সন্ত্রাস, সাইবার ক্রাইম ও অবক্ষয়: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট

ভূমিকা: গত ১৫-১৬ বছরে বাংলাদেশ এক অভূতপূর্ব সামাজিক ও প্রশাসনিক অবক্ষয়ের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছে বলে অনেকের অভিমত। সন্ত্রাস, সাইবার অপরাধ, জালিয়াতি, গুম, খুন, এবং মাদকের বিস্তার—সবকিছু মিলিয়ে একটি অশুভ ছায়া যেন দেশের প্রতিটি জেলা, শহর ও পাড়ায় বিস্তৃত হয়েছে। এই পরিস্থিতি শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে না, বরং সমাজের নৈতিক ভিত্তিকেও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে।

১. সন্ত্রাস ও প্রশাসনিক ব্যর্থতা: রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনার কারণে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সন্ত্রাস চরম আকার ধারণ করেছে। দেশপ্রেমিক, সৎ এবং ধর্মভীরু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হয় স্বেচ্ছা অবসরে পাঠানো হয়েছে, নয়তো ‘OSD’ করে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে। ফলে প্রশাসন হয়ে পড়েছে দুর্নীতিপরায়ণ ও অকার্যকর। সচিবালয় থেকে শুরু করে পুলিশের বিভিন্ন স্তর পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত রয়েছে।

২. সাইবার ক্রাইম ও যুব সমাজের পতন: দেশজুড়ে সাইবার অপরাধ দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়েছে। অবৈধভাবে প্রবেশকারী বিদেশি নাগরিক—বিশেষ করে ভারত, নেপাল ও তামিলনাড়ুর—কিছু দুর্বৃত্ত চক্র বাংলাদেশে বসে সাইবার অপরাধে লিপ্ত হয়েছে। এরা বিজ্ঞাপন সংস্থা, শিক্ষার্থী কিংবা আইটি কর্মীর ছদ্মবেশে দেশের সম্ভ্রান্ত পরিবারের কিশোরীদের টার্গেট করছে। প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে গোপনে ভিডিও ধারণ, তা এডিট করে ব্ল্যাকমেইল, এবং জোরপূর্বক অনৈতিক কাজে বাধ্য করার মতো ভয়ংকর অপরাধের শিকার হচ্ছে অনেক নিরীহ তরুণী। পরিবারের সম্মানের কথা ভেবে অধিকাংশ ভুক্তভোগী পরিবার পুলিশে যেতে সাহস পায় না। এমনকি অভিযোগ রয়েছে যে, পুলিশের একটি অসাধু অংশও এই চক্রের সাথে জড়িত।

৩. মাদক ও সমাজ ধ্বংসের পথে বাংলাদেশ: চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরসহ সীমান্ত দিয়ে মাদক পাচারের ঘটনা ব্যাপক হারে ঘটেছে। ফেনসিডিল, ইয়াবা, আইসসহ নানা ধরনের মাদক সহজলভ্য হওয়ায় দেশের তরুণ সমাজ ভয়াবহভাবে আসক্ত হয়ে পড়েছে। একসময় পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে পড়েছিল যে, অনেক বিশেষজ্ঞ দেশকে “একটি বৃহৎ রিহ্যাব সেন্টারে” পরিণত করার কথা বলেন। বর্তমানে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও মাদকের সিন্ডিকেট এখনো সক্রিয় রয়েছে।

৪. বিদেশি সন্ত্রাসী অনুপ্রবেশ ও বৈধতার অভাব: দেশের অভ্যন্তরে বহু অবৈধ বিদেশি নাগরিক প্রবেশ করে বসবাস করছে। অধিকাংশেরই বৈধ ভিসা বা অনুমতি নেই। সাইবার ক্রাইম, নারী পাচার ও ব্ল্যাকমেইলিংয়ের সাথে তারা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। বিদেশি অপশক্তি এভাবে বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সামাজিক কাঠামোকে ধ্বংস করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।

৫. করণীয় ও সুপারিশ: এই সংকটময় সময়ে জাতীয়ভাবে নিম্নোক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি: সাইবার ক্রাইম ইউনিটকে আরও দক্ষ ও আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর করা। প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করে দুর্নীতিবাজদের অপসারণ। দেশপ্রেমিক হ্যাকারদের সহায়তায় একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী সাইবার গোয়েন্দা বাহিনী গঠন। অবৈধ বিদেশি নাগরিকদের শনাক্ত ও দ্রুত বহিষ্কার। নারী ও শিশু সুরক্ষায় কঠোর আইন প্রয়োগ এবং সচেতনতা বৃদ্ধি। মাদক সিন্ডিকেট ধ্বংসে সামরিক পর্যায়ের অভিযান চালানো।

উপসংহার: বাংলাদেশ আজ এক সংকটময় সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একদিকে অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি, অন্যদিকে সন্ত্রাস ও সামাজিক অবক্ষয়। সব কিছু প্রফেসর ইউনুস সাহেবের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। এটি একার কোনো ব্যক্তির কাজ নয়। দল-মত নির্বিশেষে, বাংলাদেশের প্রতিটি দেশপ্রেমিক ভাই-বোন যদি এগিয়ে আসে, তাহলে আমরা আবারও ৫ আগস্টের মতো বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারব। ভিনদেশি সকল সন্ত্রাসীদের জবানবন্দি মিডিয়ার সামনে প্রকাশ করা উচিত, যেন জনগণ প্রকৃত সত্য জানতে পারে। একইসাথে, সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকারকে সরাসরি দায়ী করে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি প্রদান করা প্রয়োজন। সেইসব দেশের রাষ্ট্রদূতদের তলব করে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দাবি করা উচিত, যাতে ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।  এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন একটি ঐক্যবদ্ধ দেশপ্রেমিক শক্তির। রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিক, বিশেষ করে তরুণ সমাজ, প্রশাসন ও প্রযুক্তিবিদদের একসাথে কাজ করতে হবে। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি নিরাপদ সমাজ উপহার দেয়াই হোক আমাদের চূড়ান্ত অঙ্গীকার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *