বাংলা ভাষার জন্য সংগ্রাম

আবু নাসির তোহা: বাংলা ভাষার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এই বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতেই আমাদের আজকের বাংলাদেশ। তাই দেশকে ভালবাসতে হলে অবশ্যই আমাদেরকে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য যাদের অবদান তাদেরকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে হবে এবং আমাদেরকে তাদের সম্পর্কে জানতে হবে।

১৯১১ সালে রংপুরে শিক্ষা সম্মেলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ নবাব আলী বাংলা ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব উপস্থাপন করেছিলেন।

ভারতের মাতৃভাষা কি হওয়া উচিত এ প্রশ্ন মহাত্মা গান্ধী উত্থাপন করলে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিন্দি ভারতের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত বলে প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯১৮ সালে বিশ্বভারতীতে কবি গুরুর সভাপতিত্বে একটি সমাবেশে ডঃ মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ এর তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার অন্যতম দাবিদারদের বলে প্রস্তাব করেন। একইভাবে ১৯৪৭ সালে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ডক্টর মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করলে ডঃ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ এর তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে দাবি করেন।

১৯৪৭ সালে ১ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের কৃতি সন্তান অধ্যক্ষ আবুল কাশেম কিছু প্রগতিশীল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে তমুদ্দুন মজলিস গঠন করেন এবং সেখান থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু” নামক একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। উক্ত পুস্তিকায় অধ্যক্ষ আবুল কাশেম, ডঃ কাজী মোতাহার হোসেন এবং জনাব আবুল মনসুর আহমেদের লিখা ছাপা হয়। একই বছর ১ অক্টোবর অধ্যক্ষ আবুল কাশেমের তত্ত্বাবধানে অধ্যাপক নুরুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে “রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ” গঠিত হয়। উক্ত পরিষদ নিয়মতান্ত্রিক ও বুদ্ধিভিত্তিকভাবে “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” দাবিকে জনসম্মুখে নিয়ে আসে এবং মানুষকে এ দাবির পক্ষে সমবেত করা শুরু করে।

১৯৪৮ সালে অধ্যক্ষ আবুল কাশেম ‘দৈনিক সংগ্রাম’ পত্রিকা প্রকাশ করেন যা “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” এর অন্যতম মুখপাত্র হিসাবে কাজ করে।

একই বছর ২৩ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লার কৃতি সন্তান গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার দাবিদার হিসেবে উপস্থাপন করেন।

একই বছর ২১ মার্চ পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল মোঃ আলী জিন্নাহ ঢাকায় উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দেন।

২৪ মার্চ “রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ” এর একটি প্রতিনিধি দল উক্ত ঘোষণার প্রতিবাদে মোঃ আলী জিন্নাহর নিকট একটি স্মারকলিপি প্রদান করেন। উক্ত প্রতিনিধি দলে ছিলেন জনাব শামসুল হক, জনাব কামরুদ্দিন আহমেদ, অধ্যক্ষ আবুল কাশেম, জনাব মোঃ তোয়াহা, জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জনাব নঈম উদ্দিন এবং জনাব তাজ উদ্দিন আহমেদ।

১৯৫০ সালে ১১ মার্চ ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিন এর নেতৃত্বে তরুণ যুবকদের নিয়ে “রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি” গঠিত হয়। এই কমিটি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে রাজপথে নিয়ে যায় এবং ভীষণভাবে বেগবান করে তোলে।

এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি তরুণ সমাজ পাকিস্তান সরকার ঘোষিত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রাজপথে নেমে আসে। পুলিশের গুলিতে জব্বার, সালাম, বরকত, রফিকসহ আরো অনেকে প্রাণ দেয় এবং আহত হয়। এর প্রতিবাদে আজাদ সম্পাদক শামসুদ্দিন আবুল কালাম গণপরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন। জনাব আব্দুল গফফার চৌধুরী রচনা করেন শহীদ দিবসের অমর সঙ্গীত এবং সুর প্রদান করেন শহীদ আলতাফ মাহমুদ।

১৯৫৫ সালে বর্তমান আদলে প্রথম শহীদ দিবস পালিত হয়। ১৯৫৬ সালে ৩০ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান গণপরিষদে চট্টগ্রামের কৃতি সন্তান ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবির অন্যতম প্রথম প্রস্তাব উত্থাপক অধ্যক্ষ আবুল কাশেম রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং বাংলা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।

১৯৯৮ সালে ৯ জানুয়ারি কানাডা প্রবাসী জনাব রফিকুল ইসলাম এবং জনাব আব্দুস সালাম জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব জনাব কফি আনান কে পত্র লিখে বাঙালি জাতির এই মহান আত্মত্যাগ সম্পর্কে অবগত করেন এবং ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা প্রদানের অনুরোধ করেন। তার প্রেক্ষিতে ১৯৯৯ সালে ১৭ই নভেম্বর ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। এটা আমাদের বাঙালি জাতি এবং বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গর্বের বিষয়।

কিন্তু আমরা যদি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সম্মান প্রদর্শন করতে না পারি, অনুসরণ করতে না পারি তাহলে আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের সকল আত্মত্যাগ ব্যর্থ হয়ে যাবে। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে সম্মান প্রদর্শনের অন্যতম উপায় প্রত্যেকের তার নিজের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করা, সততার সাথে দায়িত্ব পালন করা, মানুষের ক্ষতি হয় এমন সকল কাজ করা থেকে বিরত থাকা। এ প্রসঙ্গে ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মর্তুজা বলেছেন, “নিজের কাজ সঠিকভাবে করাই দেশপ্রেম”। আরো একটি কথা সকলকে স্মরণ রাখতে হবে। “চন্দ্র, সূর্য এবং সত্য কখনো গোপন থাকে না।” চলুন আমরা সব সময় সত্য কথা বলি, সৎ মানুষকে সম্মান করি, ত্যাগী মানুষকে সম্মান করি এবং মানুষের জন্য, সমাজের জন্য, দেশের জন্য সর্বোচ্চটা করার চেষ্টা করি। আল্লাহ তাআলা সব দেখেন এবং উনি সঠিক ও ন্যায্য বিচারক।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *