অন্ধকারের বুক চিরে যেমন করে আলোর রেখা ফুটে ওঠে ঠিক তেমন না হলেও ঘটনাটা প্রায় একই রকম। পূর্ব ইঙ্গিত ছাড়াই কাকলি গ্রামে ফিরে আসে। তাও আবার তেইশ বছর পর! একটা অবিশ্বাস্য ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইল গোটা চালতাডাঙ্গা গ্রাম। এই আগমনে কেউ বিন্দুমাত্র প্রস্তুত ছিল না। কেউ বলতে কাকলির পরিবার থেকে শুরু করে গ্রামবাসীরা। একটা মৃত
অন্ধকারের বুক চিরে যেমন করে আলোর রেখা ফুটে ওঠে ঠিক তেমন না হলেও ঘটনাটা প্রায় একই রকম। পূর্ব ইঙ্গিত ছাড়াই কাকলি গ্রামে ফিরে আসে। তাও আবার তেইশ বছর পর! একটা অবিশ্বাস্য ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইল গোটা চালতাডাঙ্গা গ্রাম। এই আগমনে কেউ বিন্দুমাত্র প্রস্তুত ছিল না। কেউ বলতে কাকলির পরিবার থেকে শুরু করে গ্রামবাসীরা। একটা মৃত মেয়ে যাকে কিনা সকল ধর্মীয় রীতি মেনে বহু বছর আগে কবর দেওয়া হয়েছিল! সে এক নাটকীয় কাহিনী; যারাই মনে করার চেষ্টা করে তাদেরই গা শিউরে ওঠে।
সেদিন সবেমাত্র ভোরের আলো পাতার ফাঁক দিয়ে পৃথিবীর মাটিতে পড়তে শুরু করেছিল। শীতের সকালে বাড়ির অন্যরা গরম লেপ-কম্বল ছেড়ে উঠতে না চাইলেও দুরন্ত কিশোর-কিশোরীরা শীতের ঠাণ্ডা অনুভূতিকে তুচ্ছ করে ঘর থেকে বের হয়। গ্রামের শেষ বাড়ির পশ্চিমে বিস্তৃর্ণ ফসলের ক্ষেত। বাড়ি লাগোয়া একটি জমির ফসল কেটে নেওয়ায় ক’দিনের জন্যে খেলাধূলার একটা জায়গা তৈরি হয়। তারা সেখানে যেয়ে জড়ো হয় নিয়মিত। সেদিনও নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটেনি।
রুমা, কাকন, আলিফ, হাদু, মিনতি সবাই ছিল। শুধু ছিলনা কাকনের বড় বোন কাকলি। যে কিনা চপল পায়ে কারণে-অকারণে ছুটে বেড়াতো এপাড়া থেকে ওপাড়া। তার চলার ছন্দে শক্তি খুঁজে পেতো ক্লান্ত প্রকৃতি যেন। তার কণ্ঠে কণ্ঠ মেলাতো পরিযায়ী পাখির দল। প্রজাপতি- ঘাস ফড়িংয়ের সাথে ছিল হৃদয়কাড়া ভাব। এভাবেই শরীর ও মনে বড় হচ্ছিল ঠিকই; তবে তা যেন সে মানতেই চাইতো না। এমন হাসিখুশিভরা কিশোরী কোথায় গিয়েছিল? অথচ কিছুক্ষণ আগেই সে সবার উদ্দেশ্যে হাক ছেড়ে বলেছিল, ‘তোরা খেলতে থাক, আমি যাবো আর আসবো।’
বাড়ির লোকজন জানতে না পারলেও কেউ কেউ নাকি সেদিন দেখেছিল গ্রামের পাশের ছোট্ট বাজারে কয়েকজন বখাটে তাকে ঘিরে ধরেছে। কোনকিছু বুঝে ওঠার আগেই জোর করে গাড়িতে উঠিয়ে জঙ্গলের দিকে নিয়ে যায়। কেউ তখন কথা বলেনি চরম বাস্তবতায়- জীবনের ভয়ে। সবাই একজোট হয়ে হয়তো এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারতো। বাজার ভর্তি লোকজন থাকলেও সবাই যেন বোবা পাথরের ভূমিকা পালন করেছিল। না হলে ছয়-সাতজন অল্প বয়সী বখে যাওয়া ছেলেদের সাহস কীভাবে হয় এমন অপকর্ম করার!
হয়তো কাকলি নিজেকে বাঁচাতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল- কেঁদেছিল! নিজেকে মুক্ত করার আকুতি সীমা থেকে নিঃসীমায় পৌঁছেও দিতে পেরেছিল। মুক্ত সে হতে পারেনি। একসময় হারিয়ে যায় গাছের ছায়ায়- সবুজের চাদরে। গ্রামবাসী একজোট হয়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজে ফেরে তালের বনে- দক্ষিণ ভিটায়; কোথাও পায়না। তারা যখন হতাশ হয়ে ক্লান্ত-শ্রান্ত শরীরে বাড়ির পথ ধরে তখন জানতে পারে- শেখের বেটা দলবল নিয়ে তাকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল জঙ্গলের দিকে। ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। মলয় শেখ তার ছেলের পক্ষে সাফাই গায়- সেদিন নাকি তার ছেলে বাড়ি থেকে বেরই হয়নি!
হামিদ গাজীর সাথে মলয় শেখের পুরোনো শত্রুতার রূপ মহারূপে বিস্তার লাভ করে। মেয়েকে অপহরণ ও গুমের অভিযোগে মামলা দায়ের করে মলয় শেখের পরিবারের সবার নামে। যার থেকে বৃদ্ধ-মহিলারাও বাদ যায় না।
মামলা আগেই হবার কথা ছিল; যদি কাকলি নাও হারিয়ে যেতো তবুও মামলা হতো। তবে সেটা মলয় শেখ করতো হামিদ গাজীর নামে। ঘটনাক্রমে অবস্থানটা পাল্টে গেল সময়ের বিচারে।
কাকলির বড় ভাই হাবলু তিন মাস আগে মলয় শেখের মেয়ে তানিয়াকে গোপনে বিয়ে করার পর থেকে দু’পরিবারের মধ্যে অশান্তি লেগেই আছে। হাবলুর সাথে বিয়ে না দিয়ে মলয় শেখ তার মেয়েকে কেটে নদীতে ভাসিয়ে দিতেও প্রস্তুত। গোপনে বিয়ে করায় স্বীকৃতি দেওয়াতো দূরের কথা, ছাড়িয়ে নিতে সব রকম চেষ্টা করছে অনবরত। হামিদ গাজী অবশ্য তার বৌমাকে মেনে নিয়েছে প্রথম দিনই। তবে সে এত সহজে মেনে নেবার পাত্র নয়। কেন, কী কারণে মেনে নিলো তা অবশ্য অজানা। মনের ভেতরে কোন দূরবিসন্ধি আছে কিনা বাইরে থেকে বোঝা যায় না।
ইউনিয়ন পরিষদে শালিসী বৈঠক বসেছিল বেশ কয়েকবার। কাজ হয়নি। মলয় শেখ তার মেয়েকে ফিরিয়ে নেবার বাইরে আর কিছু ভাবতেই পারেনি। হামিদ গাজী তার বৌমাকে ফেরৎ দেবে কেন? এসব নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি পর্যন্ত হয়েছে। কোন সিদ্ধাতে পৌঁছাতে পারেনি স্থানীয় চেয়ারম্যান; যে সমস্যা সে সমস্যা রয়েই গেছে। বরং বৃদ্ধি পেয়েছে বলতে হয়।
হঠাৎ কাকলি নিখোঁজ হওয়ায় কলহ ফুঁলে ফেঁপে ভিমরুলের চাকে রূপ নেয়। এলাকাবাসী নিশ্চিত, নিজের মেয়েকে ফিরিয়ে নিতে না পেরে কাকলিকে অপহরণ করিয়েছে মলয় শেখ। পুলিশ আটককৃতদের মাত্রারিক্ত অত্যাচার করেও তাদের মুখ থেকে সন্তোষজনক কোন কথা বের তো করতে পারেই না, আর পারবে কিনা সেটা নিয়ে স্বয়ং পুলিশই দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যায়। ঘোড়ার পিঠের সাওয়ার হয়ে দিন পার হলেও কাকলির খোঁজ মেলে না।
একদিন দু’জন কাঠকুড়ানি জঙ্গলের মধ্যে পোড়ো বাড়িটার সদর দরজার পাশে কাকলির লাশ খুঁজে পায়। লাশের অবস্থা দেখে বোঝা যায় মৃত্যুর সময় খুব বেশি নয়। সর্বোচ্চ পাঁচ- সাত ঘন্টা। পুলিশ তখন আশেপাশে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কারো অস্তিত্ব পায় না। মলয় শেখ আর তার ছেলে ফরিদ পুলিশের ঘেরাটোপে থাকলেও তাদের দিকেই সন্দেহের তীর। ভরা বাজার থেকে কাকলিকে ইমরানই লোকজন নিয়ে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল যা সেদিন দেখেছিল অনেকেই।
পনের দিন পরে জঙ্গলের মধ্যে কাকলির সতেজ লাশ পেয়ে পুলিশ নড়ে চড়ে বসে। এই খুনের সাথে আরো কেউ নিশ্চয় জড়িত আছে। যাদের দিয়ে আসামীরা কাজটি করিয়েছে। পুলিশ নতুন করে ধড়পাকড় শুরু করে। ভয়ে কেউ কেউ বাড়ি ছেড়ে আত্মগোপন করতে পারলেও অধিকাংশকেই পুলিশ আটক করে।
তানিয়া কাঠগড়ায় উঠে বলেছিল, কাকলি যেদিন নিখোঁজ হয় সেদিন সে কাকলির সাথে ছিল! তার সামনে বড় ভাই ইমরান কাকলিকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। গাড়িতে বসা ছিল বাবা। পরে তাদের পুলিশ আটক করলে বাড়ির অন্য সদস্যরা বাবার নির্দেশে কাকলিকে হত্যা করে জঙ্গলের মধ্যে ফেলে দিয়ে আসে। মেয়ের মুখে এসব কথা শুনে মলয় শেখ মুহূর্তে অন্য জগতে হারিয়ে গিয়েছিল। এই মেয়েকে কীনা এত আদর-স্নেহ দিয়ে মানুষ করেছিল! যাকে নিয়ে দেখেছিল স্বপ্নের পাহাড়! মনে মনে খুব ভেঙে পড়েছিল সেদিন যা বাইরে প্রকাশ করেনি। পাছে ইমরান ভেঙে পড়ে। ইমরানের প্রতি তার আত্মবিশ্বাস প্রবল- যা তখনও পর্যন্ত অটুট ছিল। সে ছেলের কাছে জিজ্ঞাসা করেছিল, এমন ঘটনা ঘটিয়েছে কি না? ইমরান বাবার প্রশ্নে শুধু একটি কথাই বলেছিল, ‘আমিতো সেদিন বাড়িই ছিলাম আব্বা; আর আপনার কাছেই ছিলাম। আমি খারাপ এটা সত্য, তবে এতটাও খারাপ নই যে একটা মেয়েকে তুলে নিয়ে যাবো।’ ছেলের কথায় মলয় শেখ আর কোন প্রশ্ন করে না। আসলেইতো, যেদিন কাকলি নিখোঁজ হয় সেদিন ইমরান বাড়িতেই ছিল। সাক্ষী সে নিজেই। হাজার মানুষের সাক্ষ্যতে এই সত্য মিথ্যাতে রূপান্তর হবে না। জোরালো কোন প্রমাণ না পেলেও তানিয়ার জবানবন্দীতে তার বাবা মলয় শেখ আর বড় ভাই ফরিদের যাবৎজীবন কারাদণ্ডসহ পরিবারের অধিকাংশ সদস্যের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয় আদালত।
মলয় শেখের বাবা আর চাচা দুজনেই কারাগারে মৃত্যুবরণ করেছে। মলয় শেখ বেঁচে থেকেও যেন মৃত। তার জেল জীবনে খুব বেশি আক্ষেপ না থাকলেও নিজের মেয়ে তার বিরুদ্ধে যে সাক্ষ্য দিয়েছিল তাতেই সে বেঁচে থেকেও মৃত্যু পরবর্তী জীবন উপভোগ করছে নিরবধি। সাজা ভোগ করলেও বরাবরই নিজেদের নির্দোশ বলে দাবী করে আসছে। কাকলি হত্যার পেছনে তাদের কোন হাত ছিল না। যদি তাই হয় তাহলে কাকলিকে কে হত্যা করেছিল? বাজারে যারা সেদিন দেখেছিল ইমরানকে দলবল নিয়ে কাকলিকে উঠিয়ে নিয়ে জঙ্গলের দিকে নিয়ে যেতে তারা কী তবে মিথ্যা বলেছিল? একজন- দুইজন না হয় মিথ্যা বলতে পারে তাইবলে বাজার সুদ্ধ মানুষ কী মিথ্যা বলবে? এসব প্রশ্নের উত্তর আর কাকলির মৃত্যু গ্রামবাসীর মনে দাগ কাটলেও প্রতি বছর একটু একটু করে মিলিয়ে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল সে দাগের ব্যাপ্তি।
আজ হঠাৎ কাকলির আগমন অতি ভৌতিক ব্যাপার মনে হয়। না হলে এত বছর পর তার ফিরে আসা একদম অসম্ভব। তাকে যখন হত্যা করা হয়েছিল সেসময় তার বয়স ছিল তের কি সাড়ে তের বছর। তেইশ বছর পর সেই একই জায়গায় তার বয়স আটকে আছে! অল্প বয়সীরা বুঝতে না পারলেও ত্রিশ পেরোনো মানুষগুলো ঠিকই ভয়ে তটস্থ হয়ে উঠেছে মুহূর্তে। শুকনো পাতার শব্দে তারা কেবলই চমকে উঠছে। যারা পুনর্জন্ম বিশ্বাস করে তারা বলতে শুরু করেছে- কাকলির পুনর্জন্ম হয়েছে। বয়স্ক মানুষগুলো এক বাক্যে বলেছে, যে কোন কারণে তার আত্মা তৃপ্ত না হওয়ায় ভূত হয়ে সে ফিরে এসেছে। এখন আর কাউকে ছাড়বে না।
কাকলি নির্বাক চিত্তে এদিক-ওদিক তাকায়। সবকিছু নতুন- একদম অপরিচিত। গ্রামে ঢুকে সে বুঝেছিল কিছু একটা নিশ্চয় হয়েছে। তা না হলে সেই মেঠোপথ- শালের বন কেন অন্যরকম হবে? ছোট ছোট গাছের সারি কেমন করে ইয়া বড় বড় হয়ে যাবে? সে দ্বিধাহীন হাঁটতে থাকে। একসময় থমকে দাঁড়ায় গ্রামের দক্ষিণ দিকে পাহাড় গলা মৃতপ্রায় নদীর ওপরে খোলা প্রান্তরের সামনে। এখানে সে প্রায়ই বিকেলে বৌচি খেলতে আসতো। সেখানে মস্ত এক দালান বাড়ি; যার অবস্থা দেখে বোঝা যায় বহু পুরোনো। হয়তো ভুল হতে পারে, তবে রাস্তার ধারে এক সারিতে তিনটি তালের গাছ সে ভুলটাকে সুধরে দেয়। এই গাছগুলোর তাল সে অনেকবার খেয়েছে। ভুল হবার কোন সুযোগ নেই। পাশেই ছিল মল্লিকদের ইয়া বড় আমবাগান। কোন পাশে ছিল মনে করতে না পারলেও পূর্বদিকে ছিল বলে তার এই মুহূর্তে মনে হয়। তাইতো সেদিকে দেখার চেষ্টা করে হতাশ হয়ে যায়। সে বাগানটাও বসত বাড়ির দখলে! একটু এগিয়ে গিয়ে দেখে বাগানের কোনায় ঢাসা পেয়ারার গাছটা বহু আগেই হয়তো কাটা পড়েছে। এই গাছের পেয়ারা কে না খেয়েছে? মল্লিক বাড়ির কেউ কোনদিন নিষেধ করেনি কাউকে। তাহলে কোন প্রয়োজনে তাকে কেটে ফেলতে হয়েছে? নিজের মনে প্রশ্ন করতে করতে গ্রামের কাঁচা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকে। অল্প বয়সী কয়েকটি ছেলে তার দিকে কৌতুহল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিড়বিড় করতে করতে পাশ কেটে চলে গেলো! তাদের চোখে-মুখে একটা কিসের যেন প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে যা কাকলির চোখ এড়ায় না। যতই সময় পার হয় ততই নিজেকে অচেনা মনে হতে থাকে। কেন তার সাথে এমন হচ্ছে? চেনা গ্রাম তার কাছে কেন অচেনা হয়ে ধরা দিচ্ছে? এইতো একটু আগেই…। তার ভাবনায় ছেদ পড়ে, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মাঝ বয়সী একজনের কথায়। ‘কাকলি তু…ই!’
কাকলি তাকে ঠিক চিনতে পারে না। বলল, ‘আপনাকে ঠিক চিনতে….’ লোকটি কথাটা শোনার জন্যে কোনরূপ প্রস্তুত ছিল না। ভূত- ভূত বলে চিৎকার দিয়ে পড়ি মড়ি করে যেদিক দিয়ে এসেছিল সেদিকে দেয় দৌঁড়। লোকটির এমন আচরণে বিস্মিত কাকলি। তাকে দেখে লোকটি কেন এমন করে দৌঁড় দিলো? কেনই বা ভূত ভূত বলে চিৎকার করলো?
সুনসান দুপুর। রাস্তায় আহামরি তেমন কেউ নেই। যতদূর চোখ যায় ফসলের ক্ষেত। দূরে দাঁড়িয়ে পাহাড়ের সারি। ক’দিন থেকে ভ্যাপসা গরমের কারণে মাঝ দুপুরে ক্ষেতে কৃষকের দেখা নেই। কিছুক্ষণ আগেই তারা বাড়ি ফিরে গেছে। অন্য সময় হলে রাস্তায় পথচলা মানুষের দেখা পাওয়া যেতো। আজ ঠিক তার উল্টো। যা একজন এসেছিল সেও ভূত বলে দৌঁড়ে পালিয়েছে। কিন্তু কেন? ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রশ্ন নিজের মনের কাছে রেখে সামনের দিকে পা বাড়ায়। এমনিতে ভয় ভয় লাগছে- তার ওপর এমন নিস্তব্ধতা তার মনকে ভারি করে তোলে। পেছন থেকে দু’জন লোক সাইকেল হাঁকিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে সে তাদের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। কিন্তু কী আশ্চর্য, লোক দু’টি তার কাছে আসা মাত্র ভয়ে দুই জন রাস্তার দুই দিকে ক্ষেতের কাদা পানিতে সরাসরি সাইকেল চালিয়ে দেয়। সেখানে পড়ে গড়াগড়ি খেয়ে দু’দিকে দে ছুট। ঘটনাটি দেখে কাকলির হাসি পেলেও মনের মধ্যে বিভিন্ন প্রশ্নের উদয় হয়। এই দুইজনকে চেনা চেনা লাগে। একজন হয়তো তার ছোট কাকা ময়েন অপরজন পাশের বাড়ির রশিদ দাদা। তবে তাদের বয়সে এমন ছাপ এলো কীভাবে? এইতো গতকালই তারা ছিল ইয়ং- একদম সাবলীল। আজ তাদের দু’জনের চেহারায় এত পরিবর্তন কেন? আর ছোট কাকা তো তাকে প্রচণ্ড ভালবাসতো- তবে কেন আজ তাকে দেখে এমন ভয় পেয়ে দৌঁড়ে পালালো?
মাঠের শুরুতেই ময়েনদের বাড়ি থাকায় দু’জনে দৌঁড়ে উঠানে যেয়ে বেহুশ হয়ে পড়ে। শরীর জুড়ে কাদাপানিতে ভর্তি। লোকজন দৌঁড়ে এগিয়ে এসে চোখে মুখে পানি ছিটায়- মাথায় তেল-পানি মালিশ করে দেয়। হাত- পা ঠাণ্ডা দেখে সকলে অনুমান করে, নিশ্চয়ই ভয় পেয়েছে। এমনিতে মাঠের মাঝের পথটা বেশি একটা ভাল না, তার ওপর মাঝ দুপুর! দুপুরে অনেকে অনেক কিছু দেখেছে বহুবার। তবে তারা একা থাকা অবস্থায়। দুজন একসাথে কোনদিন কিছু দেখেনি। যে কারণে কেউ পারতোপক্ষে একলা অন্তত দুপুরে ওপথ মাড়ায় না। ময়েন আর রশিদ চোখ খুলে বড় বড় চোখে এদিক ওদিক তাকায়। যে চোখে ভয় আর শঙ্কা উন্মুক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সারা বাড়িময়। রশিদ দাঁতে দাঁত কেটে বলল, ‘কাকলি ফিরে এসেছে!’
কথাটা ঠিক ভালভাবে বোঝা গেল না। তাইতো হামিদ গাজী তার দিকে ঝুকে পড়ে বলল, ‘কী বললি রশিদ?’
রশিদের কথা বলার শক্তি নেই বললেই চলে। মুখ তার ফ্যাকাশে কাঠ হয়ে গেছে। কোন রকম অস্পষ্ট স্বরে বলল, ‘কাকলি ফিরে এসেছে!’
হামিদ গাজী মুখে তাচ্ছিল্যের ভাব এনে বলল, ‘ধ্যাৎ, যত্তসব পাগলের দল।’
ময়েন তখনও ঘোরের মধ্যে ছিল। সে এতক্ষণ একদৃষ্টে উপরের দিকে তাকিয়ে ছিল। বড় ভাইয়ের কথায় এবার মুখ খুলে কিছু একটা বলতে যেয়েও পারে না। গলা দিয়ে স্বর বের হয় না। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করার পর স্বরটা কোন রকম বের হলো। বলল, ‘হ্যা, ভাইজান; রশিদ চাচা একদম ঠিক কথাই বলেছে। তুমি বিশ্বাস করো।’
কাকলির কথা শুনে বয়স্ক মানুষগুলো যারা অন্তত কাকলিকে চিনতো-জানতো তারা যেন আকাশ থেকে পড়ে। ভয়ে তাদের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। তারা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকায়। কেউ সামনে-পেছনের গাছের দিকে তাকায়। না জানি কখন কাকলি সেখানে এসে হাজির হয়! মাঝ বয়সীরা কথাটাকে অসম্ভব বলে উড়িয়ে দেয়। তাদের ধারণা, একটা অসম্ভব কথা আর যাই হোক এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে কেউ বিশ্বাস করবে না। তাছাড়া বিশ্বাস হবার কোন কারণ নেই। তাদের সামনেই কবর দেওয়া হয়েছিল; যা এখন অতীত। অনেকেই ভুলে গেছে সে কথা। তরুণ-যুবকরা কাকলির কথা তাদের বাবা মায়ের কাছে শুনেছে। তাকে কারা হত্যা করেছিল- কে তুলে নিয়ে গিয়েছিল- কোথায় লাশ পাওয়া গিয়েছিল সব কিছু। আজ এতবছর পরে এসে এমন একটা কথা শোনার জন্যে মোটেও প্রস্তুত ছিল না কেউ। ইতিমধ্যে চারিদিকে চাউর হয়ে যায়, কাকলি গ্রামে ফিরে এসে ময়েনদের বাড়ি আশ্রয় নিয়েছে। দলে দলে লোক চারিদিক থেকে আসতে শুরু করে ময়েনদের বাড়ি। কয়েক মিনিটের মধ্যে পুরো বাড়ি এলাকার লোকজনের কোলাহলে সরব হয়ে ওঠে। একটা অবিশ্বাস্য ঘটনার সাক্ষী হবার জন্যে গ্রামবাসীর সে কী একাগ্রতা!
অবস্থা বেগতিক দেখে হামিদ গাজী বলল, ‘তোরা কী নাটক শুরু করেছিস বলতো? সারা গ্রামে রটে গেছে কথাটা। আর তোমরাও বাপু; কোথা থেকে কী শুনে এ বাড়িতে এসে জড়ো হয়েছো!’ উপস্থিত লোকজনের উদ্দেশ্যে কথাটি বলে হামিদ গাজী।
ময়েন ততক্ষণে নিজেকে একটু সামলে নিয়েছে। বলল, ‘মিয়া ভাই, আপনি জানেন আমি কখনও আপনার সাথে মিথ্যা বলিনি- বলতে পারি না। তাহলে বিশ্বাস করছেন না কেন?’
‘চুপ থাক বেকুপ। মিথ্যা বলিস না ঠিক আছে। তাহলে আজ মিথ্যা বলছিস কেন? আর কেনইবা এই আওজালা পরিবেশের সৃষ্টি করলি?’
রশিদ উঠানের মাঝে পুতে রাখা বাঁশের খুঁটি ধরে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ‘ভাইপো, ময়েন মিথ্যা কথা বলছে না। কাকলি অবশ্যই ফিরে এসেছে। বাজার থেকে ফেরার পথে আমাদের সাথে ওর দেখা হয়েছে।’
হামিদ গাজী পেটের ভেতর থেকে উঠে আসা হাসি কোনরকম থামিয়ে বলল, ‘তা তোদের কী বললো?’
‘বলার সুযোগ কই? তাকে দেখে আমরাতো ক্ষেতের মধ্যে সাইকেল ফেলে দৌঁড়ে কোন রকম জান নিয়ে ফিরে এসেছি।’ বলল ময়েন।
হামিদ গাজী আগত লোকজনের উদ্দেশ্যে বলল, ‘আমার ছোট ভাই আর চাচা ভূতের খপ্পরে পড়েছিল। তোমরা যে যার কাজে যাও। আর একটা কথা, এমন আজগুবি কথা শুনে তোমরা আবার যেন সেদিকে দৌঁড়ে যেও না।’
সবাই যখন ঘুরে বাড়ির দিকে পা বাড়ায় তখন সামনে এসে দাঁড়ায় কাকলি। সারা মুখে শুকনো মাটির আবরণ থাকলেও তাতে চেহারা লুকাতে পারে না। বিনি বাঁধা চুলে পুরোটাই জটা ধরেছে। সামনে উসকো খুসকো জংধরা কয়েকটা খোলা চুল যত্রতত্র উড়ে বেড়ায়। পরনের পোশাক যেন বহু বছর যুদ্ধ করে কোনমতে টিকে আছে। একটু ছোঁয়া লাগলেই খসে পড়বে সে। জায়গায় জায়গায় পোশাকের আসল রঙ উঁকি মারে তবুও।
তেইশ বছর আগে যেদিন লাশটা জঙ্গলে পেয়েছিল সেদিনও এই পোশাক তার পরনে ছিল! দেখে মনে হয় বহুবছর না খেয়ে-না নেয়ে ঘুমিয়ে ছিল। কিছুক্ষণ মাত্র তার ঘুম ভেঙেছে! এমন বিস্ময় সামনে দেখে দুর্বলচিত্তের মানুষগুলো সেখান থেকে পালিয়ে বাড়ি গিয়ে ঘরের খিল এটে বসে থাকে। কেউ কেউ না পালিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে অবস্থা কী বোঝার জন্যে। হামিদ গাজী ভীড় ঠেলে সামনে আসে। কাকলির দিকে চোখ পড়তেই তার সমস্ত শরীর বিদ্যুতের গতিতে চমকে ওঠে। মুখ থেকে কোন শব্দ বের হয় না। একটা কিছু বলতে যেয়েও পারে না। সব যেন গলার ভেতরেই আটকে যায়। নিজেকে সামলে নিলেও ভয়ে ঠোঁট কাঁপাকে কাঁপাতে বলল, ‘কে তুমি?’
হামিদ গাজীর বয়স হয়েছে। কালো চুল এতদিনে সব সাদা হয়ে গিয়েছে। মুখ ভর্তি লম্বা দাড়ি। সেই জৌলুস না থাকলেও এককালে যে ছিল তা দেখে সহজে বোঝা যায়। নিজের বাবাকে চিনতে মোটেও অসুবিধা হয় না কাকলির। সে দু’পা এগিয়ে বাবার সামনে যেয়ে বলল, ‘এসব আমার সাথে কী হচ্ছে আব্বা! রাতারাতি সব এতটা পাল্টে গেল কীভাবে?’
রাতারাতি! কী বলে ও। হামিদ গাজীতো হতবাক। এ কী কথা! কাকলির ফিরে আসা যতটা বিস্ময়কর ঠিক ততটা বিস্ময়কর কথা এই ‘রাতারাতি’ শব্দটা। হামিদ গাজীতো আর একবার ধাক্কা খায়। একটা কিছু বলতে যেয়েও মুখ থেকে সে কোন শব্দ বের করতে পারে না।
বাবার নীরবতা দেখে কাকলি বলল, ‘আব্বা আমার সাথে এসব কী হচ্ছে? আমাকে দেখে সব পালিয়ে যাচ্ছে কেন? আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না!’ কাকলির প্রশ্নের কোন জবাব দিতে পারে না হামিদ গাজী। চেষ্টা করেও তার গলা দিয়ে কোন স্বর বের হয় না। কী হচ্ছে এসব! ইতিমধ্যে সেখানে এসে হাজির হয়েছে হাবলু। হাতে তার হাসুয়া। গ্রামে কাকলির ভূত এসেছে শুনে ভূত মারতে একপ্রকার দৌঁড়ে চলে এসেছে। হাবলুর দুই ছেলে পেছন পেছন ছুটে আসে বাবাকে ঠেকানোর জন্যে। তারা জানে- বাবার মাথা গরম; যে কোন কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারে। তার স্ত্রী তানিয়া আসতে চাইলে হাবলু তাকে ধমক দিয়ে বলেছিল, ‘মেয়ে মানুষ, মেয়ে মানুষের মতো থাকো। যা হয় আমি দেখে এসে বলবো।’ স্বামীর কথায় আর কথা বাড়ায়নি তানিয়া। সে এত বছরে বুঝে গেছে, স্বামীর কথার অবাধ্য হলে কপালে দুঃখ এমন ভাবে নামবে যে আষাঢ়- শ্রাবণকেও হার মানাবে।
‘এই সরো তো কী হয়েছে দেখি।’ বলে হাসুয়া উঁচু করে ভীড় ঠেলে সামনের দিকে আসতে থাকলে তার ভয়ে লোকজন দুইপাশে সরে যায়। সামনে এসে কাকলির চোখে চোখ পড়তেই কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার হাতের হাসুয়া কখনযে নিচে পড়ে যায় সে বুঝতেই পারে না। বাবার মতো তার গলা দিয়েও কোন স্বর বের হয় না।
হাবলুর চেহারায় বিস্তর ফারাক হলেও নিজের বড় ভাইকে চিনতে মোটেও ভুল হয় না কাকলির। সে দ্বিধাহীনভাবে বলল, ‘তুমি নিশ্চয় আমার বড় ভাই? এ কী; তোমারও একই অবস্থা!’
হাবলু মুখ দিয়ে স্বর বের না করে শুধু মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দেয়। যদিও এই সম্মতিসূচক মাথা ঝাঁকাতে সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। যতটা রাগ নিয়ে ঘর থেকে বের হয়েছিল কাকলির মুখ দেখে ঠিক ততটাই আশ্চর্য হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘না এ অসম্ভব।’
‘কী অসম্ভব রে বড়ভাই?’ বলে তার দিকে এগিয়ে যায় কাকলি।
কাকলিকে তার কাছে আসতে দেখে ভয়ে সে ক’পা পিছিয়ে যায়।
ইতিমধ্যে কাকন এসে দাঁড়িয়েছে সেখানে। যে কিনা কাকলির ছোট ভাই হলেও ছিল তার খেলার সাথী। সবার মতো সেও বিস্মিত। ছেলেবেলার কাকলির মৃতদেহ দেখার স্মৃতি মানসপটে তার আজো জ¦লজ¦ল করে। পোস্টমর্ডেম শেষে লাশ যখন বাড়ির উঠানে নিয়ে আসে তখন চাটই থেকে কাফনের কাপড়ের ওপর নিতে যেয়ে মাথাটা একটু কাত হতেই বাম কান দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়েছিল যা কোনদিন ভুলতে পারেনি কাকন। কাকলির মৃত্যুতে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়ে কেঁদেছিল সে। কাকলি বড় বোন হলেও খুব বেশি বড় নয়- বরং তার সবচেয়ে ভাল খেলার সাথী ছিল। আজ এত বছর পরে কাকলিকে দেখে সব কথা মনে পড়ে যায়। সেদিন বৌচি খেলার মাঝে কাকলি তাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিল, ‘তোরা খেলতে থাক, আমি যাবো আর আসবো।’ সেই যে গেল, পনের দিন পরে ফিরেছিল লাশ হয়ে।
কাকন শিক্ষিত ছেলে। এই গ্রামের ভেতরে তার শিক্ষা সবচেয়ে বেশি এটা এক বাক্যে স্বীকার করবে সবাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে মাস্টার্স করে বাংলাদেশের মাটি ও প্রকৃতি নিয়ে কাজ করছে। গত সপ্তায় সাত দিনের ছুটি নিয়ে গ্রামে এসেছে। বিয়ে থা এখনও করেনি। নিজেকে পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত না করা পর্যন্ত ও ব্যাপারে ভাবার অবকাশ নেই তার। মনে তার ভয়-শঙ্কা থাকলেও সাহস করে কৌতুহলবসতঃ কাকলির সামনে যেয়ে দাঁড়ায়। বলল, ‘আমাকে কী চিনতে পারছো?’ কাকলি ভাল করে তার আপাদ মস্তক দেখে বলল, ‘না, ঠিক চিনতে পারছি না।’
‘আমি কাকন।’
কাকনকে দেখে যতটা উৎফুল্ল হবার কথা ছিল তার কিছুই হলো না। কেমন যেন হতাশা ভাব তার চোখে মুখে স্পষ্ট। বলল, ‘তোরও তো একই অবস্থা কাকন! গ্রামের ওপর দিয়ে কিছু গিয়েছে নাকি?’
‘তুমি আমাকে সত্যিই চিনতে পেরেছো?’ প্রশ্ন করলো কাকন।
‘কী সব আজগুবি কথা বলিস? তোকে চিনবো না কেন? তুইতো আমার ছোট ভাই। আচ্ছা, গতকাল রাতে গ্রামের ওপর দিয়ে কিছু কী গিয়েছে?’
‘বুঝলাম না।’
‘বলছি একরাতে সব পরিবর্তন হয়ে গেল কীভাবে? সবকিছু দেখে মনে হয় দুই যুগ পার হয়ে গিয়েছে। তুই নিজেকে আয়নায় দেখ, একদিনের ব্যবধানে বয়স তোর ত্রিশ পার হয়ে গেছে!’
কাকন সঠিকভাবে মেলাতে পারে না বর্তমান পরিস্থিতি। এ কি সত্যিই তার কাকলি আপু? যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে বয়স? একটা মানুষের বয়স কীভাবে তেইশ বছর এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে! অনেক বই জীবনে পড়েছে- কিন্তু এমন আজগুবি কথা আর যাই হোক বিজ্ঞান বিশ্বাস করবে না। বিজ্ঞান যদি বিশ্বাস না-ই করে তাহলে নিজের সামনে যেটা ঘটছে সেটা কী? দ্বিধাদ্বন্দ্ব মনে আবারো প্রশ্ন করে, ‘তুমি নিশ্চয় আমাদের বোকা বানাচ্ছো? কে তুমি, সত্যি করে বলো।’
‘তুই কি সত্যিই আমাকে চিনতে পারছিস না কাকন।’
‘আমার আপু মারা গেছে বহু বছর আগে। কমপক্ষে দুই যুগ তো হবেই।’ কাকন যত সহজে কথা বলছে মনটা ঠিক ততটায় কঠিণ হয়ে প্রশ্ন উত্তরের দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে।
‘কী সব পাগলামো কথা? আমাকে তোরা তো পাগল করে দিবি মনে হচ্ছে। আমি তোর কাকলি আপুই।’
হামিদ গাজী বলল, ‘আমার মেয়ে মারা গেছে বহু বছর আগে। এখন বিদায় হয়ে আমাদের উদ্ধার করো। এমনিতে খুব পেরেশানিতে আছি আমরা।
‘আব্বা আমি আপনার মেয়ে কাকলি।’
হামিদ গাজী ভয়ে ভয়ে দুইহাত করজোড়ে বলল, ‘আবারো বলছি, আমার মেয়ে মারা গেছে বহু বছর আগে। দেখলেতো গ্রামবাসী তোমাকে দেখে কীভাবে পালিয়ে গেল!’
‘আমি যে আপনার মেয়ে কীভাবে প্রমাণ করবো বলুন?’
‘কোন প্রমাণ লাগবে না আমার। আচ্ছা, তোমাকে মলয় শেখের লোকেরা পাঠায়নি তো?’
‘ও তাইতো, আপনাকে তো বলাই হয়নি; কালকে কেউ আমার মাথায় বাড়ি দিয়ে জঙ্গলের পোড়ো বাড়িতে ফেলে দিয়ে এসেছিল। দেখেন এই যে, এখানে।’ বলে সামনে ঝুকে মাথার কাটা দাগ দেখায় কাকলি। ঠিকইতো মাথার কাটা দাগ এখনও স্পষ্ট।
হাবলুর রাগ বাড়তে থাকে। সে খেঁকিয়ে ওঠে, ‘ও মানুষ না; নিশ্চয় টিকটিকি। আমাদের নামে বদনাম করার জন্যে এখানে এসেছে।’
হামিদ গাজী বলল, ‘দেখো মেয়ে, তুমি যেখান থেকে এসেছো সেখানে ফিরে যাও। এসব মন ভুলানো কথা আমাকে বলে লাভ নেই।’
‘আব্বা আমি আপনার মেয়ে কাকলি। আমি মরিনি- বেঁচে আছি।’
‘তোমার বয়স দেখো- আর আমাদের বয়স দেখো- কাননের বয়স দেখো। এ দেখে যদি মনে হয় তুমি আমার মেয়ে তাহলে মেনে নেবো। আর হ্যাঁ, আমার মেয়ে মারা গেছে বহু বছর আগে। তাকে গ্রামবাসী মিলে যথাযোগ্য মর্যাদায় কবর দিয়েছিলাম।’
‘আমার পরনের কাপড় দেখুনতো মনে পড়ে কী না?’
‘তোমার পোশাক কী দেখবো? তোমাকে দেখেইতো মনে হয় বহু পুরোনো অতীত থেকে এসেছো। আমাদের অতীতের কোন প্রয়োজন নেই। আমরা বর্তমান আর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবি। এখন তুমি বিদায় হও।’ হামিদ গাজী মুখে যতটা সহজে কথা বলছে মনে তার ভয় ঠিক ততটায় দানা বেঁধেছে।
ভীড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল নিতাই দর্জি। সে বলল, ‘গাজী ভাই, আমার ভাল করে মনে আছে, জাপানি টরে দিয়ে পোশাক বানানোর জন্যে আপনি নিজেই আমার কাছে অর্ডার দিয়েছিলেন। আমি কথাটা ভুলতে পারিনি এতদিন। কারণ, আমার দর্জি জীবনের প্রথম দিনই এই পোশাকটি আপনি নিজেই অর্ডার দিয়েছিলেন। পোশাকটার হয়তো রঙ বোঝা যাচ্ছে না, তবে আমার যে বানানো তা প্রথম দেখায় বুঝে ফেলেছি।’
দর্জির কথায় আর কথা বাড়ায় না হামিদ গাজী।
‘আপনি আমাকে কেন চিনতে পারছেন না আব্বা? নাকি অন্য কোন কারণ আছে?’
ভয় ও শঙ্কা স্থায়ীভাবে দানা বাঁধে হামিদ গাজীর মনে। সে থতমত খেয়ে বলল, ‘সব মিথ্যা। আমার মেয়ে মারা গেছে তেইশ বছর আগে।’ নিজেকে সংযত করে কথাটি বলল হামিদ গাজী।
এত ভুল কীভাবে হতে পারে? মাত্র একটা দিনের ব্যবধানে এত পরিবর্তন! নিজের বাবা বৃদ্ধ হয়ে গেল! ময়েন কাকা- রশিদ দাদা…। কী হচ্ছে এসব! তাছাড়া আব্বা কেন বলছে আমি মারা গেছি! সে নিজের হাতে চিমটি কাটতেই দেখে ধূলো-ময়লার তার হাতের রঙটাই পরিবর্তন হয়ে গেছে। সে হতবাক হয়ে এপাশে-ওপাশে তাকিয়ে নিজের শরীর দেখে। পরনের পোশাক পঁচে কয়েক জায়গায় ছিঁড়ে গেছে! মুখে-চুলে হাত দেয়। মসৃণ মুখে-ঠোঁটে ধার ধার অনুভূত হয়। চুলে জট বেঁধেছে! কী অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে নিজের সাথে?
‘আব্বা এ নিশ্চয় পুলিশের চর। এই তুই বের হ আমাদের গ্রাম থেকে।’ তেড়ে এসে কথাটি বলে হাবলু।
তাকে ঠেকায় কাকন। ‘বড় ভাই এত উত্তেজিত হচ্ছিস কেন? যদি পুলিশের চর হয় তাহলে সমস্যা কোথায়?’
হাবলুর রাগ চরম আকার ধারণ করে। সে উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘ওসব তুই বুঝবি না। এই চল।’ বলে কাকলির হাত ধরে টানতে টানতে মাঠের ওপারের রাস্তার মোড়ে দিয়ে যায়। কাকলি অনেকবার নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করেও পারে না। সে আর একবার হেরে যায় পারিপার্শ্বিক অবস্থার কাছে। হাবলুকে হামিদ গাজী ঠেকাতে চেষ্টাও করে না। যেন কিছুই হয়নি। কাকলি তার মেয়ে নয়- এই গ্রামের কেউ নয়। উপস্থিত কেউ কেউ অবশ্য বলেছিল, তাকে এভাবে গ্রাম থেকে বের করে না দিতে। কার কথা কে শোনে। হাবলু গায়ের জোরেই কাজটা করে যেন গৌরাবান্বিত বোধ করে। সে সবার কথা না শুনলেও হামিদ গাজীর কথা অবশ্যই শুনতো। অথচ হামিদ গাজী সেখানে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে।
কাকনের মনটা বার বার কেন যেন বলে ফিরছে, ও নিশ্চয় তার কাকলি আপু। সেই মায়া ভরা মুখ- চিতল হরিণ চোখ- কথা বলার ঢং ভুলবে কেমন করে? আবার তার মৃত্যুটাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। সে পুর্বজন্ম বিশ্বাস করে বরাবরই। আর এই বিশ্বাসের জোরেই মনে প্রশ্ন জাগে- কাকলি আপুর পুনর্জন্ম হয়নি তো?
বড়দের মুখের ওপর তর্ক করতে শেখেনি ছেলেবেলা থেকে কাকন। তাইতো কাকলিকে টেনে হিঁচড়ে বড় ভাই গ্রাম থেকে বের করে দেওয়ায় জোরালো প্রতিবাদ করতে পারে নি। সবাই যে যার বাড়ি চলে গেলে কাকন মাঠের ওপারে যায় যেখানে কাকলিকে ছেড়ে দিয়ে এসেছিল। না নেই- কোত্থাও সে নেই। এদিক-ওদিক যতদূর চোখ যায় কাউকেই দেখতে পায় না। তবে কী সে চলেই গেল! বিষণ্ন মন নিয়ে যখন বাড়ি ফিরে আসে তখন হঠাৎই আকাশে কালো মেঘে ছেয়ে চারিদিক অন্ধকার হয়ে আসে। কোনরূপ পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই শুরু হয় তুমুল ঝড় বৃষ্টি। সামান্যর জন্যে ভিজে নেয়ে একাকার। সে নিজের ঘরে যেয়ে পোশাক পাল্টে খাটের ওপর বসলেও বিষণ্নতা তাকে অক্টোপাসের মতো ঘিরে ধরে। এই ঝড়-বৃষ্টিতে বোনটা তার না জানি কোথায় আছে- কী করছে? বেশ কিছুক্ষণ পরে বারান্দায় একটা শব্দ হওয়ায় ঘরের বাইরে যেয়ে দেখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে কাকলি! কাকলিকে দেখে কাকন যেন ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে। অথচ এই কাকলিকে নিয়েই তার দুশ্চিন্তা বৃহৎ আকার ধারণ করেছিল। সে কিছুতেই যেন ভুলতে পারছিল না তার মুখ।
‘তুইও কী আমাকে…।’ কাকলিকে কথা শেষ করতে না দিয়ে কাকন বলল, ‘আমি বুঝতে পারছি না কী হচ্ছে এসব!’
‘আমি তোর বোন। তুই অন্তত বিশ্বাস কর।’
‘বর্তমান অবস্থায় কীভাবে বিশ্বাস করবো? বিজ্ঞান এমন কিছু সমর্থন করে না।’
‘আমি জানি না তুই কি বলছিস। কোন বিজ্ঞান ফিজ্ঞানের হিসাবে আমি যাবো না। তবে তুই যে আমার ভাই এটা কেউ বদলাতে পারবে না।’
‘আপু তুমি তাহলে এত বছর কোথায় ছিলে? তোমার শরীরের অবস্থা এমন কেন? তাছাড়া তোমার লাশ…’
কাকনের কথা শেষ না হতেই কাকলি বলল, ‘কাকন, ভাই আমার, ঘরে যেতে বলবি না? নাকি তুইও সবার মতো আমাকে ভয় পেয়ে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতে চাচ্ছিস?’
কাকনের কেন যেন কান্না পায়। তার চোখ জলে ভরে ওঠেছে ইতিমধ্যে। বলল, ‘ছিঃ ছিঃ আপু; কী বলছো এসব! আসো ঘরে আসো।’ বলে কাকলিকে নিয়ে ঘরে যায়। পড়ার টেবিল লাগোয়া চেয়ার টেনে দিয়ে কাকন বলে, ‘বসো আপু।’ চেয়ারে বসে কাকলি। কাকন খেয়াল করে বাইরে যেহেতু ঝড় বৃষ্টি অবিরাম চলছে, এক ফোটাও পানি কাকলির গায়ে লাগেনি! তার মনে খটকা লাগে। কিন্তু কেন? সে ভিজতে ভিজতে ঘরের বারান্দায় যখন আসে তখন কেউ সেখানে ছিল না। অবশ্য ছিল না বললে ভুল হবে, একটা কুকুর বৃষ্টির পানি থেকে বাঁচার জন্যে বারান্দায় শুয়েছিল; কাকনকে দেখে সে আস্তে আস্তে বারান্দা থেকে নেমে ভিজতে ভিজতে সামনের দিকে চলে যায়। কাকন যদিও কুকুরটাকে তাড়াতে চায়নি কিন্তু কুকুরটা নিজের ইচ্ছায় নেমে চলে গিয়েছিল স্পষ্ট মনে আছে তার। এমনকি শতভাগ নিশ্চিত, বারান্দায় কেউই ছিল না। আর বৃষ্টির তেজ এমন, চালের তলা- গাছের তলা যেখানেই থাকুক না কেন ভিজতে তাকে হবেই। তাহলে কাকলির গায়ে কেন পানির একটা ফোঁটাও লাগেনি? মনে বিভিন্ন প্রশ্নের উদয় হলেও কোন প্রশ্নকে প্রশ্রয় দেয় না কাকন। সে জানে, যা কিছু হবে তা অবশ্যই প্রকৃতির নিয়মেই হবে। তবে অতি প্রাকৃত ঘটনা যে পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মনে মনে ভাবে কাকন।
‘কাকন, আমাকে একটা কথা বলতো। অবশ্য তোকে দেখে মনে হচ্ছে ত্রিশ বছর পার হয়ে গেছে আরো অনেক আগে। তুই-তুমারি করা যদিও ঠিক হচ্ছে না তবুও তুইতো আমার ছোট ভাই।’ বলল কাকলি।
কাকন ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিৎ হাসির রেখা ফুটাতে চেষ্টা করে বলল, ‘যা কিছু করি না কেন, তুমিতো আমার বড় আপু। কী কথা বলো?’ উৎসুক প্রশ্ন কাকনের।
‘তুই হঠাৎ এত বড় হয়ে গেলি কী করে বলতো?’
‘কী বলো আপু! শুধু কী আমার বড় হওয়াটাই দেখলে? ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা শেষ করে নামকরা একটা প্রতিষ্ঠানে গবেষক হিসাবে নিয়োজিত রয়েছি সেটা কী জানো?’
‘কী বলিস তুই! এক রাতে এতকিছু ঘটে গেল?’
বিস্ময়ে চোখ কপালে তোলে কাকন। তখনও ঠিক একই কথা বলেছিল। কিন্তু কেন? এই ‘এক রাত’ এর অর্থ কী? কৌতুহল আর ধরে রাখতে পারে না সে। বলল, ‘তখনও এই এক রাতের কথাটা বলেছিলে। আসলে এই এক রাত বলতে কী বুঝাতে চাচ্ছো?’
‘আগে বল, তোদের এই আকাশ-পাতাল পরিবর্তন হলো কীভাবে? এমনকী ছোট ছোট গাছগুলো কেমন যেন ইয়া বড় বড় হয়ে গেছে! ও আর একটা কথা, আব্বা বলছিল, আমি নাকি মারা গেছি! তোরাওতো বলেছিস। একথা কেন?’
‘তুমি কী সত্যিই কিছু বুঝতে পারছো না আপু?’
‘নারে; একদম না।’
‘তোমার নিজের দিকে কী একবার তাকিয়ে দেখেছো? তোমার সারা শরীরে ময়লার স্তর জমে গেছে। চুলে ইয়া বড় জট। কাপড় পঁচে খসে পড়ার উপক্রম। যেন বহু বছর তাকে স্পর্শ করাই হয়নি।’
‘আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
‘তোমার কী মনে আছে, আমাকে শেষ কী কথা বলে গিয়েছিলে?’
‘আছে তো। সেতো গতকাল সকালে। বলেছিলাম- তোরা খেলতে থাক, আমি যাবো আর আসবো।’
‘তুমি কি এসেছিলে?’
‘আসবো কী করে- পানি খাবার জন্যে বাড়ি এসেছিলাম। তারপর হঠাৎ মাথায় একটা আঘাত লাগায় বেহুশ হয়ে পড়ি। চোখ মেলে দেখি জঙ্গলের পোড়ো বাড়িতে আমি। ওখানে কীভাবে গেলাম- কে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল তা জানিনা।’
বিস্ময় কাকনকে মোহাচ্ছন্ন করে তুলছে একটু একটু করে। অজান্তেই তার হাত- পা হীম হয়ে আসে। ‘তারপর কী হলো?’ উৎসুক প্রশ্ন কাকনের।
‘তারপর আর কী, ঘুম ভাঙতেই হাঁটতে হাঁটতে যখন গ্রামে পা রাখি তখনই বুঝতে পারলাম সব উলট পালট। মনে হয় কত বছর যেন ঘুমিয়ে ছিলাম।’
‘সত্যিই তাই আপু। এরই মধ্যে তেইশ বছর কেটে গিয়েছে।’
‘কী বলিস তুই!’ বিস্ময়ে মহাবিস্মিত কাকলি। ‘এটা কীভাবে সম্ভব?’
‘তা বলতে পারবো না আপু। তবে এটাই সত্য। রসায়নে এমন কোন ব্যাখ্যা পাইনি। তবে হ্যা, যদি তোমার কথা সত্যি হয়, তাহলে ঐ পোড়ো বাড়িতে তোমার লাশ পাওয়া, তাকে কবর দেওয়া, সেটা কী?’
‘আবার সেই লাশ! ব্যাপারটা কী বলতো?’
‘তুমি নিখোঁজের দু’দিন পরে তোমার লাশ পাওয়া যায় ঐ পোড়ো বাড়ির সামনেই। লাশ দেখে তখন মনে হয়েছিল, মাত্র ক’ঘন্টা আগেই তোমাকে কেউ হত্যা করেছে।’
‘হতে পারে হয়তো।’ কথাটায় তেমন গুরুত্ব দেয় না কাকলি। তার ভাব দেখে মনে হয়, সেই লাশ পাওয়া- কবর দেওয়া আহামরি কিছু নয়।
একটু থেমে বলল, ‘তারপর কী হলো?’
‘কী আর হবে? তোমাকে হত্যা করার অপরাধে অনেকে জেল খেটেছে। দু’জন এখনও জেলে বন্দী আছে। কেউ কেউ অবশ্য মারাও গিয়েছিল।’
‘হত্যার অপরাধে জেলে? সে কারা?’
‘মলয় শেখ, তার ছেলে ফরিদ আর সাথে যারা ছিল সবাই। বাবা মামলা দিয়ে সবার অবস্থা একদম খারাপ করে দিয়েছে।’
‘আমাকে মারার অপরাধ তাদের ওপর কেন?’
কাকন কিছু একটা বলতে যাবে এমন সময় হাবলু ক্ষিপ্রগতিতে ঘরে ঢুকে ভয়ে ভয়ে বলল, ‘তুই আমাদের বাড়ি এসে উপস্থিত হয়েছিস! বেরো এখান থেকে।’ বলে কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই কাকলির হাত ধরে ঘরের বাইরে টেনে নিয়ে যায়।
ইতিমধ্যে ঝড় বৃষ্টি থেমে আকাশ ফকফকা হয়ে গেলেও তার আগমনের চিহ্ন রেখে গেছে প্রকৃতিতে। উঠানে জটলা দেখে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে তানিয়া। সে মুখে কোন কথা না বললেও কাকলির দিকে চোখ পড়তেই চমকে ওঠে। শেষ পর্যন্ত ভূত বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে গেছে! মনে মনে ভয়ের রাজ্যে বসবাস করলেও তা প্রকাশ করে না। শুধুমাত্র একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
হামিদ গাজী গুটি গুটি পায়ে উঠানে এসে দাঁড়িয়ে মনে মনে কী যেন ভাবলো। তারপর কাকনের উদ্দেশ্যে বলল, ‘দেখলি তোর বড় ভাই ওকে গ্রামের বাইরে দিয়ে এসেছে, তাহলে তুই তাকে আনতে গেলি কেন?’
‘আব্বা, আমাকে কেউ নিয়ে আসেনি, আমি নিজেই এসেছি। নিজেদের বাড়ি- কাউকে নিয়ে আসতে হবে কেন?’ হামিদ গাজীর চোখের দিকে তাকিয়ে এই প্রথম স্পষ্ট জবাব দেয় কাকলি।
হামিদ গাজী কাকলির চোখে অস্বাভাবিক কিছু একটা দেখতে পায়। তাকে প্রথম দেখে যেমন অনুভূতি হয়েছিল ঠিক তেমনি মনের ভেতরে ঝনাৎ করে বেঁজে ওঠে। সে নিজেকে যথাসম্ভব সংযত রেখে আমতা আমতা করে বলল, ‘আমি তোমাকে কতবার বলবো, আমার মেয়ে মারা গেছে তেইশ বছর আগে। সেই শোকে তার মা’ও মারা গিয়েছিল পরের বছর।’
‘মা নেই!’ চোখ জলে ভরে যায় কাকলির। সে কেঁদে ওঠে। তাকে সান্ত্বনা দেবার মত তেমন কেউ নেই এই বাড়িতে এতক্ষণে বুঝে গেছে। তাইতো মনকে বুঝিয়ে কান্না নিবারণ করতে চাইলেও পারে না। অন্তরের গভীর থেকে কান্না যেন উছলিয়ে ওঠে অহর্নিশ।
‘এই থামতো! ফালতু নাটক শুরু করেছে। এটা কী যাত্রা মঞ্চ?’ ধমক দিয়ে বলল হাবলু।
কাকন বলল, ‘বড় ভাই, ওর কথা আমরা শুনতে পারি নাকি? কী বলতে চায় বলুক না। সবচেয়ে বড় কথা, ওর চেহারার সাথে কাকলি আপুর পুরোপুরি মিল আছে। এ পর্যন্ত যা বলেছে তার কিছুইতো মিথ্যা বলেনি। শুধু তাই নয়, যেদিন সে হারিয়ে গিয়েছিল সেদিন যে পোশাক পরা ছিল, আজও তাই আছে। একটু ভাবো বড় ভাই, কীভাবে এটা সম্ভব!’
‘পুলিশের কাছে সব সম্ভব। কেসের সমস্ত ডিটেলস্ তাদের কাছে আছে। তারা একজনকে সাজিয়ে যদি পাঠায় তাহলে অস্বাভাবিক কিছু নয়।’
‘সেটা হয়তো ঠিক। তবে এভাবে চেহারায় পুরোপুরি মিল করা শুধু অসম্ভব নয়- অবাস্তবও বটে।’
‘সব হয়- সব হয়; ওসব বুঝবি না। তুই থাম।’ বলে কাকনকে থামিয়ে দেয়।
‘আব্বা আপনি কিছু বলেন। হয়তো আল্লাহ ওকে আমাদের মাঝে পাঠিয়েছেন।’ কাকনের সরলতা দেয়ে গা জ্বলে ওঠে হামিদ গাজীর। সে কাকনকে ধমক দিয়ে বলল, ‘তোর ওসব নিয়ে ভাবতে হবে না। আমি দেখছি ব্যাপারটা।’
কাকলি মায়ের মৃত্যুশোকে মূহ্যমান। সে ফুপাতে ফুপাতে বলল, ‘মা’র কী হয়েছিল? তাকে আমি শেষ দেখাটাও দেখতে পারলাম না! আমার জন্যে তোমরা একটু অপেক্ষা করতে পারলি না?’
‘তোমার জন্যে কীভাবে অপেক্ষা করতাম? তুমিতো আরো দু’বছর আগে মারা গিয়েছিলে।’ বলল কাকন।
‘আমি যদি মারা যায় তাহলে তোদের সামনে আছি কীভাবে? এই দ্যাখ আমাকে ছুঁয়ে দেখ।’ বলে কাকনের দিকে দুই হাত বাড়িয়ে দেয় কাকলি।
‘না কাকন; একদম না। ওকে ছুবি না। তুই ছুয়ে দিলেই অন্যরকম কিছু ঘটে যেতে পারে।’ ঘরের কোনা দিয়ে গুটি গুটি পায়ে আসতে আসতে বলল ময়েন।
মায়ের মৃত্যু সংবাদে চোখে জল ভরা থাকলেও মুখে কিঞ্চিত হাসির রেখা ফুটিয়ে বলল, ‘ছোট কাকা তুমিও আমাকে চিনতে পারছো না?’
কোন কথা বলে না ময়েন। তার নীরবতা দেখে কাকলি বলল, ‘ছোট কাকা তোমার মনে আছে, একদিন ভোরে খেঁজুরের রস পেড়ে সবেমাত্র উঠানে এনে রেখেছিলে। আমি না ছেকে একটা ভাড় থেকে রস খেয়েছিলাম। তোমাকে আসতে দেখে ছুটে পালাতে যেয়ে গাছ কাটার দা’র ওপর পা দিতেই সামান্য কেটে গিয়েছিল। অল্প একটুর জন্যে সেদিন বড় বাঁচা বেঁচে গিয়েছিলাম। তুমি পরম মমতায় পায়ের কাটা জায়গায় মলম লাগিয়ে দিয়েছিলে। আমাকে মিষ্টি কিনে খাবার জন্যে দুই টাকার একটা নোট হাতে গুঁজে দিয়ে বলেছিলে, আমি যেন কাউকে না বলি। অথচ পুকুর ঘাট থেকে মা আসলে সব কথা তাকে বলে দিয়েছিলাম।’ পরেরদিন তুমি সেই দুই টাকা আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়েছিলে। মনে পড়েছে সেসব কথা?’
ময়েনের সব কথা মনে পড়ে। তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেদিনের সেই দৃশ্য। সে ভেতরে ভেতরে ভয়ে মূহ্যমান। বলল, ‘কাকলি মারা গেছে বহু আগে। ওসব বলে আসাদের মন গলাতে পারবে না। দয়া করে অন্য কোথাও যেয়ে চেষ্টা করো।’
কাকলি নিজেকে সংযত না করতে পেরে চিৎকার করে ওঠে, ‘আমাকে তোমরা কেন বিশ্বাস করতে পারছো না? আমি তোমাদের মেয়ে কাকলি। আব্বা আপনি বলুন, কী করলে বুঝবেন আমি আপনার মেয়ে?’
হামিদ গাজী থতমত খায়। নিজেকে তবুও স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল, ‘তুমি যদি আমার সত্যি মেয়ে হয়ে থাকো তাহলে তোমার কাছে হাতজোড় করে বলছি, এখন তুমি বিদায় হও। তোমাকে আমাদের কোন প্রয়োজন নেই। আমার মেয়ে মারা গেছে বহু বছর আগে, সে বিশ্বাস নিয়ে থাকতে দাও। আর জ্বালিওনা, এমনিতে চারিদিক থেকে জ্বলে পুড়ে মরছি।’
নিজের বাবার কথায় নিজেকে এখন বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় কাকলির। ঘুম ভাঙার পর যে বিশ্বাস নিয়ে বাড়িতে ফিরে এসেছিল সে বিশ্বাসের ভীত কেমন যেন নড়বড়ে হয়ে গেছে। কী করবে বুঝতে না পেরে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে। সেদিকে এগিয়ে যায় হাবলু আর ময়েন। হাবলু বলল, ‘জীবনে কত ভূত প্রেত দেখলাম; আর এ তো কোথায় বাচ্চা ভূত! এই বেরো এ বাড়ি থেকে; বের হ। আর যদি কোনদিন এ বাড়ি মুখো এমনকি গ্রাম মুখো হস তাহলে সেদিন কিন্তু আর কেউ বাঁচাতে পারবে না।’
সহজেই নিয়তিকে মেনে নেয় কাকলি। মন তার ভেঙে খান খান হয়ে গেছে। কোথায় যাবে সে? বয়সটাও আহামরি বেশি নয়। যে বয়সে বাবা-মায়ের ছত্রছায়ায় থাকার কথা সে বয়সে তাকে হতে হচ্ছে বাড়ি ছাড়া! সে মনে পর্বত সমান কষ্টা নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে মেঠো পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে একসময় চলে যায় দৃষ্টির অতলে।
কাকলিকে দেখার পর দু’চোখে ঘুম আসে না তানিয়ার। সে এতবছর সংসারে এসে কত নির্যাতন- কত অপমান সহ্য করেও শেষ রাতের দিকে দু’চোখের পাতা এক করেছে অথচ কাকলির চোখে চোখ ফেলতেই তার ঘুম সব উবে গেছে জলীয়বাষ্ম হয়ে। কেবলই তাকে কোন এক অদৃশ্য শক্তি টেনে নিয়ে যাচ্ছে আগামীর দিকে। গত তেইশ বছর হাতে গোনা দু’একবার বাড়ির বাইরে গিয়েছিল; তাও কোর্টে সাক্ষী দিতে। বাইরে যেতে মন যে চায়নি তা নয়, চাইলেও হাবলু তাকে কড়া নির্দেশ দিয়েছিল, বাড়ির বাইরে না যাবার জন্যে। কিন্তু আজ সে বাইরে যাবেই। কোন শক্তি তাকে আটকাতে পারবে না।
কাকলি হত্যা মামলা বহুবছর পর আবারো আদালতে ওঠে। কে, কী কারণে মামলা আদালতে তুললো তা বুঝে উঠতে পারে না হামিদ গাজী। যে মামলায় আসামীদের কেউ কেউ সাজা খেটে বেরিয়ে গেছে, কেউ কেউ মারাও গেছে, সে মামলা কে উপরে তুলে ধরার চেষ্টা করছে? কিছুই বুঝে উঠতে পারে না সে।
কোর্ট প্রাঙ্গণে সাজ সাজ রব। একটা স্পর্শকাতর মামলা আজ আবারো আদালতে উঠছে! তাছাড়া ভিকটিম অর্থাৎ যাকে তখন হত্যা করা হয়েছিল তাকে গ্রামে অনেকে স্বশরীরে দেখেছে বলে কানাঘুসা চলছে! সে নাকি গ্রামের বাড়িতে এসেছিল! শ’ শ’ লোকের সামনে কথাও বলেছে! এ কথার বিশ্বাসযোগ্যতা আদালতের কাছে একদমই নেই। আদালত চায় স্বাক্ষ্য-প্রমাণ, কোন অবাস্তব ঘটনা নয়।
বিচারকার্য শুরু হয়েছে। ‘সাক্ষী তানিয়া হাজির’ বলতেই তানিয়া কাঠগড়ায় উঠে দাঁড়ায়। যা দেখে চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় হামিদ গাজীর। শুধু হামিদ গাজীর বললে ভুল হবে, হাবলু থেকে শুরু করে উপস্থিত অনেকের মনে বিভিন্ন প্রশ্নের জন্ম দেয়। হঠাৎ পুরোনা সাক্ষীকে কেন তলব আদালতের? তার তো বাড়ি থেকে বের হওয়া নিষেধ। তাহলে কোন সাহসে- কী কারণে কাউকে কিছু না বলে বাড়ির বাইরে আসলো! তাও আবার আদালতে! সে তো অবাস্তব ব্যাপার। হামিদ গাজী কটমট করে তার বৌমার দিকে তাকায়। হাবলু উঠে দাঁড়িয়ে স্ত্রীকে কিছু বলতে গেলে বিচারক তাকে থামিয়ে দেয় যা তানিয়ার চোখ এড়ায় না। তানিয়া বুঝেছে, আজ এই কাঠগড়ায় উঠার ফল খুব খারাপ হবে; হয়তো সে ফল সকল চরমতাকে উৎরে যাবে। তবুও সে সংকল্প করেই ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে- আজ তার থামার কোন সুযোগ নেই। তাতে, সকল বাস্তবতা মেনে নিতে প্রস্তুত সে।
‘আপনি নির্ভয়ে বলুন’ জজের এমন নির্দেশে তানিয়া বলল, ‘জজ সাহেব, কাকলিকে অপহরণ সেদিন আমার ভাই ফরিদ করেনি। আমার বাবাতো এ ব্যাপারে কিছুই জানতো না। যা করেছিল তা আমার স্বামী আর আমার শ্বশুর মিলেই করেছিল। তাদের সাথে ছিল আরো দুইজন।’
কথাটা শুনে আদালতে উপস্থিত লোকজন তো হতবাক। এত বছর পর এসে এ কী বলছে তানিয়া। আর অভিযোগ করবি তো কর একেবারে নিজের স্বামী- শ্বশুরের নামে! পিনপতন নীরবতার চাদরে মোড়া আদালতে এ ওর সাথে গুঞ্জনে মেতে উঠলে জজ সাহেব অর্ডার অর্ডার বলতেই আবারো নীরবতা নেমে আসে। উকিল বলল, ‘আপনি বলুন, তারপর কী হলো?’
তানিয়া নিজেকে শক্ত করে বলল, ‘সেদিন সকালে কাকনের সাথে কাকলি মাঠে খেলছিল। হঠাৎ পানির পিপাসা লাগায় সে বাড়ি চলে আসে পানি পান করতে। সেই বাড়ি আসাটাই কাল হলো তার। আমার স্বামী কাকলিকে বলেছিল, জঙ্গলের মধ্যে একটি সুন্দর রাজবাড়ী খুঁজে পাওয়া গেছে; আমরা কয়জন সেখানে যাচ্ছি, তুইও চল। সে যেতে রাজি না হয়ে বলেছিল, কাকনরা আমার জন্যে অপেক্ষা করবে। পরে একদিন সবাই মিলে যাবো বলে পানি না পান করে বাইরে যেতে উদ্যত হয়। তখন শ্বশুর ইশারা করতেই আমার স্বামী কাকলির মাথায় পেছন থেকে কুড়ালের আছাড় দিয়ে আঘাত করে। কাকলি একাবার মাত্র মা বলে সেখানেই পড়ে যায়। আমি ছুটে যেয়ে অচেতন কাকলির মাথায় পানি দেবার চেষ্টা করি। শ্বশুর পাশে থাকা হাসুয়া হাতে নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে গলার ওপর ধরে বলে, ‘কথাটা যদি দুই কান করেছো তো তোমার অবস্থা এর চেয়েও ভয়াবহ হবে। যাও নিজের ঘরে যাও।’ আমি ওদের ভয়ে ঘরে যেয়ে জানালার ফাঁক দিয়ে দেখতে থাকি। ছোট চাচা শ্বশুর ময়েন আর পাশের বাড়ির রশিদ এসে কাকলির পা ধরে টানতে টানতে শ্বশুরের ঘরের ভেতরে নিয়ে যায়।’ তানিয়ার চোখে জলের বান উছলিয়ে উঠেছে ততক্ষণে। সে নিজেকে আর ঠেকাতে পারে না। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। ক্ষণেক পরে নিজেকে সামলে নিয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ ও নাকের পানি মুছে বলল, ‘সন্ধ্যার পর তারা কাকলির নিথর দেহ জঙ্গলের ভেতরে ফেলে দিয়ে এসে পরেরদিন মিথ্যা গল্প প্রচার করে- আমার ভাই ইমরান দলবল নিয়ে তাকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে! তারা মিথ্যা হত্যা মামলা দায়ের করে। যে মামলায় আমাদের পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে। কেউ কেউ আজও জেলে পঁচে মরছে।’ কথাটা শেষ করতে গত তেইশ বছর জমে থাকা কান্না আবারো বানের জলের মতো উছলিয়ে ওঠে। তার হৃদয় নিংড়ানো কান্নায় উপস্থিত অনেকের চোখে জল এসে যায়।
হামিদ গাজীর উকিল যেন সব কথা ফুরিয়ে ফেলেছে। সে ভেবে পায়না কী বলবে। হঠাৎ মনে আসায় সে বলল, ‘আপনার গল্প যুক্তির খাতিরে না হয় মানলাম। তাহলে বলুন, আপনি নিজেইতো সেদিন সাক্ষী দিয়েছিলেন পিতা- ভাইদের বিরুদ্ধে। তাহলে আজ এতবছর পর কী এমন ঘটলো যার জন্যে বয়ান একেবারে উল্টে দিলেন?’
‘আমাকে হত্যা করার হুমকি দিয়ে- প্রতিনিয়ত নির্যাতন করে আমাকে দিয়ে মিথ্যা সাক্ষী দিতে বাধ্য করেছিল সেদিন।’
‘আমার জানামতে ঘটনার সময় আপনার শাশুড়ী তো বেঁচে ছিলেন। তাহলে তিনি কিছু বলেননি কেন? তিনিও কী তাহলে…!’
‘না; একদম না। আমার শাশুড়ী খুব ভাল মানুষ ছিলেন। ঘটনার দিন তিনি দুপুরে ঘুমিয়েছিলেন। উঠেছিলেন পরেরদিন সকালে।’
‘এমনটা কী হতে পারে?’
‘কিন্তু হয়েছিল সেদিন। শাশুড়ী নিজেই বলেছিল তাকে হয়তো কোনভাবে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দেওয়া হয়েছিল। যারা কাকলিকে হত্যা করেছিল তারা সব বলতে পারবে।’
বহু যুক্তিতর্কের পরে আদালতের নির্দেশে পুলিশ হামিদ গাজী, হাবলু, ময়েন আর রশিদকে আটক করে। রিমান্ডে নিতেই তারা হড়হড় করে বলে দেয় চাপা পড়ে থাকা সব ঘটনা। তাদের নামে হত্যা মামলা দায়ের হলে তানিয়ার বাবা-ভাই ছাড়া পেয়ে যায়।
হয়তো তানিয়াও মুক্তি পেয়ে যাবে এ সংসার থেকে। অবশ্য এখানে আর থাকার ইচ্ছাও তার নেই। সুযোগ থাকলে বহু আগেই চলে যেতো- শুধু মৃত্যুভয়ে আর দুই ছেলের কথা ভেবে সে কোন সিদ্ধান্ত নেয়নি। ছেলেরা এখন বড় হয়েছে বলে কোন সিদ্ধান্ত নিতে সে পিছুপা হবে না।
এক মহেন্দ্রক্ষণে আদালত চার জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় দিলে কোন পিছুটান তানিয়াকে আটকিয়ে রাখতে পারে না। সে দুই ছেলেকে নিয়ে মেঠোপথ ধরে যখন বাবার বাড়ির দিকে রওনা হয় তখন হঠাৎই কাকলি তার সামনে এসে দাঁড়ায়। আজ আর কাকলিকে দেখে তানিয়া চমকায় না। যেন সে তারই অপেক্ষায় ছিল।
‘আমার একটা দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, তুমিই আমার হত্যাকারীদের ধরিয়ে দিতে পারবে।’
‘আমাকে ক্ষমা করে দিও। এতবছর কিছু না করতে পারার জন্যে।’ বলল তানিয়া।
‘তোমাকে ধন্যবাদ ভাবী, তোমার কাছ থেকে আমি এটাই আশা করেছিলাম।’
তানিয়ার দুই ছেলে হতবাক। হঠাৎ তার মায়ের কী হলো! এই ফাঁকা রাস্তায় সে কার সাথে কথা বলে? সামনে তো কেউই নেই! বড় ছেলে বলল, ‘তুমি কার সাথে কথা বলছো মা? পাগল হয়ে গেলে নাকি?’
‘তোর ফুফুর সাথে।’
‘ফুফু! কোন ফুফু?’
‘তোর কাকলি ফুফু।’
‘তোমার ভুল হচ্ছে, এখানে কেউ নেই।’
তানিয়া সামনে তাকিয়ে দেখে সত্যিইতো সামনে কেউ নেই। সে চারিদিক তাকায়। না কেউ নেই। সে মনে মনে ভাবে, কাকলি হয়তো তাকে ধন্যবাদ দেবার জন্যে অবচেতন মনে ফিরে এসেছিল।
হামিদ গাজীদের বিচার চলাকালীণ সময়ে কারো কারো সামনে কাকলি পড়লেও যেদিন জজ তাদের সাজার রায় দেন সেদিনের পর কাকলিকে আর গ্রামে দেখা যায়নি। কাকলির ফিরে আসার গল্প যত দিন যায় তত ফুলে ফেঁপে বিস্তর আকার ধারণ করে।
হয়তো কাকলি এসেছিল- হয়তো আসেনি। হয়তো হঠাৎই সকল গ্রামবাসীর আত্মচেতন মনে বসত গড়েছিল সে! যাই হোক না কেন, বহু বছর পরে হলেও এক অন্যরকম শক্তি অতীব মিথ্যাকে সত্যের কাছে পরাজিত করে। তানিয়ার হয়তো সত্যকে অনুধাবন করে রুখে দাঁড়াতে বহু বছর লেগেছিল, পারিপার্শ্বিক চাপ- মৃত্যুভয় আর দুই সন্তানের কথা চিন্তা করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে যে ঘুরে দাঁড়িয়ে সত্যকে সম্মুখে আনতে পেরেছিল সেজন্যে কাকলি তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিয়েছিল চিরতরে- আর ফিরে আসেনি।
Leave a Comment
Your email address will not be published. Required fields are marked with *