আল্লাহ তাআলা বলেন, “কেউ যখন আমাকে ডাকে, আমি তখন তার ডাকের জবাব দিয়ে থাকি “। (সূরা বাকারাহ,আয়াত :১৮৬) দু’আর আভিধানিক অর্থ ডাকা, প্রার্থনা করা, চাওয়া, আহবান করা,আমন্ত্রণ করা, বিনীত নিবেদন করা ইত্যাদি।পারিভাষিক অর্থে দু’আ হলো, মহান সৃষ্টিকর্তা, মালিক ও মনিব আল্লাহ্রা ব্বুল আলামীনের কাছে বিনয়, নম্রতা ও যথাযোগ্য সম্মান মর্যাদা এবং ভক্তি ও শ্রদ্ধার সাথে
আল্লাহ তাআলা বলেন, “কেউ যখন আমাকে ডাকে, আমি তখন তার ডাকের জবাব দিয়ে থাকি “। (সূরা বাকারাহ,আয়াত :১৮৬)
দু’আর আভিধানিক অর্থ ডাকা, প্রার্থনা করা, চাওয়া, আহবান করা,আমন্ত্রণ করা, বিনীত নিবেদন করা ইত্যাদি।পারিভাষিক অর্থে দু’আ হলো, মহান সৃষ্টিকর্তা, মালিক ও মনিব আল্লাহ্রা ব্বুল আলামীনের কাছে বিনয়, নম্রতা ও যথাযোগ্য সম্মান মর্যাদা এবং ভক্তি ও শ্রদ্ধার সাথে ক্ষমা প্রার্থনা করা, সাহায্য চাওয়া, মনের আকুতি ও হৃদয়ের বাসনা পূরণের নিবেদন করা, তাঁর সন্তুষ্টি প্রার্থনা করা, তাঁর অসন্তুষ্টি থেকে মুক্তি চাওয়া, তাঁর প্রকৃত দাস ও অনুগত বান্দা হবার তওফীক কামনা করা, জাহান্নাম থেকে মুক্তি চাওয়া, জান্নাত লাভের প্রার্থনা করা, তাঁর দয়া ও রহমতের আবদার করা,যাবতীয় নেকী ও কল্যাণের আবেদন করা, যাবতীয় অকল্যাণ থেকে আশ্রয় চাওয়া এবং সত্য ও নেকীর পথে চলার হিম্মত, ধৈর্য ও দৃঢ়তা
প্রার্থনা করা এবং দুনিয়া ও আখিরাতের যাবতীয় কল্যাণ প্রার্থনা করা। দু’আ একটি ইবাদত, তাই দু’আ কেবল আল্লাহর কাছেই করতে হবে।
★ দু’আ ও প্রার্থনাকারীর মর্যাদা:
দু’আ ও দায়ীর মর্যাদা সম্পর্কে রসূলুল্লাহ সা.-এর কতিপয় হাদিস নিম্নরূপ :
★ আল্লাহর কাছে দু’আর চাইতে অধিক সম্মানজনক কোনো জিনিস নেই। (তিরমিযী : আবু হুরাইরা রা.)
★ দু’আ ছাড়া অন্য কিছু তাকদীর ফিরাতে পারেনা, আর নেকী ছাড়া অন্য কিছু বয়স বাড়াতে পারেনা। (তিরমিযী : সালমান)
★ দু’আ ইবাদতের মস্তিষ্ক। (তিরমিযী : আনাস রা.)
★ যে আল্লাহ্র কাছে চায়না, আল্লাহ্ তার প্রতি রাগ করেন। (তিরমিযী : আবু হুরাইরা রা.)
★ কবুল হবার আশা ও বিশ্বাস নিয়ে আল্লাহ্র কাছে দু’আ করো। আর
জেনে রাখো অচেতন অমনোযোগী অন্তরের দু’আ আল্লাহ্ কবুল করেননা। (তিরমিযী : আবু হুরাইরা রা.)
★ তোমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করো হাতের পেট দিয়ে, পিঠ দিয়ে নয় এবং প্রার্থনা শেষে তা দিয়ে মুখমন্ডল মুছে নাও। (আবু দাউদ : ইবনে আব্বাস রা.)
★ তোমাদের প্রভু লজ্জাশীল দাতা। তাঁর কোনো বান্দাহ যখন তাঁর দরবারে হাত তুলে কিছু চায়, তখন তিনি তার হাত দুটি খালি ফিরিয়ে দিতে লজ্জাবোধ করেন। (তিরমিযী, আবু দাউদ : সালমান ফারসী রা.)
অনুপস্থিত ব্যক্তির জন্যে দু’আ করলে তা অতি দ্রুত কবুল হয়। (তিরমিযী, আবু দাউদ : আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা.)
★ উমর ইবনে খাত্তাব রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার আমি নবী করীম সা. এর কাছে উমরা করতে যাবার অনুমতি চাইলাম। তিনি
আমাকে অনুমতি দিয়ে বললেন : ‘ভাই! তোমার নিজের জন্যে দু’আ করার সময় আমাকেও স্মরণ রেখো, আমার জন্যেও দু’আ ক’রো,
আমার জন্যে দু’আ করতে ভুলে যেয়োনা।’ উমর বললেন : তাঁর এই কথাটা আমাকে এতোই খুশি ও আনন্দিত করেছে যে, গোটা বিশ্ব দান
করলেও আমি এতোটা খুশি হতাম না। (আবু দাউদ : উমর রা.)
★ তিন ব্যক্তির দু’আ কবুল না করে ফেরত দেয়া হয়না।
ক. রোযাদার ইফতারের সময় যে দু’আ করে,
খ. ন্যায়বান সুবিচারক নেতার দু’আ এবং
গ. মযলুমের দু’আ। (তিরমিযী : আবু হুরাইরা রা.)
★ তিনটি দু’আ যে কবুল হয়ে থাকে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
সেগুলো হলো :
ক. সন্তানের জন্যে বাবা-মা’র দু’আ,
খ. পথিকের দু’আ,
গ. মযলুমের দু’আ। (তিরমিযী, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ : আবু হুরাইরা রা.)
★ কোনো মুসলমানের দু’আয় যদি পাপ কাজ ও রক্ত সম্পর্ক ছিন্নের দু’আ না থাকে, তবে দু’আর জন্যে এই তিনটি ফলের একটি ফল অবশ্যি
আল্লাহ্ তাকে দান করবেন। সেগুলো হলো :
ক. হয় দুনিয়াতেই তার প্রার্থিত বস্তু তাকে দান করবেন,
খ. নয়তো পরকালে তাকে এর প্রতিফল দান করবেন,
গ. অথবা তার থেকে অনুরূপ কোনো অমংগল দূর করে দেবেন।
রসূলুল্লাহর এ বক্তব্য শুনে সাহাবীরা বললেন, ‘তবে তো আমরা বেশি বেশি দু’আ করবো।’ নবী করীম সা. বললেন : আল্লাহ্ও অধিক অধিক দান করবেন। (মুসনাদে আহমদ : আবু সায়ীদ খুদরী রা.)
★ পাঁচ ব্যক্তির দু’আ কবুল করা হয় :
ক. মযলুমের দু’আ- যতোক্ষণ সে প্রতিশোধ গ্রহণ না করে,
খ. হজ্জ পালনকারীর দু’আ- যতোক্ষণ না সে বাড়ি ফিরে আসে,
গ. মুজাহিদের দু’আ- যতোক্ষণ সে নিষ্ক্রীয় হয়ে বসে না পড়ে,
ঘ. রোগীর দু’আ- যতোক্ষণ সে সুস্থ না হয়,
ঙ. দূরে থেকে মুসলমান ভাইয়ের জন্যে মুসলমান ভাইয়ের দু’আ।
(বায়হাকী : ইবনে আব্বাস রা.)
গ. দু’আর আদব ও নিয়ম
১. দু’আ একটি ইবাদত, বরং ইবাদতের মগজ। সুতরাং দু’আ প্রার্থনা কেবল আল্লাহ্র কাছেই করতে হবে। দু’আতে অন্য কাউকেও শরীক করা যাবে না; অর্থাৎ আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো কাছে দু’আ প্রার্থনা করা যাবে না।
২. দু’আ প্রধানত দুই প্রকার :
ক. গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা ও তওবা করা এবং
খ. পরকালীন ও জাগতিক যাবতীয় কল্যাণ চাওয়া।
৩. ক্ষমা প্রার্থনা ও তওবা করার নিয়ম হলো : গুনাহ বা অপরাধ স্বীকার করতে হবে। অনুতপ্ত হতে হবে (অর্থাৎ অনুশোচনা ও লজ্জাবোধ
মনকে দু:খ ভারাক্রান্ত করে তুলবে)। বিনয় ও কাতর অনুভূতির সাথে (সম্ভব হলে অশ্রুপাত ও কান্নাকাটি করে) ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে।
আন্তরিকতার সাথে ঐ অপরাধ আর না করার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ সিদ্ধান্তের উপর অটল অবিচল থাকতে পারার জন্যে আল্লাহ্র কাছে সাহায্যের আবেদন করতে হবে। এটাই হচ্ছে তওবা ও ইস্তেগফার
৪.দু’আ করতে হবে পূর্ণ ইখলাস ও আন্তরিকতার সাথে।
৫.জাগতিক ও পরকালীন প্রার্থনা করার ক্ষেত্রে, যা হালাল ও বৈধ তাই চাইতে হবে, হারাম ও অবৈধ কিছু চাওয়া যাবেনা।
৬.দু’আ করতে হবে পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থার সাথে। মনে করতে হবে আল্লাহ্ সর্ব শক্তিমান। তিনি যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। তাঁর
রহমত থেকে কেউ বঞ্চিত হয়না। তিনি যাকে চান উঠাতে পারেন, যাকে চান নামাতে পারেন। জীবন মৃত্যু, জান্নাত জাহান্নাম, কল্যাণ অকল্যাণ, লাভ ক্ষতি, ভালো মন্দ, উন্নতি অবনতি এবং শাস্তি ও পুরস্কার যাবতীয় কিছু কেবল তাঁরই মুষ্টিবদ্ধ এবং নিষ্ঠা ও নেক নিয়তের সাথে যে তাঁর কাছে চায় তিনি তাকে দান করেন ।
৭. দু’আ করতে হবে পূর্ণ মনোযোগের সাথে এবং মনের মণিকোঠা থেকে। যা চাওয়ার, তা চাইতে হবে বুঝে শুনে পূর্ণ অনুভূতি ও চেতনা বোধের সাথে, চাইতে হবে পূর্ণ আবেগ ও আশা নিয়ে। না বুঝা ও অমনোযোগী দু’আ কবুল হবার সম্ভাবনা নেই । (সূত্র : সহীহ মুসলিম ও তিরমিযী)
৮. দু’আ করতে হবে নিশ্চয়তার সাথে। বলতে হবে, আমি এই এই জিনিস তোমার কাছে চাই। আমাকে এটা এটা দাও। এমনটি বলা ঠিক নয় যে, ‘তোমার ইচ্ছা হলে দাও’। তবে এটা বলা যেতে পারে যে, আমার জন্যে যা কিছু কল্যাণকর তা সবই আমাকে দাও। (সূত্র : সহীহ বুখারী।)
৯. আল্লাহ্ ভাণ্ডারকে বিশাল ও অপূরণীয় মনে করে বড় করে, বেশি করে এবং সর্বোত্তমটা চাইতে হবে। আল্লাহ্র কাছে বেশি বেশি চাওয়ার ক্ষেত্রে কৃপণতা করা খারাপ।
১০. দু’আ দাঁড়িয়েও করা যায়, বসেও করা যায়, শুয়েও করা যায়। হাত তুলেও করা যায়, হাত না তুলেও করা যায়। শব্দ করেও চাওয়া যায়,
নি:শব্দেও চাওয়া যায়। কারণ দু’আ তো হলো চাওয়া। আর চাইতে হয় মন থেকে। মহান আল্লাহ্ মনের খবরও রাখেন, মুখের কথাও শুনেন। তাই উপরোক্ত যে কোনো প্রকারেই মহান আল্লাহর কাছে চাওয়া যায় ।
১১. দু’আ যেমন নিজের জন্যে করা যায়, তেমনি অন্যদের জন্যেও করা যায়। তবে শুরু করতে হবে নিজেকে দিয়ে। তারপর পিতা মাতা স্ত্রী/স্বামী, সন্তান সন্ততি, আত্মীয়-স্বজন এবং সকল মুমিনের জন্যে।
১২. অমুসলমানদের জন্যে হিদায়াত’ চেয়ে দু’আ করা যাবে।
১৩. কারো জন্যে বদ দু’আ করা উচিত নয়। দু’আতে কারো ক্ষতি ও
অকল্যাণ চাওয়া ঠিক নয় ।
১৪. আল্লাহর প্রশংসা করে এবং নবী করিম সা. এর প্রতি দরূদ পাঠ করে
দু’আ আরম্ভ ও শেষ করা উচিত।
১৫. দু’আর ফল লাভের জন্যে তাড়াহুড়া করা উচিত নয়। ফল না দেখে নিরাশ হয়ে দু’আ ত্যাগ করা মোটেও সমীচীন নয়। দু’আর সুফল
আল্লাহ্ দুনিয়াতেও দিয়ে থাকেন, আখিরাতেও দিয়ে থাকেন। প্রার্থনাকারী সব সময় ফল টের নাও পেতে পারে। আর একটা ইবাদত হিসেবে দু’আর সওয়াব তো অবশ্যি পাওয়া যাবে। (সূত্র : সহীহ মুসলিম)
১৬. দু’আ সুখের সময়, দুঃখের সময় এবং সব সময়ই করা উচিত।
১৭. কেবলামুখী হয়ে দু’আ করা উত্তম ।
১৮. কষ্টসাধ্য না হলে দু’আর পূর্বে অযু করে নেয়া উত্তম ।
১৯. অপরের জন্য দু’আ করার সময় প্রথমে নিজের জন্যে দু’আ করে শুরু করা কর্তব্য।
২০. আল্লাহ্র কাছে চাওয়ার সময় তাঁর সুন্দর নাম সমূহের উসীলা করে চাওয়া উত্তম। যেমন, ক্ষমা চাওয়ার সময় ইয়া গাফফার, ইয়া
গাফূরুর রাহীম, (হে মহা ক্ষমাশীল, হে ক্ষমাশীল দয়াময়) বলে চাওয়া। এভাবে তাঁর গুণবাচক নাম সমূহের অর্থ অনুযায়ী উপযুক্ত ও
যথার্থ প্রয়োগ করে দু’আ করুন।
২১. নিজের কৃত কোনো নেক আমলের উসীলা করেও আল্লাহ্র কাছে কিছু প্রার্থনা করা বা সাহায্য চাওয়া যায়।
২২. কারো জন্যে বদ দু’আ করা উচিত নয়। নবী করীম সা. বলেছেন : তোমরা নিজের জন্যে নিজের সন্তানের জন্যে এবং নিজের সম্পদের,
জন্যে বদ দু’আ করোনা। (সূত্র : সহীহ মুসলিম)
ঘ. যেসব সময়, অবস্থা, স্থান ও ব্যক্তির দু’আ কবুল হয়
মূলত সব সময়, সব অবস্থা এবং সব স্থানেই দু’আ কবুল হয়। তবু কুরআন হাদিসে কিছু কিছু সময়, অবস্থা ও স্থানের কথা বিশেষভাবে
উল্লেখ করা হয়েছে। সেগুলো হলো :
১. কদর রাত ।
২. শেষ রাত ।
৩. ফরয নামাযের পর।
৪. সিজদারত অবস্থায় ।
৫. আযান ও ইকামতের মধ্যবর্তী সময়।
৬. আযানের সময়।
৭. রুকূ থেকে উঠে দাঁড়ানো অবস্থায় ।
৮. আল্লাহর পথে জিহাদে যাত্রা করার সময় ।
৯. জুমার দিন।
১০. এক সিজদা শেষ করে অপর সিজদায় যাওয়ার পূর্বে বা অবস্থায়।
১১. বৃষ্টি নামার সময় ।
১২. যমযমের পানি পানকালে ।
১৩. রাতে নিদ্রা ভংগ হলে।
১৪. কারো মৃত্যুর খবর শুনে ।
১৫. নামাযের শেষ বৈঠকে আততাহিয়্যাতু এবং দরূদ পড়ার পর।
১৬. কারো অনুপস্থিতিতে তার জন্যে দু’আ করা হলে ।
১৭. আরাফার দিন আরাফাতে।
১৮. রমযান মাসে।
১৯. ইফতারের পূর্বে।
২০. মুসলিমদের দীনি আলোচনার মজলিসে।
২১. বিপদের সময় ।
২২. রোযা থাকা অবস্থায় ।
২৩. যালিমের বিরুদ্ধে মযলুমের দু’আ।
২৪. সন্তানের জন্যে পিতা মাতার দু’আ।
২৫. সন্তানের উপর পিতা মাতার বদ দু’আ।
২৬. মুসাফিরের দু’আ।
২৭. অক্ষম ও মজবুর ব্যক্তির দু’আ।
২৮. ন্যায় পরায়ণ সুবিচারক নেতার দু’আ।
২৯. পিতা মাতার জন্যে সৎ সন্তানের দু’আ।
৩০. অযুর পর পর।
৩১. কা’বা ঘরে ।
৩২. সাফা ও মারওয়ায়।
৩৩. মাশয়ারিল হারামে।
৩৪. আল্লাহর প্রতি একাগ্রতা এবং ভীতি ও ভালোবাসার আবেগ সৃষ্টি হলে ।
৩৫. রোগীর দু’আ ।
একথা মনে রাখা দরকার যে, আল্লাহ্ তা’আলা সব সময়ই তাঁকে ডাকতে এবং তাঁর কাছে চাইতে বলেছেন। উপরে যেসব স্থান কাল পাত্রকে খাস
করা হয়েছে, এগুলো আমাদের প্রতি আল্লাহ্ পাকের অতিরিক্ত দয়া । যে ব্যক্তি অন্য মুসলমানের জন্য দোয়া করেন, ফেরেশতারা তার জন্য দোয়া করতে থাকেন (আবু দাউদ)
(-আল কুরআনের দু’আ, আদুস শহীদ নাসিম। আল্লাহ তাআলা লেখকের দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা দান করুন)
★অমুসলিমের জন্য দোয়া :
অমুসলিম প্রতিবেশী বা পরিচিত কেউ অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যাওয়া যাবে না-এমন একটি ধারণা অনেকের রয়েছে। আবার অনেকে মনে করে যে, মানবিক কারণে ‘ঈয়াদাত’ করা গেলেও সুস্থতার জন্য দুআ করা যাবে না।
দু’টো ধারণাই ভুল; বরং প্রতিবেশী, আত্মীয় বা পরিচিত কেউ অমুসলিম হলেও অসুস্থ হলে তার ‘ঈয়াদাত’ করা উচিত। সেক্ষেত্রে একজন মুসলমানের তাকে দেখতে যাওয়া, খোঁজ-খবর নেওয়া এবং সম্ভাব্য সকল সেবা-শুশ্রূষা করা, উপরন’ তাদের সুস্থতা ও হেদায়েতের জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করাতে অসুবিধার কিছু নেই; বরং পারিপার্শ্বিক অন্য কোনো সমস্যা না থাকলে এমনটি করাই উত্তম। কোনো বিধর্মী আত্মীয় বা প্রতিবেশী অসুস্থ হলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের দেখতে যেতেন এবং দ্বীনের দওয়াত দিতেন।
সহীহ বুখারী শরীফে আছে, এক ইহুদী কিশোর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খেদমত করত। সে অসুস্থ হয়ে পড়লে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে দেখতে গেলেন এবং তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। তখন সে মুসলমান হয়ে গেল। (সহীহ বুখারী, হাদীস : ১৩৫৬, ৫৬৫৭)
সুতরাং কোনো পরিচিত অমুসলিম ব্যক্তি অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যাওয়া ও তার সুস্থতার জন্য দুআ করার অবকাশ আছে। সম্ভব হলে তার সামনে দ্বীনের দাওয়াতও পেশ করা উচিত। হতে পারে আল্লাহ তাআলা তাকে হক কবুল করার তাওফীক দিবেন এবং জাহান্নাম থেকে নাজাত দান করবেন।
অমুসলিমদের জন্য করা দোয়া কয়েক প্রকার হতে পারে:–
১। অমুসলিমরা যাতে ইসলাম গ্রহণ করে, হেদায়েতপ্রাপ্ত হয় এ ধরনের দোয়া করা। এ ধরনে দোয়া করা জায়েজ এবং উত্তম। রসূল (সা.) এ ধরনের দোয়া করেছেন
হাদিস শরিফে এসেছে,
ইবনে উমর (রা.) থেকে সাব্যস্ত হয়েছে যে, রাসূল (সা.) বলেছেন: ‘হে আল্লাহ্! এই দুই জন লোকের মধ্যে যে ব্যক্তি আপনার কাছে অধিক প্রিয় তার মাধ্যমে আপনি ইসলামকে শক্তিশালী করুন: আবু জেহেল কিংবা উমর বিন খাত্তাব।’ [সুনানে তিরমিযি; হাদিস: ৩৬৮১, আলবানী হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন]
২। অমুসলিমদের জন্য গুনাহের ক্ষমা প্রার্থণা করা কিংবা এ-জাতীয় কোন দোয়া করা, এটি হারাম।
ইমাম নববী বলেন: ‘পক্ষান্তরে, কাফেরের জন্য রহমত প্রার্থনা করা, ক্ষমা প্রার্থনা করা এটি কুরআনের দলিল ও ইজমার ভিত্তিতে হারাম।’ [আল-মাজমু ৫/১২০]
আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘তুমি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর আর না কর। যদি তুমি তাদের জন্য সত্তর বারও ক্ষমাপ্রার্থনা কর, তথাপি কখনোই তাদের আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। তা এজন্য যে, তারা আল্লাহকে এবং তাঁর রাসুলকে অস্বীকার করেছে। বস্তুত আল্লাহ নাফরমানদের পথ দেখান না।’ (সুরা তাওবাহ : আয়াত ৮০)
“নবী ও যারা ঈমান এনেছে তাদের পক্ষে মুশরিকদের জন্য মাগফিরাতের দোয়া করা সংগত নয়, তারা তাদের আত্মীয়-স্বজন হলেই বা কি এসে যায়, যখন একথা সুষ্পষ্ট হয়ে গেছে যে, তারা জাহান্নামেরই উপযুক্ত।”(সূরা আত তওবা : আয়াত-১১৩)
কুরআনুল কারিমের আয়াতে এ বিষয়টি সুস্পষ্ট যে, যদি কেউ ঈমানহীন হওয়ার কারণে সুস্পষ্ট জাহান্নামী হয়, যদি সে আত্মীয়ও হয়; তথাপিও তার জন্য মৃত্যুর পর দোয়া করা যাবে না। কাউকে দোয়া করতে বলাও যাবে না। কেননা তা সুস্পষ্ট হারাম। আর যারা হারাম কাজ করবে বা হারাম কাজে উৎসাহিত করবে, তারা হবে সুস্পষ্ট গোনাহগার।
অমুসলিম বা ঈমানহীন ব্যক্তির জন্য দোয়া প্রসঙ্গে হজরত নুহ আলাইহিস সালামের সে ঘটনাটি উল্লেখ করা যেতে পারে। যখন তাঁর ছেলে পানিতে ডুবে মরতে ছিল। সে বিষয়টিও আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমে তুলে ধরেছেন। আর তাহলো- ‘আর নূহ তাঁর পালনকর্তাকে ডেকে বললেন- হে পরওয়ারদেগার! আমার ছেলে তো আমার পরিজনদের অন্তর্ভুক্ত; আর আপনার ওয়াদাও নিসন্দেহে সত্য আর আপনিই সর্বাপেক্ষা বিজ্ঞ ফয়সালাকারী।’ (সুরা হুদ : আয়াত ৪৫)
– ‘আল্লাহ বলেন, হে নূহ! নিশ্চয় সে আপনার পরিবারভুক্ত নয়। নিশ্চই সে দুরাচার! সুতরাং আমার কাছে এমন দরখাস্ত করবেন না, যার খবর আপনি জানেন না। আমি আপনাকে উপদেশ দিচ্ছি যে, আপনি অজ্ঞদের দলভুক্ত হবেন না।’ (সুরা হুদ : আয়াত ৪৬)
তখন হজরত নুহ আলাইহিস সালাম ঈমানহীন সন্তানের জন্য দোয়া করার আবেদন থেকে ফিরে আল্লাহর কাছে এ মর্মে প্রার্থনা করেন-
‘হে আমার পালনকর্তা! আমার যা জানা নেই এমন কোনো দরখাস্ত করা হতে আমি আপনার কাছেই আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আপনি যদি আমাকে ক্ষমা না করেন, দয়া না করেন, তাহলে আমি ক্ষতিগ্রস্ত হব।’ (সুরা হুদ : আয়াত ৪৭)
পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের পর দোয়া কবুল হয়। সম্মিলিত দোয়া কবুল হবার কিছু প্রমান দেয়া গেলো।
হযরত আবু উমামা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবীজি সা. কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ইয়া রাসুলাল্লাহ! কোন দু’আ বেশী কবুল হয়? তিনি বললেনঃ শেষ রাতের মাঝে আর ফরয নামাজগুলের পরে। সূত্র: জামে তিরমিযি হাদিস: ৩৪৯৯
হযরত মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াহইয়া (রহঃ) বলেন, ‘আমি আব্দুল্লাহ বিন যুবাইর (রাঃ) কে দেখেছি যে,তিনি এক ব্যক্তিকে সালাম ফিরানোর পূর্বে হাত তুলে মুনাজাত করতে দেখে তার নামায শেষ হওয়ার পর তাকে ডেকে বললেন,‘রাসূলে পাক সল্লাল্লাহু ‘আলাইহী ওয়া সাল্লাম কেবল নামায শেষ করার পরই হস্তদ্বয় উত্তোলন করে মুনাজাত করতেন; আগে নয়।’ সূত্র: মু’জামে কাবীর (তাবরানী) হাদিস: ১৩৭৯১
মাজমাউয যাওয়ায়েদ খ: ১০ পৃ: ১৭২ ই’লাউস সুনান খ: ৩ পৃ: ১৬১
হযরত মুগিরা রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ নামায শেষে দুআ করতেন। {আততারীখুল কাবীর, হাদীস নং-১৭৭২, ৬/৮০}
যে সকল স্থানে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সম্মিলিত মুনাজাতের প্রমাণ রয়েছে। যেমন, নামাজের পর, সূর্যগ্রহণের সময়, কবরস্থানে লাশ দাফনের পর প্রভৃতি জায়গায়; এ সকল স্থানে সম্মিলিত মুনাজাত করা জায়েজ। ই’তেসাম লীল শাতিবী, পৃষ্ঠা নং- ৫৩, দারে ইবনে আফফান, সৌদি আরব থেকে প্রকাশিত/ মিরকাত, খণ্ড নং-৩, পৃষ্ঠা নং-৩১
রাসূল সাঃ প্রতি নামাযের পর এই শব্দে আল্লাহর কাছে পানাহ চাইতেন, “হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে কৃপণতা থেকে পানাহ চাই। এবং অভাব থেকে পানাহ চাই এবং অশীতিপর বৃদ্ধাবস্থা থেকে পানাহ চাই এবং দুনিয়ার ফিতনা ও কবরের আজাব থেকে পানাহ চাই। {সুনানে নাসায়ী, হাদীস নং-৫৪৭৯}
হযরত সালমান (রাঃ) বলেন, নবী কারীম সল্লাল্লাহু ‘আলাইহী ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,কোন জামাআত কিছু প্রার্থনা করার জন্য আল্লাহর দরবারে হাত তুললে আল্লাহ তাআলার উপর ওয়াজিব হয়ে যায় তাদের প্রার্থিত বস্তু তাদের হাতে তুলে দেয়া।
সূত্র: মু’জামে কাবীর (তাবারানী) হাদিস: ৬১৪২
মাজমাউয যাওয়ায়েদ খ: ১০ পৃ: ১৭২ জামে সগীর হাদিস: ৭৮৯৩
হযরত হাবীব বিন মাসলামা আলফিহরী রাঃ। যিনি মুস্তাজাবুদ দাওয়া ছিলেন। তাকে একবার একটি বাহিনী প্রধান নিযুক্ত করা হয়। যুদ্ধের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণের পর তিনি যখন শত্রুর সম্মুখিন হলেন। তখন লোকদের বললেন, আমি রাসূল সাঃ কে বলতে শুনেছি। তিনি বলেছেন “যখনি কোন দল একত্র হয়, তারপর তাদের কথক দোয়া করে, আর অপরদল আমীন বলে তখন আল্লাহ তাআলা তা কবুল করে নেন”।
সূত্র: মাজমাউয যাওয়ায়েদ হাদীস: ১৭৩৪৭, মুস্তাতাদরাক আলাস সহীহাইন: ৫৪৭৮, আলমুজামুল কাবীর, হাদীস নং-৩৫৩৬
হযরত আয়িশাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ইয়াহূদীরা তোমাদের কোন ব্যাপারে এত বেশি ঈর্ষান্বিত নয় যতটা তারা তোমাদের সালাম ও আমীনের ব্যাপারে ঈর্ষান্বিত।
সূত্র: ইবনে মাজা হাদিস: ৮৫৬ মুসনাদে আহমাদ:২৫০২৯ জামে সগীর: ৭৭৭১ ফাতহুল গফফার খ: ১ পৃ: ৩৩৮
হযরত আনাস বিন মালিক রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা একজন গ্রাম্য সাহাবী রাসূল সাঃ এর কাছে আসলেন জুমআর দিন। এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! জিনিস পত্র, পরিবার, মানুষ সবই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। একথা শুনে রাসূল সাঃ তার উভয় হাত উত্তলোন করলেন দুআর উদ্দেশ্যে। উপস্থিত সবাই রাসূল সাঃ এর সাথে দুআর জন্য হাত উত্তোলন করলেন। {সহীহ বুখারী, হাদীস নং-১০২৯}
ফরজ নামাজের পর দোআ করা হাদিসের ছয়টি নির্ভরযোগ্য কিতাব অর্থাৎ সিহাহ সিত্তার মাধ্যমে প্রমাণিত। অন্যদিকে দোআর সময় হাত তোলার কথাও হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। কিন্তু এমন কোনো প্রমাণ নেই, যাতে ফরজ নামাজের পর হাত তুলে দোআ করাকে হারাম কিংবা নিষেধ করা হয়েছে। সাহাবায়ে কেরামের জামানা থেকে আজ পর্যন্ত হাজার বছর ধরে ফরজ নামাজের পর হাত তুলে দোআ করার নিয়ম চলে আসছে। এতে কেউ আপত্তি করেনি। ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি, ইমাম মালেক রহমাতুল্লাহি আলাইহি, ইমাম শাফেয়ি রহমাতুল্লাহি আলাইহি এবং ইমাম আহমাদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি -এর মতো অগণিত ফকিহ ও মুহাদ্দিস চলে গেছেন। কোনো একজন ইমামও এ বিষয়ে আপত্তি করেননি। শুধু ইবনে তাইমিয়া রহমাতুল্লাহি আলাইহি ও ইবনে কাইয়্যিম রহমাতুল্লাহি আলাইহি আপত্তি জানিয়েছেন। আহলে হাদিসের আলেম নাসিরুদ্দীন আলবানীর অনুকরণে বর্তমানে কিছু লা-মাজহাবি আলেম ফরজ নামাজের পর হাত তুলে মোনাজাত সম্পর্কে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছেন, যা শরিয়তের যুক্তিতে কখনো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। হ্যাঁ, যাঁরা ফরজ নামাজের পর হাত তুলে মোনাজাত করাকে বাধ্যতামূলক মনে করতেন, তাঁরাও ভুলের মধ্যে আছেন। জায়েজ কাজকে বাধ্যতামূলক মনে করাও শরিয়তের দৃষ্টিতে গর্হিত কাজ। এতে সন্দেহ নেই।দোআর জন্য নির্দিষ্ট কোনো দিন বা সময়ের প্রয়োজন নেই। হ্যাঁ, রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে ২২টি জায়গায় দোআ করার হাদিস রয়েছে। এর মধ্যে ফরজ নামাজের পর অন্যতম।
আল্লাহর রাসূল (সা.) যে কোনও প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে দোয়ায় মত্ত হয়ে যেতেন। ইসলামের অন্যতম ইবাদত হচ্ছে দোয়া। হাদিসে দোয়াকে ইবাদতের মগজ বলেও আখ্যায়িত করা হয়েছে।পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘যখন তোমার কাছে আমার বান্দা আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে (তখন বলে দাও যে), নিশ্চয়ই আমি তাদের কাছে। প্রার্থনাকারী যখন আমাকে ডাকে, তখন আমি তার ডাকে সাড়া দিই। সুতরাং তারাও যেন আমার ডাকে সাড়া দেয় ও ঈমান আনয়ন করে। আশা করা যায়, তারা সফলকাম হবে। ’ (সূরা বাকারা, আয়াত: ১৮৬)।
কেউ অতি উৎসাহী হয়ে অমুসলমান প্রতিবেশী বা বন্ধুর জন্য মৃত্যুর পর জান্নাতের দোয়া করা হারাম বা নিষেধ। যে বেক্তি বা যারা অমুসলমানের মৃত্যুর পর জান্নাতের দোয়া করিবে তারা গুনাহগার হবে। তওবা করে আল্লাহ্পাক থেকে মাফ করিয়ে নিতে পারলে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে অজ্ঞতার বশতঃ এমন লোক দেখানো দোয়া পক্ষান্তরে নিজের ধ্বংসের দোয়া করার শামিল। তাই, ইসলামী জ্ঞান অর্জন করা প্রতিটি নর নারীর জন্য আল্লাহ পাক ফরজ করেছেন। গোমরাহ মানুষের পিছনে হেটে জাহান্নামী না হয়ে প্রকৃত দ্বীনদার লোকের সাথে উট বস করার তাগিদ সর্বত্র।
Leave a Comment
Your email address will not be published. Required fields are marked with *