সামসুল ইসলাম টুকু (বাংলাদেশ থেকে) বর্তমান বিশ্বে ইসলামী অনৈক্য বিপর্যস্ত হবার প্রেক্ষিতে উপরের বিষয়ে কিছু লেখার প্রয়োজন অনুভব করলাম । বিষয়টি শুধু বিশালই নয়, সেই সাথে আন্তর্জাতিক। এ বিষয়ের উপর লেখা আমার মত অর্ধশিক্ষিত মানুষের কাজ নয়। কিন্তু বিষয়বস্ত্তর কথা শুনে আমার মনে অসংখ্য প্রশ্নের উদয় হয়েছে। তাই প্রশ্নাকারেই এ লেখা শুরু করছি। সম্ভবত এসকল
সামসুল ইসলাম টুকু (বাংলাদেশ থেকে)
বর্তমান বিশ্বে ইসলামী অনৈক্য বিপর্যস্ত হবার প্রেক্ষিতে উপরের বিষয়ে কিছু লেখার প্রয়োজন অনুভব করলাম । বিষয়টি শুধু বিশালই নয়, সেই সাথে আন্তর্জাতিক। এ বিষয়ের উপর লেখা আমার মত অর্ধশিক্ষিত মানুষের কাজ নয়। কিন্তু বিষয়বস্ত্তর কথা শুনে আমার মনে অসংখ্য প্রশ্নের উদয় হয়েছে। তাই প্রশ্নাকারেই এ লেখা শুরু করছি। সম্ভবত এসকল প্রশ্নের উত্তরই বলে দেবে বিষয়বস্ত্তর প্রয়োজন আছে কি না। যদি প্রয়োজন থাকে তাহলে এর লক্ষ্য পূরণের জন্য কী করতে হবে সেই দিক নির্দেশনাও খুঁজে পাওয়া যাবে। আসলে ইসলামী ঐক্য বলতে কী বোঝায়? ইসলামী দর্শনের ঐক্য? না ইসলামী দেশগুলোর ঐক্য? না ইসলাম ধর্মের অনুসারী মুসলমানদের ঐক্য? আর দিক নির্দেশনাই বা কার জন্য?
প্রথমে ইসলামী দর্শনের ঐক্যের কথাই ধরা যাক। ইসলামী দর্শন তো পৃথিবীতে একটিই থাকার কথা কিন্তু প্রশ্ন এসে যায় ইসলামী দর্শন যদি একটিই হয় তবে শিয়া, সুন্নী, আহমেদী কাদিয়ানী, হানাফি, সাফেয়ী, হাম্বলী, মালেকীসহ বিভিন্ন গোষ্ঠি ও সম্প্রদায় সৃষ্টি হলো কেন? আর কেনই বা তারা আল্লাহ ও তার রাসূলকে ভিন্ন ভিন্নভাবে মূল্যায়ন করে ও ভিন্ন ভিন্ন তরিকায় ধর্ম পালন করে? শুধু তাই নয় এক আল্লাহ ও তার রাসূলকে কেন্দ্র করে মারামারি, খুনোখুনি, দেশে দেশে যুদ্ধ করে রক্তের হোলি খেলে। এতে তারা কুণ্ঠিত হয় না। বরং উভয়পক্ষই মনে করে তারা ধর্ম রক্ষার জন্য জান কুরবান করে দিল, শহীদ হলো, বড় নেকীর কাজ করলো। খলিফা হযরত আলীর মৃত্যুর পর খলিফার উত্তরসূরী নিয়ে যে ধর্মযুদ্ধ শুরু হলো এবং সেই সাথে ইসলামী দর্শনের যে বিভক্তি শুরু হলো তা ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে। যা শেষ হবার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বর্তমানে মুসলমানদের যে করুণ পরিণতির শিকার হতে হচ্ছে, তাতে মুসলমানসহ ইসলামী দর্শন হারিয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে।
সত্য প্রতিষ্ঠা ও মানুষের কল্যাণের জন্য যে মহান ইসলামী দর্শনের সৃষ্টি হয়েছিল তার মৌলিক বিষয় বাদ দিয়ে আনুসঙ্গিক বিষয়, উপধারা, উপ-উপধারা, তলানী ও গৌণ বিষয় দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতবাদ সৃষ্টি হয়েছে। শুধু তাই নয়, এসব উপধারা মতবাদ সৃষ্টিকারীরা ও অনুসারীরা এমনভাবে ফতোয়া জারী করে যে, তাদের দর্শন না মানলে মুসলমান থেকে খারিজ হয়ে যাবে। যদি খারিজ করেই ক্ষান্ত হতো তবে এত সমস্যা ও বিভক্তি হতো না। সমস্যার উদ্ভব হয়েছে, যখন ওই সকল গৌণ বিষয়কে কেন্দ্র করে আলোচনা, সমালোচনায় না গিয়ে সংঘাতে গেছে। হযরত আলীর প্রয়ানের পর যে হানাহানি, রক্তক্ষয় শুরু হয়েছে তা আজও শেষ হয়নি। ইরাক-ইরান যুদ্ধই তার বড় প্রমাণ। এমন প্রমান অনেক আছে । ঘৃণিত সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দ্বারা ইরাক সরাসরি আক্রান্ত হয়েছিল। তারপরেও কি শিয়া সুন্নীর সংঘাত বন্ধ হয়েছে? না বন্ধ হয়নি। বরং এই সুযোগে অতীতের ঘটনার প্রতিশোধ কিভাবে নেয়া যায় সে পরিকল্পনাতেই ব্যস্ত। এছাড়া বিভিন্ন দেশে চলছে আহমেদি কাদিয়ানী বিরোধ সংঘর্ষসহ বিভিন্ন সম্প্রদায় ও গোষ্ঠিগত সংঘর্ষ। এমনকি কে কোন মুজহাবের অনুসারী সে নিয়েও বিতর্কের শেষ নেই। মুজহাব নিয়েও মারামারি করতে দেখা গেছে। কেউ যদি কোন মুজহাবের অনুসারী হতে না চায় বা এ ধরনের বিভক্তিকে বিশ্বাস না করে তাকে মুসলমান থেকেই বাদ দেয়ার ফতোয়া জারী করতে দেখা যায় কাঠমোল্লাদের। কোন মুজহাব ‘দললীন’ উচ্চারণ করে আবার কোন মুজহাব ‘জললীন’ উচ্চারণ করে। কেউ নামাযে দাঁড়িয়ে বুকে হাত বাঁধে কেউ আবার নাভির কাছে হাত বাঁধে। এমন সব ছোট খাটো ক্রিয়া কর্ম নিয়ে মতামতের শেষ নেই।
ইসলামী তরিকা ও আইন কানুন সমাজে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও আছে ভিন্ন ভিন্ন মত। যেমন তাবলীগ জামায়াত মনে করে সকলকে নামাজের দাওয়াত দিয়ে এবং পরকালের সুখের কথা বলে নামাজী করা যায় তাহলে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা সহজ হবে। এরা আবার ঘর সংসার ত্যাগ করে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য নিবেদিত হতে চায়। দীর্ঘকাল ধরে তাবলীগ জামায়াত এ কর্মসূচী অব্যাহত রেখেছে। আজকের এই ইসলাম বিপর্যয়ের মুখে তাদের ওই কর্মসূচীর ফলাফল মূল্যায়ন করার সময় আসেনি কি? তাদের সফলতা কতটুকু, ব্যর্থতা কতটুকু, কোন পথ গ্রহণ করলে আরও অগ্রসর হওয়া যাবে এ মূল্যায়ান তাদের নিজেদের জন্যই করার প্রয়োজন, যদি সত্যিই তারা ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে। জামায়াতে ইসলামীরা মনে করে দেশব্যাপী সংগঠন গড়ে তুলে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে একদিন অবশ্যই ক্ষমতায় যাবে এবং ইসলাম প্রতিষ্ঠা করবে, দেশে ইসলামী আইন কানুনের প্রচলন করবে। পার্লামেন্টে গিয়েও ধন সম্পদ ও প্রাচুর্যের মধ্যে থেকে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা যে আদৌ সম্ভব নয় তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। সংগঠন করে নির্বাচনের মাধ্যমে আসন সংখ্যা বৃদ্ধি হতে পারে কিন্তু নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা পাওয়া সম্ভব নয় তা দেশের রাজনৈতিক পরিমন্ডলই বলে দেয়। তাছাড়া ইসলাম বিরোধীরা ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা ক্ষমতায় যাবার জন্য তাদের পথ সুগম করে দেবে এমন ভাবার কোন সুযোগ নেই। সমাজে একটি দর্শনের প্রতিষ্ঠা করতে হলে সংগঠনের কর্মীকে ওই দর্শনের এক একটি মডেল হিসেবে গড়ে উঠতে হয়, দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হয়। এমন দৃষ্টান্ত স্থাপনে জামায়াতে ইসলামির ভূমিকা কতখানি তারাই বলতে পারবে।
বর্তমানে বেসকিছু জঙ্গি সন্ত্রাসী সংগঠনের আবির্ভাব হয়েছে। তারা ইসলাম ও সুন্নাহ অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করতে চায়। এজন্য তারা সারা দেশব্যাপী তাদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করেছে। এরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালিয়ে জানান দেয় যে তারা ইসলামী বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত । এরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সাথে যুদ্ধ করে , প্রান হারায় , ধরা পড়ে । কাজের কাজ কিছুই হয়না । কিছুদিন চুপ থাকে । আবার আত্মপ্রকাশ করে ইসলাম ও সুন্নাহর আইন চালু করার কথা বলে । সাধারণ মানুষের কাছে এ পথের গ্রহণযোগ্যতা বা জনসমর্থন আছে কি না? যদি তা না হয় তবে তাদের এসব আত্মঘাতি ও জীবনদানের কর্মসূচী কোন লক্ষ্যে ও কার স্বার্থে পরিচালনা করছে তা ভেবে দেখার সময় এখনই। অন্যথায় ইসলাম কায়েম না হয়ে, হয়তো এ সুযোগে কোন অশুভ শক্তির ক্ষমতায় আসার পথ সুগম হবে। এ সকল সংগঠন ছাড়াও পীরদের সংগঠনও আছে। তারাও সাংগঠনিকভাবে দুর্বল নয়। তারাও মনে করছে ইসলাম কায়েমের জন্য তারা নিবেদিত। পীরের আস্তানায় মুরীদের যাতায়াত ও অর্থব্যয় নেহায়েত কম নয় এবং পীরদের প্রতি মুরীদদের বিশ্বাস ও আস্থা বেশ শক্ত।
এসব সংগঠনের ও দলের ভিন্ন ভিন্ন মত ও পথের ঘর্ষণে ইসলামের অবস্থা চিড়া চ্যাপ্টা হয়ে গেছে। উপরে উল্লেখিত এই যে দর্শন বিভক্তি এর অবসান হবে কি? ইসলামের মৌলিক দর্শন নিয়ে এসব বিভক্তিকারীদের মধ্যে আদৌ কোন ঐক্য সম্ভব কি? তাহলে আসল ইসলাম দর্শনটা কী? এ বিষয়টি কি ইসলামী চিন্তাবিদ ও দার্শনিকদের কাছে স্পষ্ট? যদি ষ্পষ্ট হয় তবে কেন তারা এই দর্শন বিভক্তির সমাপ্তি টানতে পারছে না? প্রকৃতপক্ষে ইসলামের মৌলিক দর্শনের প্রতি প্রাধান্য না দিয়ে গৌণ বিষয় নিয়ে ইসলামী চিন্তাবিদরা গোঁড়ামীর অতল তলে ডুবে গেছে। তাই ইসলামের মৌলিক বিষয়টি কী তা স্থির করার জন্য ইসলামী দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের ঐক্যের প্রয়োজন আছে কি? পাঠকদের কাছে এটাও আমার জিজ্ঞাসা।
এরপর ইসলামী দেশগুলোর ঐক্য প্রসঙ্গে আসি। কোন দেশগুলো ইসলামী দেশ সেটাই প্রথমে নিরুপিত হওয়া প্রয়োজন। যে সকল দেশে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ সেগুলোই কি ইসলামী দেশ? অথবা যে সকল দেশের নামের পূর্বে ইসলামিক রিপাবলিক রয়েছে সেগুলো ইসলামী দেশ? অথবা যে সকল দেশে ইসলামিক সংবিধান চালু রয়েছে সেগুলো ইসলামি দেশ? অথবা পূর্ব পুরুষদের ইসলাম ধর্ম প্রচারের সূত্র ধরে যেগুলো ইসলামিক দেশ, সেগুলো।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, কোথাও গণতান্ত্রিক বিচার ব্যবস্থা, কোথাও একনায়কতান্ত্রিক বিচার ব্যবস্থা, কোথাও সমরতান্ত্রিক বিচার ব্যবস্থা, কোথাও রাজতান্ত্রিক বিচার ব্যবস্থা, কোথাও সমাজতান্ত্রিক বিচার ব্যবস্থা চালু রয়েছে। ইসলামী দর্শন গণতান্ত্রিক বিচার ব্যবস্থা আংশিক পছন্দ করলেও পরবর্তী ৪টি বিচার ব্যবস্থাকে ঘৃণার দৃষ্টিতে বিচার করে। কারণ সেগুলো ইসলামী বিচার ব্যবস্থার পক্ষে নয়। সুতরাং এ রাষ্ট্রগুলোর পক্ষে ঐক্যমত হওয়া কি আদৌ সম্ভব?
ইসলামিক রিপাবলিক নামধারী এবং ইসলামি সংবিধান চালু রয়েছে এমন দেশগুলোতে কি নিছক ইসলামী বিচার ব্যবস্থা চালু রয়েছে? না ইসলামী বিচার ব্যবস্থার সাথে আধুনিক রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক বিচার ব্যবস্থা যোগ করা হয়েছে অথবা বৃটিশের দেয়া বিচার ব্যবস্থাই চালু রয়েছে? এসকল প্রশ্নের উত্তরে যা বেরিয়ে আসবে তা হলো কোন ইসলামীক দেশেই নিছক ইসলামী আইন, বিচার বা সংবিধান চালু নেই। প্রেক্ষিতে প্রশ্ন হচ্ছে- ইসলামী বিচার ব্যবস্থা কি পূর্ণাঙ্গ নয় হেতু আধুনিক বিচার ব্যবস্থার সহযোগীতা নিতে হয়েছে? অথবা ওই সকল দেশের রাষ্ট্রনায়কদের ইসলামী বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে অপর্যাপ্ত জ্ঞান? অথবা ইসলামী চিন্তাবিদ ও দার্শনিকরা তেমন একটি বিচার ব্যবস্থার রূপরেখা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন? আমি জানিনা যদি তেমন পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা থাকে তবে কেন তথাকথিত ওই সকল ইসলামী দেশের রাষ্ট্রনায়করা তা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে না? যারা নিজেরা ইসলামী বিচার ব্যবস্থা তথা ইসলামী আইন ও সংবিধান স্ব স্ব দেশে প্রতিষ্ঠিত করতে উৎসাহ বোধ করে না তারা কিভাবে ইসলামিক রাষ্ট্রগুলোর ঐক্য গড়বে?
ইসলাম কায়েমের পীঠস্থান হিসেবে ধরা হয় আরব দেশগুলোকে। রুক্ষ, কঠিন, লু হাওয়ার পোড় খাওয়া মানুষরাই ওই দেশগুলোতে নবী ও রাসুল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন এবং ইসলাম কায়েম করেছেন। পূর্বপুরুষের সূত্র ধরে আজও সেগুলো ইসলামী দেশ হিসেবে চিহ্নিত। তাতে সেখানে যদি রাজতন্ত্র থাকে তবুও একনায়কতন্ত্র থাকে তবুও। মাওলানাদের বলতে শুনেছি ওই দেশগুলোর প্রতি আল্লাহর অশেষ রহমত ছিল বলেই সেখানে বার বার নবী ও রাসুল প্রেরণ করেন। এদিকে ইসলামের ইতিহাস বলে ওই সকল দেশেই সবচেয়ে অরাজক, কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও আইয়ামে জাহেলিয়াত যুগের উত্থান হয়েছিল। আর ওই ঘৃণিত যুগের পরিবর্তনের জন্য নবী রাসূলরা এসেছেন ও ইসলামী বিপ্লব করেছেন। এ সকল আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিভিন্ন কারণে প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে বিরাজ করে বিভেদ, বৈরী মনোভাব ও ঘৃণা। যা এই রাষ্ট্রগুলোর ঐক্যের জন্য বড় বাধা নয় কি? এরা নিজেদের মধ্যে ঐক্য না করে বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও অমুসলিম দেশগুলোর সাথে আতাত করে। তাতে সেটা ইসলামী দেশ না হলে ক্ষতি কী? অথবা ইসলামী দেশের বড় শত্রু হলেই ক্ষতি কী? এদের কাছে অর্থ ধন সম্পদই সবকিছু। ইসলামী দর্শন এদের জন্য কঠিন। কারণ এ দর্শনকে মনে প্রাণে বিশ্বাস ও গ্রহণ করলে ধন সম্পদ প্রাচুর্য ও বিলাসিতা ত্যাগ করতে হবে। কিন্তু আল্লাহর রহমতে এরা পেয়েছে তেলের মত বিশাল সম্পদ যার প্রাচুর্যে এরা বিলাসিতায় ডুবে গেছে। অর্থের গর্বে এরা অন্য গরীব দেশের মানুষগুলোকে মিসকিন বলতে কুণ্ঠিত নয়। মনে ও চরিত্রে এদের প্রচন্ড অহঙ্কার। এরা তেল সম্পদ থেকে অর্জিত অর্থ নিজের দেশে রাখে না। সাম্রাজ্যবাদী দেশের ব্যাংকে রেখে তাদের সমৃদ্ধ করে। তাতেও তাদের তুষ্টি নেই। তারা সাম্রাজ্যবাদের তলপীবাহক, তোষামোদকারী ও পাঁ চাটা হয়ে পাশের মুসলিম দেশকে আক্রমণ করে। নিজের অর্থ নষ্ট করে সাম্রাজ্যবাদী সৈন্য পুষে, সেই সৈন্যদের পৈশাচিক লালসা পূরণ করে। বোমা ফেলতে ফেলতে যদি পাশের ইসলামী দেশকে জনহীন মরুভূমিতে পরিণত করে তার পরেও ইসলামী ঐক্য ও সাম্যের কথা এদের মনে উদয় হবে না। তেল সম্পদ গর্বিত আরব মুসলিম দেশগুলোর পাশের ইসলামী দেশের মানুষ অভাবে, অনটনে, দুর্ভিক্ষে শেষ হয়ে যায় তবুও তারা তাদের পাশে দাঁড়ানোর প্রয়োজন অনুভব করে না। এরা ইসলামী ঐক্য কিভাবে গড়বে? পাঠকরাই এর বিচার করবেন।
ইসলামী দেশগুলোর সংবিধানে অথবা তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে নূন্যতম এই বিষয়টি যদি লিপিবদ্ধ করা হতো যে, কোন মুসলিম দেশ অন্য কোন অমুসলিম দেশ কর্তৃক আক্রান্ত হলে বিশ্বের সকল মুসলিম দেশ ঐক্যবদ্ধভাবে তা প্রতিহত করবে। তাহলে মুসলিম দেশগুলো আজ পড়ে পড়ে মার খেতো না আমেরিকার কাছে। নামকাওয়াস্তে এ সকল মুসলিম দেশের রাষ্ট্রনায়কদের ওই ধরণের মূল্যবোধে বিশ্বাস করে বলে মনে হয় না। আমেরিকার ভয়ে ভীত এ রাষ্ট্রগুলোকে একের পর এক আক্রমণ করছে আমেরিকা। ধ্বংস করছে, মুছে দিচ্ছে ইসলামী ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, আলবেনিয়ার মত দেশগুলোর মানুষরা না হয় শুনে মুসলমান বা পরে ইসলাম গ্রহণ করেছে। এ দেশগুলোতে ইসলামিক মডেল নাও হতে পারে। কিন্তু আরব দেশগুলো তো ইসলামের পীঠস্থান, সরাসরি নবী রাসুল আবির্ভূত হয়েছেন, সে দেশগুলোর একটিও কেন আজ পর্যন্ত ইসলামিক মডেল রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলো না? এ রাষ্ট্রগুলোতে না আছে ইসলামী আইন কানুন, সংস্কৃতি না আছে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর প্রতি ভ্রাতৃত্ববোধ। ইসলামী চিন্তাচেতনা ও মূল্যবোধ থেকে বহুদূরে সরে গেছে। এ মুসলিম রাষ্ট্রগুলো পরস্পরের মধ্যে অন্ততপক্ষে যদি ইসলামীক শিক্ষা সংস্কৃতি চিন্তা চেতনা বিনিময় করতো, নিজেদের সম্পদ নিজেদের মধ্যে বিলিবন্টন করে নিজেদের সমৃদ্ধ করতো তাহলে মুসলমানরা সম্ভবত বিশ্বের অন্যান্য ধর্মাবলম্বী, জাতি, গোষ্ঠির কাছে এমন ধিকৃত হতো না। বরং শক্তিশালী জাতি হিসেবে পৃথিবীতে স্থান করে নিতে পারতো। সমগ্র মানব গোষ্ঠির জন্য নিয়ামক ভূমিকা পালন করতে পারতো। সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা আজ লাঠি ঘোরাতে পারতো না। তার লোলুপ হিংস্র চেহারা দেখানোর সুযোগ পেতো না। সেখানে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর ঐক্যই একটা অসম্ভব ব্যাপার হয়ে যায়নি কি?
এবারে আসা যাক বিভিন্ন মুসলিম দেশের মুসলমানদের ঐক্য সম্ভব হয় কি না। এটি বোধ হয সবচেয়ে দূরুহ ও কঠিন কাজ। এ জন্যই যে, আন্ত মুসলিম দেশগুলোতে অভিন্ন ইসলামী দর্শন নিয়ে গবেষণা করে এমন কোন রাজনৈতিক দল বা চিন্তাবীদেদের অস্তিত্ব নেই। এ সকল রাজনৈতিক দল, সংগঠন, গবেষক, চিন্তাবীদরাই মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে যোগসূত্র সৃষ্টিতে সাহায্য করতে পারে। ইসলামী দর্শন নিয়ে সমন্বিত গবেষণা ও প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে দিক নির্দেশনা দিতে পারে। সেই সাথে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে একই দর্শনের ছায়াতলে নিয়ে আসার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু সেটাও আজ অনুপস্থিত। সুতরাং এ মূহূর্তে ইসলামী ঐক্য মোটেও সহজ নয়। আমার এক বন্ধু প্রায়ই বলেন, মূসলমানরা যেদিন থেকে হৃদয়ে জেহাদ আর কোমরে নাঙ্গা তরবারী ছেড়ে দিয়ে হৃদয়ে ভীতি, মাথায় টুপি আর হাতে তসবীহ গ্রহণ করেছে সেদিন থেকে ইসলাম ক্রমশ দূরে সরে যেতে শুরু করেছে। কুরআনের ভাষায় বলা হয়েছে আল্লাহ মানুষের উপর বিভিন্ন কাজের ভার অর্পণ করেন। এর মধ্যে যারা সবচেয়ে সহজ কাজটি গ্রহণ করে তারা সবচেয়ে দুর্বল ঈমানের লোক। আর যারা কঠিন কাজটি করার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে তারাই প্রকৃত মুমিন মুসলমান। এ প্রসঙ্গে বলা যায় সমাজে সত্যের প্রতিষ্ঠা, ন্যায়ের জন্য জেহাদ ও ব্যাপক মানুষের কল্যাণের কাজগুলো সত্যিই কঠিন। পরলোকের সুখ পাবার জন্য নামাজ রোজাসহ বিভিন্ন ইবাদতের ব্যাপকভাবে পরামর্শ দেয়া হয় মিলাদ মাহফিলে মসজিদে ও জালসায়। আমরা এ সকল সহজ কাজগুলো করে পুলসিরাত পার হয়ে পরলোকে স্থায়ী শান্তির খোঁজে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছি।
অন্যদিকে সত্যের প্রতিষ্ঠা, ন্যায়ের জন্য জেহাদ ও মানুষের কল্যাণের জন্য উৎসর্গ করার যে ইসলামী দর্শন তা থেকে আমরা দূরে সরে গেছি। যা ইহলোকেও অনাবিল আনন্দ শান্তি ও তৃপ্তি দিতে পারে। বর্তমান যুগের ইসলামী ধারক বাহকদের এক্ষেত্রে না আছে তেমন কোন দৃষ্টান্ত না আছে মানুষের কাছে কোন আবেদন। এ কাজগুলো শুধুমাত্র ব্যক্তির জন্য নয়। মূলত তা হচ্ছে সমাজের জন্য, দেশের জন্য ও বিশ্ব মানবতার জন্য। বা শুধু ইসলামী দেশগুলোকেই নয়, বিশ্ব মানবকে ইসলামী সাম্যের পতাকা তলে আনা সম্ভব। অথচ সে কাজেই আমরা সংকুচিত। এগুলোই আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বড় ইবাদত। কিন্তু এত কঠিন ইবাদত করে বেহেশতে যাবার ইচ্ছে আমাদের নেই। একজন মুসলমানকেও নাকি দোযখে যেতে দেবেন না আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)। এমন কথা বলতে শুনি কাঠ মোল্লাদের। যদি সেটা সত্যিই হয় তাহলে তো আমাদের আর কিছুই করার থাকে না। শেষ পর্যন্ত বেহেশতে যাবই মুসলমান বলে। অতএব ইসলামের কী হলো, দেশ ও জাতির কী হলো তা ভেবে লাভ কী? আর এমনটা যদি আমাদের মনে গভীরভাবে স্থান পায় তাহলে ইসলামের তথা মুসলমানের করুণ পরিণতি দেখা ছাড়া আমাদের কিছু করার থাকবে না।
সর্বোপরি ইসলাম যদি এত সহজ হতো, বেহেশত পাওয়া যদি সহজ হতো তাহলে নবীজী (সঃ) শুধু নামাজ পড়ে ও হেরা পাহাড়ের গুহায় এবাদতে মশগুল হয়ে কটিয়ে দিতে পারতেন সারাটা জীবন। ২৭টি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেন না। হিজরত করতেন না, মানব কল্যাণের জন্য মিথ্যার বিরুদ্ধে, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে জেহাদ করতেন না। তিনি জেহাদ করেছেন লোভ লালসার বিরুদ্ধে, অরাজক সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, সকল কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। নিজেকে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য জনমত গঠন করেছেন। কাফেরদের আরব রাষ্ট্রের মধ্যে অত্যান্ত সযতনে ইসলামীক রাষ্ট্র কায়েম করেছেন। ইসলামের পক্ষের সকল শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন। এসব কিছুই করেছেন জেহাদকে পুঁজি করে এবং এক আল্লহ ছাড়া অন্যের ভয়ে ভীত না হয়ে। আমরা করছি কী? একটা ছোট গল্পের মাধ্যমে তা বলবো। এক গ্রামে ইসলাম মানে এক লোক বাস করতো। তার পেশা ছিল চুরি করা। ইসলামপুর গ্রামের এক বাড়ীতে রাতে চুরি করতে গিয়ে ওই বাড়ীর নতুন খোঁড়া কুঁয়াতে হুড়মুড় করে পড়ে যায়। ওঠার কোন উপায় না পেয়ে সে চিৎকার শুরু করলো। ইসলাম ডুবে গেলরে ভাই ইসলাম ডুবে গেল, বাঁচাবিতো ছুটে আয়। এ চিৎকারে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা নিজ নিজ বাড়ী থেকে বেরিয়ে এলো। সকলে পরামর্শ করলো এতগুলো মুসলমান থাকতে ইসলাম ডুবে যাবে তা হতে পারে না। তাই তারা চিৎকার লক্ষ্য করে এগিয়ে গেল। কুঁয়া থেকে আওয়াজ আসছে বুঝতে পেরে কুঁয়াতে রশি ও বাঁশ নামানো হলো এবং তাতে ইসলাম চোর উঠে এলো। ইসলাম চোরকে তারা খানিক উত্তম মাধ্যম দিয়ে ছেড়ে দিল।
আজ আমরাও ইসলাম ডুবে যাবার আশঙ্কায় চিৎকার করছি। ইসলাম রক্ষার জন্য জীবন দিতেও প্রস্ত্তত রয়েছি। কিন্তু রক্ষা হচ্ছে না। ইসলাম ডুবতে ডুবতে হয়তো এক সময় অন্ধকার নেমে আসবে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে আসলে কি ইসলাম ডুবছে? আমি দৃঢ়চিত্তে বলছি ইসলাম ডুবে না। ইসলাম একটি মহান দর্শন। পৃথিবীর অন্য যে কোন দর্শনের চেয়ে উন্নত। দর্শন কখনো ডুবার জিনিস নয়, হারিয়ে যাওয়ার নয়। যতদিন মানব সভ্যতা থাকবে ইসলামও ততদিন থাকবে। আসলে আমরাই মুসলমান দাবীকারীরা ব্যক্তি জীবনে সমাজ জীবনে ইসলামী চিন্তা চেতনা থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। আর চিৎকার করছি ইসলাম সরে যাচ্ছে। ইসলামের সবচেয়ে সহজ কাজগুলো গ্রহণ করছি তাও মনে প্রাণে ঈমানের সাথে নয়। আর ইসলামের কঠিন কাজগুলো গ্রহণই করছি না কারণ সেগুলো সমষ্টিগত ব্যাপার তাতে ত্যাগের এমনকি আত্মত্যাগের বিষয়টি আছে। যেখানে ত্যাগ নেই সেখানে আদর্শ নেই। দর্শন নেই।
এমনি দূর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে ইসলামকে রক্ষা করতে হলে ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে ইসলামী দার্শনিক, চিন্তাবিদ ও রাজনীতিবিদদের সকল গোঁড়ামী পরিহার করে ঐক্যবদ্ধ হবার কোন বিকল্প আছে কি? পাশাপাশি এ দর্শনের মুখপাত্রদের প্রত্যেককে সত্য, ন্যায় ও মানব কল্যাণে নিবেদিত হতে হবে, দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে সমাজে যার আলোকে মানুষ আকৃষ্ট হবে।
লেখক –সাংবাদিক
Leave a Comment
Your email address will not be published. Required fields are marked with *