জগন্নাথদী থেকে লক্ষ্মীনারায়ণপুর রোডের মাঝামাঝি পৌঁছলে পথচারীদের চোখে পড়ে এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। প্রকৃতির আপন মহিমায় ভরে ওঠা একটি রাস্তার ধারে সারি সারি সোনালু গাছ দাঁড়িয়ে যেন প্রকৃতির নিজ হাতে আঁকা এক চিত্রপট। এই গাছগুলো এখন ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে। হলুদ রঙের এত বিপুল সমারোহ যে গাছের পাতা বা ডালপালার অস্তিত্বই যেন হারিয়ে গেছে। আকাশ থেকে নেমে আসা এক হলুদ ঢেউ যেন ছড়িয়ে রয়েছে প্রতিটি গাছে।
এই সোনালু গাছগুলো সাধারণত এপ্রিল-মে মাসে ফুলে ফলে ভরে ওঠে। ইংরেজিতে যার নাম “Golden Shower Tree”, বৈজ্ঞানিক নাম Cassia fistula, আমাদের অঞ্চলে একে সোনালু বা বানরলাঠি নামেও ডাকা হয়। তবে স্থান-কাল ভেদে নাম যাই হোক না কেন, তার সৌন্দর্যের কোন তুলনা নেই। প্রকৃতির এই হলুদ অলংকার যেন পথচলার ক্লান্তি ভুলিয়ে দিতে জানে।
প্রতিটি গাছে ঝুলে থাকা অসংখ্য বড় বড় ফুল যেন একেকটি হলুদ চন্দ্রহার। দীর্ঘ কাণ্ডের একেক পাশে ঝুলে থাকা পাপড়িগুলো এমনভাবে সাজানো যেন কেউ সূচিকর্ম করে গাছে পরিয়ে দিয়েছে। অগণিত ফুলের সে বাহার দেখে পথচলতি যেকোনো মানুষ অনায়াসেই থেমে যেতে বাধ্য হয়। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চোখ ভরে না দেখলে মনেই হয় না পথচলা সম্পূর্ণ হলো।
সোনালু গাছের নিচে দাঁড়ালে মাথার ওপর ঝুলে থাকা অসংখ্য ঝাড়বাতির মতো ফুলের সারি যেন মাথায় পড়া এক অলৌকিক ছায়া তৈরি করে। গাছের নিচে পড়ে থাকা অসংখ্য পাপড়ি মিলে যেন গড়ে তুলেছে হলুদের কার্পেট। তাজা ফুলের পাপড়ি থেকে ভেসে আসে এক মৃদু সৌরভ, যা হৃদয় ছুঁয়ে যায় নীরবে। মনে হয়, যেন প্রকৃতির হাতেই বিছানো এক অমায়িক স্বপ্নলোকের চিত্রপট।
পথচলা পথিকরা যখন এই গাছগুলোর নিচে এসে পৌঁছান, তারা অনেকেই থেমে যান। কেউ ছবি তোলে, কেউ ভিডিও করে। আবার কেউ কেউ একটুখানি ছায়া খুঁজে বসে পড়ে নিচের ঘন হলুদ পাপড়ির স্তূপে। এখানেই চোখে পড়ে গ্রামের কিশোরীদের অনন্য সরল সৌন্দর্য। তাদের মাথার চুলে সোনালু ফুল গুঁজে দেওয়া। মুখে স্নিগ্ধ হাসি। কারো কারো নাকে পরে থাকা একটি চিকন রিং, যা অবিকল সোনালু ফুলের ঝরা অংশের মতো দেখতে। প্রকৃতির উপহার দিয়ে নিজেকে সাজানোর এর চেয়ে সুন্দর উপায় আর কী হতে পারে?
এই ফুল শুধু যে সৌন্দর্যের প্রতীক, তা নয়। এটি আমাদের সংস্কৃতিতেও জায়গা করে নিয়েছে। বৈশাখের আগমনে সোনালুর হলুদ রঙ যেন নববর্ষের আনন্দের প্রতীক হয়ে ওঠে। অনেক স্থানে এই ফুল নববর্ষের শুভেচ্ছায় উপহার হিসেবে দেওয়া হয়। আবার অনেক কবি-সাহিত্যিকের কবিতায়, গল্পে বা গানে উঠে এসেছে এই ফুলের কথা।
স্থানীয়রা জানান, এই সোনালু গাছগুলো বহু বছর ধরে এখানে দাঁড়িয়ে। কেউ কেউ বলেন, এই গাছগুলো নাকি নিজেদের মত করে জন্মেছে, কারও লাগানো নয়। আবার কেউ কেউ বলেন, পথের পাশে ছায়া ও সৌন্দর্যের জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে লাগানো হয়েছিল। যাই হোক না কেন, আজ তারা এই রাস্তাটিকে দিয়েছে এক নতুন পরিচয়—‘সোনালু-পথ’ নামে অনেকেই ডাকেন এখন এই রুটকে।
সোনালু গাছের এই সৌন্দর্য শুধু চোখে নয়, হৃদয়ে বাসা বাঁধে। এর সৌন্দর্য মনের মাঝে রেখে পথচলা এক অন্যরকম অনুভূতি। এ যেন প্রকৃতির এক অমল স্বপ্ন, যা বাস্তবের মধ্যে থেকেই আমাদের কল্পনার রাজ্যে নিয়ে যায়।
সাধারণ একটি রাস্তা, সাধারণ কিছু গাছ। কিন্তু প্রকৃতির স্পর্শে তারা হয়ে উঠেছে অসাধারণ। এর মধ্যেই নিহিত আমাদের শেকড়, আমাদের অনুভব, আমাদের শিল্পবোধ। এই রকম দৃশ্যগুলোই মনে করিয়ে দেয়—প্রকৃতি আসলে সবচেয়ে বড় শিল্পী। আর আমরা তার দর্শক।
পরিশেষে বলতে হয়, এই সোনালু-পথ শুধু ফুলের রাস্তা নয়, এটা এক অনুভবের পথ, যেখানে চোখ, মন ও আত্মা। এখানে প্রতিটি পাপড়ি যেন বলে, “এতটুকুই প্রকৃতি চাই—স্রেফ একটু সময়, একটু মনোযোগ, আর ভালোবাসা।”