ট্রেন্স থেকে ফিরে এসে: রউফ আরিফ

পূর্ব প্রকাশের পর-

-কি করে বুঝলে?

-বোঝা যায়। আমাকে থাকতে দিয়ে তুমি নিজের বিপদই ডেকে আনলে। জানি না এর জন্য তোমাকে কত গঞ্জনা সইতে হবে।

স্বামী সম্পর্কে অন্যের মুখে এই ধরনের কথা রোজির ভালো লাগে না। তা সে একান্ত আপনজন হলেও নয়। তাই বিষয়টা হালকা করার জন্য বলে, বাদ দাও। পরের ঘর সংসার নিয়ে তোমার অত ভাবার দরকার নেই। আমাদের ব্যাপার আমরাই বুঝবো।

মুখে সাব্বিরকে ধমকালেও বুকের ভেতরে হুহু করে। সে কোনোদিন কল্পনাও করেনি আরমান তাকে এভাবে অবিশ্বাস করবে। আরমানের জন্য সে কত কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছে। আরমানের মুখের দিকে চেয়ে, নিজের সুখ দুঃখের পরোয়া না করে একাই লড়ে যাচ্ছে। আরমানের প্রেম ভালোবাসার মূল্যায়ন করছে।

সবই তো তার চোখের সামনে। সেইসব দিনের স্মৃতি আরমান এত তাড়াতাড়ি কি করে ভুলে গেলো। এমন তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় নিয়ে এমন গোলমেলে অচরণ না করে রোজির প্রতি তার বিশ্বাস এমন এক পর্যায়ে থাকা উচিত যার নাগাল অন্যনা পায়।

 

২২.

দশটার দিকে আরমান বাসায় ফিরে আসে। ঘরে ফিরে দেখে সবকিছুই গোছানো আছে। তারপরও মন থেকে সাব্বিরকে মুছে ফেলতে পারে না। ঘুরে ফিরে সাব্বিরের মুখখানাই আরমানের মানসপটে দুঃস্বপ্নের মতো বারবার হানা দিতে থাকে।

আরমান নিজেকে সামাল দিতে পারে না। ওর ভেতরে ক্ষোভ আর অভিমান যুগপৎ এমন এক বিস্ফোরণ ঘটায় যে, সে অসুস্থ বোধ করে। দুই হাতে মাথার চুল খামচে ধরে। রোজিকে দ্বিচারিনী ভাবতে শুরু করে। সে বর্তমান থাকতে রোজি সাব্বিরের শয্যাসঙ্গিনী। ছি! ছি! এমন মেয়েকে কীভাবে বিশ্বাস করবে? কীভাবে একে নিয়ে ঘর সংসার করবে! সম্ভব না। কখনোই সম্ভব নয়।

আরমান আর ভাবতে পারে না। কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে থাকে। শেষমেষ সিদ্ধান্ত নেয়, আজই রোজির মুখোমুখি হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঢাকার পাঠ চুকিয়ে রোজিকে নিয়ে চিটাগাং চলে যাবে। রোজিকে ঢাকা থেকে চিটাগাং নিয়ে যেতে পারলে, রোজি সাব্বিরের সংস্পর্শ থেকে দূরে চলে যাবে। আউট অফ সাইট আউট অফ মাইন্ড। ধীরে ধীরে সে সাব্বিরকে ভুলে যাবে।

এরপরে আরমান গোসল করে। রোজির রেখে যাওয়া খাবার খায়। তারপর সেজেগুজে বের হয়। বাসা থেকে বেরিয়ে ঠিক করে আগে ইনেসপেক্টর গাজির সাথে দেখা করবে। কিন্তু গাজিকে কোথায় পাওয়া যাবে তা সে জানে না। তবে এটা কোনো বিষয় নয়। তার পুরোনো কোনো আড্ডায় গেলেই গাজির সবকিছু জানা যাবে।

পথে নেমে সে ঠিক করে, কোনো আড্ডায় সে যাবে না। তাই গোলাম মাওলার দোকানে যায়। গোলাম মাওলা দোকানেই ছিল। সে আরমানকে দেখে উচ্ছ্বাসভরা অভ্যর্থনা জানায়। জিজ্ঞাসা করে চিটাগাং থেকে কখন ফিরেছিস?

-ভোর রাতে।

-মামার বাসার সবাই কেমন আছে?

-ভালো।

-হোটেলের চাকরি কেমন লাগছে?

-মন্দ না। তবে ঢাকায় এসে মন বসছে না। মনটা সারাক্ষণ পালাই পালাই করছে।

গোলাম মাওলা হাসে। চোখে মুখে বিস্ময় ফুটিয়ে তুলে বলে, এ তো ভালো লক্ষণ নয় রে দোস্ত।

আরমান জবাব দেয় না। মিটি মিটি হাসে। কিন্তু তার মনের জ্বালা মেটে না। বুকের ভেতরে রাবনের চিতা জ্বলতেই থাকে। মাওলা জিজ্ঞাসা করে, কি খাবি দোস্ত?

-চা বল। অন্য কিছুর দরকার নেই।

মাওলা চা নিমকি আনায়। চা নিমকি খেতে খেতে মাওলার কাছে জিজ্ঞাসা করে, গাজির সাথে তোর কোনো যোগাযোগ আছে?

-হাঁ। গাজিকে দিয়ে কি হবে?

-ওর সাথে একটু দেখা করা দরকার।

-ওর সাথে আগে ফোনে আলাপ কর। পুলিশ তো কখন কোথায় থাকে তার তো ঠিক নেই।

-তাহলে নম্বরটা বল।

মাওলা নিজেই ফোনে নাম্বার বসায়। রিসিভারে কান পাতে। ওপাশে গাজির কন্ঠ শোনা যায়। মাওলা কথা বলে, হ্যালো- তুই এখন কোথায়?

-অফিসেই আছি। একটু বাসায় যাবো।

-শোন আরমান তোর সাথে কথা বলতে চায়।

-কোথায় সে?

-আমার পাশেই আছে।

-ওকে দে।

মাওলা রিসিভার আরমানের হাতে চালান করে দেয়। আরমান কথা শুরু করে। হাঁ। ভালো আছি। গতরাতে। তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে। বাসায় আসবো? এখনি? আচ্ছা, আমি আসছি। আরমান ফোন রেখে দেয়।

মাওলা বলে, যা দেখা করে আয়। বিকেলের দিকে আসিস।

-আচ্ছা। আরমান বেরিয়ে পড়ে। গাজির বাসায় গিয়ে দেখে ওর মা বসে আছে। আরমান ওর মাকে সালাম দিয়ে বলে, কেমন আছেন আন্টি?

-ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?

-আছি একরকম।

-কালই প্রথম তোর বাসায় গিয়েছিলাম। তোর ছেলের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে। তোকে তো পেলাম না। বউমা বলল, তুই চিটাগাং থেকে আসতে পারিসনি। তোর ছেলেকে নিয়ে ভীষণ আনন্দ করলাম। খুব সুন্দর হয়েছে ছেলেটা। বউ মাও খুব ভালো মেয়ে। লক্ষ্মী একটা বউ পেয়েছিস।

আন্টি রোজির প্রশংসা করলেও এই মুহূর্তে আরমানের তা ভালো লাগছে না। আরমান একটা জিনিস খেয়াল করেছে, এই পর্যন্ত রোজির সাথে যাদের আলাপ হয়েছে তারা কেউই রোজিকে খারাপ বলেনি। সবাই তার প্রশংসা করে। এজন্য আরমানের আত্মতৃপ্তি কম ছিল না। কিন্তু, আজ কোনো প্রশংসাই আরমানের ভালো লাগছিল না। তাই রোজির প্রসঙ্গে সে কোনো উত্তর দিলো না। আন্টি যা বলল, তা নিরবে শুনে গেলো।

ওদের কথার মাঝে গাজি এসে গেলো। আরমানের পাশে বসে বলল, মা তুমি শুধু গল্প করছ। আমাদের কিছু খেতে দাও। আরমান কতদিন পরে এলো। মা উঠে গেলো। গাজি কথার মোড় ঘোরালো। তোর কেসটা নিয়ে আমি বেশ চিন্তায় ছিলাম। মিছামিছি একটা বাজে ঝামেলায় জড়িয়েছিস।

-আমি বুঝতে পারিনি ওরা আমাকে এভাবে ফাঁসাবে।

-যা হোক এযাত্রা বেঁচে গেছিস। তবে আমার পরামর্শ, ওইসব ঝামেলায় আর জড়াস না।

-তুই কি আমাকে অবিশ্বাস করছিস?

-ঠিক তা নয়। আমি যে পেশায় আছি, সেখানে কোনো কিছুরই স্থায়ীত্ব নেই। মানব চরিত্র ক্রমবিবর্তনশীল। আজ যেটা সত্য কাল সেটা মিথ্যা হয়ে যেতে পারে। তুই হয়তো জানিস না, যুদ্ধের আগের মানুষ আর আজকের মানুষের মাঝে বিশাল ব্যবধান। যারা দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছে। যুদ্ধ শেষে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশে ফিরে বলতে গেলে তারা কিছুই পায়নি। যোগ্য যায়গায় তারা অনেকেই যেমন ঠাঁই করে নিতে পারেনি, তেমনি সরকারও তাদের জন্য কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। যার কারণে অনেকেই নিজেদের ঠিক রাখতে পারছে না। অভাব অভিযোগের টানাপোড়েনে পড়ে নানা রকম ক্রাইমে জড়িয়ে যাচ্ছে। এইরকম কেস প্রায় প্রতিদিনই আমাদের হাতে আসছে।

যাকগে, ওসব বাদ দে। একটা চাকরি বাকরি দেখে নে। বউ বাচ্চা নিয়ে সুখে থাক সেটাই কামনা করি। রোজি ভাবীর মতো মেয়ে হয় না। তার প্রতি তোর দ্বায়িত্ব কর্তব্য অনেক। শুধু তোর জন্যই সে একটা অনিশ্চিত জীবন যাপন করছে।

-তার সম্পর্কে তুই কতটুকু জানিস?

-না। তেমন কিছুই না। যদিও সে আমাদের বন্ধুর বোন। ছোটবেলা থেকে তাকে চিনি। কিন্তু, তোর বউ হওয়ার পরে তাকে যেভাবে দেখছি, বিয়ের আগে তো সেভাবে দেখিনি। তাই তেমন করে কিছু বলতে পারবো না।

আরমান আর বেশিদূর এগোয় না। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে। ঠিক বলেছিস, রোজি আমার জন্য অনেক কিছু করেছে। তা না হলে অনেক ভালো ঘরে বরে তার বিয়ে হোতো। অনেক ভালো থাকতো সে।

মুখে এসব কথা বললেও আরমানের বুকে সন্দেহের কাটা খচখচ করে ফোটে। সন্দেহের আরেকটা অঙ্কুর তার মানসপটে মাথা তুলে জেগে ওঠে। তাহলে কি গাজিও রোজির প্রেমে মজেছে? তার অবর্তমানে রোজি গাজিকেও-?

আরমানকে অন্যমনস্ক হতে দেখে গাজি জিজ্ঞাসা করে, কি হলো? কি ভাবছিস?

-না। তেমন কিছু না। ঢাকাতে ঠিক গুছিয়ে উঠতে পারছি না। চাকরি বাকরি নেই। তেমন খুটির জোরও নেই। যাদের ভরসা করতাম, আজ দু’তিন বছর তো দেখলাম। সবাই গালভরা বুলিতেই সার। কাজের সময় লবডঙ্কা।

-পুলিশ ডিপার্টমেন্টে আসবি?

-স্কোপ আছে?

-যদি আসতে চাস তাহলে চেষ্টা করে দেখতে পারি।

ফোন বাজে। গাজি উঠে গিয়ে ফোন ধরে। ওপাশের কথা শুনতে শুনতে গাজি ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফোন রেখে এসে বলে, দোস্ত আমাকে এখনি আবার থানায় যেতে হচ্ছে। তুই আরেক সময় আয়।

আরমান আর অপেক্ষা করে না। উঠে পড়ে। ঠিক আছে, তুই তোর অবসর মতো আমার ওখানে আয়। গল্প গুজোব করা যাবে।

-আসবো। আমার প্রস্তাবটা ভেবে দেখিস।

-আচ্ছা।

ঘরে ফিরে এসে আরমানের মনটা আরও অশান্ত হয়ে ওঠে। এই সাজানো গোছানো ঘর সংসার সব কিছুই তার। কিন্তু এর কোনোখানেই সত্যিকার অর্থে সে নেই। বেশ খানিকক্ষণ এলোমেলো ভাবতে ভাবতে সে আবারও ঘরে তালা লাগিয়ে বেরিয়ে পড়ে। নিচে নেমে আসে। অঞ্জনা বউদির ঘরে জয় আছে। বউদিকে বলে, জয়কে একটু সাজিয়ে দাও বউদি। ওকে নিয়ে একটু ঘুরে আসি।

-যাবে! এইভর দুপুরে বেরোবে? বাইরে যে রোদ।

-কি আর এমন হবে। ব্যাটা মানুষ যখন রোদে জলে ভিজে পুড়েই ওকে শক্তপোক্ত হতে হবে।

বউদি হাসতে হাসতে জয়কে সাজিয়ে দেয়। আরমান ছেলেকে নিয়ে বের হয়। এই প্রথম আরমান ছেলেকে নিয়ে বের হয়। তারপরও ভালো লাগে। সে বাবা। ছেলেকে কোলে নিয়ে শহর ঘুরতে বের হচ্ছে।

….চলবে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *