আজকের ঘটনাটা একেবারে অপ্রত্যাশিত, যা কোনভাবেই মেনে নিতে পারেনা আনোয়ার। তাইতো ছোট ভাই, বড় ভাবী, এমনকী ভাইপো- ভাইজিদেরও তার ঘরে পাঠিয়েছে একাধিকবার। কেউ কূল কিনারা করতে পারেনি। তবে কী হাওয়া হয়ে গেল বিস্কুটের প্যাকেটটা! চিন্তার ভাঁজ পড়ে কপালে। যদিও তার কপাল একদম চকচকে কিংবা আগে থেকে কোন ভাঁজ ছিল না একথা বলা মোটেও উচিৎ
আজকের ঘটনাটা একেবারে অপ্রত্যাশিত, যা কোনভাবেই মেনে নিতে পারেনা আনোয়ার। তাইতো ছোট ভাই, বড় ভাবী, এমনকী ভাইপো- ভাইজিদেরও তার ঘরে পাঠিয়েছে একাধিকবার। কেউ কূল কিনারা করতে পারেনি। তবে কী হাওয়া হয়ে গেল বিস্কুটের প্যাকেটটা! চিন্তার ভাঁজ পড়ে কপালে। যদিও তার কপাল একদম চকচকে কিংবা আগে থেকে কোন ভাঁজ ছিল না একথা বলা মোটেও উচিৎ হবে না। তারও সমস্যা আছে। উত্তোরণের পথ বহু বছর ধরে খুঁজে চললেও সমাধান মেলেনি আজো। এখন অবশ্য সেরকম চেষ্টা না করলেও একদম যে করেনা এমনটি নয়। এইতো সেদিনও খোঁজ পেয়ে বড় আশা নিয়ে বাগেরহাটের এক ফকিরের কাছে গিয়েছিল। তার কাছ থেকে তাবিজ এনে গোপনে ঘরের চার কোনায় মাগরিবের আজানের সাথে সাথে এক নিঃশ^াসে পুতে দিয়েছিল। তারপর উৎফুল্ল মন নিয়ে বাজারে যেয়ে পরিচিত দু’চারজনকে চা পর্যন্ত খাইয়েছিল। অথচ রাতে বাড়ির উঠানে পৌঁছাতেই তার কানে ভেসে আসে কোরআন তেলওয়াতের সেই একই সুর! মনটা তার তখনি ভেঙে খান খান হয়ে যায় চৈত্রের মান্দারের বিলের মতো। এবারেও ব্যর্থ তার চেষ্টা। কাছে থাকা ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে ক্লবসিবল গেইট খুলে পাশের ঘরে ঘুমিয়ে থাকা মেয়েকে জাগিয়ে তোলে। দু’জনে রাতের খাবার খেয়ে সেঘরেই ঘুমিয়ে পড়ে অন্যদিনের মতো।
বহু বছর ধরে এমন নিয়ম চলে আসছে। আনোয়ার এখন আর সঠিক দিন তারিখ মনে করতে পারে না। তবে শামসুন্নাহারের বয়স দেড় কী দুই বছর হবে। শ্রাবণের এক বিকেলে শ^শুর বাড়ি রাধানগর থেকে হেঁটে বাড়ি ফিরছিল তারা। আনোয়ারের কোলে ছিল শামসুন্নাহার। বুড়োর বটতলা আসতেই হঠাৎ চারিদিক থেকে কেমন যেন অন্ধকার ধেয়ে আসে। তারপর ঝুমাঝুম বৃষ্টি। তারা বটতলায় আশ্রয় নেয়। বৃষ্টি শেষে বাড়ির দিকে পা বাড়াতেই আনোয়ার অন্য এক হেলেনাকে আবিষ্কার করে। সে এক দৃষ্টিতে উপরে বট গাছের দিকে তাকিয়ে থাকে, কখনও হাসে- কখনও কাঁদে। আনোয়ার বুঝতে পারে সর্বনাশের চূড়ান্ত হতে আর বাকী নেই। এই গাছের দোষ সম্পর্কে অনেকেই জানিয়েছিল। সে-ই কানে তোলেনি। বরাবরই তার এসবে বিশ্বাস ছিল না। সেদিন আর অবিশ্বাস করার সুযোগ তার কাছে না থাকায় তড়িঘড়ি হাত ধরে টেনে হিঁচড়ে হেলেনাকে বাড়ি নিয়ে আসে। বাড়ির বারান্দায় পা রাখতেই সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় মাটিতে। বাড়ির লোকজন ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে খাটের ওপর শুইয়ে দিতেই সেকি জ¦র। সাত দিন পর জ¦র থেকে সেরে উঠে এক রাতে জায়নামাজ পেতে সেই যে কোরআন তেলওয়াত করা শুরু করলো, যা আজো চলছে।
হেলেনা একটি এনজিওর ক্যাশিয়ার হিসাবে তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করলেও ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও স্বামী-সন্তানের প্রতি তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারে না। এ কারণে নীরবে চোখের জল ফেলেছে বহুদিন যা আনোয়ারের অজানা নয়। দিনের বেলা সবকিছু স্বাভাবিক। দেখে মনে হয়, এই বুঝি সে ঠিক হয়ে গেছে। অফিস শেষে আনোয়ার নিজেই মটরসাইকেলে করে তাকে বাড়ি দিয়ে আসে। দু’এক দিন এর ব্যতয় ঘটলেও অধিকাংশ দিনের রুটিন একই। হেলেনার অফিস থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটা রাস্তা পার হয়ে আনোয়ারের কাউন্টার। বাজারের এমাথা- ওমাথা। ঢাকামুখী যাত্রীদের কাছে বাসের টিকিট বিক্রি করে। আগে অবশ্য শুধু একটি পরিবহনের টিকিট বিক্রি করতো। দিন দিন মানুষের চাহিদা মাত্রাতিরিক্ত ছড়িয়ে পড়ায় সব পরিবহন সুপারভাইজারের সাথে সম্পর্ক তৈরি করে। এখন কেউ টিকিট নিতে আসলে তার আর ফেরৎ যাবার সুযোগ নেই। এ কারণে আয়- রোজগার আগের চেয়ে অনেক বেশি।
আনোয়ারের সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হয়নি আজও। যেদিন দিনে পঞ্চাশ টাকা আয় হতো সেদিন যেমন এ্যাশ কালারের গোলগলা টি শার্ট আর অপারেশন থ্রিলার মুভির শেষ দৃশ্যের নায়কের মতো প্যান্ট পরে সপ্তাহ পার করে দিত, এখন দিনে হাজার টাকা আয় হলেও সেই একই অবস্থা। গায়ের পোশাকে নখ দিয়ে আঁচড় কেটে কিছু লিখলে দিব্যি লেখা যায়। গ্রীষ্ম-বর্ষা যাই হোক না কেন, প্যান্ট গুছিয়ে হাঁটু অবধি উঠিয়ে রাখা তার বিশিষ্ট স্বভাব।
ছোট ভাই মনোয়ার মাদ্রাসার শিক্ষক। ক্লাস শেষে অধিকাংশ সময় কাটায় কাউন্টারে। তার পোষাক-পরিচ্ছদ পরিপাটি, তবে গ্রীষ্মের অধিকাংশ দিন যাত্রীদের ভেতরে খালি গায়ে কাউন্টারে বসে থাকায় মাজা অবধি লোমসহ চামড়া খুলে ফেলা পোল্ট্রি মুরগীর মত দেখায়। দুই ভাইয়ের দুই রকম অভ্যাস নিয়ে অনেকে হাসিঠাট্টা করলেও তাতে খুব বেশি সম্মানে লাগেনা তাদের।
রাতের অন্ধকার নামতেই নিজের ওপর আর নিয়ন্ত্রণ থাকে না হেলেনার। ওজু করে জায়নামাজ পেতে কোরআন তেলওয়াত শুরু করে- শেষ হয় ফজরের আজানের কিছু আগে। স্বামী-সন্তান রাতে খেল কী খেলো না, কে কোথায় ঘুমালো কী ঘুমালো না, নিজে ঘুমাতে পারলো কী না; এসব ব্যাপারে তার কোন মাথাব্যথা নেই। আনোয়ার কিংবা শামসুন্নাহার কিছু বলতে গেলেই এক অপরিচিত কণ্ঠ হেলেনাকে জ¦ালাতন না করার জন্যে হুংকার ছাড়ে। যা শুনে ভয়ে বাবা-মেয়ে অন্য ঘরে চলে যায়। ইদানীং এমন হয়েছে যে, ঐ ঘরে রাতে যাওয়া সবার জন্যে নিষেধ। গেলে নাকি বড় ধরণের ক্ষতি হয়ে যাবে। যে ক্ষতি পোষানোর জন্যে কোন সুযোগ থাকবে না।
ফজরের নামাজ পড়ার পর সব আবার আগের মতো। হেলেনা যেন এক আদর্শ স্ত্রী। সে সকালের নাস্তা তৈরি করে স্বামী-সন্তানকে খাইয়ে নিজে খায়। দুপুরের খাবার টেবিলে সাজিয়ে রেখে- নিজের খাবার নিয়ে অফিসে যায়। বছরের পর বছর ঠিকমত ঘুম না হওয়ায় তার চোখের নিচে কালি স্থায়ী বসবাসের বন্দোবস্ত করেছে। শরীর ভেঙে যশোর শহরের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়ি ভৈরব নদীর মতো অবস্থা। অফিসে আগের মতো মন না বসলেও নিজেকে ব্যস্ত রাখতে সে চাকুরীটাকে আঁকড়ে রেখেছে। আনোয়ার অবশ্য অনেকবার বলেছে, চাকুরী ছেড়ে দিতে, সে-ই রাজী হয়নি। হয়তো আনোয়ার মন থেকে বলেনি; তবুও বলেছে তো! হাজার হলেও মাস শেষে অনেকগুলো টাকা সংসারে আসে- যা একেবারে কম নয়।
সামনে এসএসসি পরীক্ষা বলে গত চার মাস যাবৎ শামসুন্নাহার মামা বাড়ি থেকে স্কুলে আসা যাওয়া করে। বড় মামা কলেজের লেকচারার। প্রাইভেট শিক্ষক হিসাবে তার নামডাক খুব। মামা তার কাছে পরীক্ষার এই ক’টা দিন পড়তে বললে শামসুন্নাহার আর না বলেনি।
গতকাল সকালে মেয়ে যখন মোবাইলে এক প্যাকেট ম্যাজিকা বিস্কুট কেনার কথা বলে তখন আনোয়ার অবাক হয়ে যায়। যে মেয়েকে জোর করে খাওয়াতে যেয়েও কষ্ট হয়; সে কিনা বলছে বিস্কুটের কথা! সে রাতে বিস্কুট কিনে বাড়ি নিয়ে টেবিলের ওপর রাখে যেন পরদিন সকালে কাউন্টারে যাবার আগে রাধানগর দিয়ে আসা যায়। ক’দিন হলো হেলেনাও সেখানে রয়েছে। আনোয়ার একা বাড়িতে। ছোট ভাইয়ের বাড়ি তিন বেলা খাওয়ার পর্ব চলে বলে আর আলাদা করে রান্নাবান্না নিয়ে চিন্তা করে না সে।
আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে রাধানগর যাবার সময় দেখে বিস্কুটের প্যাকেটটা নেই। কোথাও নেই তো নেই। টেবিলের ওপর রেখেছিল যা শতভাগ নিশ্চিত। সকলে মিলে ঘরের সমস্ত জিনিসপত্র উলটপালট করে না পেয়ে শেষ পর্যন্ত বাজারে যেয়ে আর এক প্যাকেট বিস্কুট কিনে মটর সাইকেলের হ্যান্ডেলে পলিথিনটা ঝুলাতেই মোবাইল বেঁজে ওঠে। সে প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখে শামসুন্নাহারের ফোন। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে, ‘ধন্যবাদ তোমাকে আব্বু।’
‘কেন! হঠাৎ ধন্যবাদের কী হলো?’ উদ্বেগজনক প্রশ্ন আনোয়ারের।
‘কেন বুঝলে না? সুন্দর বিস্কুট দিয়ে যাবার জন্যে।’
আনোয়ার তো হতবাক। কী বলে মেয়েটা! বলল, ‘আমি বিস্কুট দিয়ে এসেছি?’
‘নয়তো কী। বড় মামী বলল, ভোরে এসে তুমি তার হাতে দিয়ে গেছো।’
‘আমি দিয়ে গেছি!’
‘মামীতো তাই বলল। তোমার নাকি ভীষণ কাজ? আমাদের সাথে দেখা না করেই চলে গেলে!’
আনোয়ার কী বলবে বুঝতে পারে না। সে তো যায়নি। নাকি গিয়েছিল? এক মহা মৌন দ্বিধাদ্বন্দ্বে তার মাথার ভেতরটা চক্কর দিয়ে ওঠে। হঠাৎ হাতের মোবাইলটা মাটিতে পড়ে যেয়ে খুলে কয়েক টুকরো হয়ে যায়। এমনিতেই মোবাইলটা যেন পিরামিড যুগের সাক্ষর বহণ করে চলেছে। তার ওপর মাঝ বরাবর মানি গার্ডারের কয়েকটি প্যাচ দিয়ে রাখা! টুকরোগুলো তুলতে যেয়ে মাটির স্পর্শে অনুভব করে এক অন্যরকম অনুভূতি। যেখানে কিছু আছে অথচ কিছুই নেই।
Leave a Comment
Your email address will not be published. Required fields are marked with *