728 x 90

ধ্বংসাত্মক মোবাইলের বিষাক্ত ছোবল

চোখ লাল, ঘুমঘুম ভাব, মাথা উসকোখুসকো। ক্লাসে প্রবেশ করল একজন ছাত্র। শিক্ষক জিজ্ঞাস করল, তুমি কি গতকাল ঘুমানোর আগে মোবাইল হাতে নিয়েছিলে? ছাত্রটি ইতস্তত করে সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা প্রশ্ন করল, স্যার বুঝলেন কিভাবে? শিক্ষক কোন কথা না বলে মুসকি হাসলেন। মানব দেহে মোবাইলের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে যাদের সামান্যতম জ্ঞানও আছে তারা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, ঘুমানোর আগে মোবাইল

চোখ লাল, ঘুমঘুম ভাব, মাথা উসকোখুসকো। ক্লাসে প্রবেশ করল একজন ছাত্র। শিক্ষক জিজ্ঞাস করল, তুমি কি গতকাল ঘুমানোর আগে মোবাইল হাতে নিয়েছিলে? ছাত্রটি ইতস্তত করে সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা প্রশ্ন করল, স্যার বুঝলেন কিভাবে? শিক্ষক কোন কথা না বলে মুসকি হাসলেন। মানব দেহে মোবাইলের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে যাদের সামান্যতম জ্ঞানও আছে তারা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, ঘুমানোর আগে মোবাইল ব্যবহারের কি কি আপদ আছে। অনিদ্রা, মাথা ব্যাথার অন্যতম কারণ ঘুমানের আগে মোবাইল ব্যবহার করা। গবেষণায় দেখা গেছে, মোবাইল থেকে বের হওয়া রশ্মি চোখের জন্য যেমন ক্ষতিকর, তেমনি তা অনিদ্রার জন্য দায়ী। মোবাইল থেকে বের হওয়া তরঙ্গ রশ্মির কারণে শিশু-কিশোরদের স্বাস্থ্যের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। শিশুকালেই তাদের চোখ ও কানের সমস্যা প্রকট হচ্ছে। চক্ষু বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, মোবাইলের প্রতি ছোট বেলা থেকেই প্রবল আসক্তির কারণে অগণিত বাচ্চারা আজ চোখের দৃষ্টি হারাচ্ছে অথবা দৃষ্টি প্রতিবন্ধি হচ্ছে। এমনকি স্মৃতিশক্তিও লোপ পাচ্ছে। তাদের মধ্যে একঘেয়েমি ও আত্মকেন্দ্রিকতা বাড়ছে। মেজাজ খিটখিটে ও চড়া হচ্ছে। 

কথায় বলে, বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ। বিজ্ঞান দিয়েছে গতি, কেড়ে নিয়েছে চোখের জ্যোতি। এই কথাটা আজ অক্ষরে অক্ষরে সত্য হচ্ছে। বিশেষ করে মোবাইলের ক্ষেত্রে এটি আরও বেশী প্রযোজ্য। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, মোবাইলের নেশা ড্রাগসের নেশারও চেয়েও মারাত্মক। কারণ, ড্রাগসের নেশা সাময়িক, কিন্তু মোবাইলের নেশা দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত। ড্রাগসের নেশার কার্যকারিতার একটি নির্দিষ্ট সময়কাল থাকে। এই নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে গেলে নেশাগ্রস্ত ব্যাক্তি সম্ভিত ফিরে পায়, কিন্তু মোবাইলের নেশা এমন যে তার কোন সময়সীমা নেই। সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই যায় মোবাইলে হাত। আবার ঘুমাতে যাবার আগেও মোবাইল। পথে হাটছে, মোবাইলে কথা হচ্ছে। চালক গাড়ি চালাচ্ছে, মোবাইলে বকবক করছে। যাত্রী গাড়িতে উঠছে, মোবাইলে কথায় ব্যাস্ত। গাড়ির ভিতরে ছিটে বসে আছে, তাও মোবাইলে চলছে অনবরত বকবকানি। টয়লেটে ডুকছে মোবাইল, টয়লেটের ভিতরে তাও মোবাইল। পবিত্র কাজে মানুষ মসজিদে আসছে। নামাজের মধ্যেই হঠাৎ বেজে উঠছে মোবাইল। এমনকি স্বামী-স্ত্রী পাশাপাশি এক বিছানায় শুয়ে আছে, দু’জন দু’দিকে মুখ করে ফেসবুক চালাচ্ছে। ফেসবুকে অপরের ফেস (মুখ) দেখতে দেখতে নিজের আপনজনের ফেস দেখারও সময় নেই। এক কথায় মোবাইলের নেশা এমন এক নেশা যা মানুষকে সারাটা দিনই ব্যস্ত রাখছে।

ড্রাগসের নেশা মানুষ একটা বয়স হবার পরে করে থাকে। কমছে কম ১২/১৩ বছরের পর থেকে তা শুরু হয়। কিন্তু মোবাইলের নেশা এমন এক নেশা যা কয়েক মাসের কচি বাচ্চাকেও গ্রাস করে ফেলে। আজকাল হাজারো বাচ্চা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে মোবাইলের নেশায়। ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনা সব গোল্লায় যাচ্ছে। শহর কি গ্রাম, ফ্লাট কি বস্তি, ধনী কি গরিব, সকলেই আজ মোবাইলের নেশায় বুদ হয়ে যাচ্ছে। অক্টোপাস ধরে আট হাত দিয়ে, আর মোবাইল যেন আমাদেরকে গ্রাস করছে সবদিক থেকে। আগে অপরাধ ও গোনাহ করতে হলে মানুষকে সিনেমা, থিয়েটার, ক্লাব ও আরও কিছু গোপন জায়গায় যেতে হতো। কিন্তু এখন মানুষ এ সমস্ত গোনাহ বাসায় বসেই করছে। উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা যাতে বিপথগামী না হয়, সে কারণে অভিভাবকবৃন্দ তাদেরকে সন্ধার পরে বাড়ির বাইরে যেতে দিতেন না। কিন্তু আজ উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা মা-বাবার চোখের সামনেই সেই সুযোগ করে নিচ্ছে। এসবই মোবাইলের কৃতিত্ব (!)। সিএনএনের এক গবেষণা মতে, ৫০ শতাংশ কিশোর ও ২৭ শতাংশ মাতা-পিতা মনে করেন, তাঁদের মধ্যে মোবাইল ফোন আসক্তির রূপ নিয়েছে। প্রায় ৮০ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী প্রতি ঘণ্টায় তাদের মোবাইল চেক করে। ৭২ ভাগ অনুভব করে যে অন্যের মেসেজের রিপ্লাই দেওয়া তাদের জন্য জরুরী।

মোবাইলের মাধ্যমে যে শুধু নৈতিক পদস্খলন হচ্ছে তাই নয়, এর মাধ্যমে মানুষ শারিরীক ও মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ছে।

আজ মোবাইল ফোন ব্যবহারে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। ইসরাইলের হাইফা বা হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের জরিপ মতে, উচ্চ বিদ্যালয়ের ৯৪ ভাগ শিক্ষার্থী ক্লাসের মধ্যেই মোবাইল ব্যবহার করছে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে। তাদের সৃজনশীলতা ও মেধা ধ্বংস হচ্ছে। মোবাইলের মাধ্যমে তারা পরীক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছে। তারা পানাহারে অমনোযোগী হচ্ছে। ফলে স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিচ্ছে। বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি দেশের উপর জরিপ চালিয়ে জাপানের ডকোমো ফাউন্ডেশন এই তথ্য প্রকাশ করেছ যে, ৭০ শতাংশ শিশু অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহারের কারণে পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। পরিবার ও সমাজবিচ্ছিন্নতা শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিত্ব গঠনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। বাংলাদেশের ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশের রাজধানীতে ৭৭ শতাংশ স্কুলগামী শিক্ষার্থী আজেবাজে সাইটে আসক্ত হয়ে পড়েছে। যা দেখছে তা লেখার যোগ্য নয় বিধায় আর আগে বাড়ছি না। একটি মোবাইল কোম্পানির এক জরিপে উঠে এসেছে, বাংলাদেশের প্রায় ৪৯ শতাংশ স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থী কোনো না কোনোভাবে সাইবার হুমকির শিকার। তাদের মধ্যে ক্লাসের প্রতি মনোযোগিতা কমছে। মা-বাবার উপদেশ না মানার প্রবণতা বাড়ছে। দীর্ঘ সময় বসে থাকার কারণে তাদের পিঠ ও হাড়ে রোগ দেখা দিচ্ছে। ফলে পরিণত বয়সের আগেই তাদের বার্ধক্য পেয়ে বসছে। কান বেশির ভাগ সময়ে মোবাইলে ব্যস্ত থাকায় চিন্তা ও মননে এর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। তাদের মধ্যে মানবিক গুণাবলি বিকাশের পরিবর্তে অমানবিকতা ও পশুত্ব বাড়ছে।

ধ্বংসাত্মক মোবাইলের বিষাক্ত ছোবল আজ কি অপ্রতিরোধ্য!

(লেখক: মৎস্য-বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, সিডনী থেকে)

Read More

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked with *

সর্বশেষ পোস্ট

Advertising