কায়সার আহমেদ : বাংলাদেশ, আমাদের প্রাণপ্রিয় জন্মভূমি। ১৯৭১ সালের দুশো ছেষট্টি দিন সমগ্র বাংলাদেশটাই ছিলো এক ভয়ঙ্কর বন্দী শিবির। পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের ইন্ধনে এবং তৎকালিন পাকিস্তানের দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা জুলফিকার আলীর নেতৃত্বে, দীর্ঘদিনের প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত ও অভিজ্ঞ ঘৃণ্যতম সেই পাকিস্তানী সেনানায়কেরা (জেনারেল ইয়াহিয়া খান, লে.জেনারেল এ.কে. নিয়াজী, লে. জেনারেল টিক্কা খান ও লে. জেনারেল রাও
কায়সার আহমেদ : বাংলাদেশ, আমাদের প্রাণপ্রিয় জন্মভূমি। ১৯৭১ সালের দুশো ছেষট্টি দিন সমগ্র বাংলাদেশটাই ছিলো এক ভয়ঙ্কর বন্দী শিবির। পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের ইন্ধনে এবং তৎকালিন পাকিস্তানের দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা জুলফিকার আলীর নেতৃত্বে, দীর্ঘদিনের প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত ও অভিজ্ঞ ঘৃণ্যতম সেই পাকিস্তানী সেনানায়কেরা (জেনারেল ইয়াহিয়া খান, লে.জেনারেল এ.কে. নিয়াজী, লে. জেনারেল টিক্কা খান ও লে. জেনারেল রাও ফরমান আলী) বাংলাদেশে ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা চালিয়েছে তা আমরা আজো ভুলিনি। শক্তের ভক্ত, নরমের যম সেই নরঘাতকেরা স্বাধীনতা চেতনায় মরিয়া হ’য়ে ওঠা বাংলার জনগনের কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলো অবশেষে। ১৯৭১ এর ডিসেম্বরে, দেশ স্বাধীন হলেও চলার পথে হাটতে হাটতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হতো কোন পথচারীকে। হাঠাৎ করেই যত্র তত্র চোখে পড়েছিলো অর্দ্ধ পঁচা গলা লাশ আর কঙ্কাল। দিনে দিনে আবিষ্কৃত হচ্ছিলো গণকবর, স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে প্রাঙ্গণে পড়ে থাকা কোন নর কঙ্কাল দেখতে পেয়ে ভয় পেয়ে চমকে উঠতে হতো কোমলমতি শিক্ষার্থীদের।
বাংলাদেশে সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয় ১৯৭১ এর ২৬শে মার্চ থেকে আর তার সমাপ্তি ঘটে ১৬ই ডিসেম্বর। বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ছিলো একটি জনযুদ্ধ। সেই যুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিলেন প্রশিক্ষিত দক্ষ সেনা-নৌ ও বিমান বাহিনীর দক্ষ বাঙালি অফিসার ও সেনাবৃন্দ এবং সর্বস্তরের সাধারন মানুষ।দীর্ঘ স্বাধীনতাসংগ্রাম ও নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সকল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অংশগ্রহনে পরিচালিত হয়। তবে হ্যা, শুধুমাত্র জামাতে ইসলামী ও মুসলিম লীগের গুটি কয়েক ভগ্নাংশ ব্যাতিত। কিন্তু যেহেতু একটি দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ, তার একটি সামরিক নেতৃত্বও ছিল। সেখানে পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী ত্যাগ করে আসা বাঙালি অফিসাররাই নেতৃতে¦ ছিলেন। তাঁদের সাথে আরো যোগ দিয়েছিলেন তৎকালিন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেস (ইপিআপ), পুলিশ ও আনসার বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা। অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ওসমানী ছিলেন সশ¯্র বাহিনীর প্রধান সেনাপতি। তাঁর ডেপুটিদের মধ্যে ছিলেন লে. কর্নেল রব, বিমানবাহিনীর এ.আর.খন্দকার এবং বিভিন্ন অধিনায়কেরা যেমন মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর সফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোর্শারফ সহ অন্যান্য সেক্টরের কমান্ডাররা। তাঁরাই সম্মিলিতভাবে সশস্ত্র বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিলো একটি অস্বাভাবিক সশস্ত্র যুদ্ধ। সাধারণ মুক্তিকামী মানুষই ছিলো সেই যুদ্ধের নায়ক আর পরিচালক ছিলেন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তারা। মিত্রশক্তি ভারত সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছিলো , বলতে গেলে ভারতের প্রায় সব দলমতের নেতারা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নেতৃত্বাধীন সরকার এবং ভারতের জনগণ। যদিও আমরা স্বীকার করতে বিব্রত বোধ করি, কিন্তু বাস্তবতা হলো, সেদিন বাংলাদেশের পক্ষে সব কাজ সুশৃঙ্খলভাবে গুছিয়ে করা সম্ভব হয়নি।
পাকিস্তানিরা উদ্ভূত পরিস্থিতির রাজনৈতিক মীমাংসা চায়নি বলেই অনেক ভেবেচিন্তে তারা নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আক্রমন ও গণহত্যা চালিয়েছিলো। তারা চেয়েছিলো অস্ত্রের জোরে বাঙালিকে দাবিয়ে রাখতে। তখন প্রত্যেক বাঙালিই পশ্চিম পাকিস্তানিদের শত্রু– সে বাঙালি বেসামরিক নাগরিকই হোক বা সশন্ত্র বাহিনীতে কর্মরত বাঙালি কর্মকর্তা বা কর্মচারীই হোক। উল্লেখযোগ্য যে ২৫শে মার্চ সন্ধ্যারাতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আক্ষরিক অর্থেই পালিয়ে ইসলামাবাদে চলে গেলেও পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকায় থেকে যান। ঢাকায় তিনি আবস্থান করছিলেন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। সেই ভয়াবহ রাতে কেনো তিনি ঢাকায় রইলেন? সেই কথাগুলো ইস্ট পাকিস্তানের তৎকালিন সেনা কমান্ডার লে.জে.নিয়াজী অনুশোচনা থেকে তার বইতে লিখেছেন যে, ভুট্টো সাহেব স্বচক্ষে দেখতে চেয়েছিলেন যে তাঁদের প্রিয় সেনাবাহিনী বাঙালিকে যে উচিত শিক্ষা দিতে সক্ষম, তা তার নিজের চোখে দেখার বাসনা ছিলো।
ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের জানালায় দাঁড়িয়ে তিনি দেখে সন্তষ্ট হন যে ঢাকা নগর জ্বলছে। সামরিক বাহিনীর নারকীয়তায় তিনি পৈশাচিক আনন্দ উপভোগ করেন। নিয়াজী আরো লিখেছেন যে সকালে ভূট্টো, জেনারেল টিক্কা, জেনারেল রাও ফরমান ও ব্রিগেডিয়ার আবরারের পিঠ চাপড়ে অভিনন্দন জানান। ২৬শে মার্চ সকালে করাচির উদ্ধেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করার আগে ভূট্টো আবরারকে বলেন: ‘আল্লাহ কাছে অশেষ শুকরিয়া, পাকিস্তানকে রক্ষা করা গেছে’। ২৫/২৬শে মার্চ কি ঘটেছিলো তা নিয়াজী আত্মস্বীকৃতিমূলক জবানীতেই অনুমান করা যায়। তিনি লিখেছেন, ‘২৫শে মার্চের সামরিক অভিযানের নৃশংসতা বুখারায় চেঙ্গিস খান, বাগদাদে হালাকু খান এবং জালিয়ানওয়ালাবাগে ব্রিটিশ জেনারেল ডায়ারের নিষ্ঠুরতাকেও ছাড়িয়ে যায়।
“আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি” সুমধুর গানটি হঠাৎ বন্দী শিবিরে গাদাগাদি করে রাখা একটি কক্ষে আমাদের কানে আসে। তারিখ ২রা অক্টোবর ১৯৭১, স্থান তৎকালিন নাখাল পাড়াস্থ ড্রাম ফ্যাক্টরী যেখানে স্থাপন করা হয়েছিলো দখলদার পাকবাহিনীর সামরিক হেডকোয়ার্টার ও সামরিক আদালত আর তারই মধ্যে ছিলো ঘৃণতম টর্চারিং সেল। সেই টর্চারিং সেলের বন্দীরা, হানাদার বাহিনীর শিবিরে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত শুনে চমকে উঠবে সেটাইতো স্বাভাবিক। সেই দিনই আমাকে গ্রেফতার করে বন্দী শিবিরে আনা হয়েছে। এক মুহুর্তের মধ্যে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেছিলাম আমি। তবে কি দেশ স্বাধীন হয়ে গেলো! আশে পাশের আমার মত অন্যান্যদের মাঝে কোন প্রতিক্রিয়া না দেখে অবাক হয়ে তাকাতেই একজন বন্দী মুক্তিযোদ্ধা আমাকে জানালো ভাইয়া আপনি আজ এসেছেন তাই বুঝতে পারছেন না, একটু পরেই বুঝবেন।
একটু পরেই কয়েকজন পাকিস্তানী নরপিশাচ সেপাই একজন বন্দীকে আমাদের মাঝে ধাক্কা মেরে ঢুকিয়ে দিয়ে গেলো। রক্তাক্ত অবস্থা। হাত ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। সবাই তার সেবায় লেগে গেলো। কিছুক্ষন ধাতস্থ হবার পর জানা গেলো তিনি আর কেহ নন, প্রখ্যাত রবীন্দ্র সঙ্গীত গায়ক ইকবাল আহমেদ (সম্প্রতি একুশে পদকপ্রাপ্ত ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী)। তার থেকেই জানলাম তাকে যখন টর্চারিং সেলে নিয়ে যেতো প্রথমেই তাকে দিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত গেতে বলতো আর গালাগালি দিয়ে ওরা মজা করতো। টর্চারিং সেলের অত্যাচার ছিলো ভাষাতিত। বাশ ডলা, নখের ভিতর সুই, অজ্ঞান না হওয়া পর্যন্ত সিলিংএর সাথে ঝুলিয়ে লাঠি পেটা করা। আজো একজনের কথা মনে পড়লে আমি ডিপ্রেসড হয়ে যাই। তখন বন্দী কক্ষ থেকে সকাল থেকে একে একে দুজন করে ডেকে নেয়া হতো টর্চারিং সেলে। সেইদিন আমাকে ও সাথে তৎকালিন মাদারীপুর এর এসডিও সাহেবকে নেয়া হলো এক সাথে। তাকে দু’জন পাক সেনা এমনভাবে দুটো লাঠি দিয়ে এমনভাবে পেটাচ্ছিলো যে তার পিঠের চামড়া উঠে যেয়ে কক্ষটির চারদিকের দেয়ালকে লাল রংয়ে রঞ্জিত করে তুলেছিলো। সেদিনের সে অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে তিনি সেখানেই ইন্তেকাল করেন।
বন্দীদের টর্চারিং করে তাদেরকে কোন এক বাঙালী মেজিস্ট্রেট এর নিকট পাঠানো হতো দুষ্কৃতিকারী হিসেবে তাদের উথ্বাপিত সকল অভিযোগ স¦ীকার করে জবানবন্দী দেবার জন্যে। সেই জবানবন্দী আমাদের বিরুদ্ধে মামলার প্রমানপত্র হিসেবে সামরিক আদালতে পেশ করা হতো এবং স্বয়ং মেজিস্ট্রেট তখন স্বাক্ষী হতেন। মেজিস্ট্রেট এর নিকট পাঠানোর দিনটিতে সকাল থেকে একজন পাকিস্তানী ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তার নিকট বন্দীকে হস্তান্তর করা হতো। তিনি দিনব্যপী বন্দীর সাথে খুবই ভালো ব্যবহার করতেন। আমাকেও একদিন তার নিকট পাঠানো হলো। তিনি আমার উপর প্রতিদিন যে ধরনের অত্যাচার হয়েছে তা শুনে খুবই দু:খ প্রকাশ করতেন। সারাদিন তার সাথে খুব ভালো সময় কেটেছে এবং তার সাথে আমাকেও খুবই উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হয়েছিলো। তবে সরাসরি না বললেও আকারে ইঙ্গিতে বোঝাতেন যে আমি যেনো মেজিস্ট্রেট মহোদয়ের নিকট নির্ভয়ে সকল দোষ স্বীকার করে সরকারের নিকট ক্ষমা চেয়ে জবানবন্দী নিবন্ধন করাই, তাহলে আমাকে মুক্ত করে দিবেন এবং চাইলে আমাকে ভারতীয় ও পাকিস্থানী দুশমনদের সাথে যুদ্ধ করার জন্যে প্রশিক্ষন দেয়া হবে।
পরে বুঝেছি যে এই সারাবেলা একজন ইন্টেলিজেন্স অফিসারের সাথে রেখে ভালো খাবার ও ভালো ব্যবহারের উদ্দেশ্য ছিলো মগজ ধোলাই করা, আমি তার ব্যবহারে এতটাই কনভিন্স হয়ে পড়েছিলাম যে মনে হতো তিনি আমাদেরই একজন। অত:পর বিকেলে পাঠানো হতো মেজিস্ট্রেট মহোদয়ের নিকট। আবার যখন শহীদ মেজর (পরবর্তীতে কর্ণেল) হায়দার এর কথা মনে পরে যায় যিনি সব সময় বলতেন আমরা যদি গ্রেফতার হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান ও তাদের অস্ত্রের সন্ধান দিয়ে দেই, তাহলেও তারা আমাদের মুক্তি দিবে না আবার না বললেও দিবে না। বরং অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেবে আরো বেশী তথ্যের জন্যে। আমি আজ গর্বিত যে শত অত্যাচারেও আমি মুক্তিযোদ্ধাদের কোন তথ্য ফাস করিনি। বিকেলের দিকে মেজিস্ট্রেট এর কক্ষে হাজির হবার সাথে সাথে মহোদয়ের স্বাগত আপ্যায়নে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। প্রায় দশ দিন পর একজন উচ্চ পদস্থ বাঙ্গালী কর্মকর্তার দেখা পেলাম। সাধারন গোছের ভদ্রলোক আমাকে বসতে বলে চা-নাস্তা দিয়ে আপ্যায়ন করলেন। তারপর জানালেন তিনি আমার জবানবন্দী নথিভূক্ত করবেন এবং তা আমাকে নির্ভয়ে বলতে হবে। আমি তখন মহাখুশী এবং আমি নিজেকে নির্দোষ দাবী করে দীর্ঘ আধা-ঘন্টা আমার বক্তব্য রাখলাম। আমার বক্তব্য শেষ হলে, মেজিস্ট্রেট মহোদয় আমার বক্তব্য নথিভূক্ত না করে বেল টিপে সেপাইকে ডেকে বললেন আমাকে নিয়ে যেতে।
সেপাই আমাকে সেখান থেকে সরাসরি নিয়ে গেলেন সেই ভয়াবহ টর্চারিং সেলে। শুরু হলো ভয়ঙ্কর অত্যাচার। বাশ ডলা। উল্টো করে শুয়ে দিয়ে দুপায়ের হাটুর নিচের অংশে দুটো বাশ তার উপর বিশাল ওজনের দুজন সেপাই দাড়াতো আর দুজন দুদিক থেকে বাশগুলো ঘুরাতো, যাকে বলে বাশ ডলা। আমার গগনবিদাড়ী চিৎকার মনে হয় আশে পাশের সকল প্রতিবেশীরা শুনতে পেতো। তাছাড়াও বুড়ো আঙ্গলে সুই ফুটানো, সিলিংয়ে ঝুলিয়ে পেটানো চলেছে রাত দশটা নাগাদ। তারপর মৃতপ্রায় অবস্থায় বন্দীযোদ্ধাদের সাথে ফেলে রেখে এসেছে। পরের দিন আবার সেই ইন্টেলিজেন্স অফিসার ও পরে মেজিস্ট্রেট। মেজিস্ট্রেট মহোদয়কে আমি বললাম আমাকে কিভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। তিনি জানালেন আমাকে জবানবন্দীর শুরুতে অবশ্যই বলতে হবে যে আমি অত্যাচারিত না হয়ে নির্ভয়ে জবানবন্দী দিচ্ছি বললেই তিনি আমার জবানবন্দী নিবন্ধন করবেন নতুবা নয়। তারপরও আমি নিজেকে নির্দোষী বলেছি। সেদিনের বাশ ডলার কারনে আমার বাঁ পা ফ্র্যাকচার হয়ে গিয়েছিলো, তারপর থেকে আমি সোজা হয়ে হাটতে পারিনি দীর্ঘদিন। বিজয়ের পর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্ত হলে, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভারতীয় অরথোপেডিক বিশেষজ্ঞ ড. খান্না আমার পায়ে অস্ত্রোপাচার করলে আমি সুস্থ জীবন ফিরে পাই। আহত পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের উন্নতমানের চিকিৎসা দেবার জন্যে বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রনে ভারতীয় এই চিকিৎসক ঐ সময় দীর্ঘদিন ঢাকায় অবস্থান করছিলেন।
দীর্ঘ পনেরোদিন টর্চারিং সেলে থাকার পর সামরিক আদালতে হাজির করা হলে প্রথম দিনের একতরফা শুনানী শেষে ব্রিগেডিয়ার বশির পরবর্তী তারিখ ঘোষনা দিয়ে বললেন “ইয়ে সবকো রাজঘর লে যাও”। প্রথমে না বুঝলেও পরে বুঝেছি তিনি আমাদের সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে যাবার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেদিন রাতে আমাদেরকে রমনা থানায় নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে কিছু কাগজপত্র ঠিকঠাক করে রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগরে পাঠানো হলো। সেখানে আমাদের গ্রহন করার জন্যে প্রস্তুত ছিলেন তৎকালিন ডেপুটি জেলর শামসুর রহমান। জেলখানার অবস্থা দেখে বুঝতে পারছিলাম যে যথেষ্ট নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মজার ব্যপার হলো আমরা প্রায় চৌদ্দজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম, সবাইকে যখন জেলে হস্তান্তর করে ওরা মানে পাক সেনারা চলে গেলে, তখন আমরা সবাই প্রাণখুলে হাসাহাসি করছিলাম। একে অপরের সাথে কোলাকুলি করছিলাম। এসব দেখে ডেপুটি জেলর সাহেব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন তোমরা সবাই পাগলের মত হাসছো কেনো বা কোলাকুলিইবা করছো কেনো? তোমরাতো মুক্ত নয়, এখনো সামরিক আইনের আওতায় (গখজ) বন্দী। তাকে উত্তরে বলেছিলাম সে আপনি বুঝবেন না, আমরা দোযকখানা থেকে বেহেশতে এসেছি তাই আমাদের এত আনন্দ। আমরা বেঁচে আছি।
পেছনের ইতিহাস, আজ আমরা বুঝতে পারি যে কি ভয়ংকর এক যুদ্ধে আমরা নিরস্ত্র বাঙালিরা লিপ্ত হয়েছিলাম ১৯৭১এ। বিশ্বের সেরা স্বসস্ত্র প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত এক সেনাবাহিনী অথচ নির্লজ্জ জননিন্দিত, যারা নির্বিচারে নিরস্ত্র জনগনকে নির্বিচারে হত্যা করেছে। আমরা তখন হেসে খেলে যুদ্ধ করেছি। বুঝতেই পারিনি আমরা যুদ্ধ করছি। মনে হয়েছে লুকোচুরি খেলা খেলছি। সারাটাদিন বন্ধুরা মিলে আড্ডা মেরেছি আর মিলিটারীর গাড়ী দেখলে সরে পরেছি। আশে পাশের সব অভিভাবকরা ভাবতো বখাটে ছেলে পেলে। আর রাত হলেই নির্দেশ বাস্তবায়নে নেমে পড়তাম, রাতের আধারে নীল আলোর হেড লাইট জ্বালিয়ে এগিয়ে আসা মিলিটারী টহল বহরে ঝাপিয়ে পড়তাম, কখনো বা কোন রাজাকার কমান্ডারের গলা টিপে হত্যা করে বা কখনো কোন বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশন একসপ্লোসিভ দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে এসে যে যার গন্তব্যে এসে লুকিয়ে পড়তাম, আবার পরদিন সকলে বখাটে ছেলেদের হৈ হুল্লোড় আড্ডা। এই ছিলো ঢাকায় আমাদের মত গেরিলা যোদ্ধার গল্প।
২রা সেপ্টেম্বর ১৯৭১, আমি ও আমার সহযোদ্ধা বন্ধু মো: শাহজাহান ঢাকার টেনারী মোড় থেকে রিকশা নিয়ে একটি অপারেশনের জন্যে অস্ত্র-স্বস্ত্র নিয়ে রমনা পার্ক রেস্টুরেন্ট অভিমুখে যাচ্ছিলাম। সেখানে রেস্টুরেন্টে কর্মরত কয়েকজন কর্মী আমাদেরকে এই অভিযানে সহযোগিতা করার অপেক্ষায় ছিলেন। তৎকালিন সময়ে ঐ রেস্টুরেন্ট সেনাবাহিনীর আড্ডাখানা ছিলো। আমাদের যাত্রাপথে তৎকালিন লালবাগ থানা (সায়েন্স ল্যাবরিটরির মোড়ে) সন্নিকটে পাহাড়ারত ঢাকাস্থ নওয়াবগঞ্জ এলাকার রাজাকার বাহিনী কমান্ডার অবণী সওদাগর আমাদের রিকশা থামায় এবং গদির নিচে তল্লাশি চালিয়ে অস্ত্রাদি পেয়ে যায়। এই ফাকে আমার বন্ধু মো: শাহজাহান দৌড়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এখানে উল্লেখ্য যে রাজাকার কমান্ডার আমার সহযোদ্ধার পূর্ব পরিচিত ও কমান্ডার সন্দেহ করতো যে সে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে। রাজাকার কমান্ডার অবনী সর্দার তাকে গ্রেফতার করার উদ্দেশ্যেই থামিয়েছে। তাই তাদের একটি দল তার নেতৃত্বে শাহজাহানের পেছণে দৌড় দিয়েছিলো। তখন অবশিষ্টরা আমাকে এসে জেরা করলে আমি বাচার জন্যে বলেছিলাম যে আমরা দুজনে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে রিকশা ভাড়া করেছিলাম, আমি তাকে চিনি না। আমার কথা রাজাকাররা মেনে নিয়ে যখন চলে যাচ্ছিলো, ঠিক সেই মূহুর্তে রিকশাওয়ালা কেনো জানি বলে ফেললো না ইনারা দুজন একসাথেই রিকশা ভাড়া করেছে। সে হয়তো ভয়ে এই কাজটা করেছে তাই আমি গ্রেফতার হলাম।
যে স্বল্প সময় লালবাগ থানায় ছিলাম সে সময়ে বাঙালি পুলিশ কর্মকর্তা ও কনস্টেবলদের ব্যবহার ছিলো সন্তোষজনক। থানায় কিছুক্ষন পুলিশ কাস্টডিতে থাকার পর সেনাবাহিনী এসে আমাকে তৎকালিন ইপিআর হেডকোয়ার্টার পিলখানায় নিয়ে গেলো। সেখানে ইপিআর প্রধানের কক্ষে নিয়ে গেলে দেখা পেলাম হাত পিছমোড়া করে বাধা রক্তাক্ত শাহজাহানের। সে পালাতে যেয়ে ধানমুন্ডির এক বাসায় পাচিল ডিঙ্গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলো। দূর্ভাগ্যবশত্য বাসাটির অধিবাসী ছিলেন একজন পাঞ্ছাবী মেজর। বন্ধুটিকে বাসার বাঙালী কাজের মেয়ে ¯œানরত অবস্থায় গোছলখানায় লুকিয়ে রেখেও শেষ রক্ষা করতে পারেনি। পরবর্তীতে কাজের মেয়েটির ভাগ্যে কি জুটেছিলো তা আমাদের জানা নেই, তবে তার ঐ সহযোগিতাটুকু প্রমান করে বঙ্গবন্ধুর সেই অমোঘ ডাক “তোমাদের কাছে যা আছে তা নিয়েই শত্রুর মোকাবেলা করবে” শুনে বাংলার সকল স্তরের মানুষ কিভাবে যুদ্ধে শরিক হয়েছিলো।
জেলখানায় ভালো পরিবেশেই সময় কাটছিলো। বিভিন্ন এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের সহচার্য পেয়েছি। তাদের মধ্যে রবীন্দ্র সঙ্গীত গায়ক ইকবাল আহমেদ, রুপবান সিনেমা খ্যাত নায়ক আব্দুল মান্নান, সিনেমা পরিচালক রিয়াজউদ্দিন, বিউটি সিনেমা হলের মালিক প্রাক্তন এমপি এস.এ.খালেক, লেফটেনেন্ট নাসিরউদ্দিন সহ অনেকে। প্রচন্ড খাতির যত্ম পেয়েছি জেল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে, সেই সাথে জেলের কয়েদিদের সেবা মনে রাখার মত। প্রতিদিন সকালে উঠেই সবাই দৌড়াতাম জেল গেটের পতাকা দেখতে। উদ্দেশ্য পতাকা পরিবর্তন হয়েছে কিনা। মাঝে মাঝে অনেকেই মজা করে এপ্রিল ফুল করতো।
কিছুদিন পর জেলখানা থেকে বাসায় চিঠি লেখার অনুমতি দেয়া হলো। শুধুমাত্র উম্মুক্ত পোস্ট কার্ড ব্যবহার করা যাবে এবং সেন্সর করা হবে। একটা চিঠি আমি লিখেছিলাম আমার দুলাভাইয়ের নিকট। চিঠিটা আজো পড়ি আর ভাবি কবি হেলাল হাফিজ এর কবিতা নিষিদ্ধ সম্পাদকিয়তা’র পঙ্কতি “এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়” কথাটি কতটা বাস্তবভিত্তিক। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স কতই বা ছিলো? তখন আমি কলেজে দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র। বয়স পনেরো বছর। কিভাবে কোন দেশপ্রেম আর সাহস নিয়ে লিখেছি ‘আমার জন্যে আপনারা কারো নিকট মাথা নত করবেন না, এটাই আমার অনুরোধ। আমি কোন অন্যায় করিনি’। আজ নিজেকে নিজেই বিশ্বাস করতে পারিনা যে এমন দেশভক্তি মূলক চিঠি আমি লিখেছি। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে লেখা আমার সেই চিঠিটি আমার আজকে লেখার সাথে ছাপিয়ে দেয়া হলো।
স্বাধীনতার দীর্ঘ একান্নটি বছর পার হলেও আজো মিরজাফর-রাজবল্লভদের ষড়যন্ত্র থেমে নেই। ১৯৭৫ সালের আগসট মাসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের এবং ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধ নেতৃত্ব দানকারী অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, স্বারাষ্ট্র মন্ত্রী মনসুর আলি ও মন্ত্রী কামরুজ্জামানকে নৃশংস হত্যার মধ্য দিয়ে ষড়যন্ত্রের বহি:প্রকাশ ঘটে। ১৯৭০ এর নির্বাচনে বাঙালির বিজয় ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সমগ্র বাঙালির একাত্বতা আর মুক্তিযুদ্ধ, গুটি কয়েক দেশ ব্যতিত সমগ্র বিশ্বকে এই ক্ষুদ্র দেশটির পেছনে এসে দাড়করিয়েছিলো। বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর, এক স্বসস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ৩০ লক্ষ শহীদ ও ৩ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে। আজ স্বাধীনতার ৫১তম বার্ষিকীতে, আমাদের স্বাধীনতায় সরাসরি সহযোগিতা ও এক কোটিরও বেশী বাংলাদেশী সরনার্থীদের আশ্রয় দেবার জন্যে, স্বশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরন করছি ভারতের তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে এবং মুক্তিযুদ্ধে নিহত ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যদের। কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরন করছি বন্ধু দেশ সোভিয়েট রাশিয়া ও তার তৎকালিন রাষ্ট্রপতি লিওনিদ ব্রেজনেভকে। আজকের লেখাটি আমার জীবন থেকে নেয়া।
জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু। আজ সবাইকে স্মরন করে দিতে চাই যে এই দুটি শ্লোগান কোন বিশেষ দল বা গোষ্ঠীর একক সম্পদ নয়, সমগ্র বাঙালী জাতির। এই দুটি শ্লোগন ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের বুকে সাহস ও উদ্বুদ্ধকরন শ্লোগান। স্বাধীনতাকে তরান্বিত করার শ্লোগান।
Leave a Comment
Your email address will not be published. Required fields are marked with *