সামসুল ইসলাম টুকু : বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। The riches turns a man from his real life. অর্থ হচ্ছে- সম্পদ বা প্রাচুর্য মানুষকে তার আসল জীবন থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। কোরআনের এই অমোঘ বাণীটি তাকাসুর সুরার প্রথম আয়াত। কোরআনে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘‘তোমাদের মোহগ্রস্থ করে প্রাচুর্য প্রতিযোগীতা।’’ আবার অন্য আয়াতে বলা হয়েছে ‘‘সম্পদ তোমাদের গাফেল করে’’।ধন সম্পদ অর্জন করতে গিয়ে কেউ অন্যায় ও অবৈধ পথে পা না বাড়ায় এ ব্যাপারে সতর্ক করেছে ইসলাম । অতিরিক্ত উপার্জন না করাই উত্তম । আর যদি কেউ করে তা যেন আল্লাহর সন্তুষ্টির পথেই হয় । অন্যায় পথে হলে তাকে শাস্তির আওতায় আনা হবে । কোর আনের এইসব অমোঘ বানী মানুষের কল্যানের জন্যই।
মাওলানাদের বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত সম্পর্কিত কোরআনের বিভিন্ন আয়াতের বিশ্লেষণ করতে দেখেছি একের পর এক, ঘন্টার পর ঘন্টা। কিন্তু উল্লেখিত এই আয়াতটির বিশ্লেষণ করতে দেখিনি কোন ওয়াজ মাহফিলে অথবা জুম্মার নামাজে। অথবা এই মৌলিক বাণীটির বিশ্লেষণ আমার কর্ণগোচর হয়নি। অথবা তেমন অনুষ্ঠানে থাকার সৌভাগ্য আমার হয়নি।
এই আয়াতের প্রেক্ষিতে সাহাবীগণ মহানবীকে জিজ্ঞাসা করেন তাদের সম্পদের পরিমাণ কত হওয়া উচিত। মহানবী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তরে বলেন- ‘‘তোমার খাওয়া পরার জন্য যতটুকু প্রয়োজন তার বেশী নয়’’। অন্য সাহাবীদের প্রশ্ন ছিল কী পরিমান সম্পদ তারা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করবেন? মহানবী উত্তরে বলেছিলেন ’’প্রয়োজনের অতিরিক্ত সবকিছু।’’ এর পরের আয়াতে বলা হয়েছে সম্পদ মরণতক তোমাদের মোহগ্রস্থ রাখিবে। অর্থাৎ সম্পদ বা প্রাচুর্য এতই লোভনীয় যা শুধু ক্ষণিকের জন্যই মোহগ্রস্থ করে না। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মোহগ্রস্থ রাখে। কোরআনের এই আয়াতের মমার্থ যদি সত্য হয় তবে নিম্নমধ্যবিত্ত থেকে ধনী শ্রেণীর সবাই মোহগ্রস্থ থাকবে। মোহগ্রস্থ হবে না শুধু জমিতে খেটে খাওয়া কৃষক ও দিন মজুররা। এরা দিনভর অক্লান্ত পরিশ্রম করে, শুকনা ভাত খায়, পেটপুরে পানি খায়, রাত হলে প্রশান্তিতে ঘুমায়, সূর্য ওঠার আগে ঘুম থেকে ওঠে ও চলে যায় কর্মক্ষেত্রে। নেতিবাচক কিছু ভাববার বা অপরাধ করার সুযোগই আসেনা তাদের জীবনে। অন্যদিকে যার সামান্য সম্পদ আছে তাদের মনে সম্পদ বৃদ্ধির ইচ্ছে কাজ করে প্রতিনিয়ত। যা তাকে মোহগ্রস্থ করে। মোহগ্রস্থ অর্থলোলুপ মানুষগুলোই সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করে। খুন জখম ধর্ষণ সন্ত্রাস থেকে শুরু করে যুদ্ধ করতেও দ্বিধা করে না। সমাজে, দেশে, সারা বিশ্বে সকল অশান্তির মূল হচ্ছে এই সম্পদ বা প্রাচুর্য। সম্পদের নিয়ন্ত্রণ না হলে অশান্তি অনিবার্য। কমিউনিষ্টদের ভাষায়-পুঁজির চুড়ান্ত বিকাশ হলে তার পণ্য বিক্রির জন্য পুঁজিবাদিকে বাজার খুঁজতে হয় ভিনদেশে। তাতে স্বস্তি না পেলে দেশ দখল করতে হয়। এজন্য যুদ্ধ, রক্তক্ষয় চলতে থাকে এক দেশ থেকে অন্য দেশে। লুটপাট করে সম্পদের পাহাড় গড়তে গড়তে যখন সীমা অতিক্রম করে তখন সে সম্পদ মানুষের কল্যাণে না ব্যবহার করে সমুদ্রে ফেলে দেয় অথবা ধ্বংস করে। সম্পদের এই হচ্ছে মারাত্নক কুফল। সম্পদের বিষবাস্প পৃথিবীকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। এর বহু ইতিহাস আছে তেমনি বর্তমানেও প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী ধনী দেশগুলোর পৃথিবী ব্যাপী আগ্রাসী ও নগ্ন হামলা।
অথচ সম্পদ নিয়ন্ত্রণের সহজ পথ রয়েছে ইসলামে। ‘‘তোমার একদিনের খাবার রেখে বাকিটা বায়তুল মালে জমা দাও।’’ কমিউনিষ্টরা বলে ‘‘সকল সম্পদের মালিক রাষ্ট্র’’। প্রথম কথাটি হচ্ছে বিবেকের এবং দ্বিতীয় কথাটি হচ্ছে আইনের। কিন্তু কোনটাই আমরা মানতে রাজী নই। বরং এই মৌলিক নীতিগুলো কিভাবে সংশোধন এবং আরো বেশী সংশোধন করা যায় সে ব্যাপারে অত্যন্ত যত্নশীল ও সোচ্চার। সংশোধিত পথে কেউ কেউ যাকাত দিতে চাইলেও চাইতে পারে। কিন্তু কোন ভাবেই সম্পদ হাতছাড়া করতে চায় না। রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য তথা মানুষের কল্যাণের জন্য সম্পদকে বায়তুল মালে অথবা রাষ্ট্রের কাছে সমর্পন করতে রাজী নয়। সহজিয়া পথ শুধু সম্পদের ক্ষেত্রেই নয় ইসলামের মূল স্তম্ভগুলোর ক্ষেত্রেও একই পথ অবলম্বনকারী আমরা। নামাজ বা সালাত সমাজে কায়েমের পথে একটুও এগুতে চাই না। অনেকের কাছে নামাজ পড়াটাই মুখ্য। নামাজ কায়েম করাটা মুখ্য নয়। কারণ নামাজ কায়েমের পথটা অত্যন্ত কঠিন। যারা নব্য নামাজী তারা অন্যদের নামাজ পড়ানোর জন্য এমন মধুর আহবান রাখেন এবং অন্ততপক্ষে পরকালের জন্য তথা বেহেস্ত লাভের জন্য নামাজ পড়ার বয়ান দেন তাতে মনে হয় বেহেস্ত খুব দুরে নয়। খুব সহজেই লাভ করা যায়। কিন্তু ইসলামের পথ অত কুসুমাস্তির্ণ নয়। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষের কল্যাণের জন্য সারারাত ধরে ইবাদতে মশগুল থাকতেন। এই দেখে কিছু সাহাবী মনস্থ করলেন আর ঘর সংসার নয়। সব সময় ইবাদত বন্দেগী নিয়ে থাকবো। মসজিদের বাইরে যাবো না। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ খবর পেয়ে ছুটে গেলেন ওই সাহাবীদের কাছে। বললেন আমি তোমাদের নবী তোমাদের মতই রক্ত মাংশের মানুষ। আমি ঘর সংসার করি, খাই দাই। কাজ থাকলে ইবাদত ত্যাগ করে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ি। সাহাবীরা লজ্জিত হয়ে নিজ নিজ কাজে বেরিয়ে পড়লেন।
যাইহোক প্রসঙ্গে ফিরে আসি । তাকাসুর সুরার মুল কথা অনুযায়ী মুসলমানেরা যাহাই উপার্জন করুকনা কেন তারা একদিনের খাবার পরিমান অর্থ রেখে বাকিটা বায়তুলমালে জমা দিবে । বায়তুলমালের তত্বাবধায়ক রাষ্ট্র যেমন খুঁজে বের করবে কার বাড়ীতে খাবার নাই , অভাবী , রোজগারহীন , অসুস্থ মানুষদের এবং তাদের কাছে খাবার পৌছে দেবে। পাশাপাশি যারা একদিনের খাবার রেখে বাকিটা বায়তুলমালে জমা দিয়েছে তাদের আগামী দিনের কাজের নিশ্চয়তা দিবে । যেন কোথাও কনো অভাবী, অনাহারী ,বেকার , অসুস্থ মানুষ না থাকে । এই নিয়ম পালন করলে একটা সুস্থ সুন্দর সমাজ গড়ে উঠে । অন্ততপক্ষে কেউ না খেয়ে থাকবেননা । কিন্তু যখন সঞ্চয় করার সুযোগ পাবে তখন সেই সম্পদের উপর মায়া বাড়তে বাধ্য এবং সেটা অন্যের কাছে সমর্পন করতে চাইবেনা । লোভ তাকে গ্রাস করবে । মনে করবে এটা তার নিজ শ্রমে উপার্জিত সম্পদ । সে ইচ্ছে হলে দেবে আর ইচ্ছে নাহলে না দেবে । এটা তার ব্যক্তিগত অধিকার । এখানে সে কারো হস্তক্ষেপ পছন্দ করতে পারেনা । তাইতো আরবের ধনকুবেররা বা আমীরেরা তাকাসু সুরার এই ধারনাকে মেনে নিতে পারেনি । প্রচন্ড বিরোধিতা করেছে । নবীজী (দঃ) সুরার এই ধারনাকে বাস্তবায়ন করতে পারেননি । তিনিও আমীরদের বিশাল শক্তির বিরাগভাজন হতে চাননি । যদিও সেটা ছিল একটি সাম্যবাদী জীবনব্যবস্থা । যা আদিম যুগে বহাল ছিল ।ফলে নবীজী (দঃ) বিকল্প ও অপেক্ষাকৃত দুর্বল আর্থিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন । সেটাই হলো যাকাত ।যাকাত শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো , যে জিনিষ ক্রমশ বৃদ্ধি পায় ও পরিমানে বেশী হয় । যাকাত হচ্ছে , বরকত , পরিমানবৃদ্ধি পাওয়া , প্রবৃদ্ধি লাভ , পবিত্রতা , পরিচ্ছন্নতা , শুদ্ধতা ও সুসঙ্গবদ্ধতা । এগুলোর বিশ্লেষন এক বিশাল ব্যাপার । যাকাত ইসলামের ৫টি স্তম্ভের শেষ স্তম্ভ । কোরআনে যাকাত শব্দটি ৩২টি আয়াতে এ্সেছে । এর মধ্যে ২৭ বার নামাজের সাথে একত্রিত হয়ে এসেছে । এই যাকাতের মাধ্যমে তখনকার প্রচন্ড আর্থিক বৈষম্য দূর করা যায় । নবীজী সেই চেষ্টা করেছিলেন । মক্কা থেকে মদিনা হিজরত করার পর সেখানে কিছুটা কার্যকর হয়েছিল এই প্রবর্তিত প্রথা এবং যা মুলত সাহাবীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল । বাকিরা এর বিরোধিতা করেছিল সকল শক্তি দিয়ে । এই বিরোধকে কেন্দ্র করেই যে যুদ্ধ হয় সেখান থেকেই ইসলামের ইতিহাসের সূচনা , উত্থান ও বিকাশ হয়েছে পর্যায়ক্রমে ।
ধর্মের কোন মৌলিক নির্দেশ বা কাজকে পালন করতে আমরা রাজী নই। কারণ সেগুলো বহু শ্রম ও সাধনার। সহজিয়া পথ গ্রহণ করতে করতে ইসলামকে সহজ ও সস্তা করে ফেলেছি। যদি যাকাত দিতে মন চায়, সেটাও যতটা পারা যায় সংশোধিত পথে দেবার প্রচেষ্টা থাকে। কিন্তু ধন সম্পদ সঞ্চয় করবো না তা ভুল ক্রমেও মনে আসেনা। দুর্নীতি করবো, মিথ্যা কথা বলবো, সত্য গোপন করবো, পরের হক নষ্ট করবো তাতে কী হয়েছে? নামাজতো পড়ছি। মসজিদ তৈরীর জন্য টাকা দিচ্ছি। সম্পদের পাহাড় হলে কী করবো? যাকাত তো দিচ্ছি। মাওলানা সাহেবরাও হালকা মসলা দিয়ে সে সুযোগ করে দিচ্ছেন। কথায় কথায় বলেন, যাই করনা কেন নামাজ পড়। এ হচ্ছে সহজিয়া পথ। সহজিয়া পথে ইসলামের ধারে কাছে পৌছানো সম্ভব হবে না বরং আমাদের জীবন থেকে ইসলাম ক্রমশ দূরে সরে যাবে এবং ইতিমধ্যে বহু দুরে সরে গেছে।
আধা মাওলানা, নব্য নামাজীদের নিকট থেকে শোনা যায় , দাড়ি রাখেন, টুপি পরেন, ইসলামী লেবাস গ্রহণ করেন, মেয়েদের বোরকা পরান, সাদকা ফিতরা দেন এমন অনেক সুন্নত ও নফল পালনের উপদেশ দেন। এদের কখনো দেখিনি মিথ্যা কথা বলার জন্য মিথ্যাবাদীকে তিরস্কার করতে এমনকি সত্য বলার পরামর্শ দিতে।অর্থ সম্পদশালীদের এরা বলেন ভাই টাকা পয়সা হয়েছে হজ্ব করে আসুন । কখনোই বলেননি টাকা পয়সা গরীব মানুষের কল্যানে ব্যয় করুন । চোখের সামনে ডাহা ডাহা কোন অন্যায় দেখেও এরা চুপ করে থাকেন। কেউ প্রতিবাদ করতে চাইলে এরা বলেন, বাদ দেন ভাই ঝগড়া করার দরকার কী? ওদের সাথে পারবেন না।’ এভাবেই নৈতিক মূল্যবোধকে উজ্জীবিত না করে ফিকে করে দিয়েছে। অন্যায়কে ছাড় দিতে দিতে আমাদের বিবেকটাকে লুপ্ত করার জঘন্য পথ দেখিয়েছে।
মানুষের চাহিদার শেষ নেই । ভোগ বিলাসের জন্য সব উপকরন এই পৃথিবীতে আছে । যে সংযম করতে পারে সেই তো মানুষ । আমরা যে মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উম্মত হিসাবে দাবী করি সেই বিশ্বনবী সারা জীবন শুধু সংযম করে গেছেন । কখনো মিথ্যা কথা বলেননি, কাউকে কড়া কথা শুনাননি, কারো হক নষ্ট করেননি, অন্যায় দেখে প্রতিবাদ করেছেন, কারো উপর জুলম করেন নি। সেই নবী নিজে বিনা পরিশ্রমের রুজিকে নিন্দা করেছেন, ইসলাম প্রচারের জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছেন। একদিকে কোরাইশদের প্রাণান্তকর নির্যাতন সহ্য করেছেন অন্য দিকে গোপন থাকা অবস্থায় ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে সঙ্গী সাথী নিয়ে গাছের পাতা খেয়েছেন, চামড়া সিদ্ধ করে খেয়েছেন । তায়েফে বিরোধী পক্ষের ইট পাথর নিক্ষেপে ধরাশায়ী ও রক্তাক্ত হয়েছেন। পরীখার যুদ্ধে নিজে মাটির ঝুড়ি বহন করেছেন। ওহুদের যুদ্ধে তিনি দাঁত হারিয়েছেন। এরপর যখন তিনি গোটা আরবের অধীস্বর হয়েছেন তখনও তার পরিশ্রমের ও সাধনার ঘাটতি হয়নি। তিনি সারাদিন যা কামাই করেছেন তা দিয়ে খেয়েছেন। তাও সারাদিন জুটত না। মৃত্যুর পূর্বের রাতে তেলের অভাবে তার ঘরে বাতি জ্বলেনি।
আমাদের সমাজের আলেম মাসায়েখের মধ্যে কজন কায়িক পরিশ্রম করেন? পরের উপার্জিত অর্থে পরের দেয়া দান, খায়রাত, সাদকা, তোহফা, নজর নেয়াজের টাকায় ঘাড় গর্দান একাকার করেন। শরীরের মধ্যভাগ মেদে স্ফীত করেন। এছাড়া তাদের শ্রম সাধনার ফসল কোথায়? কজন আলেম মাসায়েখ পীর আছেন যারা তার মুরীদ অনুসারীদের নিয়ে কোন এলাকায় স্বেচ্ছা শ্রমের ভিত্তিতে রাস্তা নির্মাণ করেছেন, পুল কালভাট করেছেন, দীঘি খনন করে মাছ চাষে উৎসাহিত করেছেন, চাষাবাদ করে কৃষি ফার্ম করেছেন, বন্যার সময় বাঁধ দিতে গেছেন অথবা শিল্প ফ্যাক্টরী গড়ে কিছু লোককে বেকার জীবন যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়েছেন। অথবা কয়জন আলেম একত্রিত হয়ে একটা থানা ইউনিয়ন কিংবা গ্রামকে বেছে নিয়ে আদর্শ গ্রাম গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছেন। অথচ জানা যায়, এদের অনেকের গাড়ী বাড়ী ও সান শওকতের কথা। এদের এক একটা ওরশে যত টাকা পয়সা, চাল-ডাল, ছাগল, গরু, মুরগী ব্যয় হয় তাতে এক একটা গ্রাম স্বনির্ভর করা যেতে পারে।
অন্যদিকে সুদুর ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে যখন মিশনারীরা গরীব দেশগুলোতে গিয়ে দুস্থ গরীব মানুষের সেবা দেয়, শিক্ষা দেয়, ভালবাসা দেয় এবং তাদের সেবা পেয়ে মানুষ ধর্মান্তরিত হয় তখন আমরা হিংসায় জ্বলেপুড়ে মরি, কটাক্ষ করি। এই হচ্ছে আমাদের শিক্ষা। ধিক এই শিক্ষাকে। আমাদের শিক্ষার একটা ছোট্ট দৃষ্টান্ত দেই। বেশির ভাগ শিক্ষিত মানুষ বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, আমলাবৃন্দ, যখনই দুর্নীতি করেন, বিপদের পড়েন এবং নির্বাচনের সময় আসে তখন তারা স্মরণাপন্ন হন ঐ সকল পীরের দরগায়। মোটা অংকের ভেট দেন, পীরের পা মুছে চুমু খান, পারলে পীরের পায়ের নীচে মাথাটাও রাখেন। কী ভক্তি! আহ কী প্রণতি! এত ভক্তি আর প্রণতির দরকার নেই। শুধু দুর্নীতি বন্ধ করলেই দেশটা সোনা হয়ে যাবে। দেশের মানুষ আপনাদেরই ভক্তি করবে। প্রাণভরে হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে দোয়া করবে। এর চেয়ে বড় কিছু আছে? দুর্নীতির টাকা দিয়ে বড় মিল ফ্যাক্টরী করতে পারে । কিন্তু করবেনা । কারন তার টাকায় কেউ নিজের পাঁয়ে দাড়াক সেটা তারা চায়না ।
সারা বিশ্বব্যাপী মহান ইসলামের এমন অবস্থার কারণ হচ্ছে মৌলিক কাজগুলোকে আড়াল করে সহজিয়া পথ গ্রহণ করা। আর এ ব্যাপারে অগ্রনী ভুমিকা পালন করছেন তারাই যাদের আমরা ধর্মের ধারক ও বাহক মনে করি। দু-হরফ আরবী জানলে এবং কোরআন হাদীসের তরজমা করতে পারলেই তাকে আমরা আলেম পীর বুজুর্গ মনে করি। সহজ সরল মানুষেরাতো অন্ধভাবে সেটাই বিশ্বাস করে। তাহলে আরব তথা মধ্যপ্রাচ্যের সকল আরবী ভাষী মানুষ সবাই পীর বুজুর্গ আলেম? নিশ্চয়ই না। এই ধরণের বদ্ধমূল ধারণা ও কুসংস্কারগুলো মন থেকে ও সমাজ থেকে মুছে ফেলতে না পারলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ধর্ম ও বড় দর্শনের বিকাশ হবে না।
কোরআনে বলা হয়েছে মানুষকে মানুষের জন্যই সৃষ্টিকরা হয়েছে । সেটাও সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে । মানুষের উপকার করলে মর্যাদা বাড়ে ,বিপদ মুক্ত থাকা যায়, মানুষের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হয় , অহঙ্কার কমে । সকল মানুষকে সকল সক্ষমতা দিয়ে তৈরী করা হয়নি । সুতরাং যারা পিছিয়ে পড়া তাদের এগিয়ে নেওয়ার জন্য মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে । কোরআনের এসব মৌলিক শিক্ষা আমরা গ্রহন করিনা । বরং বিপরীত পথের যাই । নবীজী যখন এ ধরায় এসেছিলেন তখনকার যুগকে আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগ বলা হতো । তখন সেখানে রীতিমত দাস প্রথা চালু ছিল । কারন ছিল আকাশচুম্বি অর্থনৈতিক বৈষম্য । নবীজী এই জঘন্য প্রথাকে উৎপাটন করার জন্য নিজে যেমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন তেমনি আরবের আমীরদের সাম্যের বানী শুনিয়েছেন । কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাজে আসেনি । প্রচলিত সমাজ ব্যাবস্থাকে ভাঙ্গতে পারেননি । পরিবর্তিত পৃথিবীতে আজও দাস প্রথা চালু আছে তবে পরিবর্তিত রুপে ।
যাকাত মুলত একটি কর ব্যাবস্থা । ইসলামী বিধান মতে প্রত্যেক মানুষ তার সম্পদের ২,৫ % হারে যাকাত দেবে । কিন্তু বিভিন্ন মতভেদ রয়েছে যা সহজিয়া পদ্ধতি । এর আরও কারন হচ্ছে যাকাত প্রদান যতটা না ছিল রাষ্ট্রীয় আইন তার চেয়ে বেশী ছিল বিবেক নির্ভর । ফলে সেটা গোটা রাষ্ট্রে চালু করা সম্ভব হয়নি । কিন্তু সন্দেহাতিতভাবে যাকাত প্রথা সকল মানুষের কল্যানের জন্য । সেই যুক্তিতে সকলের যাকাত দেওয়া উচিত ।আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা মুলত জনগনের ট্যাক্সের টাকাতেই চলে । যাদিয়ে দেশ ও জাতির উন্নয়নে ব্যবহার হয় ।কল্যান রাষ্ট্রগুলোতে এমন একটা নিয়মতান্ত্রিক ব্যাবস্থা আছে যে সেখানে কাউকে ট্যাক্স দেওয়ার জন্য বাধ্য করতে হয়না । পদ্ধতি অনুযায়ী আদায় হয়ে যায় । সরকার যেমন বেতন দেয় , বেতন দেওয়ার আগে সরকারী ব্যবস্থা তেমন হারে আয়কর কেটে নেয় । সেসব দেশের মানুষেরা ট্যাক্স দিয়ে খুশী হয় । কারন তারা জানে যে তাদের দেয়া টাকা জনগনের কল্যানেই ব্যয় হবে । সেসব দেশে প্রতিটি মানুষ সুষ্ঠু সুন্দর ভাবে রাষ্ট্রের সকল সূযোগ সুবিধা পায় । শুধু তাইনয় বেকার চোর বাটপারদের জন্যও মাসিক ভাঁতা বরাদ্দ করা হয় । অষ্ট্রেলিয়া , কানাডা , নিউজিল্যান্ড , সুইডেন সহ কিছু দেশে সবচেয়ে ভালো ইসলামী ব্যবস্থা চালু আছ বলে একটা জরীপ রিপোর্ট আছে । তা তাদের নিয়মানুবর্তিতার ফল , ইসলাম আছে বলে নয় । তারাতো মুলত খৃষ্টান । অথচ মুসুলমান দেশগুলোতেই যাকাত প্রথাটাই চালু নেই । এ ব্যার্থতা মুসলমানদের । তারা কোরআনের তাকাসুর সুরা এবং যাকাতের লঙ্ঘন করেই চলেছে ।
পরিশেষে বলতে চাই, কাউকে সমালোচনা বা খাটো করার উদ্দেশ্যে এ লেখা নয়। অতি সাধারণ চিন্তা ভাবনা থেকে আমার কাছে যা ভাল মনে হয়েছে তা একান্ত বিনয়ের সাথে সবার খেদমতে তুলে ধরলাম। একজন পাঠকও যদি এ লেখা থেকে চিন্তার খোরাক পান নিজেকে ধন্য মনে করবো।
লেখক –সাংবাদিক