শিশু সাহিত্য পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ, আনন্দময় এবং শিক্ষণীয় সাহিত্য হিসেবে পরিচিত। এটি শিশুদের মানসিক বিকাশ, ভাষাগত দক্ষতা, সামাজিক শিক্ষার পাশাপাশি, তাদের সৃজনশীলতা ও কল্পনাশক্তি বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বই মেলার মতো একটি বৃহৎ ও ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক আয়োজন শিশু সাহিত্যের গুরুত্বকে আরও বিশেষ করে তোলে, কারণ এই ধরনের মেলা শিশুদের জন্য সাহিত্য প্রেম এবং পাঠাভ্যাস তৈরির একটি বিশেষ মাধ্যম। শিশু সাহিত্যের গুরুত্ব বই মেলায় কিভাবে উজ্জ্বল হয়, তা একাধিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা যায়।
প্রথমত, শিশু সাহিত্য শিশুদের মানসিক এবং সামাজিক বিকাশের জন্য অপরিহার্য। ছোটদের জন্য লেখা বইগুলো সাধারণত সহজ ভাষায় রচিত হয়, যা তাদের মেধা ও চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করে। গল্প, কবিতা, ছড়া ইত্যাদির মাধ্যমে শিশুদের মধ্যে ইতিবাচক ধারণা, মূল্যবোধ ও মনোভাব তৈরি হয়। যেমন, সততা, সাহস, সহানুভূতি, বন্ধুত্ব, মঙ্গলমুখিতা প্রভৃতি। বই মেলায় শিশু সাহিত্যের মাধ্যমে শিশুদের এই শিক্ষাগুলো আরও সহজে প্রাপ্তি হয়, কারণ বই মেলা তাদের জন্য এমন একটি স্থান যেখানে তারা বিভিন্ন ধরনের নতুন বই এবং গল্পের সাথে পরিচিত হতে পারে।
দ্বিতীয়ত, বই মেলা শিশুদের পাঠক হিসেবে গড়ে তোলার একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ সৃষ্টি করে। যখন শিশুরা বই মেলায় গিয়ে নতুন বই দেখে, তখন তাদের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ বাড়ে। বই মেলা একটি আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা হিসেবে শিশুর মনে স্থায়ী প্রভাব ফেলে, যা পরবর্তী সময়ে তাদের পাঠাভ্যাস তৈরি করতে সহায়ক হয়। যখন শিশুরা তার পছন্দের বই বা চরিত্র সম্পর্কে জানে, তখন তাদের সৃজনশীলতা ও কল্পনাশক্তি বিকশিত হতে থাকে।
তৃতীয়ত, শিশু সাহিত্য বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উপাদানকে ধারণ করে। বাংলাদেশে অনেক জনপ্রিয় শিশু সাহিত্যিক আছেন যারা তাদের লেখার মাধ্যমে আমাদের সংস্কৃতির নানা দিক তুলে ধরেছেন। বই মেলায় এই ধরনের সাহিত্যিকদের নতুন বইগুলো প্রকাশিত হয়, যা শিশুদের বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত হতে সাহায্য করে। গল্পের মাধ্যমে তারা বাংলার ইতিহাস, folklore, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও লোকজ সংস্কৃতির প্রতি এক ধরণের ভালোবাসা অনুভব করতে পারে। এই প্রক্রিয়াটি শিশুদের মধ্যে দেশের প্রতি প্রেম এবং ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা সৃষ্টি করে।
চতুর্থত, বই মেলা শিশুদের জন্য সামাজিকীকরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এখানে তারা নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে শেখে, নতুন বন্ধুদের সাথে পরিচিত হয় এবং একে অপরের বই পড়ার অভিজ্ঞতা শেয়ার করে। এটি তাদের মধ্যে সামাজিক সম্পর্ক স্থাপন এবং যোগাযোগের দক্ষতা গড়ে তোলে। এর মাধ্যমে শিশুদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায় এবং তারা আরও অনেক নতুন বিষয় শিখতে পারে।
পঞ্চমত, বই মেলায় শিশু সাহিত্যের গুরুত্ব এই ক্ষেত্রে রয়েছে যে, এটি বাবা-মায়ের কাছে একটি সুযোগ সৃষ্টি করে যে তারা নিজেদের সন্তানের জন্য সঠিক বইটি বেছে নিতে পারে। একজন অভিভাবক তার সন্তানের বয়স এবং আগ্রহ অনুসারে বই কিনতে পারেন, যা তাদের পড়াশোনার উন্নতি ঘটাবে। এর পাশাপাশি, বই মেলা শিশুদের জন্য একটি উৎসাহের জায়গা, যেখানে তারা বইয়ের প্রতি তাদের ভালোবাসা এবং আগ্রহ অনুভব করতে পারে।
অতএব, বই মেলা শুধুমাত্র একটি সাহিত্যিক অনুষ্ঠানের চেয়ে অনেক বেশি কিছু। এটি শিশুদের জন্য একটি শিক্ষা, আনন্দ এবং সৃজনশীলতার পথপ্রদর্শক। বই মেলায় শিশু সাহিত্যের মাধ্যমে শিশুরা যেমন শিক্ষা লাভ করে, তেমনি তাদের মধ্যে ভালুক, ইঁদুর, বাঘ কিংবা অন্যান্য প্রাণীর সাথে সম্পর্কিত গল্পে অনুপ্রাণিত হয়ে কল্পনাশক্তি বাড়ায়।
এতদূর আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে, বই মেলা শিশু সাহিত্যের অমূল্য উৎস এবং শিশুদের মানসিক বিকাশে এটি একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। বই মেলার মাধ্যমে শিশু সাহিত্যের গুরুত্ব শুধু তাদের জীবনে নয়, বরং দেশের সাংস্কৃতিক পরম্পরা ও উন্নয়নেও বিশেষ ভূমিকা রাখে।