728 x 90

বাংলাদেশের রাজনীতি-(পর্ব-২)

সত্যানন্দ চৌধুরী: রাজনীতিতে জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের সঠিক মাপকাঠি হল নি্রপেক্ষ ইলেকশনের ফলাফল। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশের নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন অতীত সংসদ নির্বাচন পর্যালোচনা করে কি দেখা যায়? চলুন ফিরে দেখি এক নজর। ১৯৯১-এ বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের ‘নিরপেক্ষ’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিএনপির একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয় এবং ২০০১-এ বিচারপতি লতিফুর রহমানের ‘নিরপেক্ষ’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনেও

সত্যানন্দ চৌধুরী: রাজনীতিতে জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের সঠিক মাপকাঠি হল নি্রপেক্ষ ইলেকশনের ফলাফল। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশের নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন অতীত সংসদ নির্বাচন পর্যালোচনা করে কি দেখা যায়? চলুন ফিরে দেখি এক নজর। ১৯৯১-এ বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের ‘নিরপেক্ষ’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিএনপির একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয় এবং ২০০১-এ বিচারপতি লতিফুর রহমানের ‘নিরপেক্ষ’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনেও দলটির ভূমি-ধ্বস (Landslide Victory) বিজয় অর্থাৎ ২/৩ অংশেরও অধিক সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়।

তবে এর মাঝে ১৯৯৬-এ যদি ‘জনতা-মঞ্চের’ ম খা আলমগীর গং বিদ্রোহী আমলা চক্র বিচারপতি হাবিবুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ঘিরে ধরে তাঁর লেজে টেনে নয়, একেবারে ঘাড় মটকিয়ে নিয়ন্ত্রণ না করত তবে ১৯৯৬-এ বিএনপি-ই সরকার গঠন করতো তা ছিল নিশ্চিত। কেননা ওই ম খা আলমগীর গং ‘বিদ্রোহী আমলা চক্র নিয়ন্ত্রিত’ প্রশাসন কর্তৃক ব্যাপক ‘ইলেকশন ইঙ্গিনিয়ারিং’ এর পরও আওয়ামী লীগ তখন সরকার গঠনের মতো একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা পায় নাই। ফলাফল ছিল আওয়ামী লীগ–বিএনপি (১৪৬/১১৬)। জাতীয় পার্টি আর (তাঁদের তৎকালীন মিত্র) জামাতের সমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন করতে হয়েছিল।

বিচারপতি হাবিবুর রহমানের চরম পক্ষপাত দোষে দুষ্ট ‘নিরপেক্ষতার’ কিছু নমুনা এপ্রসঙ্গে পাঠকদের কিছু একটু মনে না করিয়ে দিলেই নয়। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল তাঁর ‘সরকারের’ সর্ব শীর্ষ পদ, অর্থাৎ প্রধান উপদেষ্টার ‘মুখ্যসচিব’ হিসাবে ‘জনতার মঞ্চে’র আমলা সাইদ আহমেদের নিয়োগ। অতঃপর প্রশাসনের এই সর্ব শীর্ষ পদ দখল করে তাঁর যোগসাজশে জনতা মঞ্চের দলপতি ম খা আলমগীর, সফিউর রহমান, ডঃ মসিউর রহমান (পদ্মা সেতু চোর), ফারুক সোবহান (পশ্চিম বঙ্গে জন্ম গ্রহণকারী আপাদমস্তক আওয়ামী ঘরনার শিক্ষাবিদ প্রফেঃ রেহমান সোবহানের অনুজ), নুরুল হুদা (সাবেক সিইসি) গং

[পাঠককুল অনেকেরই হয়তো মনে আছে- এই সিইসি নুরুল হুদা- যিনি তৎকালীন (১৯৯৬) কুমিল্লার জেলা প্রশাসক থাকাকালীন তাঁর অফিস থেকে প্রধান মন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছবি নামিয়ে ফেলে বিদ্রোহী আমলাদের কাতারে একাত্বতা জানিয়েছিলেন। সরকারী চাকুরী-বিধির এই শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য বিএনপি ২০০১ এ ক্ষমতায় এসে তাঁকে চাকুরী হতে বরখাস্ত করেছিল বটে। তবে আওয়ামী সরকার ২০০৯ এ ক্ষমতায় এসে আদালতে ঘুরিয়ে বিচারপতি মানিকের (কালো মানিক) মাধ্যমে  রায় পাইয়ে দিয়ে তাঁকে চাকুরীতে পুনর্বহাল করেছিলেন।

অতঃপর তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি আবদুল ওহাব মিয়াকে (আওয়ামী ঘরনার হলেও একেবারে ‘জি-হুজুর’ মার্কা ছিলেন না বিধায়) ডিঙ্গিয়ে প্রধান বিচারপতি হিসাবে সদ্য নিয়োগ পাওয়া হাসিনার মূত্র সেবক বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন – যিনি পূর্বে হাই কোর্টের বিচারপতি থাকা কালীন রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ মিয়াঁর ‘লোক দেখানো’ বা ‘আই-ওয়াশ’ করা ‘CEC Search Committee’র সভাপতি হিসাবে আসীন থেকে, জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির স্বার্থের বিপক্ষে কাজ করতে কোন কার্পণ্য করবে না তা মাথায় রেখে মোমবাতি দিয়ে খুঁজে খুঁজে জনতা মঞ্চের চরম বিতর্কিত ঐ অবসর প্রাপ্ত সিল মারা তোফায়েল ক্যাডারের দলবাজ আমলা নুরুল হু্দাকে বর্তমান সিইসি হিসাবে নিয়োগ দেয়ার (ফরমায়েশি) সুপারিশ করে বিচারপতির নামে এক মহা-অবিচার করার নজির রেখে যান। তবে এর প্রতিদান অবশ্য তিনি শেখ হাসিনার কাছ থেকে সিনিয়র বিচারপতি আব্দুল ওয়াহাব মিয়াকে পাশ কাটিয়ে প্রধান বিচারপতি হিসাবে নিয়োগ পাওয়ার মাধ্যমে আদায় করে নিয়েছেন]

‘জনতার মঞ্চের’ আওয়ামী আমলাদের প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র সহ গুরুত্তপূর্ণ সকল সচিব ও জেলা প্রশাসনে নিয়োগ দেয়া হয়। এভাবে বিদ্রোহী আমলা চক্র বিচারপতি হাবিবুর রহমান সাহেবের মাথায় ‘কাঁঠাল’ ভেঙ্গে তাঁর ‘নিরপেক্ষ’ সরকারের সমগ্র প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন তৈরী করে ফেলেন চরম ‘অনিরপেক্ষ’ তথা সীল-মারা ‘জনতা মঞ্চের’ আমলাদের দিয়ে। বিচার-কাজে কেমন ছিলেন তা আমার জানা না থাকলেও প্রশাসন পরিচালনা জ্ঞানে বিচারপতি হাবিবুর রহমান যে একেবারে ‘গোবেচারা’ প্রকৃতির ছিলেন যা কিনা তাঁর চিরাচরিত বত্রিশ দাঁত বেড় করে দেয়া ‘হাবলা-মার্কা’ হাসিতেই ধরা পড়ত। [ পাঠককুল, যদি বিশ্বাস না করুন -লাইব্রেরীর সংরক্ষণে থাকা তৎকালিন পত্রিকার কোন পাতা খুলে দেখুন তবে বিচারপতি হাবিবুর রহমানের ‘বোয়াল’ মাছের ন্যায় দু-গাল মেলা সেই ‘হাবলা’ হাসির নমুনা!! প্রমান করতে পারবেন ]

যার ফলে তাঁকে ঘিরে থাকা ‘বিদ্রোহী আমলাদের’ চাপে তারই সহকর্মী বিচারপতি সাদেক আলীকে ‘চাপ’ দিয়ে অন্যায় ভাবে সিইসি থেকে তাঁকে (স্বেচ্ছায়?) সরে যেতে বাধ্য করে সেখানে অন্ততঃ ‘নিরপেক্ষ’ কাউকে না এনে তাঁদের পছন্দের আরেক ‘দলবাজ’ আওয়ামী আমলা আবু হেনাকে বসিয়ে দেন। আর এতসব মহাপর্বত তুল্য প্রশাসনিক উলট-পালট আর নিয়োগ-বদলী একের পর এক দেখেও ‘অলস-অবুঝ-অপদার্থ’ বিএনপি, (জেঃ নাসিমের সেনা-ক্যু ব্যর্থ করে দেয়া নিজ দলীয় অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও বিচক্ষণ প্রেসিডেন্ট আঃ রহমান বিশ্বাস ছাড়াও সদ্য নিয়োগ দেয়া তৎকালীন সেনা প্রধান লেঃ জেঃ মাহবুবুর রহমান (দৃশ্যত) অনুগত থাকার পরও বিচারপতি হাবিবুর রহমানের ঘাড়ে চড়ে বসা বিদ্রোহী আমলাদের অপসারণ করতে কার্যকর ‘রাজনৈতিক’ চাপ প্রয়োগের পথে না হেটে আদালতে ‘রিট’ করে ‘আইনি’ চাপ প্রয়োগের ‘ভুল’ পথে হেটে ব্যর্থ হতে হয়েছিল। অথচ ‘নিরপেক্ষ সরকার’ মানেই হল ‘নিরপেক্ষ প্রশাসন’। অতএব ‘নিরপেক্ষ প্রশাসন’ না হলে নির্বাচনে না যাওয়ার হুমকি দিয়ে ওই সকল বিদ্রোহী আমলাদের ‘খপ্পর’ থেকে বিচারপতি হাবিবুর রহমানের সরকারকে ‘মুক্ত’ করার জন্য ‘রাজনৈতিক’ চাপ প্রয়োগ করে বিএনপি অতি সহজেই সফলকাম হতে পারতো। কেননা আওয়ামী লীগের সদ্য ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের’ দাবী আদায়ের সাথে তুলনা করলে কেবল মাত্র এই ১৫ থেকে ২০ জন দলবাজ আমলাদের বিচারপতি হাবিবুর রহমান সাহেবের ‘ঘাড়’ থেকে অপসারণের দাবি ছিল বিশাল দেহী এক ‘মহিষের’ সহিত কেবল ‘মুরগী’ নয়- এমনকি ডিম থেকে সদ্য ফোটা ‘মুরগীর বাচ্চা’ও নয়, তা ছিল কেবল মাত্র ডানা ভাঙ্গা একটি বৃদ্ধ ‘মশা’ মারার সমতুল্য এক ঘটনা। কিন্তু তাহাই ‘অকর্মণ্য-অদূরদর্শী’ বিএনপি নেতৃত্ব করতে পারল না। তাঁরা কি করল? ‘রাজনৈতিক’ চাপের পরিবর্তে ‘আইনী’ প্রক্রিয়ার পরিণাম কি হতে পারে তা চিন্তা না করেই, এক সময়কার বিএনপির প্রভাবশালী ছাত্র নেতা ডঃ আসাদুজ্জামান রিপন উদ্যোগী হয়ে আদালতে ‘রিট’ করে বসেন। অতঃপর আইনের স্বাভাবিক গতি যা হবার তাই হল। আওয়ামী লীগ ‘আইনি’ লড়াইয়ের ‘আইনি’ মোকাবেলা করে ঐ ‘রিটে’র উপর অতি সহজেই সাময়িক ‘স্থগিতাদেশ’ বের করে আনল। এদিকে নির্বাচনের সাকুল্যে সময় মাত্র ৩ মাস। আইনী লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সময় কোথায়? ডাক্তার আসার আগেই রোগী মরে গেলে, তবে ডাক্তার ডেকে লাভ কি?।

[অথচ পাশাপাশি যদি আমরা দেখি, ২০০১ এর তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি লতিফুর রহমান যখন তাঁর মুখ্য-সচিব হিসাবে আপাদমস্তক সৎ, নির্মোহ, নির্লোভ ও নিরহংকার চরিত্রের এক আমলা শাহ-হান্নান সাহেব-কে নিয়োগ দিলেন তখন কিছুদিন না যেতেই আওয়ামী লীগ প্রতিবাদ করল এই বলে যে হান্নান সাহেবের কোন এক জ্ঞাতি ভাই কিশোরগঞ্জের একটি আসন থেকে বিএনপির নমিনেশন নিয়েছেন। অতএব হান্নান সাহেবকে মুখ্য-সচিব হিসাবে রাখা হলে নির্বাচনে প্রভাব পড়বে। তাই আওয়ামী লীগ তাকে সরানোর জোর দাবী করলে বিচারপতি লতিফুর রহমান কাল বিলম্ব না করে শাহ-হান্নান সরিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

উল্লেখ্য সরকারী চাকুরী থেকে অবসরে যাবার পর শাহ-হান্নান সাহেব এক সময়ে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ এর চেয়ারম্যান হিসাবে হাল ধরেন এবং বাংলাদেশে শরিয়া ভিত্তিক ব্যাংকিং ব্যাবস্থা চালু করন ছাড়াও অন্যান্য ব্যাংকিং কার্যক্রমে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ কে দেশের ইতিহাসে অন্যতম সফল এক প্রতিষ্ঠানে দাঁড় করিয়েছিলেন। অথচ এই সফলতায় ঈর্ষান্বিত ও জামায়াত সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এনে বর্তমান সরকার ২০১৭ সালে গায়ের জোরে ব্যাংকটিকে কেবল দখল করেই ক্ষান্ত থাকে নাই উপরন্ত মাত্র কয়েক বছর না যেতেই লুটে-পুটে খেয়ে এত সফল এই প্রতিষ্ঠানটিকে কি ভাবেই না আজ ব্যর্থ (অর্থাৎ জয়বাংলা) করে ছেড়ে দেয়া হল?]

ফলে বিচারপতি হাবিবুর রহমান সাহেবের প্রশাসন থেকে ‘আওয়ামী’ আমলাদের অপসারণের অত্যন্ত ন্যায় সঙ্গত দাবী ‘চুপসে’ পড়ায় কার্যত ‘রণে ভঙ্গ’ দিয়ে একটি ‘মোক্ষম ইস্যু’ হাতছাড়া করে বিএনপি নির্বাচনী কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। অপরদিকে আদালতের ‘স্থগিতাদেশ’ আদায় করে ম খা আলমগীর গং বিদ্রোহী আমলাদের আর পিছে ফিরে তাকাতে হয় নাই। এবার আরও বুক ফুলিয়ে- নির্বাচনী ফলাফল তাঁদের পক্ষে নেয়ার লক্ষ্যে সচিবালয় থেকে মাঠ প্রশাসন পর্যন্ত বিস্তৃত সকল স্তরে- মনের মাধুরী মিশানো ‘তুলির’ আঁচড় দিয়ে দিয়ে ‘প্রশাসনকে’ ঢেলে সাজিয়ে নিতে সক্ষম হয়। অতঃপর প্রশাসনিক কারুকার্য অর্থাৎ ‘ইলেকশন-ইঞ্জিনিয়ারিং’ করে কেবল ‘পুকুর’ চুরি নয় ‘সমুদ্র’ চুরির মতো ‘অনিয়মের’ আশ্রয় নিয়ে নির্বাচনে জিতে আন্দোলনের চুড়ান্ত ‘ফসল’ (১৪৬-১১৬ ব্যবধানে) ঘরে তুলে নিল। অথচ নির্বাচনী-কর্মকর্তাদের মাধ্যমে সঙ্ঘটিত ১১১ সংখ্যক আসনে ব্যাপক ভোট কারুচুপির বিষয়ে বিএনপির সুস্পষ্ট আভিযোগ আমলে না নিয়েই জনতার-মঞ্চ প্রাভাবিত আবু হেনার নির্বাচন কমিশন চুড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করেন।

বিচারপতি হাবিবুর রহমান সরকারের দলবাজ সিইসি আবু হেনার ১৯৯৬ এর ওই ‘ইলেকশন-ইঞ্জিনিয়ারিং’ বা ‘সমুদ্র’ চুরির নির্বাচনের কেবল ২ (দুইটি) নমুনা পাঠকদের এখানে স্মরন না করিয়ে দিয়ে পারছি না। শুনুন তাহলে (স্মৃতির পাতায় যতটুকু মনে আছে) এর কিছু-

‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং নমুনা-১।

জুন ১৯৯৬-এর নির্বাচন কালীন সময়ে (আমি তখন ঢাকার তেজগাঁও এলাকার বাসিন্দা) সেসময় তেজগাঁও কলেজের ‘ছাত্রলীগ ভিপি’র হত্যাকাণ্ডে ঢাকার ধানমন্ডি আসনের বিএনপি প্রার্থী লেঃ জেঃ মীর শওকত আলীকে প্রধান হুকুমের আসামী দেখিয়ে (পুলিশ বাদী হয়ে) মামলা করা হল। অতঃপর গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করে, ভয় দেখিয়ে দৃশ্যত মীর শওকত আলীকে আত্মগোপনে চলে যেতে বাধ্য করা হল। বিচারপতি হাবিবুর রহমান সাহেবের প্রশাসন দখল করে নেয়া জনতার মঞ্চ প্রভাবিত আমলাদের উদ্দেশ্য ছিল-কৌশলে নির্বাচনী প্রচার মাঠ থেকে মীর শওকতকে দুরে সরিয়ে রাখা। অথচ এর ১(এক) দিন পর একই ঘটনার জের ধরে তেজগাঁও টেক্সটাইল কলেজের ‘ছাত্রদল ভিপি’র হত্যাকাণ্ডে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী ডাঃ ইকবাল আর হাজী সেলিমের সম্পৃক্ততা পত্রিকার পাতায় ব্যাপক ভাবে শুনা গেলেও তাঁদের কাউকেই হুকুমের আসামী বানিয়ে (পুলিশ বাদী হয়ে) কোন মামলা করা হল না। যদিও সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সহিত সম্পৃক্ততার বিবেচনায় নিরপেক্ষ যে কেউই মত দিবে যে -লেঃ জেঃ মীর শওকত আলী ঐ দুই সিলমারা ‘সন্ত্রাসী’ আওয়ামী নেতা ডাঃ ইকবাল কিংবা হাজী সেলিমের ধারে কাছেও নয়।

  • [ কেননা ডাঃ ইকবালের মিছিল থেকে রাজ পথে দিনে দুপুরে গুলি চালিয়ে বিএনপি কর্মীদের হত্যা করার ঘটনা কিংবা ১৯৯৬-এ আওয়ামী লীগ গদিতে আসিন হওয়ার পর পুলিশের ছত্রছায়ায় এক ঝাঁক আওয়ামী গুণ্ডাদের নিয়ে তৎকালীন স্থানীয় সাংসদ ঐ হাজী সেলিম রাতের আঁধারে সরকারী ইডেন মহিলা কলেজের ছাত্রী নিবাসে চড়াও হয়ে কলেজের বিএনপির ‘ছাত্রী দল’ নেত্রীদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত ও নাজেহাল করে তাঁদের হল থেকে বিতারিত করে দেয়। ঘটনার পর কালো মজিব কোট ও সাদা পাঞ্জাবী পরা হাজী সেলিমের আঙ্গুল উঁচিয়ে দম্ভোক্তির দৃশ্য আমরা পরদিন পত্রিকার পাতায়ই দেখেছি। তখন ১৯৯৬ মেয়াদে হাসিনা সরকারের সংসদ অধিবেশনও চলছিল। (তৎকালীন সরকারের প্রত্যক্ষ প্রশ্রয় না পেলে) কোন সভ্য দেশে এধরনের বর্বরোচিত ও পাশবিক আচরন কল্পনা করা যায় কি? অথচ ২০০১ এ বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর ঐ সকল নির্যাতিত, লাঞ্ছিত ‘ছাত্রীদল’ নেত্রীরা প্রধান মন্ত্রী খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে সশরীরে দেখা করে চোখের পানি ফেলে হাজি সেলিমের ঐ লোমহর্ষক অত্যাচারের কথা বলে নালিশ করেছিলেন। তবে ‘আপোষহীন’ (অথচ আমি বলব ‘আপোষকামী’) বিএনপি নেত্রী একজন মহিলা হয়েও বিএনপির ইডেন কলেজ ‘ছাত্রীদল’ নেত্রীদের উপর মধ্যযোগীয় কায়দায় লাঞ্ছিত করার এত বড় অপরাধের জন্য হাজী সেলিমের দৃস্থান্ত মূলক শাস্থি দিয়েছেন বলে আমরা শুনি নাই। ইডেন কলেজ ‘ছাত্রীদল’ নেত্রীদের বুক ফাটা কান্নায় চোখের পানি তাঁদের আঁচল গড়িয়ে ‘আপোষকামী’ প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের মখমলের কার্পেট ভিজিয়েই পরিত্রাণ পেল।

ফলে ডাঃ ইকবাল এবং হাজী সেলিম নির্বাচনী মাঠে সশরীরে উপস্থিত থেকে মিটিং মিছিলে অংশ নিয়েছেন। মহল্লায় মহল্লায় নেতা-কর্মীদের নিয়ে জনসংযোগ করে নিজের পক্ষে ভোট চেয়ে হেসে খেলে নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে গেলেন। পাশাপাশি অত্যন্ত সৎ ও অর্থ-সম্পদের প্রতি নির্মোহ (কেননা সামরিক বাহিনীর এত বড় পদ থেকে অবসরে যাওয়ার পর ঢাকায় নিজের মাথা গুজার মতো কোন স্থাবর সম্পদ বা বাড়ী না থাকায় পুরান ঢাকার বোনের বাড়ীতে গিয়ে উঠেছিলেন বলেই আমরা পত্রিকার পাতায় দেখেছি) চৌকষ ঐ সামরিক কর্মকর্তা, মুক্তি যুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার লেঃ জেঃ মীর শওকত আলী তখন সাজানো হত্যা মামলার এক ফেরারী আসামী। গ্রেফতারের ভয়ে নির্বাচনী মাঠে না থেকে পালিয়ে বেড়িয়েছেন। পাড়া মহল্লায় হাজির থেকে জনসংযোগ করতে না পেরে এবং কেন্দ্রে কেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট পর্যন্ত ঠিক করে রাখতে না পারায় নির্বাচনে হেরে কিভাবেই না ধরা খেলেন। কারন ভোটাভোটির লড়াইয়ে প্রার্থীর উপস্থিতি যেখানে অতীব জরুরী সেখানে মীর শওকতের উপস্থিতি-বিহীন অবস্থায় এলাকার নেতা কর্মীরা হয়ে পড়লেন একেবারে এতিম। লেঃ জেঃ মীর শওকত আলী খুনের মামলার ‘ফেরারী’ আসামী!!! ভোটা-ভোটির লড়াইতে ইহা নেতিবাচক প্রভাব ফেলার জন্য যথেষ্ট। তাই হতাশ, দিগ্বিদিক শুন্য বা দিশেহারা কর্মীরা প্রচার কাজ ও ভোট কেন্দ্রে নিজ-নিজ কোন ‘দায়িত্ত’ই পালন করতে পারে নাই। ফলে ফাঁকা মাঠেই বিপক্ষ দলীয় প্রাথী হাজী সেলিম আর ডঃ ইকবাল গোল দিয়ে গেল। পাঠক কূল জেনে রাখুন- ‘র’ এর মদদপুষ্ট ‘জনতা-মঞ্চে’র আমলা নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন কালীন বিচারপতি হাবিবুর রহমান প্রশাসনের উদ্দেশ্য ছিল মীর শওকতকে ‘গ্রেফতার’ করা নয় ‘গ্রেফতারের ভয়’ দেখিয়ে তাঁকে ‘আত্মগোপনে’ চলে যেতে বাধ্য করে নির্বাচনী প্রচার কাজ থেকে দুরে সরিয়ে রাখা। [প্রমান-লেঃ জেঃ মীর শওকতকে নির্বাচনে হারিয়ে তাঁদের আসল উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হয়ে যাওয়ায়, পরবর্তীতে তাঁদেরই কাঙ্ক্ষিত হাসিনা সরকার ১৯৯৬-এ ক্ষমতায় এসে ওই তেজগাঁ কলেজের ছাত্র হত্যা মামলার জের ধরে মীর শওকতকে আর হয়রানি বা গ্রেফতার করতে আমরা শুনি নাই। কেবল নির্বাচন কালীন সময়েই তাঁকে খাঁড়া দৌড়ের উপর রাখা হয়েছিল।]

তবে বলতেই হয় লেঃ জেঃ মীর শওকত আলী(প্রয়াত), সেনা অফিসার হিসাবে বেশ ‘চৌকশ’ ছিলেন বটে তবে বাংলাদেশে চলমান ভারতীয় ‘চাণক্য’ রাজনৈতিক খেলার চাল বুঝতে পারায় ছিলেন ততই ‘সরল-সোজা’ প্রকৃতির। কেননা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী আদর্শ লালন করে পরবর্তীতে দেখা গেছে [র-এর যে অপশক্তি ভুয়া মামলার জালে আটকিয়ে তাঁকে একদিন ফেরারী আসামী বানিয়ে নির্বাচনে ফেল করিয়েছিলেন তাঁদেরই ধূসর ‘র’ এর খাস-চামচা অবসর প্রাপ্ত উচ্চ-পদস্থ দুই সেনা কর্মকর্তা এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার এবং লেঃ জেঃ হারুনুর রশিদের প্ররোচনায় তাঁদেরই সহিত হাত মিলিয়ে তথাকথিত ‘ সেক্টর কমান্ডার ফোরাম’ এ নাম লিখিয়েছেন। র-এর পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত এই ফোরামের সাথে তাল মিলিয়ে ভারতের আগ্রাসী নীতির প্রতিবাদকারী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর কড়া সমালোচনা করে সময়ে সময়ে বিএনপির স্বার্থের বিপরীত ‘বিবৃতি’ প্রচারেও শামিল হতে দেখা গেছে।

যাক যা বলছিলাম, নমুনা-১ এ বর্ণিত একই কায়দায় সারা দেশে যেখানেই বিএনপির শক্তিশালী প্রার্থী সেখানেই ‘জনতা মঞ্চের আমলা চক্র নিয়ন্ত্রিত’ প্রশাসন দিয়ে বিএনপির প্রার্থীদের কোন না কোন মামলা্র জালে আটকিয়ে অতঃপর গ্রেফতারের ভয় দেখিয়ে তাঁদেরকে নির্বাচনী প্রচার কাজ থেকে দুরে রাখা হয়। আর এই ফাঁকে অপেক্ষাকৃত দুর্বল আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের জয়ের পথ নিশ্চিত করা হয়েছিল।

‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং নমুনা-২।

১৯৯৬ নির্বাচনের ভোট সমাপ্তির পর যখন ভোট গণনা চলছিল এবং একে একে কেন্দ্রের বেসরকারী ফলাফল রেডিও টেলিভিশনে প্রচারিত হচ্ছিল। প্রাপ্ত ফলাফলে যখন দেখা যাচ্ছিল বিএনপি উল্লেখ যোগ্য আসনের ব্যবধানে এগিয়ে আছে তখন ‘বিদ্রোহী আমলা চক্র নিয়ন্ত্রিত’ বিচারপতি হাবিবুর রহমান সরকারের প্রধান নির্বাচন কমিশনার আবু হেনা দেশের নির্বাচনী Code of Conduct এর ব্যতিক্রম ঘটিয়ে মাঠ পর্যায়ে ভোট গণনা কালীন সময়ে-(বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের ইতিহাসে এই প্রথম বারের মতো) এক আদেশ জারী করেন যে মাঠ পর্যায়ে রিটার্নিং অফিসারগন নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণা করতে পারবেন না। ফলাফল ঘোষণা করা হবে ঢাকার ‘প্রধান নির্বাচন কমিশন’ অফিস থেকে। উদ্দেশ্য হাড্ডা-হাড্ডি ভোট ব্যবধানে যেখানে বিএনপি জয়ী হয়েছিল সে সকল আসনের ফলাফল ঢাকার ‘প্রধান নির্বাচন কমিশন অফিস’ থেকে পাল্টিয়ে আওয়ামী প্রার্থীদের বিজয়ী ঘোষণা করা। আর কার্যত তাই করা হল। এতসব ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং এর পরও ফলাফল ছিল আওয়ামী/বিএনপি (১৪৬/১১৬)।

অতএব, ভো্টাভোটির যুদ্ধে হার নয়, কেবল (রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে) বিচারপতি হাবিবুর রহমানের ‘প্রশাসনকে’ [কেবল মাত্র অনধিক ১৯ জন] বিদ্রোহী আমলাদের ‘খপ্পর’ থেকে ‘মুক্ত’ করতে না পারায় ১৯৯৬-এ অপরিণামদর্শী ও আন্দোলন বিমুখ বিএনপি নেতৃত্ব নিশ্চিত ক্ষমতার মসনদ হাতছাড়া করে।

Read More

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked with *

সর্বশেষ পোস্ট

Advertising