বৌদ্ধ ধর্ম ও অষ্ট্রেলিয়ার নান তিয়েন টেম্পল: সামসুল ইসলাম টুকু

 

বৌদ্ধ ধর্ম

ঈসা নবী বা খ্রিস্টের জন্মের ৫০০ বছর আগে বৌদ্ধ ধর্মের জন্ম হয় এবং তা বিস্তৃত হয় উত্তর ও দক্ষিনপূর্ব এশিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে। সে সময় বিশ্বে অন্যান্য ধর্মের অস্তিত্ব ছিলনা। আমি বলতে চেয়েছি, বিশেষত খ্রিস্ট ধর্ম এবং ইসলাম ধর্মের কথা। তবে সে সময় বিভিন্ন দেশের মানুষেরা কোনো ধর্ম পালন করেনি তা নয়। তখনকার দেশের রাজা মহারাজারা যেভাবে প্রজাদের চলাফেরা করতে বলতো সেটাই ছিল ধর্ম। বিশেষ কোনো ধর্মগুরু ছিল না। বিশ্বজোড়া সেই ধর্মহীন যুগে বৌদ্ধ ধর্মের অহিংস বাণী মানুষকে আকৃষ্ট করে এবং অতি দ্রুত বিরাট এলাকা জুড়ে বিস্তার লাভ করেছিল যা অন্য কোন ধর্মের ক্ষেত্রে হয়নি। আর সে ধর্ম প্রচার করেছিলেন সেই ধর্মের স্রষ্টা গৌতম বুদ্ধ বা সিদ্ধার্থ গৌতম। তিনি হাজার হাজার মাইল পথ পায়ে হেঁটে প্রচার করেছিলেন।

খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৬-৪৮০ সালের যে কোনো সময়ে নেপালের লুম্বিনি যা পূর্ব গাঙ্গেয় সমতল ভূমির পুরনো শহর কপিলাবস্তু নামে পরিচিত সেখানকার এক রাজ পরিবারে গৌতম বুদ্ধ জন্ম গ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন রাজা শুদ্ধোধন এবং মা ছিলেন রাণী মায়া। বাক্যকাল থেকেই তিনি ছিলেন ভাবুক প্রকৃতির এবং একাকী থাকতে ভালবাসতেন। তিনি তার বাবার রাজকাজে মন বসাতে পারেননি। রাজাদের মধ্যে হানাহানি, যুদ্ধ, রক্তক্ষয়, সামাজিক অনাচার তাকে দগ্ধ করেছিল। তাই ২৯ বছর বয়সে গৃহ ত্যাগ করেন এবং দূরে এক বোধি বৃক্ষের নিচে ধ্যানমগ্ন থাকেন। ৩৫ বছর বয়সে তিনি সিদ্ধিলাভ করেন। মানুষের জীবনটা কেমন হবে সেটাই ছিল তার সিদ্ধি লাভের মুল বিষয়। পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য যেমন খাদ্য, আশ্রয়, পোষাক ও ঔষধের প্রয়োজন, তেমনি সুস্থ জীবনের জন্য কিছু নিয়মনীতি মেনে চলতে হবে। সেগুলো হচ্ছে প্রাণনাস থেকে বিরত থাকতে হবে, যৌন অনৈতিকতা থেকে মুক্ত থাকতে হবে বা সংযমী হতে হবে, মিথ্যা বলা থেকে বিরত থাকতে হবে, চুরি করা থেকে বিরত হতে হবে এবং মদ্যপান বর্জন করতে হবে। তার ধর্মে ছিল না পারলৌকিক ভয় ভীতি, ছিল না পুনর্জন্মের যন্ত্রণা। ছিল নিয়ম নীতির কথা, মানুষের কল্যাণের কথা। যেখানে মানুষের মোক্ষম লাভ হবে, নির্বাণ লাভ হবে, মৃত্যুর পরেও অমরত্বের পথে যেতে পারবে। সিদ্ধার্থ গৌতমের জীবদ্দশায় বৌদ্ধ ধর্মের দ্রুত বিস্তার লাভের পেছনে যেসব ঐতিহাসিক কারণ ছিল সেগুলো হচ্ছে, সেসময় সাধারণ মানুষের জন্য গ্রহণযোগ্য ধর্ম ছিল না, সাধারণ মানুষ রাজা মহারাজা দ্বারা অত্যাচারিত ছিল, তাদের কোনো আশ্রয় দাতা ছিল না, ব্রাহ্মন্য বাদ ছিল খুবই স্বল্প সংখ্যক অভিজাতদের এবং সেখানে কর্তৃত্ববাদিতা, বর্ণ বৈষম্য, শোষণ, ছল চাতুরি ও কল্পনায় ভরা এবং সাধারণ মানুষের ধরা ছোয়ার বাইরে। ফলে এসব অবহেলিত মানুষেরা দলে দলে বৌদ্ধ ধর্মের সুশীতল ছায়ায় আসে ও দিক্ষা গ্রহণ করে। বৌদ্ধ ধর্মের মৌলিক বিষয়গুলো সাধারণ মানুষের কাছে খুবই গ্রহণযোগ্য ছিল। ছিল সাধারণ মানুষের আশ্রয়স্থল। সর্বোপরি সিদ্ধার্থ গৌতমের চারিত্রিক বৈশিষ্ট মানুষকে বেশি আকৃষ্ট করে। সেগুলো হলো, তার ব্যক্তিত্ব, ধীর স্থির শান্ত স্বভাব, দূর দূরান্ত থেকে পায়ে হেঁটে মানুষের কাছে যাওয়া, জাতপাত ভেদাভেদ না করা, নৈতিক শিক্ষা, ধর্মের জন্য অর্থ ব্যয় না করা, সেবামূলক উপদেশ, সুশৃঙ্খল হওয়া, পরোপকার করা, অহিংস হওয়া, আশক্তি ক্ষয় করা প্রভৃতি। তাছাড়া পিছিয়ে পড়া নিপীড়িত মহিলারাও পেয়েছিল নিশ্চিত ও নিরাপদ আশ্রয়। কালের প্রেক্ষাপটে বৌদ্ধ ধর্মের আকর্ষণীয় বাণী সমূহ ছাড়িয়ে পড়েছিল শিল্ক রোড দিয়ে চীন কোরিয়া এবং সমুদ্র পার হয়ে জাপানে। বাঙলার পার্বত্য চট্টগ্রামের রাখাইন, চাকমা তনচংগ্যা, মারমা সম্প্রদায়ের মধ্যে এবং আরাকান এলাকায় এ  ধর্মের বিস্তার ঘটে। এরপর তিব্বত, লাওস, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড বার্মা এবং বাঙলায় এমনকি শ্রীলঙ্কায়। চীন ও জাপান ছিল দীর্ঘকালের রাজা শাসিত। তাই সেখানে বৌদ্ধ ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে তাদের যুদ্ধ করতে হয়েছে। বিপরীতে যে দেশ থেকে এই ধর্মের জন্ম তথা ভারতেই এই ধর্মের বিস্তার ঘটেনি। বাঙলায় গড়ে উঠেছিল দুটি বিশাল বৌদ্ধ বিহার। নওগাঁয়ের পাহাড়পুর বা সোমপুর বিহার এবং কুমিল্লার ময়নামতিতে শালবন বিহার। এই বৌদ্ধ বিহারগুলো পুরনো ইটের মজবুত গাঁথুনির বিশাল ইমারত। এসব বিহারে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা যেমন ধর্ম প্রচারের জন্য আসতো তেমনি এখানে ধর্মীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। বাঙলার পাল রাজাদের সময় পর্যন্ত বৌদ্ধরা নিরাপদে ছিল। কিন্তু সেন বংশের কট্টর হিন্দু রাজারা বাঙলার ক্ষমতায় আসার পর বৌদ্ধদের উপর আক্রমন চালিয়ে যেমন বৌদ্ধদের হত্যা করেছিল তেমনি তাদের এই বিশাল বিহারগুলো ধ্বংস করে দেয়। এরপর সেন রাজাদের পরাজিত করে তুর্কী সেনা ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজী ক্ষমতায় আসার পর ভারতের বিহারে রাজগিরিতে অবস্থিত বৌদ্ধদের নির্মিত বিখ্যাত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে ধ্বংস করে দেয়। জ্ঞানের পর্বত নামক বিশাল লাইব্রেরিকে পুড়িয়ে দেয় ও প্রচুর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের হত্যা করে। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা প্রাণভয়ে ভারত ছেড়ে তিব্বত ও নেপালে পালিয়ে যায়।

 

নান তিয়েন টেম্পল

অষ্ট্রেলিয়া ভ্রমণের সময় একটি বৌদ্ধ মন্দির দেখার সুযোগ হয়েছিল। অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী আমার বন্ধুর মেয়ে পারভিন পরিবারের সাথে আমার ছেলের পরিবার একসাথে ওলনগং ব্লোহোল দেখতে যাওয়ার পরিকল্পনা হলো। এ  জন্য যাওয়ার আগেরদিন উভয় পরিবার যার যেমন খুশি খাবার তৈরি করে নিল। অবশ্য এ ব্যাপারে আমার বউমা ও পারভিন সমন্বয় করে নিল। পারভিনেরা থাকতো ইঙ্গেল বার্নে আর আমার ছেলেরা থাকতো কয়েক কিলোমিটার ব্যবধানে মিন্টোতে। তাই যাওয়ার দিন মোবাইলে কথা বলে যোগাযোগ করে একত্রিত হলাম। দুই পরিবার দুটি গাড়িতে করে একইসাথে যাত্রা শুরু হলো। রাস্তার দুপাশে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে উঁচু নিচু পাহাড় অতিক্রম করে এবং মাঝে মধ্যে গাড়ি থামিয়ে ছবি তুলতে তুলতে আমরা এক সময়ে সমুদ্র কিনারে ব্লোহোলে পৌছালাম। ব্লোহোলের গল্প ইতোপুর্বে সুপ্রভাত সিডনীতে লিখেছি তাই সে প্রসঙ্গে পুনরায় কিছু বলছি না। যাইহোক, সেখানে বেশ কিছু বাংলাদেশিকে দেখলাম, কথা বললাম। তারপরে সেখানে দুপুরে দুই পরিবার পেট ভরে খেয়ে আমরা আবার নান তিয়েন মন্দিরের দিকে অগ্রসর হলাম। প্রায় ঘটা দেড়েক পরে সেখানে পৌছালাম। সেখানে পৌছে নান তিয়েন মন্দির দেখে আমি থ হয়ে গেলাম। সুন্দর নক্সা ডিজাইন করা কারুকার্য বিশিষ্ট পাশাপাশি ৩টি বিশাল উঁচু ভবন সত্যিই মনোমুগ্ধকর। প্রায় ৪ তলা পরিমাণ সিঁড়ি বেয়ে উঠে সেই ভবনের নাগাল পাওয়া যায়। এই ভবনগুলো দেখে মনে হলো রাজপ্রাসাদ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নয়। নিচে সাঁন বাঁধানো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বিশাল চত্বর। নানা ফুলগাছে সুশোভিত এ চত্বর, সেইসাথে বিভিন্ন জাতের লম্বা লম্বা গাছ। এ ভবনগুলোর নিচের তলাগুলোতে রয়েছে একশত কক্ষ, যেখানে বৌদ্ধ ভিক্ষু ও অতিথিরা থাকেন। এছাড়া ভবন ৩টির মধ্যে রয়েছে একাধিক সম্মেলন কক্ষ, যাদুঘর, সভাকক্ষ, সাংস্কৃতিক ঘর এবং একপাশে রয়েছে রেষ্টুর‍্যান্ট। ভবন গুলির পাশে রয়েছে দশতলা বিশিষ্ট টাওয়ার সদৃশ্য সুউচ্চ ভবন। আর এ ভবনগুলোর কিছু পেছনে রয়েছে কেম্বালা পাহাড়। সেখানে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দেখা পেলাম না। হয়তো ভেতরে কর্মব্যাস্ত আছেন। তবে দেশি বিদেশি পর্যটক দেখলাম অগণিত। এসব দেখে খুব বেশি করে জানতে ইচ্ছে হলো এই দক্ষিণ গোলার্ধের দেশ অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রায় দশ হাজার মাইল দূরে এশিয়া থেকে বৌদ্ধরা কেন এখানে এলো? কীভাবে এলো? শুধু কি ধর্ম প্রচারের জন্য এসেছিল? এতসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলো এই বৌদ্ধ মন্দিরের কথা লিখতে বসে।

 

প্রায় পৌনে দুইশত বছর আগে অর্থাৎ ১৮৪৮ সালের দিকে চীনারা পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া ও টরেশ দ্বীপপুঞ্জে এসেছিল সোনার সন্ধানে ও সোনার খনিতে কাজ করার জন্য। তারা অস্ট্রেলিয়ার প্রেমে পড়ে যায় এবং সেখানেই থেকে যায়। তারা স্বর্ণ নিয়ে যেতে পেরেছিল কিনা, স্বর্ণ খনিতে কীভাবে কাজ করেছিল তা জানা যায় না। তবে বেশ কিছুদিন পরে শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডে এসেছিল। এছাড়াও বিভিন্ন দেশ থেকে বৌদ্ধ অনুসারীরা অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন রাজ্যে আসে। শুধু তাই নয়, বৌদ্ধরা পার্শবর্তী নিউজিল্যান্ডেও তাদের বসতি গড়ে ক্রমশ তারা চাকরি বাকরি করে স্থায়ী আসন গেড়েছিল। ধর্ম অনুসারে খ্রিস্টান, হিন্দু ও মুসলমানের পরেই বৌদ্ধদের স্থান এ দেশে। তাদের জনসংখ্যা প্রায় ৬ লাখ ১০ হাজার। যা অস্ট্রেলিয়ার জনসংখ্যার ২.৪%। অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে প্রথম বৌদ্ধ ধর্ম সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়  একসময় তারা অস্ট্রেলিয়ার স্থায়ী অধিবাসী হয়। আর সেই প্রেক্ষিতে তারা ধর্ম পালনের জন্য অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস সরকারের কাছে কিছু জায়গার জন্য আবেদন করে। তখন ওলনগং সিটি কাউন্সিলের মেয়র ফ্রাঙ্ক মারকেল (যিনি পরে ওই রাজ্যের সংসদ সদস্য হন) ওই আবেদনের প্রেক্ষিতে ১৯৬৭ সালে বার্ষিক মাত্র ১ ডলারের চুক্তিতে ৫০ হেক্টর বা ৩৫০ বিঘা জমি দান হিসেবে ১০০ বছরের জন্য বন্দোবস্ত দিয়েছিলেন। ধর্ম প্রচারের এমন বিপুল পরিমাণ জমি হিন্দু বা মুসলমান সম্প্রদায় পেয়েছে বলে হয়না, এমনকি  খ্রিস্টান সম্প্রদায়ও পায়নি বলে আমার মনে হয়।

নিউ সাউথ ওয়েলসের রাজধানীর দক্ষিণ সিডনি থেকে ৯০ কিঃ মিঃ দূরে মন্দিরটি অবস্থিত। এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এইচ সিং ইয়ান এবং স্থপতি বা আরকিটেক্ট ডিজাইনার ছিলেন ব্রেওস্টার রিগ্যান, নির্মাণ কাজ করে অস্ট্রেলিয়ার নির্মাণ কর্মীরা। ১৯৯২ সালে এর কাজ শুরু হয় এবং ১৯৯৫ সালে কাজ শেষ হয়। মঙ্গলবার থেকে রবিবার পর্যন্ত সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে। নান তিয়েন টেম্পল সত্যিই সুন্দর ও আকর্ষনীয় স্থান। কেউ অস্ট্রেলিয়া গেলে অন্ততপক্ষে নান তিয়েন মন্দির দেখে আসবেন। এই ভ্রমণকে আমরা ভীষণভাবে উপভোগ করেছি। সন্ধ্যায় আমরা ফিরে এসেছি নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *