হিজড়াদের জীবন যাত্রায় পরিবর্তন করে কাজের হাতে পরিণত করা আবশ্যক


সামসুল ইসলাম টুকু : দৈনিকগুলোর পাতা ভরে যখন শুধু হতাশা আর নেতিবাচক খবরের ছড়াছড়ি সেই সময় একটি সুসংবাদ বিক্ষিপ্ত ও ক্লান্ত মনকে স্বাভাবিকভাবে একটু আলোড়িত করে । পারিবারিক, সামাজিক এমনকি রাষ্ট্রীয়ভাবে যারা অবহেলিত ও উপহাসের পাত্র তারা আজ দেশের মানুষের জন্য কিছু করতে চায় , দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে চায়। ইতোমধ্যে তারা বেশ কয়েকজন একত্রিত হয়ে “সম্ভব ফাউন্ডেশন” নামে একটি বেসরকারী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছে এবং একটি তহবিল গঠনের মাধ্যমে গত রোজার মাসে কিছু গৃহহীন , ছিন্নমুল ,অসহায় মানুষদের ইফতার ও সেহরির ব্যবস্থা করেছে । ঈদ উপলক্ষে তারা ৬০ টি অসহায় পরিবারকে একটি শাড়ী, একটি লুঙ্গি, ৫কেজি ভাতের চাল, ১কেজি পোলাও চাল , ১কেজি চিনি, ১ কেজি ডাল, ১কেজি তেল, ১কেজি পেয়াঁজ, ১কেজি লবণ, ১কেজি দুধ , ২ প্যাকেট সেমাই দিয়েছে। এই সহযোগিতাখুব সামান্য হলেও তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই কারণেই যে যারা এই সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে তারা নিজেরাই অবহেলিত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত । অসহায় মানুষেরা তাদের সহযোগিতা পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়েছে যা দেখে তারাও আনন্দাপ্লুত হয়েছে । তারা বলেছে সঠিক পরিকল্পনা ও সঠিক মানুষের সন্ধান পেলে সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করবে ।মানুষকে উত্ত্যক্ত করা ও চাঁদাবাজী করার যে বদনাম তাদের আছে তা দূর করার লক্ষেই তারা কাজ করছে। এরা মূলত হিজড়া। হিজড়াদের সঠিক পরিসংখ্যান জানা যায়না তবে শোনা যায় দেশে তাদের সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার ।
সংবাদটি সমাজের জন্য কিছু বার্তা বহন করে । যেমন, তারা অবহেলিত হয়েও মানুষ ও সমাজের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে, তারা উপেক্ষিত থাকতে চায়না এবং অন্যদেরও উপেক্ষিত রাখতে চায়না, সম্মান নিয়ে বাঁচতে চায় , লিংগ পরিচয়ের ঊর্ধ্বে তারা যে মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি চায় এবং মূলধারায় ফিরে যেতে চায় । এসব বার্তা বা দাবিগুলো কোনোটিই অযৌক্তিক নয় এবং সেগুলো পূরণ করাও কোনো কঠিন কাজ নয় ।
তারা আজও অবহেলিত কেন সে বিষয়গুলো জানা দরকার । জন্মেই তাদের লিংগ পরিচয়টি জিজ্ঞাসার মুখোমুখি হয়। প্রকৃতির এ রহস্য আজও অনুদঘাটিত ।যদিও বিভিন্ন গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন মতামত রয়েছে। কিন্তু তাদের সামাজিক পরিচয় ও অবস্থানের ক্ষেত্রে কোনো সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেনি । তাদের বয়স ৭/৮ বছর হলে মেয়েদের মত কাপড় চোপড় পরে , মেয়েদের মত চলাফেরা করে , চুল ছাড়ে , মেয়েদের মত কথা বলে । এসব কারণে তারা নিজ পরিবারেই থাকতে পারেনা । বাল্যকাল থেকেই তাদের নিয়ে পরিবার সমস্যায় ভুগে ।একসময় তাদের চিরচেনা পারিবারিক পরিবেশ ত্যাগ করতে হয়। জীবনটা হয় ছন্নছাড়া। মহিলারা তাদের মোটেই পছন্দ করেনা । আর পুরুষরা যারা মেলামেশা করে তারা নেহাৎই রঙ তামাশা করার জন্য । তারা তো ভিক্ষার নামে রীতিমত চাঁদাবাজি করে । চাহিদামত অর্থ না পেলে মানুষকে উত্ত্যক্ত করে অকথা কুকথা বলে নাজেহাল করে । কোনো বাড়িতে নবজাতক হলে তাকে আশীর্বাদের নামে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায়েরজন্য সেই বাড়িতে যায় হৈ হুল্লোড় করে , উদ্যম নৃত্য করে , বেহায়াপনা করে যতক্ষণ তাদের প্রার্থিত অর্থ আদায় করতে না পারে । ট্রেনের যাত্রীদের সাথে দুর্ব্যবহার করে অর্থের জন্য। সেই অর্থের পরিমাণটা দশ টাকার কম নয় । যুবক শ্রেণির যাত্রীরা তাদের আক্রমণের শিকার হয় । অর্থ দিতে না পারলে বা দিতে না চাইলে খিস্তি করে অশ্রাব্য ভাষায়। এগুলোকে তাদের ন্যায্য দাবি বলে মনে করে। শুধু তাই নয়, তাদের কেউ কিছু বললে তারা একত্রিত হয়ে হামলা চালায় । অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবেশ সৃষ্টি করে। প্রতিপক্ষকে নাজেহাল করে ছাড়ে অশ্লীল বাক্যবাণ ছুড়ে ।প্রেক্ষিতে সমাজ তাদের গ্রহণ করেনা । তাহলে তারা কি করবে ? তাদের এই পথ গ্রহণ ছাড়া বিকল্প আছে কি? যাইহোক সর্বোপরি তাদের বেপরোয়া চলাফেরা ও উদ্ধত কথাবার্তার জন্য সাধারণ মানুষ তাদের কাছ থেকে দূরত্ব রাখে । ক্রমশ তারা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভাসমান জনগোষ্ঠিতে পরিণত হয় ও ডেরার জীবন বরণ করতে হয় অথবা ভিক্ষাবৃত্তির উদ্ধত জীবন গ্রহণ করতে হয় । এ জীবন থেকে মুক্ত হয়ে সামাজিক জীবনে ফিরে আসার প্রবল ইচ্ছে থাকলেও ওই সামাজিক কারণেই তা হয়না। চিকিৎসা শিক্ষা কর্ম সংস্থানসহ নানাস্থানে বিড়ম্বনার মুখে পড়ে । যদিও সরকার ২০১৩ সালে তাদের তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি দিয়েছে ।
জন্ম থেকে এদের সাথে পারিবারিক ও সামাজিক এমন অবহেলা, অসহযোগিতা ও ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও সম্প্রতি তারা অসহায় মানুষের জন্য সেবার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তা কোনোভাবেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই ।তাদের ওই শুভবুদ্ধিকে কাজে লাগাতে হবে। শুধুমাত্র তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি দিয়ে শেষ করলে চলবেনা । বরং রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের সামাজিক অবস্থানকে সুদৃঢ় করা যায় সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার সময় এসেছে । তারা তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি পেলেও সামাজিক বাধা অতিক্রম করার সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। এই পরিচয়ে হিজড়ারা ভোটার হওয়া ও জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়ার সুযোগ পেয়েছে বটে কিন্তু দেশের বিদ্যমান আইন অনুযায়ী বাবা-মার উত্তরাধিকার নিশ্চিত হয়নি । কারণ তারা ছেলেও না মেয়েও না । তাই তারা পিতা মাতার সন্তান হিসেবে সেই অধিকার নিশ্চিত করতে চায় । আর এ কারণে অনেক হিজড়া তৃতীয় লিঙ্গের পরিচয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র নিতে আগ্রহী নয় । এদিকে চাকুরির বিজ্ঞপ্তিতে শুধু পুরুষ বা নারীর উল্লেখ থাকে । তৃতীয় লিঙ্গের উল্লেখ থাকেনা । ফলে তারা সরকারি বেসরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত হয় । তাছাড়া হিজড়া বা তৃতীয় লিংগ পরিচয়ে আজও সমাজে গ্রহণযোগ্যতার পরিবেশ তৈরি হয়নি ।
হিজড়াদের এসব সমস্যা মুক্ত করতে সংশ্লিষ্ট আইনগুলোর সংশোধন ও পরিবর্তন জরুরি। সেইসাথে তাদের লেখাপড়ার ক্ষেত্রটি উন্মুক্ত করা দরকার। তাদের সেনাবাহিনী সহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য হিসেবে নিয়োগ দিলে যেমন তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে তেমনি সামাজিক মর্যাদাও বাড়বে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাদের স্বীকৃতি সহ রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয় বলে জানা যায় । আর বাংলাদেশে তাদের সমাজে অস্তিত্ব থাকলেও কাগজে কলমে নেই। তাদের কারিগরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিভিন্ন মিল কারখানা বা হস্তশিল্পে কারিগর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে । তাদের শুভবুদ্ধিকে কাজে লাগাতে হবে এখনই । এ কাজটি একমাত্র সরকারই করতে পারে । তাদের চাঁদাবাজির পথ থেকে বিরত করে কাজের হাতে রুপান্তর করা যেতে পারে । তাহলে সমাজ অনেক দ্বন্দ্ব ফ্যাসাদ মুক্ত হতে পারে ।
লেখক -সাংবাদিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *