728 x 90

জেনেটিক কোডিং: আল্লাহর অস্তিত্বের অকাট্য প্রমাণ (পর্ব-১)

শুরুতেই পাঠকের কাছে কয়েকটি প্রশ্ন। বলুন তো, মানুষের পেট থেকে কেন শুধু মানুষের বাচ্চা বের হয়? গরুর পেট থেকে গরুর বাচ্চা, ছাগলের পেট থেকে ছাগলের বাচ্চা, আর মুরগীর পেট থেকে কেন মুরগীর বাচ্চা? মানুষের পেট থেকে কেন গরু বের হয় না? অথবা গরুর পেট থেকে কেন মানুষ বের হয় না? অনেকে বলবেন, এগুলো কোন পশ্ন হলো।

শুরুতেই পাঠকের কাছে কয়েকটি প্রশ্ন। বলুন তো, মানুষের পেট থেকে কেন শুধু মানুষের বাচ্চা বের হয়? গরুর পেট থেকে গরুর বাচ্চা, ছাগলের পেট থেকে ছাগলের বাচ্চা, আর মুরগীর পেট থেকে কেন মুরগীর বাচ্চা? মানুষের পেট থেকে কেন গরু বের হয় না? অথবা গরুর পেট থেকে কেন মানুষ বের হয় না? অনেকে বলবেন, এগুলো কোন পশ্ন হলো। মাথা খারাপ নাকি? মানুষের পেট থেকে মানুষ, আর গরুর পেট থেকে গরু জন্ম নিবে এটাই স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক। তাহলে আবার প্রশ্ন হলো, ব্যাপারটা স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক আমরা কেমন করে এই কথাটি বললাম। আমি বলব এটা অত্যন্ত অস্বাভাবিক এবং অত্যন্ত জটিল প্রশ্ন। কারণ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই আধুনিক বিজ্ঞানের শক্তিশালী শাখা জেনেটিক্সের উদ্ভব ঘটেছে। এই ছোট্ট প্রশ্নের উত্তর দিয়েই অনেক বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। এই প্রশ্নের উত্তরের পিছনেই কিন্তু লুকিয়ে রয়েছে অত্যন্ত গোপন রহস্য এবং মহান সৃষ্টি কর্তার এক সুনিপূণ পরিকল্পনা যাকে ইসলামী পরিভাষায় তাকদীর বা পরিমাপ বলা বলা হয়। এই পরিমাপের কারণেই মানুষ গাছের মতো ক্রমাগত বাড়তে থাকে না; সর্বোচ্চ ৬-৭ ফুট হলেই তার উচ্চতা বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়। যদি মানুষের উচ্চতা গাছের মতো বাড়তে থাকতো, তাহলে চিন্তা করুন, আমাদের ঘরের ছাদের কি হতো! প্রতি বছরই ছাদের উচ্চতা বাড়ানো লাগতো, তাই না? প্রত্যেক মানুষ একে অপরের থেকে চেহারার দিক দিয়ে ভিন্ন। কিন্তু অনেকগুলো কালো ছাগল কিন্তু দেখতে একই রকম। সুতরাং, ছাগলের মতো যদি প্রত্যেকটা মানুষ দেখতে এক রকম হতো তাহলে একজনের ব্যাংক থেকে আর একজন অনায়েসেই টাকা চুরি করে নিত। একজনের জমি অন্যজন নিজের নামে চালিয়ে দিতো। ব্যাপারটি আরও জটিল হতো যদি একজনের স্ত্রীকে আর একজন নিজের বলে দাবি করতো। সাথে সাথে ঝগড়া-ঝাটি বেঁধে যেতো। থাকগে যাক এই সব ঝগড়া-ঝাটির কথা। এবার আরও কিছু সহজ প্রশ্ন করি। বলুন তো, হাতের জায়গাই পা, আর পা‘র জায়গায় হাত কেন সংযোজিত হয় না? চোখের জায়গায় দাঁত, আর দাঁতের জায়গায় চোখ কেন বসে না? এভাবে চিন্তা করুন, দেহের প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রতঙ্গের কথা। এই সমস্ত প্রশ্নের প্রকৃত উত্তর হলো, এগুলোকে এভাবেই পরিকল্পনা করা হয়েছে, ডিজাইন করা হয়েছে, আবার সেই ডিজাইন মোতাবেক প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে সাজানো হয়েছে। এটার উদাহরণ এমন, যেন কোন ইঞ্জিনিয়ার প্রথমে একটি বিল্ডিংয়ের ডিজাইন করলো, অতঃপর সেই ডিজাইন অনুসারে বিল্ডিংটি তৈরি করলো। বিল্ডিংয়ের ডিজাইন যেমন একটি কাগজে অঙ্কিত থাকে ঠিক তেমনি প্রত্যেকটি প্রাণীর ডিজাইনও সেই প্রাণীর দেহের অভ্যন্তরে খোদাই করা থাকে, অর্থাৎ তার সূনির্দিষ্ট তথ্য প্রদান করা থাকে। এই তথ্য বা প্রত্যাদেশ অনুসারেই প্রাণীর পরবর্তী বংশধর কেমন হবে তা নির্দিষ্ট হয়ে থাকে। জেনেটিক্সের ভাষায় এটাকেই বলা হয় ‘জেনেটিক কোডিং’ সিস্টেম। এই গোপন কোডের ভিতরেই লেখা থাকে কোন প্রাণীর উচ্চতা কতো হবে, তার শরীরের গঠন কেমন হবে, কতটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হবে, কোন অঙ্গ কোথায় বসবে ইত্যাদি..ইত্যাদি। এই জেনেটিক কোডিং সিস্টেম মহান আল্লাহপাকের এক সূনির্দিষ্ট ও সূক্ষ মাপজোক যা মানুষের ক্ষুদ্র জ্ঞান আজও পর্যন্ত পরিপূর্ণভাবে আবিষ্কার করতে পারেনি। তবে জেনেটিক কোডিং সিস্টেমের যতটুকু আবিষ্কৃত হয়েছে, তার মাধ্যমে আজ মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা মহাপরাক্রমশালী আল্লাহতায়ালার সৃষ্টি রহস্যের কিছুটা আচ করা যায়। বর্তমান জামানা হলো জেনেটিক্স ও বায়োটেকনোলজীর জামানা। সম্প্রতি জেনোম সিক্যুয়েংসিংয়ের মাধ্যমে সম্পুর্ণ জেনোম তথ্য জানা গেছে অনেক জীবের। ধীরে ধীরে উদ্ভিদ ও প্রাণীর জীবন রহস্য ও জীবনতত্ত্ব জানা যাচ্ছে। উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেহের ভিতরকার বিষ্ময়কর ডিজাইন, সুন্দর কাঠামো, সুপ্রতিষ্ঠত নিয়ম-শৃঙ্খলা ও কার্যপ্রণালীর বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। জীবের প্রতিটি অঙ্গের গঠন, আকার ও জিজাইন কেমন হবে তা পূর্ব থেকেই খোদাই করা আছে কোষের ডিএনএ-র মধ্যে। একে বলা হয় জেনেটিক কোডিং সিস্টেম যা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। খামখেয়ালীভাবে বা দৈবিকভাবে কোন কিছুই ঘটছে না। যদি ডারউইনের তত্ত্ব অনুসারে সকল জীব কাকতালীয়ভাবে দৈবচয়ন প্রক্রিয়ায় হতো তাহলে পৃথিবী ও জীবসম্প্রদায় অনেক আগেই ধ্বংস হয়ে যেতো। কয়েকটি বাস্তব উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে। সম্প্রতি জেনেটিক্স ও জেনোম তথ্যের মাধ্যমে জানা গেছে যে, আমাদের দেহে গড়ে প্রায় ৩৭.২ ট্রিলিয়ন (৩৭,২০০,০০০,০০০,০০০) কোষ আছে । তুলনা করলে পৃথিবীতে যত মানুষ আছে তার প্রায় ৪৯৬০ গুণ। প্রতিটি কোষে আছে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম। ক্রোমোজোম গুলোর ভিতরে আছে ২০ হাজারেরও বেশী জীন। এই সমস্ত জীনের ভিতর অত্যন্ত সুচারুভাবে ও সুপরিকল্পিতভাবে খোদাই করা আছে প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রতঙ্গের আকার-আকৃতি, গঠন-প্রকৃতি, কার্যপ্রণালীসহ সকল প্রকার তথ্য। এটাকে বলা হয় জেনেটিক কোডিং বা ভবিষ্যৎ বৈশিষ্ট্যের নকশা। সাধারণত অনেকগুলো এ্যামাইনো এসিড (১০০ এর কম নয়) পরপর যুক্ত হয়ে প্রোটিন তৈরি হয় যা জীবের সকল জৈবিক কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে। এক একটি এ্যামাইনো এসিড কেমন হবে তা আবার তিন অক্ষরের কোডিংয়ের সাহায্যে ডিএনএর মধ্যে নির্দেশনা দেওয়া থাকে। যদি এই সমস্ত এ্যামাইনো এসিডগুলো জীব দেহে কাকতালীয়ভাবে সংযুক্ত হতো তাহলে অনেক আগেই পৃথিবীর সমস্ত জীব চিরতরে বিলীন হয়ে যেতে। উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। একটি রোগ আছে যার নাম প্রজেরিয়া। এটি একটি বিরল রোগ। এ পর্যন্ত সমগ্র বিশ্বে মাত্র ১৪০ জনের মতো এ রোগী পাওয়া গেছে। বাংলাদেশে পাওয়া গেছে মাত্র ২ জন। কয়েক বছর আগে পত্রিকাতে খবর এসেছিল যে, মাগুরায় এই রোগী পাওয়া গেছে। তার নাম বায়েজিদ। এ রোগ হলে ৩/৪ বছরের বাচ্চাকে দেখতে ৭০/৮০ বছরের বুড়োর মতো মনে হবে। এই রোগের অন্যতম বৈশিষ্ট হলো, এই রোগী সাধারণত ১৫ বছরের বেশী বাঁচে না। পত্রিকায় যখন এই রোগের খবর প্রকাশিত হয় তখন আমি পিএইচডির কাজে অস্ট্রেলিয়া ছিলাম। যেহেতু আমি জেনেটিক্স ও জীনের প্রকাশ নিয়ে গবেষণা করছিলাম, তাই আমার কৌতূহল হলো এই রোগের আসল কারণ জানার জন্য। প্রকাশিত গবেষণা পত্র খুজে দেখলাম, প্রায় ১৮৪৮ বেজ-পেয়ার লম্বা LMNA জীনের ১৮২৪ নং পজিশনে মাত্র ১ টি নিউক্লিওটাইড (Cytosine এর পরিবর্তে Thymine) পরিবর্তন হওয়ার কারণে এই এ্যাবনরমালিটি সৃষ্টি হয়েছে। এটাকে জেনেটিক্সের ভাষায় বলা হয় পয়েন্ট মিউটেশন। এটাকে ব্যতিক্রমি ও বিরল ঘটনা বা এ্যাবনরমালিটি হিসেবেই ধরা হয়। এই জিনটিতে কমবেশী ১৮৪৮ টি নিউক্লিওটাইড আছে। সহজ ভাষায় ACTএ এই রকম ১৮৪৮ টি অক্ষর পরপর সাজানো আছে যার ভিতর মানুষের কোষ বৃদ্ধির একটা পূর্ব নির্দেশনা বা ছক খোদাই করা আছে। এটি খুবই পরিকল্পিত যা দেহের স্বাভাবিক বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে। শুধু এই একটি জিনই নয়, এরকম আরও শতশত জিন আমাদের দেহে আছে যেগুলো সম্বিলিতভাবে আমাদের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে দেহের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও গঠন নিয়ন্ত্রণ করে। এখন পাঠক একটু গভীরভাবে চিন্তা করুন, একটি অক্ষরের পরিবর্তনে যদি আমাদের দেহে এত বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটে, তাহলে সমস্ত অক্ষরগুলো যদি ডারউইনপন্থী বিজ্ঞানীদের মতে কাকতালীয়ভাবে দৈবচয়ন বা র‌্যানডন প্রক্রিয়ায় হতো তাহলে আমরা অনেক আগেই দুনিয়া থেকে বিলীন হয়ে যেতাম। মোদ্দাকথা, সমস্ত জীবজগত মহান আল্লাহর সুনিপূণ হাতের সূক্ষ ডিজাইন ছাড়া আর কিছুই নয়। সম্প্রতি আবিষ্কৃত জেনেটিক কোডিং সিস্টেম আমাদের মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর অস্তিত্বের অকাট্য প্রমাণ বহন করে।

(লেখক: আণুবিক জেনেটিক্স বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়)

Read More

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked with *

সর্বশেষ পোস্ট

Advertising