ড. ফারুক আমিন : দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি দেশে চলতি ২০২৪ সালে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। গণতন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য হলো সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মতামতের ভিত্তিতে জনগণের অধিকার নিশ্চিত করার রাজনীতি বাস্তবায়ন করা। একটি গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচনের মাধ্যমে জনমতের সর্বোচ্চ প্রতিফলন দেখা যায়। জনমতের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় কারা দেশ পরিচালনা করবে এবং কোন নীতিতে দেশ পরিচালিত হবে। এ কারণে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান হলো গণতন্ত্রের মৌলিক একটি শর্ত। কিন্তু বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের চলতি নির্বাচনসমূহ পর্যবেক্ষণে প্রশ্নের উদ্রেক হয়, দীর্ঘদিন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে কলোনি হিসেবে পরিচালিত হওয়ার অভিজ্ঞতার পর এই অঞ্চলের যে মানুষেরা ১৯৪৭ সালে স্বায়ত্তশাসনের যে অধিকার পেয়েছিলো, বিগত চুয়াত্তর বছরে সেই গণতান্ত্রিক অভিজ্ঞতার কোন সুফল কি আদৌ সে মানুষেরা পেয়েছে? চলতি বছরেই অনুষ্ঠিত কিংবা অনুষ্ঠিতব্য তিনটি দেশের তিনটি নির্বাচন থেকে এ দেশগুলোর ভবিষ্যৎ পথযাত্রা অনুমান করারও সুযোগ রয়েছে।
এ নির্বাচনগুলোর মাঝে প্রথমটি ৭ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি প্রকৃতপক্ষে ছিলো ক্ষমতা দখল করে রাখা আওয়ামী লীগের জন্য আরো পাঁচ বছরের বৈধতা পাওয়ার আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। নানা প্রহসন, কৌতুক এবং বিকৃত দলীয় দখলদারিত্ব চর্চার শেষে সরকার দাবি করেছে চল্লিশ শতাংশ ভোটার না কি এ নির্বাচনে ভোট দিয়েছে। তবে সবার সামনে যে বাস্তবতা পরিষ্কার তা হলো সমস্ত প্রচেষ্টার পরও শতকরা দুই থেকে পাঁচ শতাংশ ভোটারও এ নির্বাচনে ভোট দিতে ভোটকেন্দ্রে যায়নি।
তবে বাংলাদেশের একজন মানুষও যদি ভোট দিতে না যায় তাতে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা দখল করে রাখার অজুহাতের কোন অভাব হবে না। তারা যেহেতু নিজেদেরকে স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতার মালিক দাবি করে, সুতরাং তাদের আসল বক্তব্য হলো এই দেশে ক্ষমতা ভোগ করার একমাত্র হকদার তারাই। শেখ মুজিব আনুষ্ঠানিকভাবে একদলীয় শাসন জারি করে যে বোকামি করেছিলো, তার মেয়ে শেখ হাসিনা সেই ভুল করেনি। বরং কাগজে কলমে সবাইকে ঠিক রেখে এবং কঠোর নিয়ন্ত্রণের ভেতরে অন্যান্য দলগুলোকে টিকে থাকার অবকাশ দিয়ে অনানুষ্ঠানিকভাবেই সে বাংলাদেশে একদলীয় রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে।
২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ এই তিনটি নির্বাচনের মাধ্যমে সন্দেহাতীতভাবে এই সত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে যে বাংলাদেশে কোন দলীয় সরকারের অধীনে কোন সুষ্ঠ নির্বাচন বাস্তবায়ন হওয়া একটি অলীক কল্পনা মাত্র। এর আগে ফখরু-মইনুর ২০০৮ এর ষড়যন্ত্রনির্ভর সরকারের অধীনে নির্বাচনের ইতিহাস এ স্বাক্ষ্যও দেয় যে এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো একটি নিরপেক্ষতানির্ভর প্রকল্পকেও বাংলাদেশে বিনষ্ট করা খুব সহজ একটি কাজ। একাত্তরে স্বাধীনতা লাভের পরবর্তী ৫২ বছরের ইতিহাস এবং একানব্বই এ স্বৈরাচার পতনের পর থেকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ৩২ বছরের ইতিহাস, দুই স্তরের এ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই দেশে শীঘ্রই কোন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রচলনকে বোকামীর আশাবাদ হিসেবে সাব্যস্ত করা যায়। বরং দৃঢ়তার সাথে অনুমান করা যায় বাংলাদেশের মানুষ বৃটিশ গোলামী থেকে পাকিস্তানের গোলামীর পর এখন নিজেদেরই বংশোদ্ভুত একটি শ্রেণীর গোলামী স্তরে প্রবেশ করেছে এবং জীবন কাটাচ্ছে। এই দেশে সত্যিকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রচলন ও অধিকারনির্ভর রিপাবলিকের প্রতিষ্ঠা এখনো দূর-কল্পনা।
১৯৭১ এর আগে বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে যে দেশের একটি অংশ ছিলো, সেই পাকিস্তানে ঠিক এক মাস পরেই ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ তারিখে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এটি ছিলো পাকিস্তানের ষোলতম জাতীয় নির্বাচন। বাংলাদেশের ঠিক উল্টো ঘটনা ঘটেছে নির্বাচনের ঘটনায়, তবে পরিণতি ঘটেছে একই। পাকিস্তানের নির্বাচনে সাধারণ মানুষ বিপুল জনস্রোতে ভোটকেন্দ্রে গিয়েছে এবং ভোট দিয়েছে। ক্ষমতাচ্যুত ও কারাবন্দি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ বা পিটিআইকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়া না হলেও সে দলের নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে পুরো দেশের বিপুল বিজয় পেয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রটির মূল ক্ষমতাধর মালিক শক্তি সে দেশের সামরিক বাহিনী যেহেতু ইমরান খানের রাজনৈতিক দলকে রুখে দিতে বদ্ধপরিকর, সুতরাং নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর আড়াই সপ্তাহেরও বেশি সময় অতিবাহিত হলেও এখনো দেশটিতে কোন সরকার গঠিত হয়নি। যে কোন মূল্যে এবং অজুহাতে কম ভোট পাওয়া নেওয়াজ শরীফের দল এবং বিলওয়াল ভুট্টোর দলকে মিলিয়ে কোয়ালিশন করে আর্মির পুতুল সরকার গঠনের চেষ্টা এখনো অব্যাহত রয়েছে। সুতরাং কোন বাহুল্য ছাড়াই বলা যায়, পাকিস্তানেও বাংলাদেশের মতো নির্বাচন একটি বাহানা ও আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। জনগণের ইচ্ছার মূল্য এখানে কোন ধর্তব্য বিষয় নয়, বরং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক কুশীলবদের ইচ্ছা ও পরিকল্পনা মতোই এ দুটি দেশে সরকার গঠিত হয়।
বাংলাদেশ ও পাকিস্তান দুটি দেশেরই প্রতিবেশী দেশ ভারতের অবস্থা এ ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নরকম। চলতি বছরেরই এপ্রিল-মে মাসে ভারতের জাতীয় সংসদ বা লোকসভার আঠারোতম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। বিগত দুই দফায় ভারতে ক্ষমতাসীন হয়েছে গুজরাতের কসাই হিসেবে কুখ্যাত নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন উগ্র হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি বা ভারতীয় জনতা পার্টি। ভারতের নির্বাচন ব্যবস্থাও সবমিলে প্রশ্নবিদ্ধ। সারা দেশে নির্বাচনী সহিংসতা এবং নানা উপায়ে নির্বাচনকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা ভারতের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য। তার সাথে যোগ হয়েছে মোদীর পরিচালিত এবং সুপরিকল্পিত জাতিগত উগ্রপন্থা। এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে ভারতের বেশিরভাগ মানুষ নানা হতাশা, পশ্চাতপদতা ও প্রচারণার সম্মিলিত ফলাফলে উগ্র হিন্দুত্ববাদকে তাদের পছন্দের রাজনৈতিক চিন্তা হিসেবে বেছে নিয়েছে।
সম্প্রতি মোদী অযোধ্যায় মুসলমানদের বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে সে জায়গায় নির্মিত রামমন্দির উদ্বোধন করেছে। ভারতজুড়ে এখন ঘটছে প্রাচীন মসজিদ দখল করে মন্দির বানানোর পরিকল্পিত সব ঘটনাবলী। গরুর গোশত রাখার অপরাধে গণপিটুনি, বাড়িঘর দখল ও বুলডোজার দিয়ে ধ্বংস, ভোটার তালিকা থেকে মুসলমানদেরকে বাদ দেয়া ইত্যাদি নানা পরিকল্পিত ঘটনার স্তরের পর স্তর পেরিয়ে এখন চলছে মসজিদ দখলের হিড়িক। একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেখানে সকল মানুষের অধিকার নিশ্চিত হওয়ার কথা, ভারতে সেই গণতন্ত্রকে ব্যবহার করে বরং একটি জাতিগত নিধনযজ্ঞের দিকে দেশটিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। নরেন্দ্র মোদীর নির্বাচনী বিজয়গুলোকে এক্ষেত্রে ১৯৩৩ সালের জার্মানিতে হিটলারের বিপুল জনপ্রিয়তা এবং বিজয়ের সাথেই যথার্থভাবে তুলনা করা যায়। আগামী কয়েকমাস পরেই ভারতে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে তার ফলাফল দেখে বুঝা যাবে রাষ্ট্র হিসেবে তারা কোনদিকে যেতে চাচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত যে নমুনা দেখা যাচ্ছে তাতে আশাবাদী হওয়ার কোন সুযোগ নেই।
দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশের এ তিনটি দেশের নির্বাচন অনুষ্ঠান ও চলতি রাজনীতিতে শক্তিশালী বিরোধী রাজনৈতিক দলের অনুপস্থিতিও একটি সাধারণ বিষয়। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এই দেশগুলোতে কোন ন্যায়নির্ভর ও অধিকারনির্ভর রাজনৈতিক দল ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেনি। বরং পারিবারিক বা বংশীয় নেতৃত্বের লেজুরবৃত্তি অথবা কল্পিত শত্রুর বিরুদ্ধে ঘৃণাবাদ-নির্ভর শক্তি চর্চা এই দেশগুলোতে এখনো রাজনীতির মূল জায়গাগুলো দখল করে রয়েছে। সবমিলে বলা যায়, সাধারণ মানুষের অধিকার বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য নিয়ে যে রাজনীতিকে গণতন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়, সেই গণতান্ত্রিক গন্তব্যে পৌঁছাতে এই দেশগুলোকে এখনো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।