মিজানুর রহমান : ইসলাম ও মুসলিম বিশ্ব আজ সামরিক আগ্রাসনের পাশাপাশি মিডিয়া আগ্রাসনেরও শিকার। ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে মিডিয়া আগ্রাসনে মধ্যপ্রাচ্যে যেমন ইসরাঈল, সমগ্র বিশবজুড়ে যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ এশিয়ায় তেমনি ভারত। ভারতীয় প্রচারের কৌশল দ্বিমুখী। ভারত থেকে সরাসরি সম্প্রচারের পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশে তাদের আশ্রয়ে পালিত হচ্ছে মিডিয়া জগতের অনেকেই। প্রতিবেশী দেশের রাজনীতি ও ভূগোলকে
মিজানুর রহমান : ইসলাম ও মুসলিম বিশ্ব আজ সামরিক আগ্রাসনের পাশাপাশি মিডিয়া আগ্রাসনেরও শিকার। ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে মিডিয়া আগ্রাসনে মধ্যপ্রাচ্যে যেমন ইসরাঈল, সমগ্র বিশবজুড়ে যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ এশিয়ায় তেমনি ভারত। ভারতীয় প্রচারের কৌশল দ্বিমুখী। ভারত থেকে সরাসরি সম্প্রচারের পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশে তাদের আশ্রয়ে পালিত হচ্ছে মিডিয়া জগতের অনেকেই। প্রতিবেশী দেশের রাজনীতি ও ভূগোলকে প্রভাবিত করার লক্ষ্যে ভারতীয় পুঁজির বিস্তর বিনিয়োগ হয়েছে মূলত সাতচলিলশ থেকেই। তবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পরিচালিত ১৯৬৫-এর সামরিক আগ্রাসন ভন্ডুল হওয়ার পর তাদের প্রচারধর্মী নিরস্ত্র আগ্রাসনের মাত্রা বহুগুণে বেড়ে যায়।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় আধিপত্য সহনীয়, গ্রহণযোগ্য, এমনকি প্রশংসনীয় করতে অসংখ্য পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। এদেশটিকে কব্জায় রাখতে গিয়ে এককালে নিজেদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ব্যয় করেছিল বৃটিশরা, লক্ষ্য ছিল বাজার দখল। ভারত একই উদ্দেশ্য সাধন করছে নিজেদের রক্তক্ষয় না করেই। এ কাজটি করছে কিছু অর্থ ব্যয় করেই। বৃটিশের সামনে সমস্যা ছিল, এত অধিক হারে তারা এত আত্মবিক্রিত দালাল পায়নি। ফলে হাজী শরীয়তুল্লাহ, তিতুমীর, দুদুমিয়াদের বিরুদ্ধে তাদের নিজেদেরকেও রক্ত ঢেলে লড়তে হয়েছে। অথচ ভারতের সৌভাগ্য হ’ল, তাদের হয়ে আজ এ দেশের অনেকে লড়ছে। এর কারণ তাদের প্রবল প্রচার আগ্রাসন। তাদের প্রচারের ফসল এদেশে যে ফলেছে প্রচুর এটি তারই জ্বলন্ত উদাহরণ। বাংলাদেশী হয়েও এরা ভারতীয়দের চেয়েও বেশী ভারতীয়। তসলিমা নাসরীন হ’ল এ ক্ষেতেরই ফসল। সে যা লিখেছে তা খুব কম সংখ্যক ভারতীয়ই লেখার সাহস করেছে। এজন্য সে বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত হ’লেও ভারতে পুরস্কৃত হয়েছে। তসলিমা নাসরীনের মত সাহস না থাকলেও মন-মানসিকতায় তার মত অভিন্ন লেখকের সংখ্যা বাংলাদেশে কম নয়, বরং অসংখ্য। এক ও অভিন্ন লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে তারা। সে অভিন্ন লক্ষ্যটি হ’ল, সাতচলিলশের ভারত বিভাগ বাংলাদেশের জন্য অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর ছিল- এটি আদাজল খেয়ে প্রমাণ করা। আর এটি প্রমাণ করতে পারলে বাংলাদেশের পৃথক অস্তিত্বকে অপ্রয়োজনীয় প্রমাণ করাও তাদের জন্য সহজতর হবে। বাংলাদেশের শেকড় কাটার কাজ এবং সে সাথে ভারতের দেহে মলান হওয়ার পক্ষে প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হচ্ছে বস্তুত এভাবেই। অখণ্ড ভারতে একীভূত হওয়ার দাবি তারা এ মুহূর্তে না উঠালেও যথাসময়ে যে উঠাবে সেটি সুনিশ্চিত। নইলে ভারতঘেষা এসব বুদ্ধিজীবীদের এত কসরত কেন?
ভারতবর্ষে আর্য আগ্রাসন, ফিলিস্তীনে ইহুদী আগ্রাসন এবং আমেরিকায় ইউরোপীয় আগ্রাসনের মধ্যে গুণগত সাদৃশ্য প্রকট। এরা বিজিত দেশের মূল অধিবাসীদের অধীনস্ত বা নির্মূলের মধ্য দিয়ে নিজেদের আবাদ গড়েছে। অথচ প্রচারের বলে এরাই বিশ্বে ভাল মানুষ সেজেছে। অপরদিকে মুসলমানদের চিত্রিত করেছে সন্ত্রাসী, বর্বর ও অন্যান্য নানা বিশেলষণে। রক্তের গন্ধ আবিষ্কার করছে মুসলমানদের ইতিহাস থেকে। অথচ দু’-দু’টি বিশ্বযুদ্ধ বাধিয়ে কয়েক কোটি মানুষ হত্যা করেছে তারাই। আরো কয়েক কোটিকে করেছে পঙ্গু। হিরোশিমা ও নাগাসাকির মত দু’টো শহরকে পরিণত করেছে সাক্ষাৎ ধ্বংসস্তূপে। অথচ মুসলমানেরা যেখানেই গিয়েছে মসজিদ, মাদরাসা ও বিদ্যালয় গড়ে সভ্যতার উন্নতিকে ত্বরান্বিত করেছে। মুসলমানদের ভাণ্ডার থেকে এমনকি ইউরোপীয়রাও ফসল কম তোলেনি। ইউরোপের শিল্প বিপলব এসেছিল বস্তুত স্পেনের মুসলমানদের থেকে বিদ্যা লাভের পরেই।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ১১ সেপ্টেম্বর এসেছে মাত্র একবার। অথচ ইসরাঈল প্রতিষ্ঠার পর থেকে সেটি ফিলিস্তীনীদের জীবনে এসেছে বহুবার। নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারের যত মানুষ মারা পড়েছে তার চেয়ে অনেক বেশী মানুষ মারা গেছে সাবরা ও শাতীলার ফিলিস্তীনী উদ্বাস্তু শিবিরে। গত ৬০ বছরের বেশী সময় ধরে সন্ত্রাসের শিকার ফিলিস্তীনীদের আজ বলা হচ্ছে সন্ত্রাসী এবং সেটি প্রচারজগতে আধিপত্য থাকার কারণে।
ভৌগোলিক সীমানা দিয়ে সীমাবদ্ধ না হওয়ায় মিডিয়ার প্রতাপ এখন বিশবব্যাপী। তাদের দ্বারাই বহুলাংশে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে বিশব রাজনীতিও। বিশেষ করে আজকের মেরুদণ্ডহীন মুসলিম বিশ্বের। নিউইয়র্কস্থ কলম্বিয়া বিশববিদ্যালয়ের সাবেক প্রফেসর এডওয়ার্ড সাঈদ Covering Islam নামে একখানি বই লিখেছেন। এডওয়ার্ড সাঈদ একজন ফিলিস্তীনী আরব, যুক্তরাষ্ট্রের বুদ্ধিজীবী মহলে তার পরিচিতিও প্রচুর। ক্যাম্পডেভিড চুক্তির পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আরবদের সম্পর্কে বড় আকারের ফাটল ধরে। সে ফাটলেরই মেরামতে প্রফেসর সাঈদকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট কার্টার। সেহেতু বলা যায়, মার্কিনীদের অনেক নাড়ির খবরই তার জানা। তার বইতে তিনি প্রমাণ করেছেন মার্কিন প্রচার মাধ্যম কতটা জঘন্যরূপে পক্ষপাতদুষ্ট এবং মুসলিম স্বার্থবিরোধী। তার মতে যুক্তরাষ্ট্রে ইদানীং ঝাঁকে ঝাঁকে আবির্ভূত হচ্ছে অসংখ্য মুসলিমবিদ্বেষী বুদ্ধিজীবী, এদের কাজই হ’ল মুসলিম বিশ্বে মার্কিন সামরিক আগ্রাসনের প্রেক্ষাপট তৈরী করা। অথবা কোন আগ্রাসন পরিচালিত হ’লে সেটিকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে বৈধ প্রমাণিত করা। অনেকেরই আফসোস, পাশ্চাত্য বিশব কেন এখনও মধ্যপ্রাচ্যকে গ্রাস করছে না। তাদের বক্তব্যের সারমর্ম হ’ল, পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীর পুর্তগীজ আগ্রাসনই বর্তমান পশ্চিমা শাসকবর্গের জন্য মডেল হওয়া উচিত। তাদের মতে ঔপনিবেশিক শাসনই বিশ্বে শেষবারের মত শান্তি (?) এনেছিল।যদিও সে শান্তি ছিল হত্যা ও লুণ্ঠনের মাধ্যমে নিরীহ ও নিঃসম্বল মানুষের সামরিক ও অর্থনৈতিক পঙ্গুত্বের। এশিয়া-আফ্রিকার মজলুম মানুষের স্বাধীনতাকে এরা বর্বরতা বৈ ভিন্নরূপে দেখে না।
পাশ্চাত্যের শাসকবর্গ কোন ধর্মকেই নিজেদের জন্য আজ আর হুমকি হিসাবে ভাবে না। তবে ইসলামই এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। যেকোন দেশেই ইসলামের উত্থান তাদের কাছে এক নিদারুণ ত্রাস। যারাই এ উত্থানের পক্ষে তারাই তাদের কাছে সন্ত্রাসী। ইসলামের অনুসারীদের পরিকল্পিতভাবে চিত্রিত করা হচ্ছে মানবতার দুশমনরূপে। এ প্রচারণায় মূল ভূমিকা পালন করছে পাশ্চাত্যের মিডিয়া। অথচ মুসলিম বিশ্বে যারা সত্যিকার জালেম, যাদের দেশে প্রতিবাদী আওয়াজ তোলার ন্যূনতম শাস্তি হ’ল প্রাণদণ্ড, তাদের সাথে ওদের সখ্যতা অতি নিবিড়। বিস্তর অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য দিয়ে এসব দেশের স্বৈরাচারী শাসকদেরকে টিকিয়ে রাখাই হ’ল এদের বিদেশনীতি। এ কাজকে এরা বলে ‘স্থিতিশীলতা’। এমন স্থিতিশীলতার স্বার্থে যে কোন সামরিক বর্বরতা পরিচালনায় বা সমর্থনদানে এদের আপত্তি নেই। আলজেরিয়াতে এমনই এক বর্বরতা চলছে সেদেশের স্বৈরাচারী শাসকের হাতে। অথচ পশ্চিমা মিডিয়া এ বর্বরতা দেখেও দেখে না, শুনেও শুনে না। নিশ্চুপ এরা কাশ্মীর ও ফিলিস্তীনে পরিচালিত নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধেও। তারা বর্বরতা খুঁজে ইরানে বা সূদানে। কারণ সেখানে ইসলামপন্থীরা ক্ষমতাসীন। নিশ্চুপ এসব দেশের একাডেমী বা বিশববিদ্যালয়সমূহও। পাশ্চাত্যের নীতি ও নৈতিকতায় কতটা মড়ক লেগেছে সেটি এ থেকেই অনুমেয়। বিবেকের যে অসুস্থতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হিরোশিমা ও নাগাসাকির কয়েক লক্ষ নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও বেসামরিক মানুষকে জীবন্ত দগ্ধ করে বিজয়ের আনন্দ খুঁজেছিল, সে অসুস্থতা থেকে আজও যে তাদের আরোগ্য মেলেনি এসব তাদেরই আলামত। ইরাকে ও আফগানিস্তানে হাজার হাজার টন বোমাবর্ষণ, ইরাকের শিশু হাসপাতালে বোমাবর্ষণ, মিসাইল ছুঁড়ে ইরানের বেসামরিক বিমানের যাত্রী হত্যা- এসব নিষ্ঠুরতা সে নৈতিক অসুস্থতারই প্রমাণ। মিডিয়ার অপরাধ তারা সে নিষ্ঠুরতাকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরছে না। তারা সুনামীতে ধ্বংস হওয়ার আগে ইনেদানেশিয়ার আচেহ দ্বীপের তুলনামূলক ছবি দেখায়। কিন্তু এ ছবি দেখায় না মার্কিনীদের বোমাবর্ষণের পূর্বে ইরাকের ফালুজা কেমন ছিল।
প্রচার মাধ্যমে ইহুদীদের আধিপত্য অতি প্রবল। রয়টারের মত বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সংবাদ প্রতিষ্ঠানের মালিকানা তাদেরই। টাইম, নিউজ উইকের মত বহুল প্রচলিত পত্রিকাগুলোর প্রভাবশালী সাংবাদিক ও কলামিস্ট তারাই। এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশববিদ্যালয়সমূহে ইহুদী শিক্ষকগণই অধিকতর প্রভাবশালী। যে কোন গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতে প্রচার মাধ্যম এসব শিক্ষকদের মতামতকেই অধিকতর গুরুত্ব দেয়। অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রশাসনও নির্দেশনা নেয় তাদের থেকেই। প্রচারে ইহুদীদের প্রভাবের কারণেই ফিলিস্তীনী বসতি নির্মূলের পরও আগ্রাসী ইহুদীরা প্রচার পায় শান্তিবাদী রূপে। অথচ ইসরাঈলের জন্মই হয়েছে সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে। টিকেও আছে বিরামহীন সন্ত্রাস চালিয়ে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই যুদ্ধ আর সন্ত্রাস চালিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তিকে তারাই বিনষ্ট করেছে। শুধু মধ্যপ্রাচ্যে নয়, মার্কিনীদের পর তারাই এখন বিশ্বের বৃহৎ আগ্রাসী শক্তি। আর এদের সাফাই গাচেছ পাশ্চাত্যের মিডিয়া। মিডিয়ার হাতে জিম্মি পশ্চিমা বিশ্বের রাজনীতিকেরাও, ঈসরাঈলী স্বার্থের বিরোধিতা দূরে থাক তাদের স্বার্থে সামান্য নীরবতাও তাদের জন্য বিপদ ডেকে আনে। মিডিয়ার আগ্রাসনের মাধ্যমে ফিলিস্তীনীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত তাদের বীভৎস ধ্বংসযজ্ঞকে তারা একটি ন্যায্য যুদ্ধ রূপে বিশ্বময় প্রচার করছে। পাশ্চাত্য বিশ্বে সেটি গ্রহণযোগ্যতাও পাচেছ। মিডিয়া যে কিভাবে মানুষের মনের ভুবনে আধিপত্য বিস্তার করতে পারে এ হ’ল তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। এককালে বহু অর্থ ও বিপুল রক্তক্ষয়ে প্রকান্ড এক সামরিক যুদ্ধ লড়েও এমনটি সম্ভব ছিল না। আগ্রাসী শক্তি রূপে এটিই হ’ল মিডিয়ার ক্ষমতা। সমগ্র মুসলিম বিশ্ব আজ সে শক্তির কাছেই প্রচন্ডভাবে পরাজিত।
একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র অনুযায়ী জানা যায়, ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যাপকহারে অপপ্রচারে অনেক মিডিয়া লিপ্ত আছে। তন্মধ্যে ২০০টি রেডিও স্টেশন, ১৭০০টি টিভি চ্যানেল এবং দৈনিক, সাপ্তাহিক ও অন্যান্য প্রায় ২২ হাজার ম্যাগাজিন প্রতিনিয়ত ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে যাচেছ।
মূলতঃ দ্বীনের সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর বিষয়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আলেম-ওলামা মিডিয়াতে অংশগ্রহণ না করায় নাস্তিক্যবাদীরা মোক্ষম সুযোগ পেয়ে ইসলামের নাম-নিশানা চিরতরে উড়িয়ে দিতে মিডিয়ার অপব্যবহারে মাতাল হয়ে লেগেছে। ইসলামে চিরনিষিদ্ধ অপকর্মগুলোকে মিডিয়াতে ব্যাপকহারে অতি জোরালোভাবে সম্প্রচার করা হয়। মিডিয়ায় প্রচারিত বিষয়গুলো প্রত্যক্ষ করলে অনায়াসেই অনুমেয় হয় যে, এটার প্রচারক কে বা কারা? বর্তমানে মিডিয়াতে অতি গুরুত্বের সাথে ইহুদী, খ্রিষ্টানদের চাল-চলন, বেশ-ভূষণ, কাজ-কর্ম সম্প্রচার করা হয়। মিডিয়ায় প্রচারিত বিষয়গুলো প্রত্যক্ষ করে আমাদের মুসলিম দেশের মানুষেরা নাস্তিক ও লম্পটদের সংস্কৃতি ও উলঙ্গপনাকে পসনদসই মনে করছে। ইসলামী সংস্কৃতির চেয়ে তথাকথিত উলঙ্গপনার সংস্কৃতিকে মুসলমানদের মুষ্টিমেয় ছেলে-মেয়েরাই অগ্রাধিকার দিচ্ছে। ইসলামী তাহযীব-তামাদ্দুনকে এড়িয়ে চলছে।
এ মিডিয়ার যুগে যদি সঠিকভাবে ইসলাম প্রচার করা হয়, মিডিয়ার প্রতিটি সেক্টরে যদি ইসলামের বিধি-বিধান থাকে তাহ’লে ইসলামের যে কত বড় একটা খেদমত হবে তা বলাই বাহুল্য।
সম্প্রতি মুম্বাই-এর ডা. যাকির নায়েক ইসলামী মিডিয়া অঙ্গনে বড় আকারে আলোচিত ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। তিনি মিডিয়া ব্যবহার করে ইসলাম প্রচারে একনিষ্ঠভাবে কাজ করছেন। তার পরিচালিত ‘পীস টিভি’ বর্তমানে সারাবিশ্বে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। তিনি বিধর্মীদের সাথে বিভিন্ন সেমিনার ও আলোচনায় অংশ নিচেছন। তার প্রতি সেমিনারে হাজার হাজার জনতা অংশগ্রহণ করছেন। তিনি এত জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন শুধুমাত্র মিডিয়া চ্যানেল ও ইন্টারনেটে অংশগ্রহণের কারণে। তাছাড়া তার লেকচার বিশুদ্ধ ইংরেজী ভাষায় এবং তার কথাগুলোও বৈজ্ঞানিক যুক্তিপূর্ণ। তাই যুগের পরিবর্তনে, সময়ের দাবিতে, ইসলামের খাতিরে ইন্টারনেট ও টিভি চ্যানেলসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় হক্বপন্থী আলেমদের শক্ত অবস্থান একান্ত আবশ্যক।
আজ বিশ্বজুড়ে মানুষ শান্তির বার্তা খোঁজাখুঁজি করছে। যারা বুঝেছে শান্তির ছায়া একমাত্র ইসলামেই, তারা এখন ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞানদানকারী ব্যক্তিকে তালাশ করছে। ইসলাম জানতে তারা হা করে তাকিয়ে আছে। কিন্তু মিডিয়াতে হক্বপন্থী জ্ঞানী লোকের স্বল্পতা চরম পর্যায়ে। তাই অতি শীঘ্রই এই শূন্যতা পূরণে এগিয়ে আসতে হবে। কোন জায়গায়, কীভাবে মিডিয়াকে অপব্যবহার করা হচ্ছে তা পর্যবেক্ষণ করে মিডিয়ার মাধ্যমেই বাতিল শক্তির মুখোশ উন্মোচন করতে হবে। সাম্রাজ্যবাদীদের মোকাবেলায় মিডিয়াকে অস্ত্র হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। প্রিনট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া আয়ত্তে এনে তাতে ইসলাম প্রচারের সুগম ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
বর্তমান যুগ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের যুগ। তাই বিশ্বের যেকোন প্রান্তে ঘটে যাওয়া ঘটনার খবর মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে সারা দুনিয়ায়। আর এ খবর যার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে তা হ’ল এই আধুনিক নিউজ মিডিয়া। ভয়েস অব আমেরিকা, বিবিসি সহ বিশ্বের প্রধান নিউজ মিডিয়াগুলো সম্পূর্ণ ইসলাম বিদ্বেষীদের করায়ত্তে। এ কারণে প্রতিদিন ইসলাম ও ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রচার, কুৎসা রটনা ও বিভিন্ন অপপ্রচারের মাধ্যমে সহজ-সরল মানুষদেরকে ইসলাম ও ইসলামপন্থীদের সম্পর্কে ভুল ধারণা দেওয়া হচ্ছে। যার ফলে সন্দেহপ্রবণ মানুষকে ইসলামপন্থীদের পক্ষে আনা সম্ভব হচ্ছে না। তাই জ্ঞান অর্জনসহ বিভিন্ন পন্থায় নিউজ মিডিয়ার যুগে একটি বস্তুনিষ্ঠ ও প্রতিবাদী নিউজ মিডিয়া সৃষ্টি করলে একবিংশ শতাব্দী ইসলামের বিজয়ের শতাব্দীতে পরিণত হবে ইনশাআল্লাহ।
এ সঙ্কটময় অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য নিম্নলিখিত কয়েকটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে।
(১) মুসলিম বিশ্বের জনবলকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে হবে। মুসলিম বিশ্ব বিশেষ করে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার কাঠামো একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী হিসাবে গড়ে তুলতে হবে।
(২) সমগ্র মুসলিম বিশ্বে গণমাধ্যম ও তথ্য প্রবাহের অবস্থা খুবই করুণ। এ অবস্থা উত্তরণের জন্য গণমাধ্যম বিষয়ক শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিতে হবে।
(৩) তথ্য ও প্রযুক্তিতে মুসলিম বিশ্ব অনেকটাই পিছিয়ে। এর অন্যতম কারণ হ’ল তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ না থাকা। ইসলামী বিশ্ব এক্ষেত্রে কোন পর্যায়ে অবস্থান করছে, এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তথ্য প্রযুক্তি বিশ্ব এ পরিবারের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে।
(৪) OIC (Organization of Islamic Conference) কর্তৃক ১৯৭৯ সালে সঊদী আরবের রাজধানী জেদ্দায় IINA (International Ialamic News Agency) প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ। এটাকে সত্যিকার অর্থে রয়টার বা সিএনএন বা আল-জাযীরা-এর ন্যায় সংবাদ সংস্থা হিসাবে গড়ার কার্যকরী পদক্ষেপ ওআইসিকেই নিতে হবে।
(৫) মুসলিম বিশ্বের সাংবাদিক ও গণমাধ্যম কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক দৃঢ়তর ও সুনিবিড় করার লক্ষ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধি করার কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে।
গ্লোবালাইজেশন; মুসলিম বিশ্বের ভবিষ্যৎ কি?
পশ্চিমের ভাষায় ক্যামব্রিজ ডিকশনারিতে গ্লোবালাইজেশন (Globalization) বা বিশ্বায়নের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে: Globalization: the increase of trade around the world, especially by large companies producing and trading goods in many different countries: “গ্লোবালাইজেশন অর্থ হলো-বাণিজ্যকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। বিশেষ করে বিভিন্ন দেশে বাড় বড় কোম্পানি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এবং আমদানি ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যস্থতায়।” বিশ্বায়নের সবচাইতে বড় প্রতিনিধি ওয়ার্ল্ড ট্রেড অরগানাইজেশন তার সংজ্ঞা দিয়েছে “গ্লোবালাইজেশন অর্থ দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের মধ্যকার অর্থনৈতিক সহায়তা, যা উৎপাদিত পণ্য এবং সেবার (প্রোডাক্ট এবং সার্ভিসেস) বিনিময়ের আধিক্যের কারণে প্রসার লাভ করে। তার কারণে দেশের পুঁজির মধ্যেও প্রবৃদ্ধি আসে, সারা দুনিয়ায় প্রযুক্তির প্রসার ঘটে। এই ব্যবস্থার উদ্দেশ্য কাস্টম এবং ভৌগোলিক
সীমার প্রতিবন্ধকতা উঠিয়ে দেওয়া। এবং সারা বিশ্বকে এক আন্তর্জাতিক বাজারে রূপান্তর করা।” এইসব সংজ্ঞা অনুযায়ী বিশ্বায়ন সাধারণ মানুষের উপলব্ধিতে একটি ইতিবাচক ধারণা হিসেবে হাজির হয়। মনে করা হয়, নতুন আবিষ্কারের মারফত সারা দুনিয়া একটি জনপদের রূপ নিয়েছে-এটাই গ্লোবালাইজেশন বা বিশ্বায়ন। কিছু মানুষ বিশ্বায়নকে সংক্ষেপে ‘সীমানার প্রতিবন্ধকতার পরিসমাপ্তি’র অর্থে গ্রহণ করেন। এবং মনে মনে আনন্দিত হন এই ভেবে যে, হয়তো-বা শীঘ্রই সারা দুনিয়া একটি দেশের মতো হয়ে যাবে। আর সকলে ভাই ভাই হয়ে বসবাস করবে। কিন্তু এই পরিভাষার আড়ালের বাস্তবতা এত সরল এবং এত ইতিবাচক নয়। যদিও তাকে সাদাসিধা এবং ইতিবাচক প্রমাণ করবার জন্য আমেরিকা ও ইহুদিশক্তি তাদের সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
মুদ্রার অপর পিঠ, নেতিবাচক দিক
কিন্তু কথা হলো-গ্লোবালাইজেশন কি এতটাই সরল ব্যাপার? নথিপত্র ঘাটলে দেখা যায়, এই পরিভাষা আন্তর্জাতিক প্রসিদ্ধি তখনই লাভ করেছে যখন আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সিনিয়র তার এক লেকচারে তা ব্যবহার করেছেন। এই লেকচারটি উপসাগরীয় যুদ্ধ সমাপ্তির পর উপসাগরীয় অঞ্চলে মোতায়েনকৃত সেনাসদস্যদের উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়েছিল। বুশ তার এই লেকচারে সন্ত্রাসবাদ-মুক্ত এমন একটি বৈশ্বিক ব্যবস্থাপনার চিন্তা হাজির করেন, যা পৃথিবীতে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করবে। এবং জনসাধারণকে সুখ ও সমৃদ্ধির সাথে জীবনযাপনের অবকাশ এনে দেবে। এই ব্যবস্থাকে ‘নয়া বিশ্বব্যবস্থা’ (New World Order) শিরোনামেও ব্যক্ত করা হয় এবং পর্যবেক্ষকদের মতেও বিশ্বায়নের আসল লক্ষ্য হলো বুশের ঘোষিত এই ‘নয়া বিশ্বব্যবস্থার’ই পথ মসৃণ করা।
বিশ্বায়ন পশ্চিমের অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে কেবল নয়; বরং সারা পৃথিবীকে একটি বিশেষ সভ্যতা ও সংস্কৃতির রঙে রাঙিয়ে তোলাও তার অন্যতম উদ্দেশ্য বটে। আর একথা তো এখন কারুর থেকেই গোপন নেই যে, সেই একক কালচার আমেরিকান কালচার ছাড়া কিছু নয়, যে কালচার ও সংস্কৃতির দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে গোটা পৃথিবীকে। স্বয়ং আন্তর্জাতিক অর্থনীতি বিশ্বকোষে (The International Encyclopedia of Business & Management) বিশ্বায়নের সংজ্ঞা এভাবে দেওয়া হয়েছে যে, ‘বিশ্বায়ন হলো, বৈশ্বিক সভ্যতার প্রচার ও প্রসার ঘটানোর এক রোডম্যাপ।’ সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনও এক জায়গায় স্বীকার করেছেন, বিশ্বায়ন কেবল অর্থনৈতিক বিষয় নয়; বরং এটা পরিবেশ-পরিস্থিতি, সভ্যতা-সংস্কৃতি এবং স্বাস্থ্যের মতন বিষয়ের সাথেও সম্পর্ক রাখে। বস্তুত বিশ্বায়ন এমন একটি ব্যবস্থা এবং এমন একটি রূপকল্প, যার একদিকে একজন শক্তিধর, মেধাবী এবং সমৃদ্ধশালী ব্যক্তি, অপর প্রান্তে একজন নিঃস্ব, মেধাহীন ও দুর্বল ব্যক্তি। একজনের কাছে সবকিছু আছে, অন্যজনের কাছে কিছুই নেই। এই ধরনের বাণিজ্যের পরিণাম এই ছাড়া আর কী হবে যে, দুর্বল ব্যক্তি তার ব্যক্তিস্বাধীনতা থেকেও বঞ্চিত হয়ে শক্তিধরের দাসে পরিণত হয়ে পড়বে। (১৯৯)
কোন কারনে মুসলিম বিশ্বই কেন বিশ্বায়নের মূল লক্ষ্য?
যদিও বিশ্বায়ন সারা বিশ্বেই কর্তৃত্বশীল হয়ে উঠছে; কিন্তু তার প্রকৃত লক্ষ মুসলিমবিশ্ব ও মুসলমান। এর চারটি কারণের কথা উল্লেখ করা যায়: ১. বিশ্বের মানচিত্রে ইসলামি দেশগুলোর অবস্থান সর্বোত্তম রেখায়। ২. ইসলামি দুনিয়া প্রচুর পরিমাণ খনিজ সম্পদের অধিকারী, যার অধিকাংশ এখনো ভূগর্ভেই রয়ে গেছে। তিন প্রধান ধর্ম: ইসলাম, খ্রিষ্টান এবং ইহুদি-এর পবিত্র ভূমি ইসলামি বিশ্বেই অবস্থিত। বিশ্বায়নের প্রতিষ্ঠাতা জায়নিস্ট রাষ্ট্রের অবস্থানও ইসলামি বিশ্বে, যার বিস্তৃতি ও প্রসার বিশ্বায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যও বটে। ৪. পশ্চিম এই কথা ভালো করেই জানে যে, বিশ্বায়নের অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক হামলার জবাব দেওয়ার সামর্থ্য কেবল ইসলামি ব্যবস্থারই রয়েছে। এ কারণে ইসলামকে একেবারে নির্মূল করে ফেলা এবং ইসলামি ব্যবস্থার পুনর্জাগরণের সকল সম্ভাবনা নিঃশেষ করে দেওয়া অবধি বিশ্বায়নের স্বপ্ন পূরণ হবার নয় ।
বিশ্বায়নের চার ক্ষেত্র
বিশ্বায়ন মূলত ইহুদিদের স্বপ্ন। শত বছর ধরে তারা এমন এক বৈশ্বিক রাজত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে নিরত রয়েছে, যার রাজধানী হবে জেরুসালেম। আর তার সিংহাসনে বিরাজমান হবে বনি ইসরাইলের সর্বজনীন বাদশাহ (মাসিহে দাজ্জাল)। সেই অভাই লক্ষ্য পূরণে চারটি ক্ষেত্রে তারা বিশ্বায়ন বা গ্লোবালাইজেশনের প্রসারের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সেগুলো হলো: ১. রাজনৈতিক বিশ্বায়ন। ২. অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন। ৩. সাংস্কৃতিক বিশ্বায়ন। ৪. সামাজিক বিশ্বায়ন।
বিশ্বায়নের মোকাবেলার উপায়
এতক্ষণের আলাপের দ্বারা বিশ্বায়নের ভয়াবহতা বেশ স্পষ্টই ফুটে উঠেছে এবং তার আশু প্রতিরোধ ও মোকাবেলার প্রয়োজনীয়তাও আশা করছি কারুর কাছে অস্বীকারযোগ্য নয়। সে উদ্দেশ্যে বিচার-বিবেচনা করা, পরিকল্পনা করা, কার্যকর প্রয়াস-প্রচেষ্টা চালানো এখন আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। নিচে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বিশ্বায়নের গতি থামিয়ে দেবার জন্য কিছু প্রস্তাবনা পেশ করা হচ্ছে। কিন্তু কাজটি কার্যক্ষেত্রে উপর্যুক্ত বিন্যাসের বিপরীতে সম্পাদিত করতে হবে। অর্থাৎ, সমাজ ও সভ্যতা-সংস্কৃতিতে আমাদের সফল প্রতিরোধের পরই আমরা অর্থনীতি এবং রাজনীতির ময়দানে এই ভয়াবহ তুফানের প্রতিরোধে সামর্থ্যবান হয়ে উঠব, তার আগে নয়। সামাজিক বিশ্বায়নের মোকাবেলা : সামাজিক বিশ্বায়নের প্রতিরোধে নিম্নযুক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি
সর্বপ্রথম মুসলিম উম্মাহকে আল্লাহ এবং তার রাসুলের সাথে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের আপ্রাণ প্রয়াস আরম্ভ করতে হবে। * নারী ও শিশুদের পশ্চিমা এবং ধর্মহীন প্রভাব থেকে বাঁচানোর জন্য স্বতন্ত্র প্রচেষ্টা চালানো হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পত্রপত্রিকা এবং মিডিয়ায় বৈধ পন্থায় ঈমান, ইসলামি সমাজ এবং ইসলামি আচার-ব্যবহার রীতিনীতির উপকার ও গুরুত্বের ব্যাপক প্রসার ঘটাতে হবে। * ইসলামকে একটি মডেল ও অনুসরণযোগ্য জীবনব্যবস্থা হিসেবে হাজির করতে হবে। * মুসলিম-পরিবারের সাথে সম্পর্কিত এমন বিষয়ের ব্যাপক প্রসার ঘটানো, যার মাধ্যমে ইসলামে নারীর অবস্থান এবং অধিকার বিষয়ে কারুর মনে কোনো প্রকার ধোঁয়াশা না থাকে।
বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্ৰাসনের ইতিবৃত্ত – ২৩৫
সাংস্কৃতিক বিশ্বায়নের মোকাবেলা:
সাংস্কৃতিক বিশ্বায়নের প্রতিরোধে নিম্নযুক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি-
পশ্চিমা ভাষার বিপরীতে আরবির ব্যাপকতা নিশ্চিত করা। যেইসব দেশে আরবি ভাষা পৌঁছেনি, সেখানে আরবি ভাষার প্রচার করা। পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং তুরস্কের মতন মুসলিম দেশ, যেখানে আরবি ভাষা নিত্যকার আলাপচারিতার ভাষা নয়, সেখানে আরবি ভাষার প্রচলন ঘটানো। পশ্চিমা দুনিয়াতেও আরবি ভাষা ছড়িয়ে দেবার প্রয়াস চালানো এবং তার সূচনা স্থানীয় মুসলিম কমিউনিটির মাধ্যমে করা যেতে পারে।
আরব দেশগুলোতে সাধারণ আরবির বদলে বিশুদ্ধ আরবির বিস্তৃতি ঘটানো। আরবি ভাষার এই প্রসারের মাধ্যমে কুরআন-সুন্নাহর প্রচার ও প্রসারের পথ সুগম করে তোলা।
অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের মোকাবেলা।
অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে চব হট মূলনীতির আলোকে হয়ে মুলনীতি, বিপন উপলব্ধি করানো। সাধারণ মানুষকে বিশ্বায়নের ওয়াবহতা বিরতি করিয়ে তাদের মধ্যে এই বোধ ও উপলব্ধি তৈরি করতে হবে যে, তারা মথনেতিক ক্ষেত্রে যুদ্ধাবস্থা পার করছে এবং জীবন-মরণ ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছে। স্বতীর মৃতনীতি। যতদূর সম্ভব বিদেশি পণ্য বয়কট করা। সাধারণ মানুষের চেতনা ভারত করে এই আবাতগ্রাথের জন্য প্রস্তুত করতে হবে যে, যেসব পণ্য দেশেও উৎপাদন হয় সে-সব পণ্যের ক্ষেত্রে তারা কেবল দেশি পণ্যই ক্রয় করবে। বিদেশি নও কেবল সেগুলোই কিনতে পাবে, যেগুলো দুর্লভ এবং যেগুলোর কোনো বিকল্প দেশে তৈরি হয় না। যেমন জীবন বাঁচাবার ওষুধপথ্য। কম্পিউটারের যন্ত্রাংশ ইত্যাদি। সাজসজ্জার সামগ্রী, ফাস্টফুড, কোমল পানীয়, খেলনা, পোশাক, গহনা ইত্যাদি পর বিদেশি ব্র্যান্ড কখনো না কেনা, তার গুণগত মান যতই উন্নত হোক না কেন। তার বিকল্প যদি না থাকে, তবু। এই কাজটি সহজ হবে না। খুবই কঠিন। কাজটি করতে গিয়ে আত্মার উপর মহাবিক চাপ অনুভূত হবে। বিদেশি কোম্পানিগুলো এমনসব আকর্ষণীয় কৌশল অবলম্বন করবে যে, শক্তপোক্ত মানুষের পা পর্যন্ত পিছলে যাবে। তারা বিজ্ঞাপনকে আরও বেশি চিত্তাকর্ষক ও চটকদার করে তুলবে। সিনেমার নায়ক-নায়িকা আর খেলোয়াড়ই কেবল নয়; বরং রাজনীতিবিদ এমনকি রাষ্ট্রপ্রধানকে পর্যন্ত নিজেদের পণ্যের আগ্রহী হিসেবে দেখাবে। পুরস্কারের লাইন লাগিয়ে দেবে। দাম খুবই হ্রাস করে দেবে। সাময়িকভাবে ‘না লাভ না লোকসান’ পদ্ধতিতে ব্যবসা করতে উদ্যোগী হয়ে চীবে। দেশের মধ্যে নানা কল্যাণকর কাজ শুরু করে দেবে। ফ্রি খাদ্য এবং ফ্রি শিক্ষার মতন কর্মসূচি গ্রহণ করবে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রকাশ্যে অনুদান দিয়ে হলেও সাধারণ মানুষের সহমর্মিতা অর্জনের চেষ্টা করে যাবে। জ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী, আলেম ও বিজ্ঞজনেরা বিভিন্ন ইভেন্টে তাদের পণ্য গর্বের সাথে ব্যবহার করছে, এসব দেখিয়ে সাধারণ মানুষের মনে পোক্ত ধারণা তৈরি করবে যে, দেখো, আমরা তোমাদের শত্রু নই; বরং বন্ধু। কিন্তু বিশ্বায়নের ফধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডগুলো সামনে রেখে সাধারণ মানুষকে তাদের সকল ফাঁদ থেকে বাঁচাতে হবে। নিজের মুঠির পয়সা স্থানীয় পণ্যের জন্যই কেবল সারাক্ষণ করে রাখতে হবে। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর পন্থা হলো বিদেশি গন্তের বিজ্ঞাপন একেবারেই উপেক্ষা করে চলা। সংবাদপত্রের অ্যাডভাটাইজ এবং সাইনবোর্ড এর দিকে একদমই চোখ তুলে না তাকানো।
রাজনৈতিক বিশ্বায়নের মোকাবেলা
সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের সামনে দৃঢ়তা থাকার পর রাজনৈতিক বিশ্বায়নের আমাদের জন্য খুব বেশি কঠিন হলেও তার জন্য আমাদের যা করতে হবে।
- মুসলমানদের জাতীয়, আঞ্চলিক এবং ভাষাগত স্বার্থ ভুলে গিয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
- ইসলামের রাজনৈতিক ব্যবস্থার শিক্ষাকে জনপ্রিয় করে তুলতে হবে। খেলাফত এবং গুরা-ব্যবস্থা নিজেরা বোঝা এবং সাধারণ মানুষকেও বোঝানো।
- এমনসব দল অস্তিত্বে আনতে হবে, যারা প্রচলিত রাজনীতির দূষণ থেকে যুক্ত থেকে সাধারণ মানুষকে নিজেদের প্রতি আস্থাশীল করে তুলবে। তারা কেবল সাধারণ মানুষের ধর্মীয় রাহনুমায়ী করবে না, বরং তাদের পার্থিব ও আর্থিত সমস্যাবলির সমাধানও হাজির করবে।
খেলাফত প্রতিষ্ঠাকে মূল লক্ষ্য বানিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।
যতদিন খেলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠা না হচ্ছে ততদিন এমন কোনো স্বাধীন ও প্রভাবশালী প্ল্যাটফরম বানানো দরকার, যা মুসলমানদের রাজনৈতিক অধিকার আদায়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবে। এবং পশ্চিমের উপর নিশ্চিত চাপ প্রয়োগ করতে সমর্থ হবে।
আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত পোক্ত চিন্তার অধিকারী তরুণদের ইসলামি দেশের পেশাদার বাহিনী, রাজনৈতিক দল, আইন রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান, পুলিশ, বিচারবিভাগ এবং সচিবালয়ে উঁচু পদ পর্যন্ত পৌঁছে দিতে হবে। এই কাজটি একনাগাড়ে কয়েক দশক পর্যন্ত হওয়া জরুরি, যাতে ভবিষ্যতে প্রতিটি সরকারেই পশ্চিমা এজেন্টদের স্থানে ইসলামের সত্যিকারের নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরা ক্ষমতায় থাকতে পারে।
বিশ্বায়ন বা গ্লোবালাইজেশনের চিন্তাধারা, দর্শন এবং তার প্রতিটি আক্রমণের প্রতিরোধপন্থা ইমলামের চিন্তা, আকিদা, আইন, সভ্যতা, সংস্কৃতি এবং তার নীটিলাত ও সামাজিক ব্যবস্থাপনার মধ্যেই রয়েছে। এই ব্যবস্থাপনার প্রসারের প্রচেষ্টা যত দ্রুত হবে, বিশ্বায়নের মোেহ তত দ্রুতই কেটে যেতে থাকবে।
ওরিয়েন্টালিজমের গোগ্ৰাসী ছোবলে উম্মাহ !
ওরিয়েন্টালিজমের পরিচয়
ওরিয়েন্টালিজম শব্দটি মূলত ইংরেজি। আরবিভাষায় বলা হয় ‘আল-ইসতিশরাক’। বাংলায় প্রাচ্যবাদ। ল্যাটিন ভাষায় coriont শব্দটি কোনো কিছু খোঁজা বা জানার অর্থে ব্যবহৃত হয়। জার্মানা তাযায় sich orentierent এর অর্থ কোনো বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা। আর ফরাসিভাষায় orienter শব্দটি পথপ্রদর্শনের অর্থে ব্যবহার হয়। আমদেওয়ার্ড ডব্লিট সাইদ তার বিখ্যাত গ্রন্থ orientalism ‘ওরিয়েন্টালিজমে’ প্রাচাবিদের পরিয়ে বিবৃত করেছেন এভাবে- ‘যিনি সামগ্রিকভাবে প্রাচ্য সম্পর্কে অথবা এল বিশেষায়িত কোনো আশ সম্পর্কে শিক্ষা দেন, লেখালেখি করেন বা গবেষণা করেন তিমি নাতাত্ত্বিক, সমাজতাত্ত্বিক, ইতিহাসবিদ, ভাষাবিজ্ঞানী যেই হোন না কেন, তিনি অলিফেন্টালিস্ট বা প্রাচ্যতাত্ত্বিক। এবং তিনি যা করছেন, তা-ই ওরিয়েন্টালিজম বা প্রাচ্যতত্ত্ব। ওরিয়েন্টালিজমের উক্ত সংজ্ঞা থেকে প্রতিভাত হয় যে, প্রাচ্যবিদ মানেই ইউরোপীয়, এমন নয়। তিনি প্রাচ্যেরও একজন হতে পারেন। বস্তুত মুসলিম নন কিন্তু মুসলিমদ্যে জ্ঞান-রাজ্যে কর্তৃত্ব ফলাবার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি মাত্রই ওরিয়েন্টালিস্ট রা প্রায়কিদ আর তারা কর্মটিই ওরিয়েন্টালিজম বা প্রাচ্যবাদ নামে খ্যাত
ওরিয়েন্টালিজমের ক্রমবিকাশ
ইসলাম সম্পর্কে ইউরোপ ও পাশ্চাত্যের নেতিবাচক ধারণার প্রধান কারণ-সাম্প্রদায়িক গোঁয়ার্তুমি ও ইসলাম ফোবিয়া।
ইসলাম সম্পর্কে পাশ্চাত্যের সমস্ত চিন্তার বুনিয়াদ গড়ে উঠেছে পুরোহিত সমাজের হাত ধরে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তায় কী পরিমাণ বিকৃতি ও মিথ্যাচার ছিলো-তা বলাই বাহুল্য। পশ্চিমবাসী ইসলামকে জেনেছে গির্জার মাধ্যমে। ইসলাম মানেই ভয়ংকর বন্য কিছু-এভাবে চূড়ান্ত ঘৃণ্য রূপে ইসলামের বিবরণ পেয়েছে তারা। ধর্মীয় ঘৃণা ও বিদ্বেষ তো ছিলোই, পাশাপাশি ছিলো ইসলামের মূলনীতি, আক্বীদা- বিশ্বাস এবং ইতিহাস সম্পর্কে সীমাহীন অজ্ঞতা। এসব মিলিয়ে তারা এমন কট্টর আচরণ করেছে। তারা দেখাতে চেয়েছে-ইসলাম মৌলিক কোনো ধর্ম নয়, এর প্রণয়ন হয়েছে ইহুদী ও খৃস্ট ধর্মের আদলে। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইহুদী ও খৃষ্টান ধর্মযাজকদের কাছেই এর দীক্ষা পেয়েছেন।
ইরফান আব্দুল হামীদ, আল-মুসতাশরিকুন ওয়াল ইসলাম, তৃতীয় প্রকাশ, আল মাকতাবুল ইসলামী, বৈরুত।
ইসলাম ও নবীজীর নামে এসব মিথ্যাচারের ব্যাপক প্রচার ঘটে অষ্টম ঈসাব্দের মধ্যভাগে। এক্ষেত্রে আমরা কয়েকজনের নাম উল্লেখ করতে পারি। ‘আবু কুবরা’ নামে এক ব্যক্তি ছিলো, ইসলামী আক্বীদাশাস্ত্র বিষয়ে যার জানাশুন্য অপরিণত পর্যায়ের ছিলো।৬০ আরেকজন ছিলো Jhon of Dumascus (কিদ্দিস ইউহানা দামেশকী, মৃত্যু: ১৩২ হি./৭৪৯ঈ.)। এ লোক ইসলামকে তুলনা দেয় এরিয়ানিস্ট বৈধর্মের সাথে। তার মতে- ইসলাম নতুন কোনো ধর্ম নয়, পূর্ববর্তী সঠিক ধর্মগুলোর আলোকে তৈরি একটি মতবাদ। এভাবেও বলা যায়-খৃস্টধর্ম থেকে বিচ্যুত নাস্তিক্যবাদী এক মতবাদের নাম ইসলাম।
ইসলাম সম্পর্কে এরূপ বিরূপ প্রতিক্রিয়া জনমনে ছড়িয়ে দিতে তারা নানা ধরনের উদ্যোগ নিচে আরম্ভ করে সে তো বিভিন্ন দেশে দেশে মিশনারী সংস্থা ও একটি বিশেষ দল গঠন করা হয় ইসলাম ও নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে এই মিথ্যা কথা ছাড়াতে।
এসব মিথ্যাচারের প্রভাব বই পুস্তক পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকেনি, গড়িয়েছে যুদ্ধের মাঠ পর্যন্ত। একাদশ শতকে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আওয়াজ উঠে, সমগ্র পশ্চিমা বিশ্বে। পোপ দ্বিতীয় সেলভেস্টার আওয়াজ তুলেন- হে যিশুর পুত্ররা! তোমরা জাগ্রত হও, একাদশ শতক (৩৯৩ হি./১০০২ ঈ.) চলে এসেছে। এরপর শুরু হয়ে যায় ইসলামের ইতিহাসের অন্যতম দীর্ঘ ও রক্তক্ষয় ী যুদ্ধ-পুরুষের যুদ্ধ
এভাবে যখন একের পর এক যুদ্ধে ক্রুসেডাররা পরাজয় বরণ করতে লাগলো তখন তাদের মনে দৃঢ়বিশ্বাস জন্মালো-ইসলাম নিছক সমরশক্তি নয়। যুদ্ধশক্তি দিয়ে মুসলমানদের পরাজিত করা আদৌ সহজ নয়। কারণ নিছক নগর বা রাষ্ট্র পদাবনত করার মধ্যে ইসলামের শক্তি নয়, বরং শুদ্ধ বিশ্বাস প্রতিষ্ঠার মধ্যেই ইসলামের প্রকৃত শক্তি নিহিত।
অন্যদিকে ইউরোপীয় সভ্যতার আকাশে তখন কালো মেঘ ছেয়ে গিয়েছিল। তমসাচ্ছন্ন পৃথিবীতে সভ্যতা, আদর্শের অনুপস্থিতি ছিল ঢের। ইউরোপে সে-সময় dark age (অন্ধকার যুগ) চলছিল। মূর্খতা, শঠতা, দুর্বৃত্তপনা সে সমাজে সর্বসমাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। তথ্য- প্রযুক্তি, সাহিত্য-দর্শন ও ধর্ম-সামাজিকতার অবক্ষয় ছিল এমন, পৃথিবীর ইতিহাসে যা বিরল। অন্যদিকে, আরববিশ্বে ইসলামের জয়যাত্রা সমগ্র বিশ্বকে বিস্ময়াবিষ্ট করেছিল। সভ্যতাবিবর্জিত সাম্রাজ্যগুলোতে দলিতদের আর্তনাদ থেমে গিয়ে মুক্তির জয়গান ধ্বনিত হচ্ছিল। ইসলামে কে আগে দীক্ষিত হবে, এ নিয়ে রীতিমতো চলছিল প্রতিযোগিতা।
ইসলামের কৃষ্টি-কালচারগত বিজয়ে সর্বপ্রথম টনক নড়ে চার্চের। নিদারুণ বিহ্বলতা ও উদ্বেগ নিয়ে কিছু পাদবি হাজির হয় স্পেনে, সভ্যতার সংস্পর্শে। কারো কারো মতে, এসময় থেকেই শুরু হয় ওরিয়েন্টালিজম বা প্রাচ্যবিদ্যার যাত্রা। অন্য অনেকে অবশ্য উমাইয়া শাসনকালকে সূচনাকাল ধরেছেন। সে-সময়, হিজরি দ্বিতীয় শতাব্দীতে ‘পাদরি ইউহোন্না দিমাশকি’ দুটি বই লেখেন- ১. হায়াতে মুহাম্মদ (মুহাম্মদ সা.-এর জীবনী) ২. হিওয়ার বাইনা মাসিহিয়্যিন ও মুসলিমিন (মুসলিম-খ্রিষ্টান সংলাপ)। এতে তার উদ্দেশ্য ছিল, মুসলিমদের সাথে ধর্মীয় বিতর্কে খ্রিষ্টানদের দিক-নির্দেশনা প্রদান করা। বাস্তবিকপক্ষে প্রাচ্যবিদ্যার চর্চা উমাইয়া শাসনকালে হয়ে থাকলেও অ্যাকাডেমিক বা গতানুগতিক ধারায় এর চর্চা শুরু হয় আরো পরে; স্পেনে মুসলিম শাসনামলে। পাদরিরা এসময় দর্শন, চিকিৎসা ও গণিতশাস্ত্র শিখতে মুসলমানদের সংস্পর্শে আসে।
প্রভাবশালী কিছু প্রাচ্যবিদ
১. এ জে আরবেরি (a.j. arberry)। ব্রিটিশ প্রাচ্যবিদ। মৃত্যু: ২ অক্টোবর ১৯৬৯ সাল। তার পাণ্ডিত্য ছিল তাসাউফ ও ফারসি সাহিত্যে।
২. আলফ্রেড গেয়ম (alfred geom)। ব্রিটিশ প্রাচ্যবিদ। মৃত্যু: ৩০ নভেম্বর ১৯৬৫ সাল। আরবিভাষায় পারদর্শী ছিলেন। তার ধ্যানধারণায় মিশনারি চিন্তা প্রবল ছিল।
৩. এইচএআর গিব (H. A. R. Gibb)। ব্রিটিশ প্রাচ্যবিদ। মৃত্যু: ২২ অক্টোবর ১৯৭১ সাল।
৪. গোল্ড যিহার (Gold zihar)। পুরো নাম ইগনাজ আইজেক ইহুদা। একজন হাঙ্গেরিয়ান ইহুদি প্রাচ্যবিদ। মৃত্যু: ১৩ নভেম্বর ১৯২১ সাল। ইসলামের প্রতি তার বৈরী মনোভাব সর্বস্বীকৃত।
৫. ফিলিপ খুরি হিত্তি (philip khuri hitti)। লেবাননি বংশোদ্ভূত আরব ও ইসলামি সভ্যতার ইতিহাসবিদ। মৃত্যু: ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭৮ সাল।
প্রাচ্যবিদগণ এবং তাদের গবেষণা ও চিন্তাধারার প্রভাব
বর্তমান মুসলিম বিশ্বের পরিচালক ও শাসকশ্রেণীর মস্তিষ্কের মধ্যে ইসলামের অতীত কালের ব্যাপারে কুধারণা, ইসলামের বর্তমান সময় সম্পর্কে অসন্তুটি,
ইসলামের ভবিষ্যৎ হতে নৈরাশ্যে, ইসলাম, পয়গম্বরে ইসলাম ও ইসলামী উৎস (Resources)-সমূহ সম্পর্কে সন্দেহ ও দ্বিধা সৃষ্টি করা এবং ধর্মের সংস্কার, ইসলামী আইনের সংস্কারের জন্য তাদেরেেক প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে (যার নমুনা ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে) ঐ সমস্ত পাশ্চাত্য প্রাচ্যবিদদেরই শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের প্রভাব। কারণ তারা সাধারণত উচ্চ শিক্ষা লাভ করছে পাশ্চাত্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অথবা তারা ইসলামী জ্ঞান লাভ করেছে পাশ্চাত্য ভাষায়, এই প্রাচ্যবিদগণ ইসলাম সম্পর্কে পুস্তকাদি পাঠে জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাদেরকে সাধারণত Orientalist বলা হয়। তারা জ্ঞানের প্রসারতা, গবেষণার গভীরতা। প্রাচ্যের জ্ঞানী ও রাজনৈতিক শ্রেণীর মধ্যে সম্মান ও মর্যাদা লাভ করেছেন এবং প্রাচ্যে ইসলামী বিভিন্ন বিষয়ে তাদের গবেষণা ও মতামতকে শেষ কথা ও চূড়ান্ত ফয়সালা মনে করা হয়। এই প্রাচ্যবিদগণের ইতিহাস বহু পুরাতন। তারা প্রকাশ্যভাবে খ্রিস্টীয় ১৩ শতাব্দী হতে কাজ শুরু করে। তাদের আন্দোলন ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক তিন প্রকারের ছিল। ধর্মীয় আন্দোলন অতি স্পষ্ট। তাদের বড় উদ্দেশ্য ছিল খ্রিষ্ট ধর্মের প্রচার-প্রসার ও ইসলামের এমন ছবি অংকন করা যাতে খ্রিষ্ট ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাধান্য আপনাআপনিই প্রমাণিত হয় এবং আধুনিক শিক্ষিত সমাজ ও নতুন প্রজন্মের মধ্যে খ্রিষ্ট ধর্মের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হয়। তাই বলা যায়, খ্রিষ্ট ধর্মের প্রচার এক সাথেই কর্মতৎপর রয়েছে। এদের বেশির ভাগ মূলত পাদরী, তাদের অধিক সংখ্যক বংশে ও ধর্মে ইহুদী। রাজনৈতিক আন্দোলন এই যে, এই প্রাচ্যবিদগণ সাধারণত প্রাচ্যে পাশ্চাত্য শাসন ও ক্ষমতার অগ্রদূত (Pioneers)। পাশ্চাত্য শাসনসমূহকে জ্ঞানের ক্ষেত্রে সাহায্য ও উপকরণ সরবরাহ করা তাদেরই কাজ। তারা এই সমস্ত প্রাচ্য জাতি ও প্রাচ্য দেশসমূহের রীতি, রেওয়াজ, স্বভাব-প্রকৃতি, বসবাসের প্রণালী, ভাষা ও সাহিত্য, এমন কি আবেগ, উদ্যম, মনোভাব প্রভৃতি সম্পর্কে সঠিক ও বিশুদ্ধ তথ্যাদি পৌছে দেন, যাতে প্রাচ্য দেশসমূহ পাশ্চাত্য নাগরিকদের শাসন করা সহজ হয়। এর সাথে সাথে তারা প্রাচ্যের ঐ সমস্ত অবস্থা, আন্দোলন, আকীদা ও কল্পনাকে ধূলিসাৎ করে দেন যা ঐ পাশ্চাত্য ঔপনিবেশিকদের জন্য চিন্তা ও মাথা ব্যথার কারণ হয় এবং এমন মনোভাব ও বৃত্তিজনিত পরিবেশ সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হয় যার ফলে সরকারের বিরোধিতার কল্পনাও যেন মনে সৃষ্টি হতে না পারে। এর বিপরীত তাদের সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্ব ও তাদের খিদমতের প্রতি শ্রদ্ধার ভাব সৃষ্টি হয় এবং প্রাচ্যের অধিবাসীদের মধ্যে দেশের সংশোধন ও উন্নতিকল্পে পাশ্চাত্যের
অনুসরণ ও অনুকরণের এমন আবেগ সৃষ্টি হয় যাতে ঐ সমস্ত পাশ্চাত্য সরকার চলে যাওয়ার পর তাদের মনোভাব ও সভ্যতার ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত থাকে। এ কারণে পাশ্চাত্য সরকারসমূহ এই প্রাচ্যবিদদের গুরুত্ব ও উপকারিতার কথা পূর্ণভাবে উপলব্ধি করেছিল। পাশ্চাত্যের নেতাগণ পূর্ণভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। এই উদ্দেশে বিভিন্ন দেশের প্রাচ্যবিদগণ মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্কিত পুস্তিকা ও পত্রিকাসমূহ প্রচার করেন যার মধ্যে মুসলিম বিশ্বের অন্তরের প্রবণতার ওপর বিশদ বর্ণনা ও পর্যালোচনা অতি নিপুণতার সঙ্গে প্রচারিত হয়। বর্তমানেও মধ্যপ্রাচ্য নামে (Journal of Near East) ও মুসলিম বিশ্ব নামের পত্রিকা (The Muslim World) আমেরিকা হতে ও (Le Monde Musalmans) নামে একটি পত্রিকা ফ্রান্স হতে প্রকাশিত হচ্ছে।
প্রাচ্যবিদদের প্রভাব কেবল তাদের ব্যক্তিত্ব পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়। যদি কেবল তা-ই হতো, তাহলে আমাদের মনোযোগের কেন্দ্র ও এই আলোচনার বিষয়বস্তু হতো না। বিষয়ের বেশি ভয়াবহ ও সুদূরপ্রসারী দিক হলো এই যে, তারা তাদের সমস্ত যোগ্যতাকে যৌক্তিক ও অযৌক্তিকভাবে ঐ সমস্ত দুর্বলতাকে চিহ্নিত করতে এবং তা অত্যন্ত ভয়ানক আকারে পেশ করতে ব্যয় করেন। তারা অনুবীক্ষণ যন্ত্র দ্বারা দেখেন এবং পাঠকবর্গকে দূরবীক্ষণ যন্ত্র দ্বারা দেখান। সরিষাকে পর্বত বানানো তাদের একটি ক্ষুদ্র কাজ। তারা ইসলামের অন্ধকার ছবি পেশ করার ক্ষেত্রে এত চতুর, চালাক ও এত ধৈর্য অবলম্বন করেন যে, যার উদাহরণ পাওয়া কঠিন। তারা প্রথমে একটি উদ্দেশ্য ঠিক করে নেন এবং একটি সিদ্ধান্ত করে নেন যে, একে প্রমাণিত করে নিতে হবে। তৎপর ঐ উদ্দেশ্যের জন্য প্রতি প্রকারের ভাল, মন্দ, ধর্ম ও ইতিহাস, সাহিত্য, গল্প, কবিতা, অকৃত্রিম, কৃত্রিম সম্পদ হতে উপকরণ যোগাড় করেন যা দ্বারা তাদের উদ্দেশ্য অর্জনের যৎকিঞ্চিৎও সুবিধা পাওয়া যায়। তা শুদ্ধতা ও সনদ হিসেবে যতই ক্ষত-বিক্ষত ও সন্দিগ্ধ ও মূল্যহীন হোক তাকে বড়ই দীপ্তি উজ্জ্বলতার সাথে পেশ করেন এবং বিভিন্ন উপকরণ দ্বারা একটি কল্পিত বিষয়ের পূর্ণ কাঠামো তৈরি করেন, যার পূর্ণ অস্তিত্ব কেবল তাদের অন্তরেই রয়েছে। তারা প্রায়ই একটি মন্দ দিক বর্ণনা করেন এবং তাকে মস্তিষ্কের মধ্যে বসিয়ে দেবার জন্য বড়ই উদারতার সাথে
আলোচিত বিষয়ের বা ব্যক্তির দশটি সৌন্দর্যের বর্ণনা দেন, যেন পাঠকদের মন তার বিচার, অন্তরের প্রশস্ততা ও পক্ষপাতিত্বহীনতা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তার একটি সন্দহ সমস্ত সৌন্দর্য নষ্ট করে দেয়ার মত গ্রহণ করে নেয়।
প্রতিকার ও উত্তরণের উপায়
এই অবস্থার সংশোধন ও প্রাচ্যবিদদের বিধ্বস্তকারী ও সন্দিগ্ধ করার ক্রিয়াকে বাধা দেয়ার একমাত্র পন্থা হলো এই যে, ঐ সমস্ত বিষয়ের ওপর মুসলমান দার্শনিক ও গবেষকগণ লিখতে বদ্ধপরিকর হন এবং প্রাচ্যবিদদের ঐ সমস্ত প্রশংসনীয় বিশেষত্বসমূহের প্রতি কেবল লক্ষ্য রেখেই নয়, বরং তাকে আরও উন্নত মানের করতে হবে যা প্রাচ্যবিদদের কর্ম বলে এতদিন মনে করা হতো। মুসলিম
লেখকগণকে প্রমাণিত ও শুদ্ধ ইসলামী অভিজ্ঞতা ও ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি পেশ করতে হাব। তাদেরকে এমন পুস্তক ও সাহিত্য রচনা হতে হবে যা মৌলিক (Ciginality) ও ব্যাপক অধ্যয়নের ফল, দৃষ্টির গভীরতা, পরিচয়ই প্রামাণিতা উৎসের ও তথ্যনির্ভর হওয়ার দিক দিয়ে প্রাচ্যবিদদের পুস্তকসমূহ হতে বহু গুণে শুভ ও শ্রেষ্ঠ হবে। এর মধ্যে তাদের সমস্ত সৌন্দর্য-সৌকর্য থাকবে এবং তাদের দুর্বলতা ও দোষ-ত্রুটি হতে মুক্ত হবে। অপর দিকে প্রাচ্যবিদদের পুস্তকাদির সঠিক পর্যালোচনা করতে হবে এবং ভাদের প্রতারণা ও প্রবঞ্চনাকে প্রকাশ করে দিতে হবে। মূল পাঠের অর্থ উদ্ধারে তাদের যে ভুল হয়েছে এবং অনুবাদ ও মর্ম গ্রহণে যে ভুল-ত্রুটি রয়েছে তাকে স্পষ্ট করে দিতে হবে। তাদের উৎসের দুর্বলতা ও তাদের গৃহীত ফলাফলের ভুল-ত্রুটি তুলে ধরতে হবে। তাদের প্রচারে ও শিক্ষা দানে যে কু-উদ্দেশ্য, ধর্মীয় অভিসন্ধি রয়েছে এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অন্তর্ভুক্ত আছে একে ভালরূপে জানিয়ে দিতে হবে এবং বলতে হবে, বরং এটা উপলব্ধি করতে হতে যে, এটা ইসলাম, ইসলামী সমাজ ও সভ্যতার বিরুদ্ধে কত বড় একটি গভীর ও হীন ষড়যন্ত্র। প্রথমটি ইতিবাচক কাজ (ইসলামী বিষয়সমূহের ওপর পুস্তক ও প্রবন্ধ লেখা) এবং অপরটি নেতিবাচক কাজ। পর্যালোচনা ও বিচার এই দু’টি পন্থায় অগ্রসর হতে হবে। নতুবা মুসলিম বিশ্বের বুদ্ধিজীবী ও উচ্চ সাহসী লোকদের যারা ইউরোপ ও আমেরিকার উচ্চ বিশ্ববিদ্যালয় অথবা নিজ দেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা লাভ করেছেন এবং পাশ্চাত্য ভাষায় (যে ভাষায় তারা বেশি অভিজ্ঞতা রাখেন) ইসলামী সাহিত্য পাঠ করেন তারা প্রাচ্যবিদদের ভ্রান্ত ধারণা ও কল্পনার বিষক্রিয়া হতে মুক্ত হতে পারবেন না। আর তারা যত দিন এই বিষাক্ত ছোবল হতে মুক্ত হবেন না, ইসলামী দেশসমূহ ততদিন চিন্তার বিশৃঙ্খলা ও বিশ্বাসে সন্দেহ-সংশয়ের বিপদে নিমজ্জিত থাকবে। ফলে ঐ সমস্ত দেশ আধুনিক ও পাশ্চাত্যের সমর্থকরা সব সময় ক্ষতিকর বিভিন্ন চিন্তা ও কল্পনাকে প্রকাশ করতে থাকবে। আর যখন তাদের হাতে ক্ষমতা আসবে তখন তাকে কাজে পরিণত করতে চেষ্টা করবে যা ইসলামী তত্ত্বের বিপরীত। অতঃপর এমন এক সমাজ প্রতিষ্ঠিত করবে যা কেবল নামে ও পরিচয়ে পুরাতন ইসলামী সমাজের সাথে সাদৃশ্য রাখে, অথচ যার লক্ষ্য পাশ্চাত্য সমাজ, সভ্যতা ও খাঁটি বস্তুবাদ।
Leave a Comment
Your email address will not be published. Required fields are marked with *