল ১০:৫০ ঘটিকার মধ্যে বিডিআর হেডকোয়ার্টোসের চারদিকে অবস্থান নেয়, তাদের সঙ্গে এপিসি ছিল, ট্যাংক যোগ দেয় আরও পরে। তাদেরও অপারেশন চালানোর অনুমতি দেয়া হয়নি।

অন্যদিকে, রাজনৈতিক চেষ্টায় সাড়ে ১২টা থেকে ১টার মধ্যে এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, হুইপ মির্জা আজম, এবং এমপি মাহবুব আরা গিনি ও সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি পিলখানায় প্রবেশ করে। উল্লেখ্য নানকের ক্লাশমেট এই তৌহিদের সঙ্গে আগের দিন ২০৪ মিনিট টেলিফোন আলাপ গোয়েন্দারা রেকর্ড করে! নানক ১৪ জন বিদ্রোহী বিডিআরকে নিয়ে শেখ হাসিনার বাসভবনে যান বিকেল ৩-২৮ মিনিটে। সেখানে তাদেরকে হোটেল শেরাটন থেকে নাশতা এনে আপ্যায়ন করা হয়। যমুনায় ১৫০ মিনিট অবস্থান করে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে ডিএডি তৌহিদরা বেরিয়ে যাওয়ার সময় নানক এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন প্রেসকে জানান, আলোচনা সফল হয়েছে, বিদ্রোহী বিডিআরদের নিজের সন্তান হিসাবে উল্লেখ করেন সাহারা। অন্যদিকে টিভি স্ক্রলে তখন ভেসে আসে, দাবির মুখে ডিএডি তৌহিদকে বিডিআরের ভারপ্রাপ্ত ডিজি নিয়োগের খবর!

পিলখানার ঘটনার পরে সকালেই সেনাপ্রধান জেনারেল মইন প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন অস্থায়ী বাসভবন যমুনায় যান (উল্লেখ্য, মাত্র এক সপ্তাহ আগে রহস্যজনক কারণে শেখ হাসিনাকে সুধাসদন থেকে খুব তড়িঘড়ি করে যমুনায় সরিয়ে নেয়া হয়! কেননা পিলখানার ডেঞ্জার এরিয়ার মধ্যে ছিল ওটা। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার মেরামত কাজ শেষ না হওয়া স্বত্বেও অজ্ঞাত সিগনালে খুব দ্রুততার সাথে হাসিনাকে সুধাসদন থেকে সরানো হয়েছিল। এটা একটা অস্বাভাবিক ঘটনা!) বেলা ১ টার দিকে নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনী প্রধানকে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন যমুনা’য় ডেকে নেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী তাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলার পরে তাদেরকে একটি ওয়েটিং রুমে বসতে বলা হয়। জেনারেল মইনের ভাষ্যমতে, ঐ কক্ষ থেকে তাদেরকে আর বের হতে দেয়া হয়নি। কার্যত তারা ছিলেন আটক। তাদের মোবাইল ফোনগুলো গেটে জমা দিয়ে ঢুকতে হয়। পরে তাদের চা-নাশতা দেয়া হয়। তারা শুনতে পান পাশের কক্ষে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে উচ্চস্বরে কথা বলায় হাস্যরসে ব্যস্ত ছিলেন তাপস, নানক, আজম, সাহারা খাতুন সহ কেবিনেট মেম্বাররা!

এভাবে সময় ক্ষেপণের মাঝখানে বিডিআরের ডিজি জেনারেল শাকিলসহ অফিসারদেকে হত্যা করে লাশ ফেলে দেয়া হয় ড্রেনে বা মাটিতে পুতে ফেলা হয়, সেনা অফিসারদের বাসভবনে হামলা চালিয়ে লুটতরাজ চালায়, এবং নারীদের ওপর অত্যাচার চালায় বিদ্রোহীরা। এর মধ্যে বিডিআর ডিজির স্ত্রী এবং কর্নেল দেলোয়ারের স্ত্রীকে হত্যা করে। ফলপ্রসু আলোচনার (!) সূত্র ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নে শেখ ফজলে নূর তাপসের বরাতে টিভি স্ক্রলে ঘোষণা দিয়ে পিলখানার ৩ কিলোমিটার এলাকা ফাঁকা করে দেয়ার নির্দেশ জারি করা হয়। পরে জানা যায়, এলাকা শূন্য করার মধ্য দিয়ে বিদ্রোহীদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছিল। রাত ১০টার দিকে তিন বাহিনী প্রধান সহ সেনাপ্রধান মইন যমুনা থেকে বের হয়ে এসে প্রেসকে জানান- Army is subservient to the Government!” জেনারেল মইন জানিয়েছেন, বিদ্রোহ দমন করতে সেনা অভিযান চালাতে প্রধানমন্ত্রী অনুমতি দেননি। উপরন্তু প্রধানমন্ত্রী কায়দা করে তিন বাহিনী প্রধানকে তার বাসভবনে ৮ ঘণ্টা আটকে রেখে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য পর্যাপ্ত সময় দেয়া হয়েছিল। গভীর রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা পিলখানায় গিয়ে কিছু বন্দী পরিবার মুক্ত করে আনেন। ঐসময় পিলখানা থেকে কয়েকটি কালো কাঁচের এম্বুলেন্স বের হতে দেখা যায় (পরে জানা যায়, প্রতিবেশী দেশ থেকে আসা শুটারদের বের করে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল)! তবে পরে প্রকাশিত ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ২৫ তারিখ রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের কাছে অস্ত্র সমর্পণের নাটক করা হয়, বাস্তবে পিলখানার বিদ্রোহ দমন হয়নি। অবশ্য রাতের বেলায় অনেক সৈনিক দেয়াল টপকে পিলখানা ছাড়ে। পরের দিন ২৬ তারিখ বিকালে শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশ্য ভাষণ দেন। ততক্ষণে পিলখানার হত্যাযজ্ঞ শেষ হয়েছে। এরপরে সেখানে সেনা পুলিশ ঢোকে ২৬ তারিখ রাতে। বিডিআর বিদ্রোহীরা বেশিরভাগই পালিয়ে গেলেও হোতা ডিএডি তৌহিদ সহ কিছু অপরাধী আটক হয়। তবে ততক্ষণে ৫৭ সেনা অফিসার ও আরও ২০ জন নিহত, সাথে বিডিআর নামক বাহিনী ধংস হয়ে গেছে।

একমাত্র আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আমাদের প্রিয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অপমান, নির্যাতন, হামলা, অত্যাচার এবং হত্যার মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটে থাকে। এর কারণ সম্ভবত অতিরিক্ত ভারতপ্রেম বা মোদী প্রেম।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতিটি সদস্য অকুতোভয় এবং দেশের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে সবসময় প্রস্তুত। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনীর তুলনায় কমপক্ষে দশগুণ বেশি সাহসী। সীমান্তে আমাদের সেনাবাহিনী সবসময় পাহাড়ের মতো অটল ছিল, আর তাদের এই অকুতোভয়তা কারণে ভারতীয়রা বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে যমের মতো ভয় পেত এবং বাবার মতো সম্মান করত। কখনো বাবার সামনে বেয়াদবি করার সাহস দেখাতো না। দেশের স্বার্থে কোনো আপস করতে আমাদের জওয়ানরা প্রস্তুত ছিল না। হাসিনা সরকারের আমলে দেশ ও সীমান্ত নিয়ে এক বিশাল ষড়যন্ত্র চলছিল, যার মূল পরিকল্পনাকারী ছিল ভারত। এই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে, সেনাবাহিনীর ভয় ঢুকিয়ে দিতে এবং দেশের সীমান্ত অরক্ষিত করে ফেলার লক্ষ্যে বিডিআর হত্যাযজ্ঞের মাস্টারপ্ল্যান করা হয়। এর ফলস্বরূপ, পিলখানায় বাংলাদেশের অমূল্য রত্ন, ৫৭ জন অফিসার নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বহুবার দেশকে মহা বিপদ থেকে রক্ষা করেছে এবং বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে। ১৯৭১ সালে মূলত আমাদের সেনাবাহিনীর অক্লান্ত পরিশ্রম, মেধা, কৌশল এবং সাহসের মাধ্যমে দেশকে শত্রুমুক্ত করা সম্ভব হয়েছে। বহু সৈনিক ও অফিসার জীবন উৎসর্গ করেছেন। এরপর ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনী একটি বিপ্লবের মাধ্যমে দেশ আবার স্বাধীন করে। অপ্রিয় হলেও সত্যি,সেদিন পুরো বাংলাদেশে আনন্দের জোয়ার বইতে শুরু করে।

যখন দেশের মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যায় এবং তাদের কোনো পথ খোলা থাকে না, তখন রক্তিম সূর্যের মতো উদিত হয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। দেশের সর্বস্তরের সাধারণ মানুষের শেষ আশ্রয় বা শেষ ঠিকানা হচ্ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। তারা নিজের জীবনকে পরোয়া না করে, তৎপরতা ও সাহসিকতার সঙ্গে সংকট মোকাবিলা করে। এছাড়া, আগস্ট ২০২৪ সালে চৌকস সেনাপ্রধান কারুজ্জামানের সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আমাদের দেশ পুনরায় স্বাধীনতা অর্জন করে।

যুগে যুগে ঐতিহ্যবাহী সেনাবাহিনীর গৌরবকে ম্লান করার জন্য কিছু মীরজাফরের আবির্ভাব ঘটেছে, যাদেরকে  জাতি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। বিশেষ করে স্বৈরাচারী এরশাদ এবং খুনী  হাসিনা সরকারের ভূমিকা সবার কাছে পরিচিত। তবে, সবার চোখের অন্তরালে একটি বিশাল ঘটনা ঘটেছে যা আওয়ামী লীগ সরকার কখনো সামনে আনতে দেয়নি এবং বিএনপির শাসনকালেও তেমন গুরুত্ব পায়নি। এটি হলো, ১৯৭১ সালে পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে ষড়যন্ত্র করে মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার এ.জি.এম. ওসমানীকে বাধা দেওয়া হয়। ভারতীয় সৈন্যরা ওসমানীর হেলিকপ্টারকে নিচ থেকে গুলি করে ফেলে দেয় , এতে করে জে.ওসমানী গুরুতর আহত হয়ে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারেননি। এটি ভারতের একটি কুচক্র ছিল। যেহেতু জেনারেল ওসমানী উপস্থিত হতে পারেননি, আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে সব কাগজপত্র দস্তখত করে নিয়েছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর অধিনায়ক অরোরা। এটাই ছিল ভারতীয়দের ষড়যন্ত্র।

এই ঘটনার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ভারতীয়দের রাজনীতির হাতিয়ার ছিল বাঙালি জাতি। শেখ মুজিব কিংবা আওয়ামী লীগের কোনো নেতা বা কর্মী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়নি। বেশিরভাগ নেতারা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে মদ্যপান এবং বিনোদন করেই সময় কাটিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের কোনো কর্মীও অংশ নেয়নি। পরবর্তীতে তারা গল্প শুনে শুনেই মুক্তিযোদ্ধা বনে গেছেন। প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধ করেছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। জেড ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে তিনি দেশ স্বাধীন করেন। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের মতো সাহসী বীরদের জাতি সবসময় শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে এবং তাদের কৃতিত্বকে কখনো ম্লান হতে দেবে না। প্রতিটি দেশপ্রেমিক বাংলাদেশির অন্তরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী একটি বিশেষ স্থান করে নিয়েছে।

শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি ক্ষুদ্র অংশ দেশ বিরোধী কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে, যা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। কিছু দেশদ্রোহী সদস্য সেনাবাহিনীর দীর্ঘদিনের সম্মান এবং ঐতিহ্যকে বিপন্ন করে দেয়। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন: জেনারেল আজিজ আহমেদ, সাবেক মেজর জেনারেল মামুন খালেদ, ডিজিএফআইর মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আকবর হোসেন, মেজর জেনারেল সাইফুল আবেদীন, শেখ হাসিনার উপদেষ্টা মেজর জেনারেল তারেক সিদ্দিকী, আয়না ঘরের প্রতিষ্ঠাতা মেজর জেনারেল জিয়াউল হক এবং শেখ হাসিনার স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল মুজিবর রহমান। এরা ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সরাসরি কাজ করতেন এবং রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য সরবরাহ করতেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা দেশের ভেতর রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তার কোনো গুরুত্ব ছিল না। এনএসআইসহ রাষ্ট্রের সকল গোপনীয়তার দরজা হাসিনা সরকারের দ্বারা ভেঙে দেওয়া হয়। সরকারের এই পদক্ষেপে সেনাবাহিনী ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সেনাবাহিনীকে জনগণের বিরুদ্ধে গুলি চালানোর আদেশ দেওয়া হয়। এর ফলে সেনাবাহিনীর প্রতি সাধারণ জনগণের আস্থা কমতে থাকে এবং একসময় তারা সেনাবাহিনীর প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। ভারত এ পরিস্থিতিকে সুক্ষ্মভাবে কাজে লাগিয়ে কিছু মীরজাফরের মাধ্যমে তাদের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে সক্রিয় হয়ে ওঠে।

ভারতের প্রভাবমুক্ত হওয়ার পর থেকে শেখ হাসিনার শাসনকালের সমাপ্তির পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আবারও জনগণের ভালোবাসা ও আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। দ্রুতই সেনাবাহিনী জনগণের সেবায় ফিরে এসেছে এবং জনগণ বুঝতে পেরেছে আসল শত্রু কে। নিশ্চয়ই আপনারা আমার সঙ্গে একমত হবেন যে, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার অপর নাম বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। ভালোবাসায় সিক্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের অতন্দ্র প্রহরী এবং তাদের সঙ্গে অন্য কোনো সংস্থার তুলনা চলে না।

বিভিন্ন দুর্যোগের সময়ে আমাদের সেনাবাহিনী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, মূল্যবান সময় ও সম্পদ উৎসর্গ করে, দেশ থেকে দেশান্তরে ছুটে যায় মানবিক সহায়তার জন্য। নিজের পরিবার পরিজনকে ছেড়ে, বন্যা, ঝড় ও তুফান উপেক্ষা করে, এ বিশেষ মানবিক দলটি অপরের জীবন রক্ষায় সদা প্রস্তুত থাকে।

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানে সেনাবাহিনীর বিশেষ একটি অবিস্মরণীয় ভূমিকা ছিল, যা আমাদের জন্য মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত। যখন জাতি চরম দুর্দশার সম্মুখীন ছিল এবং গোটা জাতি দিশেহারা , তখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। ফ্যাসিস্ট হাসিনা সেনাবাহিনীকে ছাত্রদের দমাতে, প্রয়োজনে আরো লাশ ফেলতে আদেশ দিয়েছিলেন। এমনকি তিন বাহিনীর প্রধানকেও একই নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তবে, দেশরত্ন সূর্য সন্তানেরা দেশের জনগণের সাথে বেইমানি করেনি; চার বাহিনীর প্রধান খুনি হাসিনাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। সেনাবাহিনীর প্রধান হুংকার দিয়ে বলেছেন, দেশের নিরীহ জনগণের ওপর আর একটি গুলিও ছোড়া হবে না।

বিশেষ সূত্রে জানা গেছে, শেখ রেহানা তার বোন হাসিনাকে বুঝাতে ব্যর্থ হয়ে সজীব ওয়াজেদ জয়কে ফোনে সংযোগ করেন। জয়ের মতো একটি  ছোট বাছুর সেনাবাহিনীর প্রধানকে অশ্রাব্য ভাষায় কথা বলে। সেই বিশেষ মুহূর্তে সেনাবাহিনীর প্রধান ধৈর্যের সর্বোচ্চ পরীক্ষা দেন। একজন সেনাবাহিনী প্রধান চাইলে হাসিনাকে আরো ৪/৫ বছর ক্ষমতায় রাখতে পারতেন। কিন্তু চৌকস সেনাপ্রধান ওয়াকারুজ্জামান অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে সঠিক সিদ্ধান্তে অটল থাকার কারণে দেশ স্বাধীন হয়েছে।

হাসিনার এসএসএফকে প্রস্তুত করা হয়েছিল, প্রয়োজনে সেনাপ্রধানকে সরিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল। তবুও ছাত্র-জনতার আন্দোলন নস্যাৎ করে হাসিনাকে মসনদে রাখতে হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। অবশেষে, চার বাহিনীর কঠিন অবস্থানে স্বৈরাচারী হাসিনা দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়।

ওদিকে, ভারতীয় গোয়েন্দা ও বিভিন্ন সামরিক বাহিনীর গোপন সদস্যরা নাকে খত দিয়ে দেশ থেকে পালিয়ে যায়। একটি ভিডিও ফুটেজ ভাইরাল হয়েছে, যেখানে দেখা যায়, গতানুগতিক ইমিগ্রেশন বা কাস্টমস না করে রানওয়েতে অস্ত্র ফেলে দৌড়িয়ে প্লেনে উঠছে শতশত ভারতীয় চর। এই খুনিরা দেশের ভিতরে সব ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করতো। রানা  প্লাজায় আগুন, বিভিন্ন শপিং মলে আগুন, ট্রেনে, লঞ্চে আগুন, নারায়ণগঞ্জে জুমায় এয়ারকন্ডিশন ব্লাস্ট হয়ে শত শত মানুষ হত্যা—এসব ছিল ঠান্ডা মাথার খুন। বিভিন্ন মসজিদে মুয়াজ্জিন ও ইমামের গলা কাটা লাশ, সাগর রুনি হত্যাকাণ্ড, অর্থাৎ বিগত ১৬ বছরে অজস্র হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে মাফিয়া সম্রাট শেখ হাসিনা।

শেখ হাসিনা পালানো মানে ভারতের পরাজয় এবং গুজরাটের কসাই মোদী সেটা মেনে নিতে পারছিলেন না। কিছু না পেরে ভারতের সর্বশেষ ট্রমকার্ড ‘বাঁধ’ ছেড়ে দিয়েছে । পশুর চেয়েও অধম, শুয়োর থেকেও নিকৃষ্ট এ জাতি বাংলাদেশকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়ে এই ধরনের পানি দিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটাতে শুরু করেছে।

বন্যা কবলিত এলাকাগুলোতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বিশেষ অবদান রেখেছে এবং দিন-রাত নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। হেলিকপ্টার দিয়ে প্রতিটি বন্যাকবলিত এলাকা পরিষ্কার করছে। গলা পানিতে নেমে মানুষকে উদ্ধার করছে এবং ক্ষয়ক্ষতি থেকে হেফাজত করছে। সেনাবাহিনীর সব পদবির সদস্যদের এক দিনের বেতনের সমপরিমাণ অর্থ বন্যার্তদের সহযোগিতায় প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে প্রদান করেছেন। গত চব্বিশ ঘণ্টায় সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট ও কন্টিনজেন্টসমূহ বন্যাকবলিত জেলাসমূহে প্রায় ৫৫টি বোট ও হেলিকপ্টারের মাধ্যমে আনুমানিক ৯ হাজার ৫০০ বন্যাদুর্গত ব্যক্তিকে উদ্ধার করে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠিয়েছে। এছাড়াও, প্রায় পাঁচ হাজার বন্যার্তের মাঝে ত্রাণ ও খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে।

বন্যাকবলিত জেলাসমূহে চিকিৎসা সহায়তার জন্য সশস্ত্র বাহিনীর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মেডিকেল টিম মোতায়েন রয়েছে। বন্যাদুর্গত এলাকায় চিকিৎসাসেবা প্রদানের পাশাপাশি গত ২৩ আগস্ট ফেনীর ফুলগাজী থানা থেকে অন্তঃসত্ত্বা মোছাম্মৎ সুমি বেগমকে মুমূর্ষু অবস্থায় সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারের মাধ্যমে উদ্ধার করে কুমিল্লা সিএমএইচে পাঠানো হলে সেখানে তিনি পুত্রসন্তান প্রসব করেন। একই দিন সেনা ও বিমানবাহিনী প্রধান এবং সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) হেলিকপ্টারে বন্যাদুর্গত এলাকা পর্যবেক্ষণ করেন এবং উদ্ধার কাজে নিয়োজিত সশস্ত্র বাহিনী সদস্যদের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেন।

নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লাসহ দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় আক্রান্ত বানভাসি মানুষের সহযোগিতায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে সশস্ত্র বাহিনী, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী। চরম বিপর্যয়ের মাঝেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা বন্যাদুর্গত এলাকায় পানিবন্দিদের উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করছে এবং অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সাধ্যমতো সহায়তা প্রদান করছে।

গত কয়েক দিনের ধারাবাহিকতায়, শুক্রবারও ফেনী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মৌলভীবাজার, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও অন্যান্য এলাকায় আকস্মিক বন্যায় পানিবন্দি মানুষদের উদ্ধার এবং ত্রাণসামগ্রী বিতরণের নানা মানবিক কার্যক্রম পরিচালনা করেছে সশস্ত্র বাহিনী। সেনাবাহিনী বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়া এলাকাগুলোতে নৌকা, স্পিডবোট ও হেলিকপ্টারসহ নানা মাধ্যমে উদ্ধার তৎপরতা ও খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করে যাচ্ছে। সেনাবাহিনীর দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের ফোন নম্বর গণমাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে, যাতে এলাকাভিত্তিক সহযোগিতা নিশ্চিত করা যায়। একইভাবে নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীও তাদের সরঞ্জাম ব্যবহার করে বন্যার্ত অসহায়দের সেবা দিয়ে যাচ্ছে এবং বন্যাদুর্গত এলাকা পর্যবেক্ষণ ও ত্রাণ সহায়তা পৌঁছে দিতে কাজ করে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যেকোন সময় অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী, প্রজ্ঞাবান, মেধাশীল ও অসীম সাহসী। আমাদের সেনাবাহিনী জানে, তারা মারা গেলে শহীদ হবে, আর তাই মৃত্যু ভয় তাদের ভিতরে নেই। যে জাতি মৃত্যুকে ভয় করে না, যে জাতি মৃত্যুকে জয় করেছে—তাদেরকে ভয় দেখাবে কোন জাতি? যারা আমাদের বীরত্ব গাঁথা সেনাবাহিনীর ইতিহাস জানেন না, শুধু তারা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে নিয়ে ইঁচড়ে পাকা কথা বলতে পারে, যা মূল্যহীন। আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ অতি সাধা-সিধা, এবং বেশিরভাগ বাংলাদেশী মনে করেন—সেনাবাহিনী আমাদের শেষ আশ্রয়স্থল।

 

Read More

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked with *

সর্বশেষ পোস্ট

Advertising