প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউসুফ আলী: ভাল ছাত্র মাত্রই পরীক্ষার পূর্বে প্রস্তুতি গ্রহণ করে। একজন ভাল মুসলমান হিসেবে আমাদের গড়ে তুলতে হলেও, এখন থেকেই আমাদের রমজান মাসের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া দরকার, যাতে আমরা রমজানের মহাকল্যাণ থেকে বঞ্চিত না হই এবং রোজার যাবতীয় উপকার লাভ করতে পারি। আরবি শাবান মাস শেষের দিকে। আর কয়েক দিন পরেই শুরু
প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউসুফ আলী: ভাল ছাত্র মাত্রই পরীক্ষার পূর্বে প্রস্তুতি গ্রহণ করে। একজন ভাল মুসলমান হিসেবে আমাদের গড়ে তুলতে হলেও, এখন থেকেই আমাদের রমজান মাসের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া দরকার, যাতে আমরা রমজানের মহাকল্যাণ থেকে বঞ্চিত না হই এবং রোজার যাবতীয় উপকার লাভ করতে পারি। আরবি শাবান মাস শেষের দিকে। আর কয়েক দিন পরেই শুরু হচ্ছে বরকত, রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস পবিত্র রমজান মাস। রমজানের পূর্ব প্রস্তুতি হিসাবে আমাদের কয়েকটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। রমজান মাস পাওয়ার জন্য আল্লাহর রসুল (স.) দোয়া করতেন, “আল্লাহুম্মা বারিকলানা ফী রজাবাও ও শাবান, ওয়া বাল্লিগনা রমাদ্বন”-অর্থাৎ, ‘হে আল্লাহ! আপনি আমাদের রজব ও শাবান মাসের বিশেষ বরকত দান করুন এবং আমাদের রমজান পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিন।’ (মুসনাদে আহমাদ)। আমাদেরও বেশী বেশী এই দোয়া করা চাই।
বিশেষজ্ঞ ডাক্তারগণ বলেন, শরীর ফিট রাখতে হলে নিয়মিত ব্যায়ামের দরকার হয়। এই ব্যায়ামের একটি নিয়ম হলো, প্রথমে আস্তে আস্তে খাবার নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এরপর ধীরে ধীরে ব্যায়ামের মাত্রা বাড়ানো হয়। এক বারে প্রথম থেকেই ডায়েটিং বা খাবারের মাত্রা কমিয়ে দিলে এবং ব্যায়ামের মাত্রা বেশী হলে তা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। অনুরূপভাবে রমজানের ফরজ রোজার আগে শাবান মাসের রোজা দ্বারা শরীরকে আস্তে আস্তে রোজার জন্য প্রস্তুত করা হয়। এর মধ্যে অবশ্যই হিকমত নিহিত আছে। রমজান মাসের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে শাবান মাসের নফল রোজা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সহিহ হাদিসে আয়িশা (রাঃ) বলেন, রসুলুল্লাহ (স.) কে আমি শাবান মাস ছাড়া অন্য কোন মাসে এত অধিক নফল রোজা পালন করতে দেখিনি। তিনি যেন গোটা শাবান মাসই রোজা পালন করতেন। তিনি সামান্য (কয়টি দিন) ব্যতীত গোটা শাবান মাস রোজা রাখতেন (সহিহ মুসলিম)। মহানবী (স.) এক ব্যাক্তিকে বললেন, তুমি কি এ মাসের অর্থাৎ শাবান মাসের মধ্যেভাগে কিছু দিন রোজা রেখেছো? সে বলল, না। তিনি তাকে বললেন, রমযানের রোজা পালন শেষ করে তুমি এক দিন বা দুই দিন রোজা রাখবে (মুসলিম:২৬২৪)। আর এক হাদিসে এসেছে, আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (সা.) শাবান মাস ব্যতীত বছরের অন্য কোন মাসে এত অধিক রোজা পালন করতেন না। তিনি বলতেনঃ “তোমরা যথাসাধ্য অধিক পরিমাণে ভাল কাজ কর। কারণ আল্লাহ তা’আলা সওয়াব দিতে কখনও ক্লান্ত হন না বরং তোমরাই আমল করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়” (মুসলিম:২৫৯৪)।
কাজা রোজা আদায় করা
বিগত বছরের কোন রোজা কাজা থাকলে তা রমজান আসার আগেই, অর্থাৎ এই শাবান মাসের মধ্যেই আদায় করার কথা হাদিসে এসেছে এবং আল্লাহর নবী (স.) তার সহধর্মিনী আয়েশা (রা.) কে এই শিক্ষা দিয়েছেন।
রমজানের জন্য দিনক্ষণ গণনা
রমজানের জন্য দিনক্ষণ গণনা করা ও চাঁদের হিসাব রাখা সুন্নত। রমজানকে স্বাগত জানানোর জন্য মহানবী (স.) নতুন চাঁদের সন্ধানে থাকতেন এবং নতুন চাঁদ দেখে আল্লাহর রসুল (স.) এই দোয়া পড়তেন, আল্লাহুম্মা আহিল্লাহু আলাইনা বিল আমনি ওয়াল ঈমা-নি ওয়াছ ছালামাতি ওয়াল ইসলামি, রব্বী ওয়া রব্বুকাল্লাহ; হিলা-লু রুশদি ওয়া খইর। অর্থঃ হে আল্লাহ, এই চাঁদকে আমাদের ওপর উদিত কর নিরাপত্তা, ঈমান, শান্তি ও ইসলামের সাথে। হে চাঁদ তোমার ও আমার প্রভু একমাত্র আল্লাহ (তিরমিজী)। এছাড়া অন্যান্য দোয়ার কথাও হাদিসে বর্ণিত আছে। হজরত মুয়াল্লা ইবনে ফজল (রহ.) নামে এক বিখ্যাত তাবেয়ী বলেন-‘আমাদের পূর্ববতী বুজুর্গগণ রমজানের ৬ মাস আগ থেকে আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন- ‘হে আল্লাহ, আপনি আমাদের রমজান পর্যন্ত হায়াত দান করেন। আর রমজান শেষে তারা বাকি ৬ মাস দোয়া করতেন- হে আল্লাহ, রমজানে যা আমল করেছি; তা আপনি কবুল করে নিন।’
রমজানের ঠিক পূর্বে রোজা ছেড়ে দেওয়া:
হাদিসের ভাষ্যমতে, রমজানের ঠিক পূর্বে, অর্থাৎ এক-দুই দিন আগে রোজা ছেড়ে দেওয়া উত্তম। এটাও রমজানের প্রস্তুতি। এর কারণ হলো, নফল রোজা থেকে মহামূল্যবান ফরজ রোজাকে পৃথক করা।
রমজান সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানো:
শাবান মাস থেকেই পবিত্র রমজানের গুরুত্ব তুলে ধরে জনগণকে সচেতন করা মহানবীর (স.) অন্যতম সুন্নত আমল। রাসুলল্লাহ (স.) একদা শাবান মাসের শেষ দিনে সাহাবায়ে কিরামকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, ‘তোমাদের প্রতি একটি মহান মোবারক মাস (রমজান) ছায়া স্বরূপ আসিতেছে। এ মাসে সহস্র মাস অপেক্ষাও উত্তম একটি রজনী আছে। যে ব্যক্তি এ মাসে একটি নেক আমল করল সে যেন অন্য মাসে একটি ফরজ আদায় করল। আর এ মাসে যে ব্যক্তি কোনো ফরজ আদায় করে, সে যেন অন্য সময়ের ৭০টি ফরজ আদায় করল। এটি সংযমের মাস, আর সংযমের ফল হচ্ছে জান্নাত (মিশকাত)’।
হাদিসে বর্ণিত প্রস্তুতি ছাড়াও আমরা আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় খেয়াল রাখতে পারি। যেমন:
(১) রমজানের নিয়ম-কানুন শিক্ষা করা,
(২) রমজানের আগমনে আনন্দ প্রকাশ করা,
(৩) রমজানের ২৪ ঘণ্টার রুটিন তৈরি করা,
(৪) অফিসের বা বাসার বাড়তি কাজ থাকলে তা আগেই সেরে ফেলা,
(৫) কর্মচারীকে কাজের বোঝা হালকা করার জন্য নতুন রুটিন তৈরি করা,
(৬) গুনাহ ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করা,
(৭) দোয়া-জিকিরের জন্য সময় ঠিক করা,
(৮) কুরআন শরীফ সহিহভাবে পড়া শিক্ষা করা,
(৯) কুরআনের অর্থ বুঝার চেষ্টা করা,
(১০) জাকাতের হিসাব করা,
(১১) রমজানের আর্থিক প্রস্তুতি গ্রহণ করা। যেমন, কিছু টাকা বাঁচিয়ে তা দিয়ে গরীব ও অভাবীদের সাহায্য করা, অথবা রোজাদারকে ইফতারির করানোর জন্য কিছু অর্থ এখন থেকেই জমা রাখা।
মহান আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে রমজানের যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ করার তৈফিক দান করুন এবং আমাদেরকে রমজান পর্যন্ত হায়াত বৃদ্ধি করে দিন। আমীন। (লেখক: মৎস্য-বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, পোস্ট ডক্টরাল ভিজিটিং ফেলো, সিডনী)
Leave a Comment
Your email address will not be published. Required fields are marked with *