প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউসুফ আলী : আল্লাহর জন্য করণীয় ইবাদত পালনে লোক দেখানো, প্রশংসা বা বাহবার ইচ্ছা পোষণ করাকেই রিয়া বলা হয়। রিয়া এমন এক রোগ যা মানুষের আমলকে সমূলে ধ্বংস করে দেয়। কুরআন ও হাদীসে রিয়া বা প্রদর্শনেচ্ছার ভয়াবহতা সম্পর্কে অনেক সতর্ক করা হয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন: ‘হে মু’মিনগণ! দানের কথা প্রচার করে
প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউসুফ আলী : আল্লাহর জন্য করণীয় ইবাদত পালনে লোক দেখানো, প্রশংসা বা বাহবার ইচ্ছা পোষণ করাকেই রিয়া বলা হয়। রিয়া এমন এক রোগ যা মানুষের আমলকে সমূলে ধ্বংস করে দেয়। কুরআন ও হাদীসে রিয়া বা প্রদর্শনেচ্ছার ভয়াবহতা সম্পর্কে অনেক সতর্ক করা হয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন: ‘হে মু’মিনগণ! দানের কথা প্রচার করে এবং কাউকে খোটা দিয়ে তোমাদের দানকে নিষ্ফল করো না, (সূরা বাকারা: ২৬৪)।
কয়েকটি বাস্তব উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও পরিস্কার হবে। জনস্বার্থে তৈরি করা হয়েছে দাতব্য চিকিৎসালয় ও হাসপাতাল। সৌজন্যে লেখা আছে ‘আলহাজ্জ মোখলেছ উদ্দিন’। মসজিদে দান করা হয়েছে ফ্যান। তাতে নাম লেখা রয়েছে ‘এখলাছুর রহমান’। মসজিদে ঝুলানো আছে নামাজের সময় সূচী সম্বলিত বোর্ড। তাতেও লেখা আছে দাতার নাম সৌজন্যের ঘরে। এখলাছের অর্থ শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোন কাজ করা। আর মোখলেছ অর্থ সেই ব্যাক্তি যে সকল ভাল কাজ করে শুধুমাত্র আল্লাহর খুশীর জন্য। কথা হলো, মোকলেছ যদি এখলাছের সাথে কাজ করে, অর্থাৎ শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করে তাহলে দানের উপর তার নাম লেখার অর্থ কি? ভালো কোন কাজ করলে আজ বিলবোর্ড ও ব্যানারে দাতার ছবি বড় বড় করে প্রিন্ট করা হচ্ছে। জনস্বার্থে করা ব্রীজ-কালভার্ট, হাসপাতাল-ক্লিনিক, রাস্তা-ঘাট যাই করা হোক না কেন তার গায়ে দাতার নাম লেখা যেন আবশ্যক হয়ে গেছে। এই রোগ আজ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। পাঠক নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, এই রোগের নাম প্রদর্শনেচ্ছা বা রিয়া। রিয়াকাররা সাধারণত লোক দেখানোর জন্য নামাজ, হজ্জ ইত্যাদি আমল করে। এ ব্যাপারে আল্লাহপাক এরশাদ করেন:‘‘ধ্বংস ঐ সমস্ত নামাজ আদায়কারীদের জন্য যারা নামাজের ব্যাপারে উদাসীন এবং যারা লোকদেরকে দেখানোর উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ে (সূরা আল মাউন:৪-৫)। কুরআনের আরও অনেক আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, লোক দেখানোর জন্য কৃত কোন আমল আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ আল্লাহপাক কোন বিষয়েই শরিক পছন্দ করেন না। মুমিনের ইবাদত ধ্বংস করার জন্য শয়তানের অন্যতম ফাঁদ এই রিয়া। সহিহ হাদিসে পাওয়া যায়, যশ-খ্যাতি ও লোক দেখানোর জন্য আমল করার কারণে কিয়ামতের দিন একজন আলিম, একজন শহীদ ও একজন বড় দাতাকেও জাহান্নামে উপুড় করে নিক্ষেপ করা হবে (বুখারী ও মুসলিম)।
বিভিন্ন হাদীসে রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম রিয়াকে শিরকে আসগার (ছোট শিরক) এবং শিরকে খাফী (লুকায়িত শিরক) বলে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ, বান্দা আল্লাহর জন্য ইবাদত করলেও অন্য সৃষ্টি থেকেও সেজন্য কিছু ‘পুরস্কার’ বা প্রশংসা আশা করে আল্লাহর সাথে অন্যকে শরিক করে। এ শিরকের কারণে একজন মুসলিম কাফির বলে গণ্য না হলেও তার ইবাদত কবুল হয় না। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম বলেছেন: ‘‘আমি সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি তোমাদের ব্যাপারে ভয় পাই তা হলো শিরকে আসগার। সাহাবীগণ প্রশ্ন করেন: হে আল্লাহর রসূল, শিরকে আসগার কী? তিনি বলেন: রিয়া বা প্রদর্শনেচ্ছা। কিয়ামতের দিন যখন মানুষদের তাদের কর্মের প্রতিফল দেওয়া হবে তখন মহান আল্লাহ এদেরকে বলবেন, তোমরা যাদের দেখানোর জন্য আমল করতে তাদের কাছ থেকে তার প্রতিদান নিয়ে নাও (মুসনাদে আহমদ)। আর এক হাদিসে মহানবী (স.) এরশাদ করেছেন, দাজ্জালের চেয়েও যে বিষয় আমি তোমাদের জন্য বেশি ভয় পাই, সে বিষয়টি কি তোমাদের বলব না? সাহাবারা বললেন, হ্যাঁ অবশ্যই বলুন। তিনি বলেন, বিষয়টি গোপন শিরক। গোপন শিরক হলো, একজন নামাজে দাঁড়াবে এরপর যখন দেখবে, মানুষ তার দিকে তাকাচ্ছে তখন সে নামাজ সুন্দর করবে (ইবনে মাজাহ)। রিয়া বা প্রদর্শনেচ্ছা মুমিনের আমলের জন্য অত্যন্ত ধ্বংসাত্মক। এ ব্যাপারে রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম বলেছেন যে, দুটি ক্ষুধার্ত বাঘকে একটি মেষপালের মধ্যে ছেড়ে দিলে বাঘ দুটি মেষপালের যে ক্ষতি করবে, সম্পদ ও সম্মানের লোভ মানুষের দীনের তার চেয়েও বেশি ক্ষতি করে (তিরমিযী)। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সকলকে রিয়া মুক্ত রাখেন এবং আমাদের সকল আমল শুধুমাত্র মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করার তৌফিক দান করুন। আমীন।
(লেখক: মৎস্য-বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়; পোস্ট ডক্টরাল ভিজিটিং ফেলো, সিডনি)
Leave a Comment
Your email address will not be published. Required fields are marked with *