সামসুল ইসলাম টুকু : মৌমাছি মৌমাছি কোথা যাও নাচি নাচি , দাঁড়াওনা একবার ভাই ; ওই ফুল ফোটে বনে যাই মধু আহরনে ,দাঁড়াবার সময়তো নাই। ছোট পাখি ছোট পাখি কিচিমিচি ডাকি ডাকি ,কোথা যাও বলে যাও শুনি ; এখন না কব কথা আনিয়াছি তৃনলতা , আপনার বাসা আগে বুনি । পিপিলিকা পিপিলিকা দলবল ছাড়ি
সামসুল ইসলাম টুকু : মৌমাছি মৌমাছি কোথা যাও নাচি নাচি , দাঁড়াওনা একবার ভাই ;
ওই ফুল ফোটে বনে যাই মধু আহরনে ,দাঁড়াবার সময়তো নাই।
ছোট পাখি ছোট পাখি কিচিমিচি ডাকি ডাকি ,কোথা যাও বলে যাও শুনি ;
এখন না কব কথা আনিয়াছি তৃনলতা , আপনার বাসা আগে বুনি ।
পিপিলিকা পিপিলিকা দলবল ছাড়ি একা , কোথা যাও যাও ভাই বলি ;
শীতের সঞ্চয় চাই খাদ্য খুজিতেছি তাই , ছয় পায়ে পিলপিল চলি
নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের লেখা “কাজের লোক” শীর্ষক এ কবিতাটি ছোট বেলায় পড়েছিলাম ।সে সময় বুঝেছিলাম কবি ওইসব ক্ষুদ্র প্রানীর মত মনুষ্য প্রানীকেও তার প্রতিটি মুহুর্তকে কাজে লাগানোর ইঙ্গিত করেছেন ।সিডনীতে বেড়াতে এসে এই সত্যটা গভীরভাবে অনুভব করেছি । শুনলাম সিডনীর ক্যাম্পবেল সিটি কাউন্সিলের মিন্টো এলাকায় যেখানে আমার ছেলে থাকে সেখানে প্রচুর বাংলাদেশী বাস করেন ।এমনকি তাদের অনেকের নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে । আগে থেকেই ইচ্ছে ছিল এখানে বাংলাদেশীরা কেমন থাকে তা জানার । পোষাক পরিচ্ছদ , চেহারা , চলন বলন ও গায়ের রঙ দেখলেই বুঝতে পারবো ।কিন্তু শুধু বুঝলেতো হবেনা তাদের সামনাসামনি এবং রাস্তায় পেতে হবে । কিন্তু এখানে সবারই ২/১ খানা গাড়ী তথা কার আছে ।এটা দেখে অষ্ট্রেলিয়াকে কারের দেশ বলে মনে হয়েছে এবং এ দেশের জনসংখ্যা আড়াই কোটি হলে কারের সংখ্যাও ততটি বলে আমার বিশ্বাস । যখনই তারা বাড়ী থেকে বের হয় তখন গাড়ী নিয়েই বের হয় । হেঁটে যেতে দেখা যায়না বললেই চলে ।এখানে রিক্সা , ভ্যান ,ভটভটি , অটো চলেনা । সাইকেল মোটর সাইকেল হঠাৎ কখনো চোখে পড়ে ।
তাই বাংলাদেশীকে দেখতে হলে মলে বা বাজারে যেতে হয় । বাংলাদেশের মত বাজার এখানে নেই যেখানে সেখানে চীনাবাদাম ,ঝাল মুড়ি , চপ , বেগুনি , পিয়াজি,ফুচকা ,আমড়া, খিরা, চাটনি পাওয়া যায়না । অভ্যেসবসত এমন কিছু খেতে চাইলেও পাইনি । আর মলে কিছু পাওয়া গেলেও তা আমার মত গরীবের কাছে খুব দুর্মুল্য । আমাদের দেশের প্রান কোম্পানীর ১০ টাকা দামের চীপসের মুল্য এখানে ২ ডলার বা ১৪০ টাকা আর ৪০টাকা মূল্যের বোম্বে চানাচুর সাড়ে ৩ ডলার বা ২৪৫ টাকা ।তাছাড়া সিডনী ব্যয়বহুল শহর হিসেবেই পরিচিত । তাই রসনাকে সংযত রাখতে বাধ্য হয়েছি । সেই মল আবার সীমানা বেষ্টিত এবং প্রতিটি মলের পাশে রয়েছে অন্ততপক্ষে এক হাজার কার পার্কিং এর ব্যবস্থা ও রাস্তা। প্রায় মলে যেতাম । চেনা অচেনা যার সাথে দেখা হয়েছে তার সাথে সালাম হাই হ্যালো করে কথা বলতে চেয়েছি তার সম্পর্কে , দেশ ও দশের সম্পর্কে । কেউই ২/১ মিনিটের বেশী সময় দেয়নি । কেউ কেউতো কথাই বলেনি । এমনকি চেনার চেষ্টাও করেনি ।নবাগত ভেবে যেঁচে কেউ কথা বলেনি । বরং আমি গায়ে পড়ে কথা বলেছি । মনে হয়েছে তারা হয়তো ব্যস্ততার কারনে কথা বলেননি অথবা ভেবেছে আমি তার ঘাড়ে চেপে বসতে পারি বা সাহায্য চাইতে পারি তাই তারা দুরত্ব বজায় রেখেছে । আন্তরিকতার ছোয়া দেখতে পাইনি । যাকে আঞ্চলিক ভাষায় বলে আঠাছাড়া ভাব। কারো কারো সাথে মোবাইলে কথা বলেছি কিন্তু ৫/৬ মিনিটের বেশী নয় । তারা আমাকেই বেশী জানতে চেষ্টা করেছে আমি কিভাবে অষ্ট্রেলিয়া এসেছি ।আর যারা কর্মক্ষেত্রে থাকেন তারা সে সময়টুকুও দিতে পারেনি । এমনকি ফোনটাও ধরেনি ।
তখন স্পষ্টতই মনে হয়েছে কর্মক্ষেত্র তাদের অন্য গল্প করার সুযোগ দেয়নি । মনের মধ্যে ভেসে উঠেছে সেই মৌমাছি ,ছোটপাখি ওপিপিলিকার কথা ।তবে শুধু বাংলাদেশী নয় অষ্ট্রেলিয়ার প্রতিটি নাগরিকের রাস্তায় বের হওয়া মানেই কাজে বের হওয়া ।যার যা কাজ তা আপন মনেই করে চলেছে তাদের কেউ খবরদারী করছে এমনটাও চোখে পড়েনি । কোন অদৃশ্য প্রভাব বা দায়িত্ববোধ তাদের তাড়িত করছে । দুদন্ড কথা বলা বা দাঁড়াবার সময় তাদের হাতে নেই । কবির কল্পিত সেই খোকার প্রশ্নের উত্তরে ওই ক্ষুদ্র প্রানীগুলো যে উত্তর দিয়েছিল তারই প্রতিধ্বনি শুনতে পেলাম অষ্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশীদের কাছ থেকে । এখানে শনি রবি দুদিন ছুটি থাকে । এ দুদিন পরিবার সহ বেড়াতে বের হয় । বাকী ৫ দিন থাকে কর্মক্ষেত্রে ।যার যখন কর্মক্ষেত্রে যাবার সময় হয় তখন দ্রুত মুখে দুটো গুঁজে আর বক্সে দুপুরের খাবার নিয়ে কার চালিয়ে ছোটে ।কোন সময় হয়না তার । আগে অর্পিত দায়িত্ব পালন । ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ নেই ।প্রত্যেকেই তার কাজকে নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করে ।আয়েসপ্রিয় সুবিধাভোগী মানুষেরা এটাকে যান্ত্রিক জীবন মনে করলেও দার্শনিকদের মতে যে জাতি যত পরিশ্রমী সে জাতি তত উন্নত । অন্য কথায় বলা যায় সৃষ্টিকর্তা মানুষকে এই ধরাধামে পাঠিয়েছে কাজ করার জন্য , পরস্পরের কল্যানের জন্য ।সুতরাং মানুষকে বেঁচে থাকতে হলে কর্মঠ হবার বিকল্প নেই ।
যাইহোক যে কারনে এ লেখার অবতারনা তা হচ্ছে অষ্ট্রেলিয়ায় এসে বাংলাদেশীরা কি কাজ করে ,কেন করে , কেমন থাকে সে বিষয়ে কিছু বলার জন্য ।এখানে যারা বিএ পাশ এম এ পাশ করে এসছেন তারা যেমন ক্লিনার ,সিকিউরিটি গার্ড , ড্রাইভার , কসাই , সেলসম্যান , কারখানা শ্রমিক , কৃষি মজুর , চাইল্ড কেয়ার , ওল্ড কেয়ার সহ বিভিন্ন অড জব বা নিম্নস্তরের কাজ করেন এবং সানন্দেই করেন । তেমনি বিশেষ শিক্ষায় শিক্ষিত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার্ , কৃষিবিদ , আইটি বিশেষজ্ঞ এমনকি প্রশাসনের কর্মকর্তা ও বিভিন্ন পদে চাকুরী করেন । কেউ এসেছেন চাকুরী নিয়ে , কেউ এসেছেন নাগরিকত্ব নিয়ে তাদের অনেককেই প্রথমে এসে অড জব করতে হয়েছে । তাছাড়া এখানে এসে বাধ্যতামূলকভাবে পুনরায় এম এ পাশ করতে হয়েছে বা ডিপ্লোমা নিতে হয়েছে কোন না কোন বিষয়ে । তবে কেউই বাংলাদেশের মত আলাদা চেয়ার পাননা , আলাদা চেম্বার পাননা। সকলের জন্য একই রকম চেয়ার টেবিল ।অধস্তনদের হূঙ্কার অহঙ্কার দেখানোর সুযোগ পাননা । কোটীপতি ব্যবসায়ীরাও এসেছেন কিন্তু টাকার দেমাগ দেখাতে পারেননা । টিকিট কাটার প্রয়োজন হলে লাইনে দাঁড়িয়ে নিতে হয় । টাকা আর ক্ষমতার জোরে কোন কাজ হয়না । যে স্কুলে ক্লিনারের সন্তান পড়ে সেখানেই একই আসনে আমলা এবং কোটিপতির সন্তানকে লেখা পড়া শিখতে হয় ।বাংলাদেশীরা এখানে এসে কিভাবে এসব বিপরীত ধর্মী সংস্কৃতি মেনে নিচ্ছে এর রহস্য কি তা জানা দরকার । বাংলাদেশে আজও সাধারন মানুষ কাজের সময় কাজ করে পায়না ,উর্ধতন কর্মকর্তাকে স্যার বলে সম্বোধন সহ কুর্নিশ করতে হয় ,তারপরেও ফাইল পড়ে থাকে দিনের পর দিন , এমন কোন প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে দুর্নীতি নাই , স্বজনপ্রীতি সরকারের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে আছে , সুবিধাভোগী শ্রেনীর মধ্যে সীমাহীন লোভ তীব্রভাবে কাজ করে , চোরাচালান , জালিয়াতি , প্রতারনা , আর লুট পাট করে গাড়ী বাড়ী করছে , যা অন্যদের মাঝেও সংক্রামিত হচ্ছে , সমাজে এর প্রতিযোগীতা চলছে , আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হচ্ছে একেকজন । আর এর কুপ্রভাবে গরীব মধ্যবিত্ত মানুষেরা চিড়া চ্যাপ্টা হচ্ছে প্রতিনিয়ত ।কেউ ফিরেও দেখেনা ।
এমন চলমান সংস্কৃতির ধারক বাহক বাংলাদেশের ছাত্র ,শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবী্, চাকুরীজীবী মানুষগুলোইতো এখানে এসেছে এবং বেমালুম ভুলে গেছে ঐ অপসংস্কৃতি । হয়ে উঠেছে মৌমাছি , ছোটপাখী ,পিপিলিকার মত চঞ্চল, কর্মঠ , করিতকর্মা ও নিয়মানুবর্তী ।কিভাবে এমনটা সম্ভব হলো? দেশান্তরী হয়েছে বলেই কি ? না তা নয় । সম্ভব হয়েছে এদেশের কঠিন কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলা । এখানে আছে আইনের শাসন । ক্ষমতার শীর্ষ পর্যায় থেকে একান্ত সাধারন মানুষ সকলের জন্যই সমভাবে আইনের নিশ্চিত প্রয়োগ আছে । দুর্নীতির কোন সুযোগ নাই ।সুনির্দিষ্ট আয়ের পথ খোলা আছে । আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হবার সুযোগ নাই । চাকুরীজীবী দের কাছ থেকে সর্বোচ্চ ৪০% পর্যন্ত আয়কর কেটে নেওয়া হয় । খুব উঁচু স্তরের চাকুরিজীবী এবং একজন ক্লিনারের পারিশ্রমিকের ব্যবধান খুবই কম ।কাউকে হীন ভাবা অবহেলা করা রীতিমত অসন্মানের ব্যাপার ।কাউকে শ্রমিক মজুর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়না ।উর্ধতন কর্মকর্তাকে স্যার বলার কোন চর্চা এখানে নেই , সকলের জন্যই কাজ আছে । গরীব বুভুক্ষ মানুষ দেখা যায়না এখানে ।পথে ঘাটে কেউ ময়লা ফেলেনা । ফেললে জরিমনার ব্যবস্থা আছে । ট্রাফিক আইন মেনে চলে সবাই । না মানলে জরিমনা দিয়ে আসতে হয় সংশ্লিষ্ট দপ্তরে হাজির হয়ে। গাড়ীর হর্ন শোনা যায়না । এই নিয়ম শৃঙ্খলা যেমন মেনে চলে একজন অষ্ট্রেলিয়ান ইংরেজ তেমনি বাংলাদেশী প্রবাসী সহ অন্যান্য দেশের প্রবাসীরাও । নিয়মের মধ্যে শৃঙ্খলিত জীবন যাপনই এ দেশের একমাত্র মন্ত্র । স্বাধীনতার নামে এক শ্রেনীর অবাধ উচ্ছৃঙ্খলতা নেই এখানে ।
Leave a Comment
Your email address will not be published. Required fields are marked with *