মানবিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে গুণগত ও মানসম্মত শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা

শাহানাজ শিউলী :`রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে,প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলা হয়ে আসবে,তবুও বই থেকে যাবে অনন্ত যৌবনা যদি তেমন বই হয়।’

কিংবদন্তি ফার্সি কবি ওমর খৈয়ামের এই বিখ্যাত উক্তি আজ সময়ের ফ্রেমে বন্দি। বিবেকবান, নীতিবান, আলোকিত মানুষ গঠনের জন্য যেমন প্রয়োজন পরিবার ও বিদ্যাপীঠ তেমনি গুণ গত  ও মানসম্মত  শিক্ষার জন্য প্রয়োজন গুনগত গ্রন্থ।

দেহ আর মন নিয়েই মানুষ। দেহের পুষ্টির জন্য যেমন খাদ্যের প্রয়োজন, তেমনি মনের স্বাস্থ্যের মানসিক খাদ্য অপরিহার্য। মনের খাদ্য আহরণ করতে হয় রূপ -রসের আনন্দবাজার থেকে। মনের ঐশ্বর্যের গুণেই মানুষ মহৎ হয়, হয় মৃত্যুঞ্জয়ী। গুণগত বই হলো সেই ঐশ্বর্যের খনি। মনের খাদ্য প্রত্যক্ষ নয়, অনুভবের বিষয়, উপলব্ধির বিষয়। সেই ভাব -সৌন্দর্য  সমগ্র জীবনেই ব্যাপ্ত হয়ে পড়ে। একটা গুণগত বই যুগে যুগে মানুষকে দেয় মহৎ ও উন্নত জীবনের দীক্ষা। একটা ভালো বই পাঠের মাধ্যমে মানুষ তার ভিতরে সাড়া শুনতে পায় এবং নিজেকে চিনতে শিখে, বুঝতে শেখে

অবগুন্ঠনে ঢাকা জীবনের সার-সত্যকে। ফলে সে মানবিক হয়ে ওঠে। আর মানবিক মানুষ দিয়েই তৈরি হবে মানবিক বাংলাদেশ।

কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো বর্তমান পরিস্থিতিতে উন্নত মানের পাঠ্য পুস্তক একেবারেই বিরল । একটা জাতিকে মেধাশূণ্য করতে হলে শিক্ষা ব্যবস্থার  মেরুদন্ড আগে ভাঙতে হয়। সে দিক থেকে আমরা বেশ সফলতা অর্জন করেছি। পাঠ্যপুস্তক এর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে তার করুণ চিত্র দেখা যায় যে

শিক্ষার গুণগতমান চরম ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আর এই গুণগত শিক্ষার অভাবে শিক্ষার্থীদের বিপদগামী অবিমৃষ্য আচরণ, বিবেচক রুচি সম্মত হতে পারছে না। যার ফলে জাতি ক্রমেই অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছে। একটি গুণগত মানের বই মানুষের হৃদয়ে গভীর চেতনা ও সংবেদনশীলতার জন্ম দেয় এবং বিশ্বকে পূর্ণাঙ্গভাবে উপলব্ধির সক্ষমতার সৃষ্টি করে। শুধু এই নয় নিদ্রাচ্ছন্ন জাতির জীবনে ঘুম ভাঙ্গায়। তার পরশেই নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ হয়।

এখন জানা দরকার গুণগত, মানসম্মত ও মানবিকতার শিক্ষা কী?

গুণগত শিক্ষা:

গুণগত শিক্ষা হলো এমন একটি পরিকল্পিত ব্যবস্থা যার উদ্দেশ্য হল সামগ্রিকভাবে শিক্ষার্থীকে সাহায্য করা যেন শিক্ষার্থীরা তাদের পূর্ণ সম্ভাবনার বিকাশ ঘটিয়ে সমাজের জন্য একজন পূর্ণাঙ্গ উৎপাদনশীল নাগরিক হয়ে ওঠে।

মানসম্মত শিক্ষা:

একটি মানসম্মত শিক্ষা হলো এমন একটি শিক্ষা,যা সম্পূর্ণ শিশুর উপর দৃষ্টি নিবন্ধ করে লিঙ্গ, জাতিগততা,আর্থসামাজিক অবস্থা বা ভৌগোলিক অবস্থান নির্বিশেষে প্রতিটি শিক্ষার্থীর সামাজিক মানসিক ও শারীরিক এবং জাতীয় বিকাশ। একটি  গুণগত ও মানসম্মত শিক্ষা ব্যক্তি, সম্প্রদায়, সমাজের উন্নতির জন্য ফলাফল প্রদান করে প্রতিটি শিশুকে উন্নতির সুযোগ দেয়।

মানবিক শিক্ষা:

মানুষের বিবেক, মনুষ্যত্ব, মূল্যবোধ ও অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং পরার্থে মঙ্গল প্রদর্শন করার নামই হলো মানবিক গুণাবলি। আর এই মানবিক গুণাবলি  প্রতিষ্ঠার জন্য যে ন্যায়- নীতি শিক্ষা দেয়া হয় তাকে মানবিকতার শিক্ষা বলে।

মানবিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে গুণগত শিক্ষার কেন প্রয়োজন :

একটি গুণগত মানের শিক্ষা তার সংকীর্ণ সীমাকে অতিক্রম করে বিশ্ব মনীষীর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়।গৌরব উজ্জ্বল সোনালী সম্ভাবনাকে স্বাগত জানিয়ে মানবিকতাকে হাতছানি দেয়।আর এই মানবিকতাই মানবিক বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। কেননা মানবিকতার মধ্যে রয়েছে মহত্ব, উদারতা, আত্মত্যাগ, সেবা পরায়ণতা। আর এ গুলোই আমাদের সমাজ সচেতনতা, সহমর্মিতা, সংবেদনশীলতা, সেবাপরায়নেতা সমাজ, জাতি, ও দেশকে স্বর্গপ্রসূ করে তোলে। ক্ষুদ্রতা, স্বার্থপরতার ঊর্ধ্বে মানবতা। আর এই মানবিকতার অভাবে গড়ে ওঠে না সুস্থ, বিবেক, উন্নত রুচিবোধ ও মার্জিত আচরণের মানুষ। যার পরিপ্রেক্ষিতে সমাজ, রাষ্ট্রের, প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে অন্ধকারের হাতছানি তথা অশনিসংকেত। আর এই কারণেই দেশে ধর্ষণ, খুন,ঘুষ,রাহাজানি, স্বার্থের ডঙ্কা দিন দিন বেড়ে চলেছে।

বর্তমানে আমরা এমন এক সময় অতিবাহিত করছি যখন সমাজ, রাষ্ট্রে আলোকিত ও মানবিকতার মানুষের  তীব্র অভাববোধ করছি। আমরা এটাও জানি আলোকহীন ঘরে  যেমন খুব বেশিদিন থাকা যায় না তেমনি আলোকিত মানুষ ছাড়া সমাজ, রাষ্ট্র চলতে পারেনা।

একটি গুণগত ও মানসম্মত মানের বই একটি মানবিকতার মানুষ উপহার দিতে পারে। একটি মানবিকতার মানুষ একটি মানবিকতার দেশ দিতে পারে। মানবিকতা হল, নীতি, সহানুভূতি, মায়া, মমতা, প্রেমপ্রীতি প্রভৃতি সুকুমার বৃত্তি । যুগে যুগে মানসম্মত বই মানুষকে শিখিয়েছে ত্যাগের শিক্ষা, বীরত্বের  মহত্ত্ববোধ, সত্য ও সুন্দরের সাধনা যা মেটাতে পারে মানুষের মনের ক্ষুধা। দৃষ্টিকে করে উদার, মনকে করে উন্নত। একটি গুণগত মানের বইয়ের মাধ্যমে  মানুষ জগতের প্রকৃত সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের সন্ধান পায়। কিন্তু অপ্রিয়  হলেও সত্য যে বর্তমানে বাংলাদেশের ভালো বই বা উন্নত মানের বই তেমন প্রকাশ হচ্ছে না। যার কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে গড়ে উঠছে না মনুষ্যত্ব মূল্যবোধ। মানুষ দিনে দিনে বই থেকে বহু দূরে সরে যাচ্ছে।। ঝুঁকে যাচ্ছে সস্তা বিনোদনে। তৈরি হচ্ছে উগ্রতা, হিংস্রতা। শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষাই গড়ে তুলতে ব্যর্থ হচ্ছে। এই কারণেই ছেলের হাতে বাবা, বাবার হাতে সন্তান খুন হচ্ছে। ঘরে বাইরে মানুষের উগ্রতা ও হিংস্রতার কারণে মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। জাতির জন্য এটা একটা ভয়ংকর রূপ। তাই আজ এই পরিস্থিতির অবসানের জন্য আশু প্রয়োজন।আলোকিত মানুষ ব্যতীত কখনো মানবতার দেশ গঠন করা সম্ভব নয়। মানুষের বিবেক, মনুষ্যত্ব, মূল্যবোধের জন্ম দিতে পারে একটি গুণগত ও মানসম্মত বই। আর এই বই পাঠের মাধ্যমেই মানবিকতার মানুষ গড়ে ওঠা সম্ভব। আর এই মানবিকতার মানুষই উপহার দিতে পারে মানবিকতার বাংলাদেশ। তাই মানবিকতার দেশ বিনির্মাণে গুণগত ও মানসম্মত শিক্ষার অপরিহার্য।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *