প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউসুফ আলী: আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগে যখন কুরআন নাজিল হচ্ছিল তখন সেখানকার মানুষ কিভাবে শিরক করতে তা না জানলে একজন মুসলমান বুঝতে পারবে না প্রকৃত অর্থে শিরক কাকে বলে। আমাদের অধিকাংশ মুসলমানের এই ভুল ধারণা আছে যে আরববাসীরা ওই সময় আল্লাহকে অস্বীকার করত, তাকে রব হিসেবে মানত না। কিন্তু পবিত্র কুরআনের অসংখ্য আয়াত
প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউসুফ আলী: আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগে যখন কুরআন নাজিল হচ্ছিল তখন সেখানকার মানুষ কিভাবে শিরক করতে তা না জানলে একজন মুসলমান বুঝতে পারবে না প্রকৃত অর্থে শিরক কাকে বলে। আমাদের অধিকাংশ মুসলমানের এই ভুল ধারণা আছে যে আরববাসীরা ওই সময় আল্লাহকে অস্বীকার করত, তাকে রব হিসেবে মানত না। কিন্তু পবিত্র কুরআনের অসংখ্য আয়াত থেকে বুঝা যায় তারা আল্লাহকে অস্বীকার করত না, আল্লাহকে সৃষ্টি কর্তা, রিজিকদাতা, পালন কর্তা হিসেবে বিশ্বাস করত। কিন্তু আল্লাহর সাথে শিরক করত ভিন্নভাবে। তাদের শিরক ও মূর্তিপূজার ধরন ছিল নিম্নরূপ:
১. মূর্তিকে আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের মাধ্যম মনে করা: তারা মূর্তিরপাশে বসে তাকে উচ্চকণ্ঠে আহবান করত ও তাদের অভাব মোচনের জন্য অনুনয়-বিনয় করে প্রার্থনা জানাতো। তারা ধারণা করত যে, এই মূর্তি তাদেরকে আল্লাহর নৈকট্যশীল করবে (সূরা যুমার:৩) এবং তাদের জন্য আল্লাহর নিকটে সুফারিশ করবে (সূরা ইউনুস:১৮)। উল্লেখ্য যে, আরববাসীদের মূর্তিগুলো ছিল পূর্ব জমানার প্রসিদ্ধ বুজুর্গ ব্যাক্তিদের।
২. মূর্তির ওছিলা দিয়ে রিজিক প্রার্থনা করা: আরববাসীদের শিরকের একটি ধরন এই ছিল যে, তারা বিভিন্ন মূর্তি ও দেবতার ওছিলা দিয়ে বৃষ্টি, রিজিক, সন্তান ইত্যাদি প্রার্থনা করত। আর পবিত্র মক্কা ও কাবা শরিফে এই শিরকের সর্বপ্রথম প্রচলন করে কুরায়েশ বংশের বনু খোযা‘আহ গোত্রের সরদার আমর বিন লুহাই। এই আমর বিন লুহাই ছিল বেশ ধার্মিক, দানশীল ও দরবেশ স্বভাবের লোক। তিনি একবার শামের বালক্বা অঞ্চলের ‘মাআব’ নগরীতে গিয়ে দেখেন যে, সেখানকার লোকেরা জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে ‘হুবাল’ মূর্তির পূজা করে। তিনি তাদেরকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা বলে যে, আমরা এই মূর্তির ওছিলায় বৃষ্টি প্রার্থনা করলে বৃষ্টি হয় এবং সাহায্য চাইলে করলে সাহায্য পাই। আমর ভাবলেন অসংখ্য নবী-রসূলের জন্মভূমি ও কীর্তিভূমি এই শামের ধার্মিক লোকেরাই যখন ‘হোবল’ মূর্তির ওছিলায় বৃষ্টি প্রার্থনা করে, তখন আমরা করলে দোষ কি। আমরাও এটা করে উপকৃত হতে পারব। ফলে বহু মূল্যের বিনিময়ে আমর একটা হোবল মূর্তি খরীদ করে নিয়ে গেলেন এবং মক্কার নেতাদের রাজী করিয়ে পবিত্র কা‘বাগৃহে স্থাপন করলেন।
৩. মূর্তি ও দেবতার নামে পশু ছেড়ে দেয়া: মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম বলেন, ‘আমার সম্মুখে (স্বপ্নে) জাহান্নামকে পেশ করা হল, … অতঃপর আমাকে দেখানো হল আমর বিন লুহাইকে। জাহান্নামে সে তার নাড়ী-ভুঁড়ি টেনে বেড়াচ্ছে। এ ব্যক্তিই প্রথম তাদের উপাস্যদের নামে উট ছেড়ে দেওয়ার রেওয়াজ চালু করেছিল (যা লোকেরা রোগ আরোগ্যের পর কিংবা সফর থেকে আসার পর তাদের মূর্তির নামে ছেড়ে দিত)। ঐসব উট সর্বত্র চরে বেড়াত। কারও ফসল নষ্ট করলেও কিছু বলা যেত না বা তাদের মারা যেত না (বুখারী ও মুসলিম)। মূর্তি ও দেবতার নামে এভাবে উট ও অন্যান্য পশু ছেড়ে দেওয়াকে কুরআনে এবং হাদিসে শিরক নামে অভিহিত করা হয়েছে।
৪. মূর্তির উদ্দেশে হজ্জ, তাওয়াফ করা: তারা মূর্তির উদ্দেশ্যে হজ্জ করত, ত্বাওয়াফ করত, তার সামনে নত হতো ও সিজদা করত। ত্বাওয়াফের সময় তারা শিরকী তালবিয়াহ পাঠ করত। যেমন; লাব্বাইক লা শারিকা লাকা ইল্লা শারিকান হুয়া লাকা তামলিকু ওয়া মা মালাকা..। অর্থ, হে আল্লাহ! আমি হাজির। তোমার কোন শরীক নেই, কেবল ঐ শরীক যা তোমার জন্য রয়েছে। তুমি যার মালিক এবং সে যা কিছুর মালিক। মুশরিকরা ‘লাববাইকা লা শারীকা লাকা’ বলার পর রাসূল (ছাঃ) তাদের উদ্দেশ্যে ক্বাদ ক্বাদ (থামো থামো) বলতেন (মুসলিম)। এজন্যেই মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘তাদের অধিকাংশ আল্লাহকে বিশ্বাস করে। অথচ সেই সাথে শিরক করে’ (সূরা ইউসুফ:১০৬)।
৫. নযরানা ও মানত করা: তারা মূর্তি জন্য নযর-নেয়ায নিয়ে আসত এবং মূর্তির নামে মানত ও কুরবানী করত (সূরা মায়েদাহ: ৩)। এছাড়া তারা মূর্তিকে খুশী করার জন্য গবাদিপশু ও চারণক্ষেত্র মানত করত। যাদেরকে কেউ ব্যবহার করতে পারত না (সূরা আন‘আম:১৩৮-১৪০)।
৬. শুভাশুভ নির্ণয় করা: তারা তাদের বিভিন্ন কাজের ভাল-মন্দ ফলাফল ও শুভাশুভ নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন প্রকারের তীর ব্যবহার করত (সূরা মায়েদাহ:৯০-৯১)। যাতে হ্যাঁ, না, ভাল, মন্দ ইত্যাদি লেখা থাকত। হোবল দেবতার খাদেম সেগুলো একটি পাত্রের মধ্যে ফেলে তাতে ঝাঁকুনি দিয়ে তীরগুলি ঘুলিয়ে ফেলত। অতঃপর যে তীরটা বেরিয়ে আসত, সেটাকেই তারা ভাগ্য মনে করত এবং সে অনুযায়ী কাজ করত। এছাড়া তারা পাখি উড়িয়ে দিয়ে বা রেখা টেনে কাজের শুভাশুভ ও ভাল-মন্দ নির্ধারণ করত এবং পাখি ডাইনে গেলে শুভ ও বামে গেলে অশুভ ধারণা করত (মুসলিম)।
৭. জ্যোতিষী ও গণকের কথা বিশ্বাস করা: এতদ্ব্যতীত তারা জ্যোতিষী ও গণকদের কথা বিশ্বাস করত এবং বিশেষ বিশেষ নক্ষত্রকে মঙ্গলের কারণ মনে করত (বুখারী ও মুসলিম।
৮. ফেরেশতাদেরকে আল্লাহর কন্যা সাব্যস্ত করা: তারা ফেরেশতাদেরকে ‘আল্লাহর কন্যা’ বলত এবং জিনদের সাথে আল্লাহর আত্মীয়তা সাব্যস্ত করত (সূরা ছাফফাত:১৫০-৫২, ১৫৮-৫৯)। তারা নিজেদের জন্য পুত্রসন্তান ও আল্লাহর জন্য কন্যাসন্তান নির্ধারণ করত (সূরা নাজম:২১-২২)।
এই সমস্ত শিরক ছাড়াও তৎকালীণ আরব সমাজে আরও অনেক শিরকের প্রচলন ছিল। আমাদের সমাজেও উপরোক্ত মূর্তিপূজা ও শিরকের বীজ স্থানপূজা, কবরপূজা, কবরে মানত-নযরানা পেশ করা, সম্মানিত ব্যাক্তিদের ছবি-প্রতিকৃতি বানিয়ে সম্মান করা, জ্যোতিষী ও গণকের কথা বিশ্বাস করা ইত্যাদি রুপে অত্যন্ত সন্তর্পণে প্রবেশ করছে। শিরকের গোনাহ সবচেয়ে মারাত্মক ও ধ্বংসাত্মক। শিরকের গোনাহ অমার্জনীয়, এই মর্মে মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেন, “নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা তার সাথে শিরক করার অপরাধ ক্ষমা করবেন না। এ ছাড়া অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দেন। আর যে কেউ আল্লাহর সাথে শরিক করে, সে মহাপাপ করে (সূরা নিসা:৪৮)”। মহান আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে সহিহ বুঝ দান করুন এবং শিরক থেকে বেঁচে থাকার তৌফিক দান করুন। ।
(লেখক: মৎস্য-বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, পোস্ট-ডক্টরাল ভিজিটিং ফেলো, সিডনী)
Leave a Comment
Your email address will not be published. Required fields are marked with *