সামসুল ইসলাম টুকু: সঞ্চয়পত্র যেন গত কয়েক বছরে সরকারের খেলার সামগ্রী হয়ে উঠেছে। একটা সময় এই সঞ্চয়পত্র স্কীমটি সরকারের কাছে যেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল তেমনি জনসাধারণের কাছেও অতি প্রিয় ছিল। বিভিন্ন বিধি নিষেধের বেড়াজালে স্কীমটি অজনপ্রিয় ও অবিশ্বস্ত হয়ে উঠেছে। ইচ্ছে করলেই সঞ্চয়পত্র কেনার জন্য পর্যায়ক্রমে যেমন শর্ত আরোপ করা হয়েছে তেমনি ইচ্ছেমতো শর্ত শিথিল করাও হয়েছে। আবার ইচ্ছেমতো সুদের হার কমানো বাড়ানো হয়েছে। যার ফলে বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণির সঞ্চয়পত্র ক্রেতারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইতোমধ্যে। হালে খেলাপি ব্যাংকগুলোর অসহযোগিতার কারণে সঞ্চয়পত্র কেনা বেচার ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভাটা পড়েছে।
৬/৭ বছর আগে প্রায় তিন যুগ ধরে সঞ্চয়পত্র অফিস থেকে ও পোস্ট অফিস থেকে খুব সহজ শর্তে সঞ্চয়পত্র কেনা-বেচা হয়েছে। সঞ্চয়পত্রের টোকেনের মাধ্যমে সুদ গ্রহণে ও সঞ্চয়পত্র ভাঙানোর ক্ষেত্রে কোনো সমস্যার সৃষ্টি হয়নি। সময়ের কোনো অপচয় ছাড়াই দ্রুততম সময়ে হাজার হাজার গ্রাহকের লেনদেন সম্পন্ন হয়েছে। কোনো জটিলতার কথা শোনা যায়নি। জটিলতা সৃষ্টি করা হলো ৬/৭ বছর আগে সরকারের আয়কর বিভাগ থেকে। নির্দেশ হলো , যে কোনো সঞ্চয়পত্র ক্রেতাকে আয়কর অফিস থেকে টিন সার্টিফিকেট নিতে হবে। অন্যথায় সঞ্চয়পত্র কেনা যাবেনা। এই নির্দেশের কারণ হিসেবে বলা হয় জনসাধারণকে আয়কর জালে আটকানো। হতে পারে একটি রাষ্ট্রের প্রতিটি মানুষ আয়করের আঁওতায় এলে রাজস্ব আয় যেমন সহজ হয় তেমনি জনসাধারণকে সেবা প্রদানও সহজ হবে। সরকারিভাবে এ ধরনের কথা বলা হলেও দেশের সিংহ ভাগ অর্থ যাদের হাতে এবং বর বড় খেলাপিদের কাছ থেকে সরকার আয়কর আদায়ে ব্যর্থ হয়েছে। আর সেই ব্যর্থতার দায় মধ্যবিত্তদের ও সাধারণ মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
সঞ্চয়পত্র ক্রেতারা তাদের তিল তিল করে সঞ্চিত অর্থ অন্য কোনো খাতে বিনিয়োগের ঝুঁকি আছে মনে করেই সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ করে। এ ্কারণে আয়কর বিভাগ এর নির্দেশের প্রেক্ষিতে দলে দলে ছুটলো আয়কর অফিসে টিন সার্টিফিকেট সংগ্রহের জন্য। এর পরের বছর নির্দেশ এলো যারা টিন সংগ্রহ করেছেন তাদের সকলকে প্রতি বছর রিটার্ন দাখিল করতে হবে বিশেষত সর্ব নিম্ন ৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ক্রেতাদের। এই রিটার্ন দাখিল করার যন্ত্রণায় বহু ক্রেতা সঞ্চয়পত্র কেনা ছেড়ে দিলো। এসব ক্রেতারা বলেন যে কোনো সঞ্চয় হিসেব হোকনা কেন তার প্রাপ্ত সুদ থেকে কর্তৃপক্ষ রিটার্ন দাখিল কারীদের কাছ থেকে ১০% হারে এবং যারা রিটার্ন দেননা তাদের কাছ থেকে ১৫% হারে আয়কর কেটে নেয়। ক্রেতা আপত্তিও করেনা। তাহলে রিটার্ন দাখিল করার কঠিন কাজটি চাপিয়ে দেওয়ার কোনো যুক্তি নেই। শুধু তাই নয় এজন্য আয়কর উকিল ধরতে হবে , তার পকেট ভরতে হবে। সে ক্ষেত্রে সরকার যদি ২০% হারে আয়কর কেটে নেয় তাতেও ক্রেতারা আপত্তি করবেনা। তাছাড়া ক্রেতার যদি আরও সম্পদ থাকে তার খোঁজ খবর নেওয়ার দায়িত্ব আয়কর বিভাগের এবং তাদের রিটার্ন দাখিলে বাধ্য করতে পারে। এরপরের বছর নির্দেশ এলো নগদ টাকায় সঞ্চয়পত্র কেনা যাবেনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে এবং সেই ব্যাংক থেকে চেক প্রদানের মাধ্যমে সঞ্চয়পত্র কেনা যাবে। এর ফলে অল্প টাকার সঞ্চয়পত্র ক্রেতারা আর এক দফা সঞ্চয়পত্র কেনা বন্ধ করে দিলো। এরপরে সরকার আরও এক ধাক্কা দিলো সঞ্চয়পত্রের সুদের হার প্রায় ৩% কমিয়ে। ফলে মাধ্যবিত্তদের একটা অংশ তাদের অর্থ অন্য কোনো খাতে বিনিয়োগ করা শুরু করলো। এদের অধিকাংশই প্রার্থিত লাভ না করতে পেরে পুঁজি হারাতে থাকলো। সঞ্চয়পত্র বিক্রি আশঙ্কাজনক হারে কমে গেল। এ নিয়ে পত্র পত্রিকায় লেখা লেখিও হলো। অন্য দিকে মোটা অঙ্কের সঞ্চয়পত্র ক্রেতারা তাদের অর্থে জমি জায়গা কেনা শুরু করলো। ফলে জমি জায়গা দোকান পাটের দাম হু হু করে বেড়ে গেল।
অর্থনীতির এই পরিবর্তন জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়লো।
ঠিক এরপর নির্দেশ এলো ৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ক্রেতাকে রিটার্ন দিতে হবেনা এবং যৌথভাবে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত সঞ্চয়পত্র কিনতে পারবে। এসময় খেলাপি ব্যাংক গুলোর চেহারা প্রকটভাবে উন্মোচিত হলো। তারা ব্যাংকের আমানত বাড়াতে সুদের হার বৃদ্ধি সহ বিভিন্ন চমকপ্রদ ও আকর্ষণীয় সঞ্চয় স্কীম চালু করলো গ্রাহকদের আকৃষ্ট করার জন্য। এ প্রক্রিয়ায় কিছু মানুষতো আকৃষ্ট হলো। এসব খেলাপি ব্যাংক গ্রাহকের টাকা ব্যাংকে রেখে দিলো আর গ্রাহকের জরুরি প্রয়োজনেও তাদের জমাকৃত টাকা উঠাতে গিয়ে বাধাগ্রস্ত হলো এবং এখনো হচ্ছে। এদিকে সরকার সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বৃদ্ধি করে আগের পর্যায়ে অর্থাৎ ১২.৫% দেবার ঘোষণা করলো। কিন্তু তাতে কি হবে ? সঞ্চয়পত্র কেনার জন্য যখন ব্যাংকের চেক দিচ্ছে তখন তা ব্যাংকগুলো ছাড় দিচ্ছেনা ডিজনার করছে। গ্রাহকরা সঞ্চয়পত্র কিনতে পারছেনা। লাল জোনে চিহ্নিত এসব ব্যাংক গুলো গ্রাহকদের সাথে নির্লজ্জভাবে প্রতারণা করছে। গ্রাহকদের প্রার্থিত অর্থ প্রদানে দিনের পর দিন ঘোরাচ্ছে হয়রান করছে। শুধু তাইনয় কোনো গ্রাহক নগদ টাকা জমা দিয়ে পরের দিন জরুরি প্রয়োজনে টাকা উঠাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসছে। হাজার হাজার গ্রাহক আজ এই সঙ্কটে নিপতিত। কোনো গ্রাহক ব্যাংকের এই আচরণে বিরক্ত ও চেচামেচি করলে তাকে ভয়ভীতি প্রদর্শন সহ হয়রান করা হচ্ছে। এসব খবর পত্র পত্রিকায় এলেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছেনা। যদিও সরকার তথা বাঙ্গলাদেশ ব্যাংক এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে বা খেলাপি ব্যাংকগুলোকে সচল রাখার জন্য বেশ কিছু অর্থ প্রদান করেছে এবং প্রয়োজনে নতুন টাকা ছাপিয়ে ব্যাংকগুলোকঙ্কদেওয়া হবে বলে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে পাশাপাশি ব্যাংকের গ্রাহকদের আশ্বস্ত করে বলা হয়েছে তাদের অর্থ পাবে ,তবে ধীরে ধীরে। আর এ সুযোগ গ্রহণ করছে ব্যাংকগুলো । গ্রাহকদের টাকা দিতে গড়িমসি করছে। নিরুপায় গ্রাহক তা মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে অনিচ্ছা সত্ত্বেও। অনেক গ্রাহক তাদের জমাকৃত টাকা আদৌ ফেরত পাবে কিনা সেই আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছে। এভাবেই গ্রাহকদের প্রিয় ও বিশ্বস্ত সঞ্চয়ী স্কীম খোলা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হচ্ছে। যা কিনা সরকারের আপদকালীন ফান্ড হিসেবে বহুকাল ধরে পরিচিত। এমন হাজার হাজার সঞ্চয়পত্র গ্রাহক সঞ্চয়পত্র কিনতে পারছেনা খেলাপি ব্যাংকগুলোর অন্যায় ও অবৈধ অসহযোগিতার কারণে। এসব ব্যাংক গ্রাহক কাকে এই অভিযোগ গুলো জানাবে? কে এর প্রতিকার করবে ? তাদের অর্থের কি হবে ? এমন অনেক প্রশ্নে গ্রাহকেরা নিজেরাই জর্জরিত। মুখ বন্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছে ব্যাংকগুলোর দুর্ব্যবহার। একটা গুমোট অবস্থা বিরাজ করছে মাঠ পর্যায়ে। বিস্ফোরিত হতে পারে যে কোনো সময়ে।
লেখক-সাংবাদিক